15 July 2013

কে সি নাগ

সুস্নাত চৌধুরী


ইস্কুল যেতে পেটব্যথা হবে। পরীক্ষার হলে ঘাম দিতে থাকবে। তেল মাখা বাঁশে উল্লাসে উঠেছে মাংকি! প্রোপোজ-টোপোজ ঘুচিয়ে ম্যাথস-এর কোচিং-এ প্রেস্টিজ ফুটো হবে। কেননা চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে তত ক্ষণে সব জল বেরিয়ে যাচ্ছে, আর উপরের কোন ব্যাটাচ্ছেলে খুলে দিয়েছে কল! এমতাবস্থায় কোনটে চাই, ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, সেটুকু ধরতেই মাথা গুলিয়ে গ। এই কিংকতর্ব্যবিমূঢ়তারই আদি পিতা কে সি নাগ।
আবার, কে সি নাগ একটা চ্যালেঞ্জের নাম। তেমন জুতসই একটা অঙ্কের সমাধান কারও কনফিডেন্সের ফুসফুসটা আরও ফুলিয়ে দেয়। এক-একটা অনুশীলনী যত গড়িয়ে আসতে থাকে, খেলা তত জমে। উনতিরিশ, তিরিশ, একত্রিশের দাগের অঙ্কগুলো যেন এক একটা হার্ডল, টপকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে সাঁইসাঁই রেস জেতার উল্লাস।



ছবি: সুমন চৌধুরী

ছাত্রজীবন, শিক্ষকজীবন
১৮৯৩ খ্রি.। ১৩০০ বঙ্গাব্দ। রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশবচন্দ্র নাগ। বাবা রঘুনাথ, মা ক্ষীরোদাসুন্দরী। শৈশবেই পিতৃহারা হন কেশব। সন্তানদের মানুষ করতে শুরু হল ক্ষীরোদাসুন্দরীর লড়াই। কেশবচন্দ্রের পড়াশোনার শুরু স্থানীয় বাংলা স্কুলে। গুড়াপে তখন ওই একটিই স্কুল। তার পর ক্লাস সেভেন থেকে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়। রাত থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়া, তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে প্রতি দিন স্কুল যাওয়া। হেঁটেই ফেরা। ক্লাস নাইনে ভরতি হলেন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। ১৯১২ সালে সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া। এ বার রিপন কলেজ। বিষয় বিজ্ঞান। এই সময় থেকেই প্রাইভেট টিউশনি শুরু করে দেন কেশবচন্দ্র। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগেই পাশ করলেন আইএসসি।



কেশবচন্দ্র নাগ
যে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক দিন ছাত্র ছিলেন, সেখানেই শুরু করলেন শিক্ষকতা। যোগ দিলেন থার্ড মাস্টার হিসেবে। সংসারের ভার তখন কাঁধে, চাকরি ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার চেষ্টা চলল। বিজ্ঞান নয়, যদি কলা বিভাগেও স্নাতক হওয়া যায়! অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করলেন কেশবচন্দ্র। এ বার ডাক এল অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার, সেই ছাত্রবেলার কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে। সেখানেও কিছু দিন শিক্ষকতা করলেন তিনি। তার পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল। এ সময়ই অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে কেশবচন্দ্রের সুখ্যাতির কথা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছয়। মানুষ চিনতে তিনি ভুল করেননি। মিত্র ইনস্টিটিউশন ভবানীপুরে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসা হয় কেশবচন্দ্রকে। রসা রোডে মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। তত দিনে তাঁর জীবনের কেন্দ্রে কেবল একটিই শব্দ গণিত। এই মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নেন কেশবচন্দ্র। মেসবাড়ি ছেড়ে ১৯৬৪ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনের নতুন বাড়িতে। আজও যে বাড়িতে ‘কেশবচন্দ্র নাগ’ লেখা নেমপ্লেটটি উজ্জ্বল! তাঁর শিক্ষকজীবনের শেষার্ধ কেটেছে কলকাতায়। তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু, অন্তরের টানে বারে বারে ফিরে গিয়েছেন হুগলির গুড়াপে, তাঁর মাটির কাছে।

বই লেখা
বই লেখার কথা দূর কল্পনাতেও ছিল না। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। সেখানে তাঁর অগ্রজ সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায়। তাঁর বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’। আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকরা। কেশবচন্দ্রও হয়ে ওঠেন সেই আড্ডার অন্যতম। শরৎচন্দ্রই নাকি তাঁকে প্রথম বলেন গণিতের বই লেখার কথা। তখন কেশবচন্দ্র বিষয়টাকে বড় একটা পাত্তা দেননি। তার পর এক দিন তাঁকে প্রায় চেপেই ধরেন কবিশেখর। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের জন্য বই লেখার কথা বলেন। ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ প্রবন্ধে সে কথোপকথনের একটা ইঙ্গিত রেখেছেন লেখক চিত্তরঞ্জন ঘোষাল। কালিদাসবাবু বলেন ‘ক্লাসে যেভাবে অঙ্ক শেখাও, আর ছেলেরা যেভাবে চুপ করে ওই শুকনো খড়কুটো গোগ্রাসে গেলে, দেখে তো মনে হয় ভাই যে তুমি গল্প লেখা শেখাচ্ছো। তাহলে নিজে লিখতে পারবে না কেন?’ শুরু হল পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। তখন তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। প্রকাশিত হল ‘নব পাটীগণিত’। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। কেশবচন্দ্র নাগের সেই ‘কে সি নাগ’ হয়ে ওঠার শুরু। বছর কয়েকের মধ্যেই তামাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও অনুমোদিত হল।
আক্ষরিকই, অপাঠ্য বই লিখেও অনেকের কপালে সাহিত্যিক-সুলেখকের তকমা জোটে। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের রচয়িতাকে ‘লেখক’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্র্যাকটিসে নেই। ল্যাডলিমোহনের কেমিস্ট্রি বা সিআরডিজি-র ফিজিক্স অনেক বাজারি গপ্পো-কবিতার চেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে, বেশি মানুষের ‘কাজে’ লেগেছে। তবু তাঁদের আমরা লেখক বলি না। কে সি নাগের ক্ষেত্রেও ‘পাঠক’-এর অবস্থানটা সেরকমই। ভুললে চলবে না, কে সি নাগকে অঙ্কের বই লিখতে বলছেন কবি আর কথাশিল্পী। শরৎচন্দ্র মজা করেই তাঁকে ডাকছেন ‘গণিত-শিল্পী’ বলে! কে সি নাগের সেই সব অঙ্কবইয়ে কি তবে কোনও মৌলিকত্ব নেই? তাঁকে পুরোদস্তুর ‘লেখক’-এর তকমা দেওয়া কি উচিত নয়?
ঘটনাচক্রে কেশবচন্দ্রের মেসে এক দিন এসে পড়েন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল। টেবিলের উপরেই ছিল কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা। দেখামাত্রই চমকে ওঠেন পরেশবাবু। কোন অঙ্ক কোন উপায়ে করলে সহজেই বোধগম্য হবে ছাত্রদের, তার হরেক রকম টেকনিক লিখে রাখা পাতার পর পাতায়। সেই খাতাটি বইয়ের আকারে ছাপার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে একেবারেই রাজি হননি কেশবচন্দ্র। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, অঙ্কের কি হেল্প-বুক হয়, না শিক্ষকদের জন্য গাইডবুক হবে এটি? শেষমেশ কেশবচন্দ্রকে রাজি করাতে সফল হন প্রকাশক। ১৯৪২। প্রকাশিত হল অঙ্কের সহায়িকা ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। বেরনো মাত্রই বইটির চাহিদা হয়েছিল আকাশছোঁয়া।
একে একে তাঁর আরও বই প্রকাশিত হতে থাকে। ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। পাকিস্তান বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী লিখেছিলেন ‘পাক ম্যাথমেটিক্স’। দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ব্রেল সংস্করণও। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মার্টিন বার্ড স্নাইডার কে সি নাগের বইগুলির বিষয়ে বলেছিলেন, ‘দ্য থিয়োরিটিকাল ট্রিটমেন্ট অব দ্য সাবজেক্ট ইন দিজ বুকস ওয়্যার সুপিরিয়র টু দ্যাট ফাউন্ড ইন সিমিলার বুকস ইন দ্য ইউএসএ’।

অ-গণিত প্রতিভা
গণিতের বাইরেও অগণিত ক্ষেত্রে অবিচল যাতায়াত ছিল কেশবচন্দ্রের। ছেলেবেলাতেই তাঁর ভেতর জনসেবার বীজ রোপণ করেছিলেন প্রতিবেশী জিতুদা জিতেন্দ্রনাথ রায়। পরে যিনি হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ মহারাজ। এক কথায় তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্রের মেন্টর। তাঁর প্রতিটি কথা জীবনভর মন্ত্রের মতো পালন করতেন কেশবচন্দ্র। তাঁর আয়োজনেই উপনিষদ, বেদ-বেদান্তের চর্চা। শ্রীশ্রীসারদামায়ের প্রত্যক্ষ শিষ্যত্বও নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। সমাজসেবা আর অধ্যাত্মচিন্তা একযোগে চলেছে, শিক্ষকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
ব্যক্তিগত ডায়েরি ‘রত্ন-বেদী’-তে লিখে গিয়েছেন বহু কবিতা, ভক্তিমূলক গান। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসিকতার কথাও। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য যেখানে যে মন্তব্যটি মনে ধরেছে, টুকে রেখেছেন এই খাতায়। আর খাতার উপরে লিখে রেখেছেন ‘বিনা অনুমতিতে পাঠ নিষেধ’! ১৯২৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত টানা এই অভ্যাস চালিয়েছেন। এ ছাড়াও কেশবচন্দ্র বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বামী অভেদানন্দের বহু ইংরেজি বক্তৃতা। অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার লেখাও।
গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও শামিল হয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। তাঁর বই তত দিনে বাজারে ঝড় তুলে দিয়েছে। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন গ্রামে। ধনেখালি থানা কংগ্রেসের তখন তিনি সভাপতি। চলল মিছিল, আন্দোলন। পুলিশ গ্রেপ্তার করল কেশবচন্দ্রকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দিন কাটতে লাগল জেলখানায়। গুজব রটল ইংরেজরা চাইছে কেশবচন্দ্রকে গুম করে দিতে! অবশেষে তিনি ছাড়া পেলেন বেশ কয়েক মাস পর। ফিরে এসে ফের যোগ দিলেন গাঁধীজির অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আন্দোলনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান। ভোটে দাঁড়াতে বলেন। সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কেশবচন্দ্র।
কেশবচন্দ্রের আরও এক আগ্রহের জায়গা ছিল খেলার মাঠ। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস সবেতেই সমান আগ্রহ। ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য। বয়সকালে মাঠে যেতে পারতেন না, রেডিয়োয় সম্প্রচার শুনতেন। আর পাটিগণিত থেকে শিফ্ট করে যেতেন জ্যামিতিতে! রিলে শুনতে শুনতেই কাগজে আঁক কেটে বুঝতেন ও বুঝিয়ে দিতেন মাঠের এক একটা মুভমেন্ট।
১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫। রেডিয়োয় চলছে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী। কানপুরে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট। কেরিয়ারের শুরুতেই তিন নম্বর সেঞ্চুরিটি হাঁকাচ্ছেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। টানটান রোমাঞ্চ। উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেশবচন্দ্র। সেরিব্রাল। আরও দু’বছর পর থেমে গেল সব অঙ্ক। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭।

স্যরের ছাত্ররা
তালিকাটা স্বভাবতই বেশ লম্বা। তারকাখচিতও বটে। চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বিকাশ রায়। রঞ্জিত মল্লিক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ গ্রন্থে (চিত্তরঞ্জন ঘোষাল সম্পাদিত ও ‘গ্রন্থ সম্পুট’ প্রকাশিত) কলম ধরেছিলেন তাঁর এই সব কৃতী ছাত্ররা। নিজেদের মাঠে যাঁরা সব হিসেব এক্কেবারে মিলিয়ে দিয়েছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গণিতবিদ হয়েও বেদ-উপনিষদে কেশববাবুর যে টান, তাতেও এ দুইয়ের নিকটাত্মীয়তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।’ সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলছেন, ‘ছাত্রদের সাহায্য করতে (শুধু অঙ্কে নয়, যে কোনও ব্যাপারে) তাঁর দিনে রাত্রে কোনো সময়েই কিছুমাত্র অনাগ্রহ বা উদ্যমের অভাব ছিল না। এবং সে সাহায্যের মধ্যে কোনো দেনাপাওনার সম্পর্কের লেশমাত্র ছিল না।’ সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘অবাক হয়েছিলাম, যাঁকে দেখে ভয় হোত, কড়া ধাতের মানুষ বলে মনে হোত সেই কেশববাবু স্যারই যখন গান করার উৎসাহ দিতেন আমাকে।’ তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিতে দেখেছেন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। তিনি লিখছেন, ‘তাঁরই প্রেরণায় উপলব্ধি করলাম অঙ্ক কত সহজ অঙ্ক একটা ম্যাজিক অঙ্কের মধ্যেও সাহিত্য-শিল্প আছে।’ আবার গুড়াপ সুরেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের স্মারকগ্রন্থে লিখছেন অভিনেতা বিকাশ রায় ‘মোটা চশমার আড়ালে গম্ভীর মুখের ছায়ায় একজোড়া সহানুভূতি-ভরা চোখ আমরা দেখেছিলাম, আমরা ভাল কিছু করতে পারলে সেই চোখে উৎসাহ জ্বলে উঠতো, আমাদের দুষ্টুমি দেখে সেই চোখে মৃদু ভর্ৎসনার সঙ্গে সামান্য indulgence ফুটে উঠতো।’

অঙ্ক মেলে না
আমি-আপনিও কি কে সি নাগের ছাত্র নই? কে সি নাগ বহু মানুষের কৈশোরের এক অনিবার্য স্মৃতি। এক আইকন। তিনিই আমাদের পাঠ্যক্রমের একমাত্র অরণ্যদেব। অথচ বইয়ের টাইটেল পেজে নামের পাশে ডিগ্রি লিখতেন না তিনি। আজও তাঁর বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত রয়্যালটির টাকার একটা বড় অংশ চলে যায় দুটি চ্যারিটি ফান্ডে। একটি তাঁর নিজের নামে, অন্যটি তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীমণির নামে। এখনও প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হয় গুড়াপে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের উদ্যোগে। আয়োজিত হয় কেশবচন্দ্র নাগ স্মারক বক্তৃতা। এ বারও হয়েছে। কিন্তু সে খবর আমরা ক’জন রাখি? ক’টা টিভি ক্যামেরা যায় সেখানে? হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে জাস্ট দু’পা হাঁটলেই কে সি নাগের কলকাতার বাড়ি। পাড়ার মেয়েটিও আগে জন্মদিনে প্রণাম করে যেতেন বৃদ্ধ কে সি নাগ’কে বলছিলেন তাঁর বড় ছেলে দেবীপ্রসাদ নাগ। এখন মেয়েটি ইচ্ছে করলেই হয়তো মানুষটির স্মৃতি উদযাপনে অনেক কিছু করতে পারেন।
আমাদের অবশ্য প্রণাম-ট্রনাম খুব ভাল আসে না। পাটিগণিতের মতোই, বেশ গুলিয়ে গেছে। এই নল দিয়ে ঢুকছিল শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধ আর ওই নল দিয়ে খরচ করে ফেলছিলাম ফুর্তিময় বিন্দাস মুহূর্ত, হাতে রইল যেন কী?





আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ জুলাই ২০১৩

03 July 2013

গাঁধীজির পাশেই গাই ফকস

সুস্নাত চৌধুরী


ভি ফর ভিনিগার’-ই আজকের ব্রাজিলে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মহাত্মা গাঁধী ও গাই ফকসকে। হাজার হাজার মানুষের হাতে গাঁধীজির ছবি, মুখে গাই ফক্সের মুখোশ। সেই গাই ফকস, চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে, যাঁর নামে প্রতি ৫ নভেম্বরের রাত্রি উদ্যাপিত হয়ে আসছে বিলেত জুড়ে। ‘গাই ফকস নাইট’। ‘গানপাউডার প্লট’-এর অন্যতম চক্রী। ১৬০৫ সালে রাজা প্রথম জেমসকে হত্যা ও ব্রিটেনের পার্লামেন্ট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে ক্যাথলিকদের একটি দল। বারুদের বিপুল মজুত দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন দলের অন্যতম সদস্য গাই ফকস। কিন্তু ৫ নভেম্বর তিনি ধরা পড়ে যান। মৃত্যুদণ্ড হয় তাঁর। ফক্সের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছিল, ফক্সের গ্রেফতারি বচ্ছরকার উদ্যাপন— তবু তামাম বিশ্বে মিথ হয়ে বেঁচে রয়েছেন গাই ফকস। তাঁর মুখের আদল সহজ মুখোশে বদলে নিয়েছে মানুষ— সেজেছে সরু গোঁফ আর ছুঁচলো দাড়িতে। সে মুখে অম্লান হাসি। যে হাসি স্পর্ধার। অ্যানার্কির মধ্যে যে কমিকাল ভায়োলেন্স আছে, তা ফুটে ওঠে এই হাসিতে। মুখের ছাঁদে কোথাও যেন এসে পড়ে রবিন হুডের অনুষঙ্গও। মুখের উপর মুখোশ মানেই সব মানুষের এক হয়ে যাওয়া, এই মুখোশ সেই সাম্যের সঙ্গে জুড়ে নেয় প্রতিরোধের আগুন, প্রতিবাদের ভাষা।


গাই ফক্সের মুখোশ আগেও বহুবার দেখেছে বিশ্ব। গত বছরই পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে দেখা গিয়েছিল গাই ফক্সের মুখোশ পরা একঝাঁক সদস্যকে। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ইন্টারনেট সেন্সারশিপ বিষয়ক অ্যান্টি-কাউন্টারফেইটিং ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা অ্যাক্টা-র। ‘হ্যাকিং’ ও ‘অ্যাক্টিভিজম’-এর জোড়কলম ‘হ্যাকটিভিজম’-এ যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁদের আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যানোনিমাস-এর লোগোও হয়ে উঠেছে গাই ফক্সের মুখোশ। ভারত সরকারও যখন টরেন্ট, ফেসবুক বা টুইটারের উপর থাবা বসাতে চাইছিল, আঘাত করতে চাইছিল দেশবাসীর ই-স্বাধীনতায়, তখনও মুম্বই বা বেঙ্গালুরুতে বিক্ষোভ-জমায়েতে প্রতিবাদীদের মুখে উঠে এসেছিল স্লোগান। সঙ্গে এই মুখোশ। আঁকা হয়েছিল এমন ছবিও— স্বয়ং মহাত্মা গাঁধী মুখে পরে নিচ্ছেন অ্যানোনিমাস-এর লোগো, গাই ফক্সের মুখোশ। আজ আবার ব্রাজিলের রাস্তায় একসঙ্গে দেখা গেল গাঁধী ও ফকসকে।
বছর দুই আগে, অণ্ণা হাজারে যখন রামলীলা ময়দানে অনশনে, তখন এক আশ্চর্য ছবি দেখা গিয়েছিল রিও-র কোপাকাবানা বিচে। শামিল হয়েছিলেন একদল ব্রাজিলীয়; মাথায় ছিল গাঁধী-টুপি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতবাসীর লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। সালভাদোরের রংচঙে কার্নিভালেও পথে নামতে দেখা যায় একদল মানুষকে, যাঁদের পরনে থাকা সাদা পোশাক। নিজেদের তাঁরা বলেন— ‘ফিলহোদ দে গাঁধী’, অর্থাৎ গাঁধীর সন্তান। গাঁধীর সঙ্গে ব্রাজিলের সম্পর্কের আরও একটি উদাহরণ নারীবাদী লেখিকা মারিয়া লাসেরদা দে মউরা। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে গাঁধীর প্রসঙ্গ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রাজিলের আমজনতা আবার হাতিয়ার করে নিলেন মহাত্মাকে।
তা হলে কি কোথাও একটা মিলছে না? একটা দ্বিচারিতার মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটছে ভি ফর ভিনিগার মুভমেন্ট? আপাতভাবে দেখলে দ্বিচারিতা রয়েছে বটেই। ব্রাজিলবাসীর এই আন্দোলন কোথাও শান্তিপূর্ণ অবস্থান— সেখানে গান, বাজনা, সাম্বা। আবার কোথাও ভয়াবহ হিংসাত্মক চেহারা তার। চলছে অবাধ ভাঙচুর, লুঠপাট। মনে হবে, একই মুদ্রার এক পিঠে হিংসা, অন্য পিঠে অহিংসা।
আসলে শুধু ড্রিবল আর মাপা পাসের সৌন্দর্য দিয়েই ম্যাচ জিততে চায় না ব্রাজিল, কড়া ট্যাকলও চায়। ফেয়ার প্লে নয়, চ্যাম্পিয়নের ট্রফির দিকেই তাদের নজর। প্রেসিডেন্ট দিল মা রউসেফের যাবতীয় ঢোঁকগেলা প্রতিশ্রুতিকে উড়িয়ে দিয়ে আজ এতদিন পর তারা নানা ভাবে যেটা বলতে চাইছে— হ্যাঁ, সেটা আমাদেরও খুব চেনা স্লোগান— মানছি না, মানব না।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ জুলাই ২০১৩

01 July 2013

বেওসা

সুস্নাত চৌধুরী


অন্যকে নিয়ে বাঙালি খুব ইয়ার্কি মারতে পারে। মাড়ওয়ারিকে ‘মেড়ো’ বলতে পারলে সে খুশি হয়। আরও খুশি হয় অন্যের দক্ষতাকে তার ডায়ালেক্টেই খাটো করতে পারলে। ব্যবসাকে ‘বেওসা’ বলার কোনও মতে এক পিস সুযোগ পেলে বাঙালির প্রাদেশিক অন্তরাত্মা জুড়োয়। কেননা, নিজে সে চিরকাল বাড়ি থেকে মুখস্থ করে গিয়ে লিখে এসেছে ‘বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার’ শীর্ষক কোটেশনসমৃদ্ধ বাংলা রচনা। তার পর পাশ-টাশ দিয়ে বেকারের সংখ্যা দাঁড় করিয়েছে এক্স প্লাস ওয়ানে। তার পর সুখতলা খুইয়ে চাকরি খুঁজেছে ওই ‘মেড়ো’-র আন্ডারেই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসা শুরু করার মুরোদ তার নেই।
অথচ অনেক বাঙালি দেবতা তাকে চাবকে বলেছিলেন, ব্যবসা ধর! বহু দিন আগে কলেজপাড়ায় বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন এক বাঙালি ইন্টেলেকচুয়াল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত প্রেস অ্যান্ড ডিপোজিটরি। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে পার্টনার হিসেবে ছাপাখানা বসিয়েছিলেন। সেই ব্যবসা কত দূর সিরিয়াস ছিল, বুঝতে পারা যায় বিদ্যাসাগরের লেখনী থেকেই। তর্কালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছয়, তর্কালঙ্কারের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর ‘শিশুশিক্ষা’-র কপিরাইট বাবদ টাকা মেরে দিয়েছেন, এমন কথাও রটে। রটান তর্কালঙ্কারের জামাই যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ। ব্যবসার এই টানাপোড়েন আইন-আদালত পর্যন্তও গড়ায়। ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর যে ‘পরস্বহারী’ নন, তা প্রমাণ করতে শেষমেশ ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’ নামক গোটা একখানি পুস্তিকাই লিখে ফেলতে হয় লেখক বিদ্যাসাগরকে। না, ব্যবসা করতে, নিজের ব্যবসায়ী সত্তাকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে তাঁর প্রেস্টিজে লাগেনি।

ছবি: সুমন চৌধুরী

লেখক শংকরকে এক বার নাকি তাঁর এক গুজরাতি বন্ধু বলেছিলেন, ‘নিজেদের বেনিয়া বলতে আপনারা অপমান বোধ করেন, অথচ দেখুন মহাত্মা গাঁধীকে, কথায় কথায় নিজের বেনিয়াত্ব ঘোষণা করতেন।’ শংকরের বিশ্বনাথ বোসকে দিয়ে যে-কথা বলিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান, তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে পার, কিন্তু সওদা করবে কী করে?’ ‘জনঅরণ্য’-র সোমনাথের উদ্দেশে বলেছিলেন ওই বিশুদা। আর এক বছর ধরে চাকরি খুঁজে হয়রান সোমনাথ যখন বাড়িতে জানাল, সে ব্যবসা করবে, তার বাবা মন্তব্য করেছিলেন— ‘এটা যেহেতু মেনে নেওয়ারই যুগ, তুই ব্যবসা করলেও সেটা আমি মেনে নেব।’ বোঝা যায়, বাঙালি মাস্ যেটুকু ব্যবসার দিকে হেঁটেছিল, তার অধিকাংশটাই বাধ্যত। অগতির গতি। একখানি কেরানির চাকরিও যদি তার আগেভাগে জুটত, হার্গিস সে ব্যবসার দিকে পা বাড়াত না।
ব্যবসার প্রতি বাঙালির এই দৃষ্টিভঙ্গির কথা সম্প্রতি ফের উঠে এল ‘গয়নার বাক্স’ ছবিতে। ঠাটবাট বজায় রাখতে গিয়ে যখন জমিদার বংশের ঘটিবাটি বেচা চলছে পুরোদমে, তখন ঘুরে দাঁড়াতে বাড়ির ছোট বউ আর ছোট ছেলে দিল শাড়ির দোকান। ব্যবসার ক্যাপিটাল এল ভূত-পিসিমার গয়না বন্ধক রেখে। খাট-পালঙ্ক বাসনকোসন বেচে খেতে যাঁদের আপত্তি নেই, তাঁরা কিন্তু যথারীতি উঁচু নাক ঢের কুঁচকোলেন। বে-রোজগেরে কর্তামশাই খবর পেয়েই বললেন— ‘আমাগো বংশের পোলা দোকানদারি করতে বইছে? কুলাঙ্গার!’ পিরিয়ড পিস হোক বা হালফিলের কাহিনি— এই চারিত্র বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। ‘বং কানেকশন’। এই আধুনিক সময়েরই প্রেক্ষাপট। প্রবাসী অ্যান্ডি কলকাতা আসার পর তার ভাইদা (জেঠতুতো দাদা) তাকে নিজের বাবার কথা বলছে— ‘আমার বাপটা শালা সারা জিন্দেগি কেরানিগিরি করে চালিয়ে গেল, বললে আবার রেগে যায়!... (আমায়) ব্যবসা করতে দেবে না বলে তো শালা একটা পয়সা ধার দিল না। সেন বাড়ির ছেলেরা নাকি ব্যবসা করে না, করলে জাত যায়!’
কিন্তু বাঙালির ইতিহাস এই কথা বলে না। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগে বাঙালি বংশপরম্পরায় বাণিজ্য করেছে। সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তাম্বুলবণিকদের একটা বড় অংশ বাংলার। ধনপতি সওদাগরের কাহিনি, চাঁদ সওদাগরের কাহিনি গড়ে উঠেছে এই মাটিতেই। পরবর্তী কালে দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, নকুড় ধর, রামদুলাল দে সরকারের মতো লোকজনের মধ্যেও ব্যবসায়ী প্রবণতার ঘাটতি ছিল না। সে যুগেই মাড়ওয়ার থেকে এসে এ রাজ্যে ব্যবসা ফেঁদে কোটি-কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন জগৎ শেঠ। ব্যবসায়ী বলতে আজ যে মাড়ওয়ারি শ্রেণিকে দূর থেকে দেখে বাঙালি, তাকে ঠিকঠাক হিংসে করারও সে দম পায় না। তখন কিন্তু মাড়ওয়ারিদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছিল সে। তা হলে বাঙালি জাতি সেই টেনাসিটি ধরে রাখতে পারল না কেন? হয়তো বেহিসেবি ভোগবিলাসের জন্য, হয়তো দূরদর্শিতার অভাবে ভুল বিনিয়োগে, হয়তো সহজেই আত্মসন্তুষ্ট হয়ে ওঠার কারণে।
উনিশ শতকের সংবাদপত্রগুলি জগদ্দল বাঙালিকে তেড়ে গাল দিয়েও নড়াতে পারেনি। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখছে, ‘তাঁহাদের ধনে বিদেশের লোক বড়মানুষ হইতেছে, রঙ্গে রত্নে অনঙ্গ দেশ ঐশ্বর্যশালী হইতেছে, বঙ্গমাতা এক্ষণে কেবল কতকগুলি মুটে ও চাকর প্রসব করিতেছেন।’ ‘সোমপ্রকাশ’ লিখছে, ‘প্রকৃতপক্ষে চাকুরীর এখন যেরূপ দুরবস্থা তাহার অপেক্ষা সামান্য মুদির দোকান করিয়া দিনাতিপাত করা ভাল। আমাদিগের সমাজে অলস অপদার্থ ও অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা অধিক বলিয়াই এরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে, ...যাবৎ লোকের মন হইতে চাকুরী প্রবৃত্তি বিদূরীত হইয়া দেশের উন্নতির চেষ্টা ও স্বাধীন কার্যে প্রবৃত্তি না জন্মিবে তাবৎ প্রকৃত উন্নতির সম্ভাবনা নাই...।’

দশটা-পাঁচটার কেরানি-জীবনই বাঙালির অভীষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বটতলার ‘কেরানি-দর্পণ’ নাটকে দেখি, আপিসে ঢোকার মুখে এক ভিনরাজ্যের কুলি বলছে— ‘ক্যারে বাবু, ক্যা ফুটানি কর্তা তু, তোরা মাফিক্ বাবু হাম্ বাহুত্ দেখা হ্যায় দশ্ পনেরা রূপেয়া মে হাম দো তিনঠো করাণী রাখনে সেকতা...’! তবু এই ডালহৌসি স্কোয়ারই যেন বাঙালির একমাত্র লক্ষ্য। কালপেঁচা লিখেছিলেন এমনই এক ব্যাংক-কেরানি ভজহরিবাবুর কাহিনি। তহবিল তছরুপের অভিযোগে তাঁর চাকরি যায়। তবু রোজ বেলা দশটার মধ্যে নাকে-মুখে গুঁজে আপিস পৌঁছে যেতেন তিনি। দাঁড়িয়ে থাকতেন গেটের ঠিক বাইরে। যদি ওই দোতলা থেকে কোনও মতে বড়বাবুর দূরদৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ে। ভজহরিবাবুর জীবনে দূরদৃষ্টি বলতে ছিল এই অসম্ভব কল্পনাটুকুই। কালপেঁচা লিখছেন, ‘কলকাতা শহরের লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরুপদ্রব কেরানীর মূর্তিমান প্রতিনিধি ভজহরিবাবু। জীবনের কোন আশা নেই, ভরসা নেই, কোন ইচ্ছা নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই, কোন বিদ্বেষ নেই, অভিযোগ নেই।’ চাকরির জন্য, কেরানি-সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য যে স্ট্রাগ্ল যে কম্প্রোমাইজ বাঙালি করেছে, আজও করছে, তার ভগ্নাংশও যদি ব্যবসার জন্য করত, জাতটা অনেক উপরে উঠত। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখাতে তার আপত্তি নেই, ব্যবসার জন্য ব্যাঙ্কে লোনের অ্যাপ্লিকেশন করতে সে দু’বার ভাবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরির পরীক্ষা থাকলে রেকর্ড ভিড় হয় ট্রেনে-বাসে। ব্যবসার জন্য ভিড় করতে হলে এই বাঙালির অধিকাংশই আস্তে আস্তে কেটে পড়ে আজও। ডালহৌসি স্কোয়ার বড় জোর শিফ্ট করে যায় সেক্টর ফাইভে। গড়ে ওঠে কর্পোরেট কেরানিকুল। রিসেশনের ভূত ইঞ্জিনিয়ারদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, হাজার-হাজারের হাতে কোনও প্রোজেক্ট নেই, তবু ব্যবসা ফাঁদতে ভয়।
আসলে বাঙালি বিশ্বাসই করে ফেলছিল, শুধু ধর্মতলায় কর্মখালি নয়; মুশকিল আসানও উড়ে মালিই! নানা রাজ্যের লোক এ রাজ্যে এসে ব্যবসা করে টাকা কামিয়ে লাল হয়ে গেল। বাঙালি তাদের হ্যাটা করল, আর চাকরগিরি করেই কাটিয়ে দিল কয়েকশো বছর। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘বাঙালীর ধ্বংসের কারণ’ প্রবন্ধের শুরুতেই বলছেন— ‘আমরা যাহাদিগকে মেড়ো, ছাতুখোর ইত্যাদি আখ্যা দিয়া থাকি, তাহারাই সুদূর রাজপুতানার মরুপ্রান্ত হইতে রেলপথ হইবার পূর্বে পদব্রজে লোটাকম্বল সম্বল করিয়া, সত্যসত্যই ২/৪ পয়সার ছাতু খাইয়া, এই বাংলাদেশের বুকের উপর আসিয়া বসিয়াছে এবং শতবর্ষ ধরিয়া ক্রমান্বয়ে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য আয়ত্ত করিয়াছে। তবুও আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাহাদের পারদর্শিতার কথা উপলব্ধি করিতে পারি না। আমরা দু’পাতা Shakespeare, Milton এর পদ আওড়াইয়া বা Differential Calculus এর পাতা উল্টাইয়া গর্বে স্ফীত হইয়া পড়ি, এবং মাড়োয়ারী প্রভৃতি অ-বাঙালী ভ্রাতাগণকে হীন ও মুরুব্বীয়ানার চক্ষে দেখি।’

ব্যবসা না করার এই যুক্তিকে খণ্ডন করতে দীর্ঘ দিনই বাঙালির কমন দুটি অজুহাত। প্রথমত, ব্যবসার টাকা সে পাবে কোথায়? হক কথা! তার পূর্বপুরুষ তো লকার-ভরা ধনসম্পদ রেখে যাননি। স্বল্প পুঁজির ব্যবসার রাস্তায় তো হাঁটতেই পারত মধ্যবিত্ত বাঙালি; কিন্তু সেখানে তার পাহাড়প্রমাণ ইগো। ‘বাঙালীর শক্তি ও তাহার অপচয়’ প্রবন্ধে প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন এই কথাই। ‘ছোট্ট ঘর ভাড়া লইয়া পশ্চিমা অশিক্ষিত লোক বিদ্যুতের যোগে গমপেষা কল চালায়। কলিকাতার অলিতে গলিতে এই প্রকার কত আছে। ইহারা মাসে ৭০/৭৫ টাকা উপার্জন করে। চতুর ও তীক্ষ্নবুদ্ধিবিশিষ্ট বাঙালীর সন্তান এই ব্যবসায় করে না। মূলধনের অভাবে নাকি বাঙালীর পক্ষে সম্ভব হয় না। অথচ এই প্রকার ব্যবসায়ে অতি সামান্য মূলধনের প্রয়োজন হয়।’ জাস্ট টাকার অঙ্কটা বদলে নিলে, এ সব কথা আজও ষোলো আনা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। বাঙালির দ্বিতীয় অজুহাত— ব্যবসার চেষ্টা করেও বাই চান্স ধাক্কা খেলে, ব্যর্থ হলে, সে উঠে দাঁড়াবে কী করে? এ কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু বাঙালিই তো শুধু ব্যবসায় ফ্লপ করে না, সব দেশের মানুষই করে। তা হলে তারা পারে কী করে? কারণ তারা লেগে থাকতে পারে। লড়ে যেতে পারে। সেই কবে, ‘সোমপ্রকাশ’ পত্র লিখছে— ‘...বোম্বাইবাসীরা সেরূপ নহে। দুর্ভাগ্যক্রমে একবার ক্ষতিগ্রস্থ হইলেও বসিয়া না পড়িয়া কপাল ঠুকিয়া আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কাহারও সাহায্য ভাগী হইয়া বাণিজ্য কার্যে রত হয় এবং অসাধারণ অধ্যবসায় বলে অল্প দিনেই ক্ষতি পূরণ করিয়া লয়।’ আর বাঙালি? সে এক বার পড়ে গেলে নিজের মায়ায় বুক ভাসিয়ে হাঁটুর ফুলোয় হাত বোলায় আর ডেকে ডেকে নাকে কেঁদে বলে, ‘এই হাঁটুটাঁ ছঁড়েঁ গেঁল বঁলেঁ, বুঁঝলেঁন, নঁইঁলেঁ...’!

এর পর নিজের অক্ষমতাটাকে সে একটা টুইস্ট দিল। নিজেকে বুঝিয়ে ছাড়ল, ব্যবসায়ী মানেই খারাপ লোক। এ দিকে, বাঙালি তো ভীষণ ভাল লোক। উঁচু ঘরের, খাঁটি চরিত্রের! গম্ভীর হয়ে সে রটাল, উচ্চবিত্ত মানেই অসৎ। তার প্রিয় খিস্তি হল— ‘বড়লোকের ব্যাটা!’ বড়লোক ব্যবসায়ীগুলো বোকা, মূর্খ, ভোঁদকা। ‘বিরিঞ্চিবাবা’-র কেসটাই ধরুন না, বাঙালিকে তিনি শোনাচ্ছেন বুদ্ধ, আইনস্টাইনের কাহিনি। যুক্তিবাদী বাঙালি তাঁর ঢপবাজি ধরেও ফেলছে। কিন্তু ১৯১৪-য় নিয়ে গিয়ে যাঁকে তিনি জলের দরে লোহা কিনিয়ে দিচ্ছেন, তিনি মেকিরাম আগরওয়ালা। বোকাসোকা অবাঙালি। ‘পরশ পাথর’ বানাতে গিয়ে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও টাইটেলের পরই পরদা জুড়ে লিখে দিচ্ছেন— ‘ইহাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়বিশেষের প্রতি সচেতন ভাবে কটাক্ষ হয় নাই’। কাদের কথা ভেবে এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ? কৃপানন্দ কাচালু? যে শেঠজি ছবিতে অ্যাপিয়ার করেই বলছেন— ‘বেটার নেভার দ্যান লেট’! বাঙালি দর্শক তাকে দেখে হেব্বি মজা পায়, কিন্তু ভুলে যায়, বাঙালি কেউকেটাদের নিজেদের বাড়িতে ডেকে বিনি পয়সায় দেদার মাল খাওয়ানোর ক্ষমতা রাখে এই শেঠজি। বাঙালি এই শক্তপোক্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে নম্বর দিতে চায় না। মনে করতে চায়, এই সব লোক লটের দরে হয় বোকা, নয় ধান্দাবাজ! নইলে বাঙালির নিজের ভিতই টলে যাবে। এত পড়াশোনা, এত ফুকো-দেরিদা করেও লক্ষ্মীর কৃপা থেকে বঞ্চিত থাকার জ্বালা এ ভাবেই জাস্টিফাই করে সে। নিজেকে দারুণ সৎ ও মহৎ হিসেবে দেখতে চায়। যেন গরিব থাকাটা অপরিসীম গৌরবের! 
বাংলা মেনস্ট্রিম ছবিতেও দেখুন, নায়ক বা নায়িকার ভিলেন-টাইপ বাবা মানেই তাঁর বিরাট ব্যবসা, অগাধ সম্পত্তি। ধরুন, ‘দেয়া নেয়া’— উত্তমকুমার অভিনীত প্রশান্ত চরিত্রটির কাজকম্ম না-করে সর্ব ক্ষণ গান গাইতে চাওয়াকেই গ্লোরিফাই করে দেখানো হল। তাঁর বাবা বি কে রায় (কমল মিত্র) ব্যবসার ক্ষতি নিয়ে সরব হওয়ায় তাঁকে তুলে ধরা হল বেরসিক, রাগী, কিছুটা দুষ্টু লোক হিসেবেই। আবার ‘পথে হল দেরি’— মল্লিকার (সুচিত্রা সেন) বাবা বিরাট ধনী শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি বিশ্বাস) জয়ন্তর (উত্তমকুমার) ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘তোমরা কী, জমিদার না ব্যবসাদার?’ এই প্রশ্নটিই যেন বাঙালি দর্শকের কাছে মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরিচালকের খাটো করে দেখানোর হাতিয়ার! তা হলে কি বাংলা ছায়াছবিতে ব্যবসাকে পজিটিভ আলোয় দেখানোই হয়নি? বিলক্ষণ হয়েছে। হীরেন নাগের ‘সাবরমতী’। দুঃখের কথা একটাই, সে ছবিতে উত্তমকুমার অভিনীত প্রধান চরিত্রটির নাম— শঙ্কর সারাভাই। আর ছবির শুরুতেই পরদা জুড়ে ক্যাপশন— ‘শিল্পনগরী আমেদাবাদের পটভূমিকায় রচিত’! এমনি এমনি কি আর সানন্দে থাকে ন্যানো!
বাঙালি তাই নিজ বংশগৌরব ব্যাখ্যানে চির কালই ‘তাসের দেশ’-এর ছক্কার মতো সদাগরকে বলে এসেছে, সৃষ্টিকার্যে মগ্ন ব্রহ্মা বিকেলের দিকে প্রথম যে হাই তুললেন, সেই পবিত্র হাই থেকেই তার জন্ম! সাধে কি আর সে এত দিন সরকারি চেয়ার-টেবিলে ধুলোময় ফাইলের পাহাড়ের সামনে বসে মন্ত্রের মতো আওড়েছে— ‘হা-আ-আ-আই।/ হাতে কাজ নাই।/ দিন যায় দিন যায়।/ আয় আয় আয় আয়।/ হাতে কাজ নাই’?


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ জুন ২০১৩