31 December 2012

বাঙালির ল্যাং

সুস্নাত চৌধুরী


পদস্থ মানুষকে অপদস্থ করায় বাঙালি তুখড় জাত। টেনে নামানোর খেলায় সে উপরে উঠেছে অনেক। যুগ-যুগ ধরেই তার এক হাতে কাঠি, অন্য হাতে চুনকালির ভাঁড়। বাঙালি পাবলিকের হতাশা ছিল, ইনসিকিয়োরিটি ছিল, কিন্তু সে সব ছাপিয়ে ছিল, আছেও, অপরকে হেয় করার বেসিক ইনস্টিংক্ট। বিশেষত, সেই জাতভাইকে, যে তার সঙ্গে এক প্ল্যাটফর্মে থেকেও আজ অনেকটা উপরে উঠে গিয়েছে। কে জানে কী করে, কপাল-জোর না ব্যাকডোর! আমি অধম মানলুম। কিন্তু ও ব্যাটা উত্তম সাজবে কেন? অতএব, টেনে নামাও। পিছনে লাগো। হ্যারাস করো।
ভারতচন্দ্র সেই কবে লিখেছিলেন ‘শিবের ভিক্ষা-যাত্রা’-র কথা :

‘দূর হইতে শুনা যায় মহেশের শিঙ্গা।
শিব এল ব’লে ধায় এত রঙ্গচিঙ্গা।।
কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া।
ছাই মাটী কেহ গায় দেয় ফেলাইয়া।।’

শিব আসছেন বুঝে চ্যাংড়া ছোঁড়াদের অতি আগ্রহ, ক্ষুধার্ত শিবকে ঘিরে তাদের শয়তানি, এ সবই টিপিক্যাল বাঙালি সাইকি। যে প্রবৃত্তি অপদস্থ করতে চেয়েছিল বিশ্বম্ভর মিশ্রকে। তিনি ‘বিশ্বম্ভর’ থাকলে কিছু আসত-যেত না, ‘চৈতন্যদেব’ হয়ে গিয়েই বাঙালিকে চাপে ফেললেন। সমাজের তথাকথিত নিচুতলার মানুষজন তাঁর ছাতার তলায় জায়গা পাওয়ায়, বিদ্রুপ করে বাংলা প্রবাদই তৈরি হয়ে গেল :
‘মাছ খাই, মাংস খাই না, ধর্মে দিয়েছি মন
বৃদ্ধা বেশ্যা তপস্বিনী এসেছি বৃন্দাবন।’

জগাই-মাধাইয়ের আক্রমণ সেই মেগা-সিরিয়ালের একটা এপিসোড মাত্র। পরে ভুল বুঝে, জগাই-মাধাই না থাকলে নিমাইকে লোকে চিনত না: সাফাই গেয়ে বাঙালি প্রেমের মলম লাগাল। আত্মঘাতী বাঙালির কথা বলতে গিয়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রেম-মলমটির সাইড-এফেক্ট কী মারাত্মক হতে পারে, দেখিয়েছেন। ‘চৈতন্যদেব সম্বন্ধে জনপ্রচলিত ধারণাটা একদিক হইতে ভুল। তিনি একমাত্র প্রেমের প্রচারক ছিলেন না; নাচুনে-কাঁদুনে তো ছিলেনই না।’ কিন্তু সে দিনের প্রাচীনপন্থী নিন্দুক পুরোহিতদের মতো আজকের বাঙালিও চৈতন্যকে ‘নাচে, কাঁদে, হাসে, গায় যৈছি মদমত্ত’ দেখতেই অভ্যেস করে ফেলেছে। সেই মধ্যযুগ থেকেই ঢলোঢলো ‘ন্যাকাচৈতন্য’ লেবেল সেঁটে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে তাঁর গায়ে। তকমা সাঁটার এই সুবিধেবাদী বাঙালি রাজনীতি কাজ করেছে রামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও। শিবনাথ শাস্ত্রীকে শেষ বার সাক্ষাতের সময় তিনি বলছেন ‘একবার ভেবে দেখ, সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর গলার ক্যান্সারে মরতে বসেছে!/ অতঃপর উৎসাহী শিষ্যদের উদ্দেশে স্বগতোক্তি করিলেন বোকার অশেষ গুণ!’(‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’/ ‘মহান পুরুষদের সান্নিধ্যে’/ শিবনাথ শাস্ত্রী)। এমন যাঁর বিবেচনা, জগৎসংসার সম্পর্কে আত্মোপলব্ধি, সেন্স অব হিউমার শত ফুল-বেলপাতা সত্ত্বেও সেই প্রকৃত সাধককে অ-স্বাভাবিকতার ফ্রেমে আঁটিয়ে ক্যালেন্ডারেই ঝুলিয়ে রাখতে চেয়েছে বাঙালি মাস্। যেমন শহিদ ক্ষুদিরামকে চেয়েছে ‘বাড় খাওয়া’-র সমার্থক করে জনমানসে বাঁচিয়ে রাখতে। সচেতনে নয়, হ্যাটা করার এই প্রবণতা মিশে গিয়েছে বাঙালির অবচেতনেই।
রবীন্দ্রনাথকেও বাঙালি ছেড়ে কথা বলেনি। ‘পায়রা কবি’ অভিধা জুড়েছে তাঁর সঙ্গে :

উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা।
তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাব মাখা!!

(কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, রাহু)।
কখনও ধেয়ে এসেছে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের প্যারডি, কখনও সুরেশ সমাজপতি অ্যান্ড কোং-এর বিলো দ্য বেল্ট আক্রমণ। ১৯১৪ সালে, অর্থাৎ নোবেল পাওয়ার পরের বছর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ম্যাট্রিকুলেশনের প্রশ্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ বইয়ের অংশ উদ্ধার করা হয়—
4. Rewrite in chaste and elegant Bengali:
যেদিন লিখবার ঝোঁক চাপে সেদিন হঠাৎ এত ভাব মনের মধ্যে এসে পড়ে যে দিশাহারা হয়ে যেতে হয়। এক সাথে কোকিল, পাপিয়া, হাঁস সকলগুলি ডাকতে আরম্ভ করে, আর বসন্ত, নিদাঘ, বর্ষা, শরৎ ছুটে এসে পড়ে। কতক যদি বা বলা হয় ত অনেক পড়ে থাকে। এতটা একটুখানি মানুষের মন পেরে উঠবে কেন?
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কর্তৃপক্ষ তখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গদ্য ভাষাকে সাধু (chaste) বলিয়া স্বীকার করেন নাই।’ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত তাঁর স্মৃতিকথায় অভিযোগ করেছিলেন, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে হেয় করার জন্য এই কাজটি করেছিলেন, পরে আশুতোষ দীনেশচন্দ্র সেন ও সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের ওপর দোষ চাপান। তাঁরা এই মিথ্যা অপবাদ সহ্য করলেন কারণ আশুতোষ নাকি তাঁদের নানা সুযোগ সুবিধে দিয়ে বশীভূত করেন।
রামমোহন রায় সম্পর্কে পথে-পথে বাঙালি গেয়ে বেড়াত :

‘সুরাই মেলের কুল,
বেটার বাড়ি খানাকুল,
বেটা সর্বনাশের মূল,
ওঁ তৎসৎ বলে বেটা বানিয়েছে স্কুল;
ও সে জেতের দফা করলে রফা
মজালে তিন কুল।’

রামমোহন-বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, যখন শোনা গেল, হিন্দু কলেজ তৈরির জন্য প্রস্তাবিত কমিটিতে রামমোহন আছেন, কলকাতার তাবৎ হিন্দু ভদ্দরলোক বেঁকে বসলেন: ‘তবে এই কালেজের সহিত আমাদের কোনও সম্পর্ক থাকিবে না।’ বড় একটা পরিকল্পনা বাধা পাবে বুঝে, রামমোহনই নিজেকে সরিয়ে নেন। শুধু কেচ্ছার নিরামিষ খেলাতেই থামেনি বাঙালি, তাঁর গাড়িতে দিনের পর দিন ইট পাথর কাদা ছুড়ে মেরেছে। তিনি মুচকি হেসে, গাড়ির দরজা টেনে বলেছেন, ‘কোচম্যান, হেঁকে যাও’। মদ্যপানের অভিযোগেও বিস্তর নিন্দেমন্দ শুনতে হয়েছে তাঁকে। বাধ্য হয়ে, রীতিমতো শাস্ত্র থেকে কোট করে-করে প্রমাণ দিতে হয়েছিল ওতে বিষ লাই! দু-এক পাত্তর খেলে কায়স্থের জাত যায় না! (‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’/ রামমোহন রায়)।
বিবেকানন্দকে বাঙালি হেনস্থা করেছে স্রেফ চা-পানের অভিযোগে। চা খেলে শরীর-স্বাস্থ্য গোল্লায় যাবে তখন দিকে-দিকে এই প্রচার চালাচ্ছেন পণ্ডিতরা। কিন্তু বিবেকানন্দ হাতে তুলে নিলেন ধোঁয়া-ওঠা চায়ের পেয়ালা। পুরসভা তাঁর মঠের ট্যাক্স দিল বাড়িয়ে। বলল, এ তো নরেন দত্তর বাগানবাড়ি; এখানে দেদার চা-পান চলে! তবে তার চেয়ে অনেক বিষাক্ত অপমান সইতে হয়েছে, ‘কালাপানি’ পার হয়েছিলেন বলে। একে কায়স্থ, তায় ম্লেচ্ছদেশে গেছেন, ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মিশেছেন, ম্লেচ্ছদের পাক করা ম্লেচ্ছ খাবার খেয়েছেন! তিনি সন্ন্যাসী হন কী করে? ‘বঙ্গবাসী’ কাগজ বাংলা ও হিন্দি সংস্করণে স্বামীজিকে নিয়ে নানা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করতে থাকে। পরে স্টার থিয়েটারে মাসের পর মাস ‘অবতার’ নামে ব্যঙ্গ-নাটক অভিনীত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে রাগ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় গিয়েছিল, ১৮৯৭ সালের ২১ মার্চ বিবেকানন্দ যখন খেতড়ির মহারাজার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যান, ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস (মথুুরবাবুর ছেলে) তাঁকে ‘পরোক্ষ ভাবে’ তাড়িয়ে দেন। এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক ছিল, শেষে ত্রৈলোক্যবাবু নিজেই চিঠি লেখেন ‘বঙ্গবাসী’তে, ‘...স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁহার সঙ্গিগণ পরোক্ষভাবে মন্দির হইতে বিতাড়িত হইয়াছিলেন,প্রত্যক্ষভাবে অবশ্য নয়...স্বামীজি ও রাজাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য আমি কাহাকেও বলি নাই, এবং আমিও তাঁহাদের অভ্যর্থনা জানাই নাই। যে-ব্যক্তি বিদেশে যাওয়া সত্ত্বেও নিজেকে হিন্দু বলিতে পারেএমন কাহারও সহিত আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক থাকা উচিত বলিয়া আমি বিবেচনা করি নাই।...প্রতিমার পুনরভিষেকের যে-সংবাদ আপনারা প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য।’ (তার মানে দাঁড়ায়, স্বামীজি মন্দিরে ঢুকেছিলেন বলে কালীমূর্তির পুনরভিষেকের প্রয়োজন হয়েছিল!)


ছবি: সুমন চৌধুরী

শিকাগোয় প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার নামে এক জন হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় রটিয়েছিলেন: বিবেকানন্দ ভণ্ড সন্ন্যাসী, আমেরিকায় নারীদের সঙ্গে পশুর মতো নোংরা জীবন কাটাচ্ছে। বিবেকানন্দ চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার বুড়ি মা এখনও বেঁচে আছেন, ...তিনি যদি শোনেন, তাঁর শ্রেষ্ঠ আশার, সবচেয়ে ভালবাসার সন্তানটি দূর দেশে গিয়ে পশুর মত জঘন্য নীতিহীন জীবন কাটাচ্ছে...তাহলে সে সংবাদ তাঁকে একেবারে মেরে ফেলবে।’ কলকাতার টাউন হল-এ বিবেকানন্দের ধন্যবাদ-সভা করা হয়, হাই কোর্টের বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সেই জনসভায় সভাপতিত্ব করেননি, কারণ: বিবেকানন্দ নাম গুরুদত্ত নয়, তা ছাড়া শাস্ত্রমতে ‘শূদ্রের’ সন্ন্যাসে অধিকার আছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। শেষে উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় বক্তৃতা দেন, তবে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ না বলে, ‘ব্রাদার বিবেকানন্দ’ বলেন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর শোকসভায় সভাপতিত্ব করার প্রস্তাব ফিরিয়ে গুরুদাস বলেন, ‘হিন্দু রাজার আমল হলে তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হত।’
কমিউনিস্টরা (যাঁদের একটা বড় অংশ ছিলেন বাঙালি) নেতাজিকে ‘তোজোর কুকুর’ বলেছিলেন সে তো সবারই জানা। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপল’স ওয়র’-এ ছাপা হয় একের পর এক কার্টুন। কোথাও গাধারূপী সুভাষ বোসের পিঠে বসে সম্রাট তোজো। কোথাও ক্ষুদ্রকায় সুভাষচন্দ্রের হাত ধরে এগিয়ে আসছেন জাপানের বাহিনী। কোথাও কুকুররূপী সুভাষকে মাইক্রোফোনের সমানে তুলে ধরেছেন গোয়েব্ল্স।
বিদ্যাসাগর-বিরোধী কু-গাওয়ার কোরাসেও প্রবল শামিল বাঙালি। বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সমর্থকরা যখন গান বেঁধেছেন, ‘বেঁচে থাকুন বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’, বিরোধীরা স্লোগান ছুড়েছেন, ‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে’। উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ফেরার পথে গাড়ি উল্টে পড়ে মারাত্মক জখম হন বিদ্যাসাগর, পথে এক জনও এগিয়ে আসেনি তাঁকে তুলতে; বরং পরে-পরেই বাঙালির ‘রগুড়ে’ কলম ধরে ফেলে সেই দুর্ঘটনাকে :

‘উত্তরপাড়া স্কুল যেতে, বড়ই রগড় হল পথে,
এট্কিনসন উড্রো আর সাগর সঙ্গেতে।
নাড়াচাড়া দিলে ঘোড়া মোড়ের মাথাতে,
গাড়ী উল্টে পল্লেন সাগর, অনেক পুণ্যে গেছেন বেঁচে।’

বিদ্যাসাগর রাস্তায় বেরোলে লোকজন তাঁকে ঘিরে ফেলে ঠাট্টা-মশকরা করেছে, গালাগাল করেছে। এমনকী ‘সুপারি কিলার’ লাগিয়ে তাঁকে খতম করার চেষ্টাও চলেছে। শেষমেশ বীরসিংহের সিংহশিশুকে এক জেলে-সর্দার বডিগার্ড পর্যন্ত নিয়োগ করতে হয়েছিল।
নাইট ক্লাব ফেরত ভদ্রমহিলার দিকে আজও যে ভাবে কটাক্ষ হানে গোঁড়া কলকাতা, সে দিন স্ত্রীশিক্ষা নিয়েও ছবিটা তেমন ছিল। বোঝা যায়, ‘প্রেক্ষিত’ বদলেছে, এ শহর বদলায়নি। মেয়েদের স্কুলগাড়ি রাস্তায় বেরোলেই লোকে হাঁ করে তাকাত, শিশু-বালিকাদের উদ্দেশে ছুড়ে দিত কান-গরম-করা শব্দবাণ। ‘যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে কেতাব হাতে নিচ্চে’, দেখে শিউরে উঠত বাঙালি পুরুষতন্ত্র। প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়কেও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে স্বীকৃতি আদায় করতে হয়েছিল। তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকায় লিখছেন, ‘কুলকামিনীদিগকে অবজ্ঞা করা অধিকাংশ লোকেরই প্রকৃতি, কতকগুলা লোকের প্রকৃতি এত তীব্র যে, নারীদিগের মঙ্গলার্থক একটি বাক্য শুনিলেও নিতান্ত বিরক্ত হন।’ স্বভাবতই দ্বারকানাথের গায়েও তকমা লাগাল বাঙালি... ‘মেগে’!
বাঙালি এই উপহাস-প্রবণতার লেগাসি সগৌরবে বয়ে নিয়ে চলেছে। মিমিক্রি নিশ্চিত ভাবেই শিল্প, কিন্তু বাঙালি যে-ভাবে চপল ভাদুড়ি বা ঋতুপর্ণ ঘোষ সাজতে গিয়ে লাফটার শো থেকে লোকাল ট্রেন, মোড়ের আড্ডা থেকে ইউটিউব অবধি আবাদ করেছে ভাঁড়ামি, তাতে সে-জাতির স্থূল ক্যাওড়ামির চারিত্র্যই ফুটে ওঠে। কিছু মানুষের বডি, ল্যাঙ্গুয়েজ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ হয়তো কোনও বিশেষ মানসিক শারীরিক সামাজিক অবস্থানই রয়েছে সেখানে, যা গতবাঁধা ধারণার বাইরে তাকে ব্যঙ্গ করা মানে শুধু নির্দিষ্ট সেই মানুষটিকে নয়, একই সঙ্গে আরও বহু সহনাগরিককে অপমান করা। তাঁদের ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হাত দেওয়া।
স্বাধীন জীবন যাপন করতে গিয়ে বাঙালির হাতে ‘জিনা-হারাম’ হওয়ার আর এক উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলী। ষাটের দশকের শুরুর দিকে মুজতবা আলী ফের শান্তিনিকেতনে, খ্যাতির শীর্ষে। স্বভাবতই বেরিয়ে পড়ল ঈর্ষার ঝুলি। ঠিকমত ক্লাসে না যাওয়া, গবেষণার কাজ না করা, অনিয়মিত জীবনযাপন, মদ্যপান এ সবের অভিযোগ উঠতে লাগল। একেবারে কোণঠাসা করে দেওয়া হল তাঁকে। মুজতবা আলী এ সময় কাউকে চিঠি লিখলে, চিঠির মাথায় লিখছেন: ‘শ্মশান, শান্তিনিকেতন’! অন্নদাশঙ্কর রায় মুজতবা আলীকে উদ্ধৃত করেছেন: ‘যত দিন আমার চাকরি ছিল না সকলে আমার বন্ধু ছিল, এখন আমি সকলের ঈর্ষার পাত্র।’ তিনি পাকিস্তানের গুপ্তচর এমন কথাও রটে। শেষে গোয়েন্দা পুলিশের জেরার মুখোমুখিও হতে হয় তাঁকে।
আবার, গায়ক সুমন কেন জিন্স পরেন এ নিয়েও এক সময় বাঙালি ভাবুকদের ভাবনার শেষ ছিল না। বছর কয়েক পর সুরসিক বাঙালি কতকটা এই রকমই নিদান দিল সুমন ধর্ম বদলেছেন, নাম পাল্টেছেন, একাধিক বিয়ে করেছেন, অতএব তিনি ফালতু গায়ক! সুমনও চেষ্টা করেছিলেন বাঙালিকে চিনতে ‘কারা এত রেগে যাচ্ছিলেন? এত মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন আমাকে অপদস্থ করার জন্য? টিকিট ব্ল্যাকার, গুন্ডা, দাগি আসামি, ছাতুঅলারা, ‘ছাতা-সারাবে’ বলে যাঁরা ঠা ঠা রোদ্দুরে হেঁটে যান কলকাতার পথ ধরে, ফেরিঅলারা, বস্তিবাসীরা, লটারির টিকিট-বিক্রেতারা? কারা?’
আমরা। আমরাই সেই বাঙালি, যারা সামনে আসার মুরোদ নেই বলে ‘পিছনে’ লাগি। ‘বক দেখানো’ থেকে ‘বাঁশ দেওয়া’ যাদের ফেভারিট হবি। দেব-সেনাপতিকে যারা অবহেলায় বানায় ‘ক্যালানে কাত্তিক’!

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ ডিসেম্বর ২০১২

04 December 2012

স্বপ্ন বনাম মতলব বনাম জিজ্ঞাসাচিহ্ন

সুস্নাত চৌধুরী


জর্জ বার্নাড শ-কে নাকি একবার এক রূপসী ফরাসি অভিনেত্রী অচানক যেচেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একটু হতচকিত শ এমন আবেদনের কারণ জানতে চাইলে আবেদনময়ী বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হলে যেটা হবে, তা হল একটি ফাটাফাটি বাচ্চা! আমার রূপ ও আপনার প্রজ্ঞা নিয়ে সে জন্মাবে।’ ভুরু তুলে শ-এর জবাব, যেন রিফ্লেক্সে --- ‘আমি ভাবছিলাম, উলটোটা হওয়ার চান্সও তো আটআনা থেকে যাচ্ছে। মানে, যদি, আপনার প্রজ্ঞা ও আমার রূপ...!’
আমিও একাই এক শ। আ স্যুটেবল বয়। তর্জমায় ‘সৎ পাত্র’-ও বলতে পারেন। সু ও কুমার গঙ্গারামের আর্কেটাইপ। তাই, শ-সুলভ সমস্যা আমাদের নেই। রূপ ও প্রজ্ঞা, বাই দ্বি-ফল্ট, দুয়েরই তথৈবচ হাল আমার। শূন্যকে থ্রি-এক্স দিয়ে গুণ করলেও তো শূন্যই হয়, তা সে প্রবল গুণই হোক আর প্রচ্ছন্ন গুণ। আমার ‘তিনি’ শত জিনোটাইপ-ফিনোটাইপ কষে, মেন্ডেলের মটরশুঁটি থেকে ইঁদুরছানার পিছে ছুটে, বায়োলজি থেকে জাভা সিপ্লাসপ্লাস হয়ে, ফের জাভা সুমাত্রা বালি পেরিয়ে উত্তরপাড়াতেই এসে থেমেছেন। এবং অবশেষে বুঝেছেন (বিয়ের মাত্র তিন বছরে হাড়ে-হাড়ে বোঝা সম্ভব নয়, বিশেষত স্ত্রীদের পক্ষে), আমাকে দিয়ে বাথরুম পরিষ্কারও করানো যায় না। নিছক আত্মোপলব্ধি নয়, এ ফ্যাক্ট। তবু নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস রাখেন বলেই, লার্নিং ইংলিশের ফ্যামিলি ট্রি কি অবনেদি বাড়ির বংশলতিকা নির্মাণের আশায় এই নেভার এন্ডিং লুপ-এ পা বাড়িয়েছেন ভদ্রমহিলা। আমি স্রেফ ডিকটেশন শুনে-শুনে ডিটেকশন করেছি। ওয়ান প্লাস ওয়ান ইজ ইকুয়াল টু থ্রি। সংসারের যোগে ক্যালকুলেটর ছেড়ে ইউএসজি-র উপর ভরসা রাখতে হয়েছে আমায়।
ব্যয় আছে, তবু একথা সত্য, সংসার নামক চড়ুইভাতিতে আমি আসলে অব্যয়। ‘তিনি’ একাই কর্তৃকারক ও কর্মকারক। অতএব জিনের দায়িত্বও আমার নয় --- তা সে আলাদিনেরই হোক, বা নিজের সন্তানের। এমতাবস্থায়, যখন তিনি ও তাঁর সন্তানের মোট ওজন কিলোয় মাপা হবে না কুইন্টালে, এই নিয়ে রিপোর্ট-লিখিয়েদের মধ্যে জোর বাদানুবাদ --- আমি কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে হোটেলের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে চলেছি। কেননা, সত্যি কথা বলতে কী, নিজের সন্তানকে নিয়ে আমার ওসব স্বপ্ন-টপ্ন কিস্যু নেই। আমার আসলে অন্য কিছু মতলব আছে!
আপাতত, একটা মতলবের কথাই খুলে বললে, টের পাবেন বাকিগুলো কেমন হতে পারে। আমার ওই বনের মোষগুলির একটি, বছরে একবারই বনে বেরোয়, জানুয়ারি নাগাদ। লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। তারপর শিং উঁচিয়ে বইমেলার ধুলো-কাদা মেখে তার ও আমার ফেরা। তো ব্যাপার হচ্ছে, গায়ে-গতরে এখন সে ব্যাটা বেশ পুরুষ্টু। তার ভবিষ্যতের ফর্মার কথা ভেবে আমি আরও শঙ্কিত। দূরদর্শীর মতো এলআইসি না করে, বরং ভদ্রমহিলার দিকে ইদানীং এগিয়ে দিচ্ছি দু-পাতা চারপাতা প্রুফ। মানে, প্রুফ দেখার ব্যাপারটা যদি ইনফিলট্রেট করা যায়। বাবা হিসেবে আমার শুধু এটুকুই আগাম চাহিদা! আর মেলার মাঠে টেবিল সামলানো? উলটোদিকে তন্বী পাঠিকা কিংবা মাচো কবি থাকলে, বাঙালি রক্ত এমনিই পৌঁছে যাবে ‘মিলনমেলা’-এ।

***
এই অবধি লিখে, দেখছি, আমার ধুনকি কেটে গিয়েছে। ব্যাপারটা অত ফচকে নয়। এটা কি একটা ফরমায়েসি হাজার শব্দের গদ্য, নাকি অন্য কিছু হয়ে যাচ্ছে? আমি কি সময়ের চেয়ে দু-এক পা এগিয়ে গিয়ে কিছু ডকুমেন্টেড করে যেতে চাইছি? কাকে লিখছি আমি, পাঠককে? নাকি ‘ভণ্ড পাঠক’-এর তোয়াক্কা না-করে --- ২০২৩, ২০৩১, আমার মতো ২০৪৫, কিংবা জানি না কবে কখন এ-লেখার উলটো দিকে সে বসে আছে বলেই ভাবছি আমি। হয়তো খিস্তিই করছে সে, অস্ফূটে।
এই যে ভবিষ্যতকে দেখতে পাওয়া, আগামীর সঙ্গে কথোপকথন, এও তো একরকম স্বপ্নই! হিন্দোল ব্লগ লিখে রাখছে কেলো-র জন্য। বড়ো হলে হাওয়ায়-হাওয়ায় পড়বে সে। মুজতবা আলি ভবিষ্যতের অ্যাড্রেসে চিঠি লিখছেন সৈয়দ মুশাররফ আলি আর সৈয়দ জগলুল আলি-কে। সম্বোধন করছেন ‘বাবা ফিরোজ’, ‘বাবা ভজু’। চিঠির শেষে --- ‘তোমার আব্বু’। পাতার পর পাতা জুড়ে ‘প্রবাসী পিতার বুভুক্ষু বাৎসল্য’। আমি কি টস হওয়ার আগেই নেমে পড়েছি ব্যাট করতে? সিজার না নর্মাল, তা বুঝতেও তো এখনও কয়েক মাস।

                                                                                                                  ১২ই জুন ১৯৫৫
বাবা ফিরোজ,
তুমি নাকি একদিন আদর করে ভজুকে জিজ্ঞেস করলে, ‘ভজু, তোর আব্বু কোথায়?’
আমি তখন ঢাকাতে তোমাদের দেখতে গিয়েছিলুম। তুমি ‘তোমার আব্বু’কে পেয়ে ভারী খুশী।
কিন্তু ভজুকে ভালোবাসো বলে দুশ্চিন্তা হল --- আমার তো তাই মনে হয় --- এর আব্বু একবারও আসেনি কেন?
                                                                                                                                     আব্বু

বড়ো ছেলেকে মুজতবা আলির এই চিঠি যেটুকু বাস্তবের ইঙ্গিত, আমি কি উপস্থিত সেটুকুও স্বপ্নের মতো কামনা করছি? অমন ‘ভারী খুশী’-র অনুভূতি যদি তার কোনওদিন না জাগে, আমি কি ভেঙে পড়ব? হয়তো পড়ব, হয়তো পড়ব না-ও। কিন্তু গর্ভে তো ধারণ করিনি, স্রেফ পার্শিয়ালি ক্রোমোজোম দিয়েছি বলেই, আমি এভাবে কতদূর বুনে যেতে পারি স্বপ্নের জাল? যদি বা গর্ভবানও হতাম, তা-ও কি সঙ্গত ছিল এইসব ড্রিম সিকুয়েন্স? ও যদি পাজ্‌ল-এর সাইট থেকে ধাঁধা সল্‌ভ করে একের পর এক, কিন্তু ফরমুলা মনে রাখতে না-পেরে ত্রিকোণমিতিতে গোল্লা পায় --- আমি কি রাগ করব? যদি সিলেবাসের নির্বাচিত অংশের বদলে গোগ্রাসে গিলে ফেলে গোটা উপন্যাসের পিডিএফ, কিন্তু নোট মুখস্থ করতে না-পেরে বাংলায় থার্টি পার্সেন্ট তোলে --- বকব, ভীষণ বকব গোপনে? কিংবা যদি সবকিছুই উলটো খাতে বয় --- অঙ্কে নিরানব্বই, পাজ্‌ল নিয়ে সময় নষ্ট না করে --- বাংলায় হায়েস্ট, ‘মানে বই’-কেই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ঠাওরায় --- আমি কি খুশিই হব, নাকি ভাসমান থাকব হতাশায়? কিংবা দু-টি অপশনেরই মাঝামাঝি, একদম মিডিওকার --- ধাঁধায় বাহান্ন, অঙ্কে তিপ্পান্ন --- টেক্সটবই কি কবিতা সমগ্র, দু-থেকেই শতহাত দূরে --- তখন?
লেটার প্রেস হলে, এতক্ষণে ‘জিজ্ঞাসা চিহ্ন’ ফুরিয়ে যেত! এই ডিজিটাল উত্তর-আধুনিক যুগ প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিতে পারে। আমি তারই ফায়দা লুটছি বেদম। হয়তো উত্তরসূরির কাছে প্রশ্নসূচি সাজিয়ে নিজেকে একটা নিরপেক্ষ উচ্চতায় তুলে নেওয়ার রাজনীতিই করছি। হয়তো, আড়ালে-আড়ালে এটাও বুঝে নিতে চাইছি, আমি কি আরেকজন ‘দ্বিতীয় আমি’-রই মুখোমুখি হতে চাই...
একজন পুরুষ কি বলতে পারে না, ‘কার ছায়া তোর মুখে মনে পড়ে না’?

***
আশা ছিলো সন্তানের উৎপন্ন চুলের পরে হাত
রাখা যাবে, আশা ছিলো --- এরকমতর ছিলো আশা
সংসারে ও চৌরাস্তায় ন্যাংটার মুখশ্রীখানি দেখে
একদিন অন্ধকারে নিজহাত রেখেছি মাথায়।
এখন আমার মনে হচ্ছে, ব্যক্তি মানুষের সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা হল, তার জন্মের সিদ্ধান্ত সে নিজে নিতে পারে না। তার বেড়ে ওঠাও অনেকাংশেই নিজের ইচ্ছাধীন থাকে না। বড়োজোর সে পরে একদিন মনে-মনে চিৎকার করে উঠতে পারে, ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’। কিন্তু হাসপাতালইস্কুলঅফিসফার্নেসের এই পৃথিবীতে ততক্ষণে যা হওয়ার, হয়ে গিয়েছে। তাই, ছেলে না মেয়ে, সাদা না কালো, বাপের মতো না মায়ের মতো --- এসব ছাপাখানার ব্যাপার-স্যাপার থেকে শুরু করে --- বিকেলে ড্রইং না সুইমিং, রাতে ভাত না রুটি, জয়েন্ট না অনার্স, অঙ্ক না ইতিহাস, লভ না অ্যারেঞ্জড --- এ-সবকিছু নিয়েই ক্রমাগত এত আশা আর এতধিক আশাভঙ্গের কাহিনি। এসব বড়োরাস্তা এড়িয়ে আমি কি পারব অন্য কোনও একটা গলি খুঁজে নিতে? না হয়, একটু ঘুরপথই হল। যেখানে স্বপ্ন-দেখা নেই, স্বপ্ন-দেখানো আছে।
কিন্তু আমিও তো অদ্যাবধি কোনও পারমিশন নিতে পারিনি। অদক্ষ অভিনেতার মতো নিজের হাত দুটো কোথায় রাখব, এখন ডিসাইড করতে পারছি না। হয়তো সত্যিই কোনও স্বপ্ন আমার ন্যাপস্যাকে নেই। আমি হয়তো কতকগুলো গোপন জিজ্ঞাসাচিহ্ন মনে-মনে বহন করছি মাত্র। তবু কে জানে কেন, মাঝে-মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। আর, ঝাপসা দেখছি। লেন্সে ফাংগাস, নাকি মেঘ করেছে আকাশে? নাকি প্রকৃত প্রস্তাবে, দৃশ্য এমনই? নচেৎ... প্রম্পটার, তুমি ভবিষ্যৎ থেকে প্রম্প্‌ট করো। যেন শুনতে পাই, শোনো, এ-নাটক মাইরি পড়া নেই --- কী ভয় করছে রে শালা, বাকি সব কাস্টিং কোথায়?



আত্মজ, ২০১২

22 October 2012

ঠাকুরের পিছন দিক

সুস্নাত চৌধুরী


ছবি: সুমন চৌধুরী

আমাদের যত ভাবনা, শুধু দুর্গার সামনেটা নিয়েই। এক বারও ভেবে দেখি না, তাঁর পিছনের দিকটা কেমন হল। ওমা, কী অলুক্ষুনে কতা গো! মায়ের আবার ‘পেছন’ কী! আগুপিছু ভেবেই বলছি শুধু দুর্গা নন, লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ, কারও পশ্চাদ্দেশ নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা নেই। কী থাকে তাঁদের পিছনে? বাঁশ। কাঠের ঠেকনা। ইতস্তত বেরিয়ে আসা খড়। আর, খড়খড়ে লেপা মাটি। লজ্জা ঢাকতে কিছু না হোক, সস্তা এক টুকরো কাপড়ও তাঁদের ‘ও দিকে’ জোটে না।
চালার ঠাকুর হলে বাই ডিফল্ট বাঁচোয়া। তা না হলে, পিছনের নগ্নতা ঢাকার বাড়তি প্রয়াস আমাদের লিফলেটে নেই। রিয়েল লাইফ মূর্তি ক্রমশ লার্জার দ্যান লাইফ হবে, দিঘে ফুট থেকে ফুটান্তরে যাবে, আড়ে অতিক্রম করবে ওয়াইড লেন্সের সীমা। কিন্তু আমরা ততটাই সাজাব যতনে, যতটা দেখতে পাবে কুসুমে, রতনে। দর্শনার্থীদের ‘ঠাকুর দেখা’র স্বতঃস্ফূর্ততাকে দীর্ঘ দিন ধরেই একটা ‘প্র্যাক্টিস’-এ পরিণত করে ফেলতে চেয়েছি। লাইন দিয়ে ঢুকে সে ততটাই দেখছে, যতটা তাকে দেখানো হচ্ছে। তার দৃষ্টি-ধরনকে ‘প্রেডিক্ট’ করে নিয়ে, ‘গ্রান্টেড’ ধরে নিয়ে, আমরা স্বপ্নের রাজ্য গড়েছি। প্যান্ডেল বানিয়েছি। কিন্তু, পাবলিক কান্নিক মেরে চোখের আলোয় দেখেছে চোখের বাহিরে।
যে নৈপুণ্যে নির্মিত হয় প্রতিমার প্রচ্ছদ, সে ভাবেই তো নির্মাণ করা যায় তার ব্যাক কভারও। চন্দ্রের তেজে যদি দুর্গার স্তন হতে পারে, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, তা হলে পৃথিবীর তেজে নিতম্ব হতে ক্ষতি কী? দুর্গার ধ্যানেই তো বলছে, তিনি ‘সুচারুদশনাং তদ্বৎ পীনোন্নতপয়োধরাম্’। তাঁকে তো সম্পূর্ণ করেই গড়ে তোলা যায়। সব দিক থেকে। ত্রুটিহীন, নিখুঁত, সর্বাঙ্গসুন্দর।
দুর্গার হেয়ার স্টাইল ‘জটাজুটসমাযুক্তা’। আমাদের নির্মাণে সেই কেশবিন্যাসও আংশিক। সামনে দু’একটা লক্স। পাশে কার্লের ঢল নেমেছে। কিন্তু পিছনে একেবারে টাক। মাঝে আবার মুকুটের আড়ালে ছাঁচের ফুটো। কিন্তু আমরা যখন পার্লারে গিয়ে বসি, সামনে-পিছনে আয়না থাকা মাস্ট। আলোর সরলরেখা যাতে মুহূর্তে বানিয়ে ফেলতে পারে রেশমি চুলের পশ্চাৎভাগের অসংখ্য প্রতিবিম্ব।
ভাবের পুজো তো আমরা কবেই ছেড়েছি। আমাদের মূর্তিপুজোটুকুও ঠিকঠাক সৎ হবে না কেন? উমাকে বাপের বাড়ি এনে যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জগৎ আমরা তৈরি করি, বচ্ছরকার পাঁচ দিন তার ভেতর ডুবে থাকি, নিজস্ব সেই অনুভূতিকে আর একটু নিষ্ঠায় রুচিসম্মত করে তোলার প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা নেই। আমরা অকল্পনীয় সব থিম কল্পনা করব। সাবেক রীতিকে বয়ে নিয়ে যাব মুখস্থের মতো। চড়া লাইটিং-এ মুড়ে দেব পাড়ার পর পাড়া। টুনি কিংবা এলইডি-তে আনসিন গল্প বলব। ভুল বানানে ‘দূর্গাপূজো’ লিখব। জঘন্য অন্ত্যমিলে ছড়াব মিনিমাম বিশ-তিরিশটা হোর্ডিং। আর, যাবতীয় অন্ধকার উগরে দেব প্যান্ডেলের একদম ভেতরের দিকে। বাজেটের সব কাটছাঁট গুঁজে রাখব প্রতিমার ‘ওই পারে’। প্রথমে ব্লাউজের কাপড়, শাড়ির থান ফুরোবে। তার পর দু’এক এম এম বেরিয়ে থাকবে ফেড হতে থাকা গায়ের ‘অতসীপুষ্পবর্ণ’। এ বার হালকা সাদা রং দেখা যাবে। একদম শেষে, গ্রেনিচের ঠিক উল্টো দিকে ইন্টারন্যাশনাল ডেটলাইনের কাছে স্রেফ নগ্ন মাটি। ওখানটা তো কেউ দেখতেই পাবে না। যা এক্সপোজ্ড নয়, তা যেন উপেক্ষণীয়।
রাজা সুরথ আর সমাধি যখন নদীর ধারে দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন, তার আগে দেবীসূক্ত পাঠ করে, সে-সবের সারকথা ভাবতে ভাবতে তপস্যা করতে হয়েছিল। কারণ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল জগন্মাতার সম্যক দর্শনলাভ ‘সন্দর্শনার্থমম্বায়াঃ’। ‘সম্যক’ বিশেষণটি ভিড়ের একাকিত্বে আর আলোকসজ্জার অন্ধকারে আমরা বহু দিন হারিয়েছি। আজ আমরাও মা দুর্গার দর্শন চাই, সঙ্গে ইনক্রিমেন্ট চাই, গোয়িং অ্যাব্রড চাই, ধবধবে বউ চাই, ইন্টেলিজেন্ট বাচ্চা চাই, ম্যাথ্স-এ ফুল মার্কস চাই। কিন্তু কিছুই ‘সম্যক’ ভাবে চাই না। পুরোপুরি চাইলে, চিন্ময়ীর জন্য না হোক, অন্তত মৃন্ময়ীর জন্য আমাদের তপস্যা ত্রুটিহীন ও পরিপূর্ণ হত। আসলে, ষোলো আনার বায়না নিয়ে ঠাকুরকে আমরা মোটে আট আনা বানিয়েছি।

আমাদের বেলা ঠাকুর কিন্তু ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা দিয়েছেন। বাজেট বেড়ে যাওয়ার ভয় খেয়ে স্রেফ সামনেটা বানিয়ে ছেড়ে দেননি। খামখা আর একটু সময় যাবে বলে, পিছনে কঙ্কাল বের করে রাখেননি। পিছনেও মাংস লাগিয়েছেন, চামড়া চড়িয়েছেন। হয়তো সামনে চোখ মুখ নাক কান দিয়েছেন, যৌনাঙ্গ দিয়েছেন, কিন্তু পিছনে দিয়েছেন বাড়তি শক্তি। সহনশীলতা। ফ্রি-কিকের দেওয়ালে দাঁড়ালে বোঝা যায়, গোলার বেগে শট এলে কী ভাবে মুহূর্তে ঘুরে যেতে হয়। সিলি পয়েন্টে বসলে দেখা যায়, ঠাটানো স্কোয়ার কাট কী ভাবে আপনাআপনি ঘুরিয়ে দেয় রিফ্লেক্স অ্যাকশন। পিঠে খেলে, পেটে সয়। লক্ষ কোটি বছরের অভিযোজনে আমাদের সামনেকে সামনে পিছনকে পিছন করে তুলেছে প্রকৃতি। সেই পশ্চাদ্ভাগে আরও ভ্যালু অ্যাড করে নিয়েছি আমরা। যোগ করেছি গ্রীবার মাহাত্ম্য। খোঁপার মাহাত্ম্য। নিতম্বের মাহাত্ম্য। স্টাইল স্টেটমেন্টে ঝড় তুলেছে হিপ ক্লিভেজ। খোলা পিঠ আরও সুন্দর করেছে কারুকাজ। টিশার্টের পিছনে ক্যাপশন লিখে ঘুরেছে। কিন্তু যে দেবীকে নিয়ে তার এত উদ্যাপন, এত উৎসব, যাকে সে সবার উপরে বসিয়েছে, তার বাকি আট আনার ব্যাকগ্রাউন্ড করে রেখেছে কদর্য। সেখানে ঠাঁই হয়নি এতটুকু নান্দনিকতারও।
প্রাচীন গ্রিসের প্রবাদপ্রতিম ভাস্কর ফিডিয়াস। একের পর এক দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করে তিনি প্রায় গ্রিসের বিশ্বকর্মা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে নাকি প্রশ্ন করা হয়েছিল, এ সব দেবদেবীকে তো তিনি চাক্ষুষ করেননি, তা হলে কোন কল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলেন তাঁদের? ফিডিয়াস জানিয়েছিলেন, তিনি স্টুডিয়োতে জনা কুড়ি গ্রিক অ্যাথলিটকে নগ্ন করে বৃত্তাকারে ঘোরান। বৃত্তের কেন্দ্রে থাকেন তিনি। কর্মরত। তাঁদের দেহসৌষ্ঠব, অপূর্ব অ্যানাটমি তাঁকে ঈশ্বরের আন্দাজ দেয়। কেন বৃত্তাকারে ঘোরাতেন ফিডিয়াস? কেন এক জন ভাস্করের দরকার হয় রিভল্ভিং প্ল্যাটফর্ম? কারণ সে তিনশো ষাট ডিগ্রিই নির্মাণ করতে চায়। সামনে আর পিছনে সে তুলে ধরে সমান ডিটেল। মার্জার সরণি বেয়ে হেঁটে আসা রূপসীরাও তো প্রথমে ক্লকওয়াইজ অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ মোচড় দেন। তার পর, থামেন। আবার পিছু ফিরে দুলকি চালে হেঁটে যান। কেন না যিনি সুন্দর, তিনি তিনশো ষাট ডিগ্রিই সুন্দর। আমাদের পুজোর রীতিতেও কিন্তু এই ‘প্রদক্ষিণ’ অনিবার্য অঙ্গ। সেখানেও বামাবর্ত আর দক্ষিণাবর্তের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ কিনা দেবস্থানকে, স্বয়ং দেবতাকে ঘুরে ঘুরে উপাসনা করবে ভক্ত। আমাদের দুর্গাপ্রতিমায় সেই রাউন্ড-আপ থাকে না। সে শুধু সামনে থেকেই দেখার চিজ। ব্যাক টু ক্যাম ঈশ্বর, আমাদের দিগ্দর্শনে নেই। ব্যাপারটা আরও দৃষ্টিকটু হয় বিসর্জনের দিন। প্রদক্ষিণের রেফারেন্সটা উল্টে যায়। ‘আমাদের প্রতিমা ধীরে ধীরে নিরঞ্জনের পথে’ এগিয়ে চলে, আমরা পথের দু’পাশে স্থির থাকি। তখন সেই আপেক্ষিক গতিবেগ জাঁকজমকে আড়াল করে রাখা বাঁশ, কাঠামো, খড়, মাটিকে ল্যাংটো করে দেয়। হ্যালোজেনের ফোকাস মেরে সেই অন্ধকার কখনও গোপন করা যায় না।

মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবণতাতেই থ্রি-ডি দেখতে চায়। চোখে চশমা লাগিয়ে টু-ডি পর্দাতেও সে তিন মাত্রাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। এই বঙ্গেই ঘূর্ণির মিনিয়েচার পুতুলেও সেই ত্রিমাত্রিক পরিপূর্ণতার ছোঁয়া মেলে। কিন্তু দুর্গাকে আমরা ঠায় বসিয়ে রেখেছি মাপ করে কাটা একটা টু-ডি খোপের মধ্যে। যেন খাড়া করে রাখা দ্বিমাত্রিক শবদেহ।
দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখিনি, দেখেছি খোলা রাস্তায়। প্রতি বছর দেখি, পুজোর কিছুটা আগে। বাইরে শুকোতে দেওয়া আদুড় গায়ে দুর্গা। এমনই আমাদের সচেতনতা। এমনই আমাদের নান্দনিকতা। বসন পরো মা। এ ক’দিন অর্ধেক বেনারসিতেই চালিয়ে নাও। বাকি অর্ধেকে পট না-পাও, চটই টাঙিয়ে নিও।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ অক্টোবর ২০১২

15 September 2012

পক্ষীরাজ ঘোড়া তার পক্ষীরানি ঘুড়ি

সুস্নাত চৌধুরী


এ গল্পটা বরং সেই ছেলেটাকে নিয়ে, যে বয়স বারো কি তেরোর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ময়দানে। আর বিস্ময়ে তাকিয়েছিল আকাশের ক্যানভাসে। যেখানে তখন অসংখ্য রঙের ফোঁটা কেউ স্থির, কেউ সরে যাচ্ছে। না, তার হাতে সে দিন লাটাই ছিল না। ছিল সরু আর লম্বা একটা ডাল। ছোট্ট ছেলেটা তার হাতের অস্ত্র দিয়েই সে দিন নামিয়ে নিয়েছিল কে-জানে-কার কেটে যাওয়া একটা ঘুড়ি। লেগে থাকা সুতোটাকেই সম্বল করেই শুরু হয়েছিল তার আকাশে ওড়া। সারা আকাশকে চ্যালেঞ্জ জানানো। সেই তার বড় হয়ে ওঠার শুরু।
খুব তাড়াতাড়ি সে শিখে নিয়েছিল ঠিকঠাক কল খাটানোর কৌশল। জেনে গিয়েছিল কোনটা পেটকাটি, কাকে বলে মুখপোড়া, রসগোল্লা বা মোমবাতি আসলে কী রকম, ভড়-ই বা ঠিক কী! শুনে ফেলেছিল কত রকম সুতোর কথা। স্পেকট্রা, ডেক্রন, ডিকট। তবু, এত সবের মধ্যেও ওকে টানত যা-হোক কিছু নিয়ে বাতাসে ভেসে থাকার মজা। আর একটু... আর একটু উপরে যদি শুধু ওঠা যায়। ঘুড়ি নিয়ে লড়াই তখন ওর ভালই লাগত না। পাড়া-কাঁপানো ‘ভোকাট্টা’ চিৎকারে বাচ্চা ছেলেটা হকচকিয়েই যেত। অশালীন লাগত। খানিক আগেও যে ‘ভোম্মারা’ বলে লাফিয়ে উঠেছে, সেই দুষ্টু লোকটার ঘুড়ি কেটে গেলেও ওর মন খারাপ হয়ে যেত। আসলে, সুতো ছিঁড়ে ভেসে যাওয়া ঘুড়ি দেখলে ওর মরে-যাওয়া বাবার কথা মনে পড়ত। ও চিনতই না হারবার্ট সরকারকে, যে শিশুকালে মৃতা মার অনতিদূরে শুয়ে ঢিলি প্যাঁচ দেখেছিল। ‘মেঘলা আকাশে অনেক ওপর দিয়ে কেটে যাওয়া একটা কালো বুলুম দেখে হারবার্টের প্রায় ভয় করেছিল। এত গম্ভীর শেষযাত্রা হারবার্ট আগে বা পরে কখনও দেখেনি।’ তবে, ও খুব চেষ্টা করত অজানা পথে পাড়ি দেওয়া সেই সব ঘুড়িগুলোকে হারিয়ে যাওয়ার আগে নিজের কাছে টেনে নিতে; তার পর আবার সুতো বেঁধে আকাশে তোল্লাই দিতে। এতেই ওর মন উৎসব-উৎসব হয়ে যেত!
আসল উৎসব সতেরোই সেপ্টেম্বর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরেই নিয়েছিল, পাঁজিতে নির্ঘাত লেখা আছে, বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানোই বিহিত। ঠিক তখনই নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছিল শিল্পের শ্রেষ্ঠকর্তা বিশ্বকর্মার হাতে ঘুড়ি তুলে দেওয়ার থিয়োরি। বাবলুকাকুর গ্যারাজের হেল্পারদের কালিমাখা হাতে রেঞ্চ-প্লায়ার্স নয়, সতেরো তারিখ ববিন লাটাই তুলে নেওয়ার ব্যাখ্যা। আর একটু বড় হয়ে অবশ্য আরও অনেক কিছু ভেবে নিয়েছিল। সতেরোই সেপ্টেম্বর মানে সংক্রান্তি। যেমন মকর সংক্রান্তির দিন ঘুড়ির উৎসবে মাতেন গুজরাত বা বাংলাদেশের মানুষ। এ প্রশ্নও জেগেছিল মনে, এর মধ্যে কি কোথাও শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার ভাবনা কাজ করছে? ইন্দোনেশিয়ায় বিবিন ঘুড়ি, জানগান ঘুড়ি উড়িয়েই তো প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কৃষকরা। জাপানের হনসু-তে খরা কাটানোর জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ আছে। চিনের ড্রাগন ঘুড়িও প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজনে কামনায় ওড়ানো। মকর সংক্রান্তির ‘আউনি-বাউনি’ও তো ধান তোলারই অনুষ্ঠান। তা হলে ভাদ্র সংক্রান্তির মর্মই বা অন্য রকম হবে কেন? যে উৎসব জানান দিচ্ছে আশ্বিনের আগমনের, যে আশ্বিনে আসবেন মা দুর্গা স্বয়ং। অতএব? না, এ সব তত্ত্ব উড়িয়ে ও ফাইন্যালি ধরে ফেলেছিল খুব গরম নয়, খুব ঠান্ডা নয়, আকাশে মেঘ নেই, কড়া রোদও নেই স্রেফ সে কারণেই সতেরোই সেপ্টেম্বর ঘুড়ি ওড়ানোর উপযুক্ত তিথি!
বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে ঘুড়িকেই ওর প্রেমিকা মনে হয়েছিল। রূপসী, তন্বী, নিখুঁত ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স। কখনও তিরতির কাঁপছে, কখনও স্থির। তত দিনে ও শুনে ফেলেছে রফি আর লতার কণ্ঠে ‘চলি চলি রে পতং মেরি চলি রে... সারি দুনিয়া ইয়ে দেখ দেখ জলি রে... ’ স্বপ্ন দেখত, ও চেপেছে পক্ষীরাজ ঘোড়ায়, আর সঙ্গে পক্ষীরানি ঘুড়ি। ওর মনে তখন বাজত হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে...
ঘুড়ি নিয়ে যারা কালচার করে, তারা জানে মাথা তুলে বাঁচতে। উপরের দিকে তাকাতে। সাহস করে ও-ও এক দিন উঠে গিয়েছিল একতলা বাড়ির ছোট্ট ছাদে। বাড়তে গিয়ে বুঝেছিল, চার পাশে বড্ড দেওয়াল। ওর আকাশ আসলে অন্যের জানলা মাত্র। তিনতলা-চারতলা-সাততলা বাড়িরা যেন ওর প্রেমিকাকে গডজিলার মতো গিলে ফেলবে। সে দিনই ও সিদ্ধান্ত নেয়, আরও উপরে উঠতে গেলে আরও উপরে তাকাতে হবে। অগত্যা ওকে শিখতেই হল মাঞ্জা। মায়দানি, বেরিলি, ডাবল স্পেশাল, সারস। তত দিনে ও বুঝে গিয়েছিল, কাটাকুটি না করলে বেঁচে থাকা যাবে না। ওর ঘুড়িকে কেউ উপরে উঠতেই দেবে না। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। শুধু নন্দিনীর বাড়িতেই নয়, দুনিয়ার সর্বত্রই ‘ঢিল দে ঢিল দে দে রে ভাইয়া’ বলে উঠতে না পারলে সমীরদের ব্যর্থ হতেই হবে। হাম ঢিল দে চুকে সনম!
আজ নতুন ফ্ল্যাটের ছাদে উঠেই বুঝতে পারছে, এখানে পৌঁছতেই পারবে না কোনও কানকাটা, ময়ূরপঙ্খী। আসবে না সেই পক্ষীরাজও। এত দিন পর পিনুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। স্কুলের বন্ধু। বাবার টেলারিং-এর দোকান থেকে সুতো চুরি করে আনত। ঘুড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে। হলদে চাঁদিয়ালের হলুদ সুতো, লাল মুখপোড়ার জন্য লাল। কিন্তু, ও সুতোয় কি ঘুড়ি টেকে আকাশে! পারেনি পিনু। ওরও আজ নিজেকে বড্ড পারফেক্ট লাগছে। সব মিলে যাচ্ছে। লাটাই, সুতো, মাঞ্জা এ সব কি বড় বেখাপ্পা ওর কাফলিঙ্ক লাগানো হাতে? এ বার কি দিনভর www.gamesgames.com কিংবা www.thekidzpage.com-এ ঢুকে ফ্লাইং কাইটস খেলবে তবে!
না কি, এক বার নীচে নেমে দেখবে? সূর্য ডোবার আগে পক্ষীরানিও তো ফিরে এসেছিল। ও-ও ফিরে যাবে ময়দানে। মাঞ্জা নয়, একদম সাদা সুতোর মতো দিনটা কাটাবে। আকাশটা রঙে রঙে ছেয়ে দেবে।



আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২