15 August 2014

ভাষার স্বাধীনতা

সুস্নাত চৌধুরী


ভদ্রজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় স্বপ্ন দেখেন, সেটাই তাঁর মাতৃভাষা। ইতরজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় গালাগাল দেন, মাতৃভাষা সেটাই। বাঙালি ফ্যাতাড়ু-শিরোমণি গোপাল ভাঁড় ‘শঁড়া অন্ধা’র রিফ্লেক্স অ্যাকশনে এ থিয়োরি মানিয়ে ছেড়েছেন। কাজেই, গোধূলি লগ্নে কর্পোরেট কিউবিক্ল থেকে জানলার কাচ ভেদ করে স্বপ্নবিহ্বল দৃষ্টিতে যে বঙ্গনাগরিক হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো অস্তাচলগামী সূর্যটিকে দেখে ‘ওয়াও’ বলে উঠছেন, তিনি নির্দ্বিধায় ‘অবাঙালি’। গোবরে পা পড়লে তাই তিনি ‘ধুস শালা’ বলেন না, রিফ্লেক্সেই ‘শিট’ বলেন। এখন ব্যাপার হল, এই অবিচল অবাঙালিয়ানা নিয়ে তাঁর জীবনে ফোঁটামাত্র চাপ নেই; যত চাপ আমাদের, একদা ভাষা-শহিদ বাঙালির। মুখ ভেংচে আমরা এঁকে ‘ট্যাঁশ’ বলব, ‘টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার’ বলব।


এক দিন শ্রী মধুসূদন দত্তকেও যে কথা শুনতে হয়েছিল ‘মাইকেল’ হওয়ার ফলস্বরূপ। ইংরেজি সাহিত্যে তেমন কলকে পেলে তিনিও দাসকে মনে রাখার জন্য মায়ের কাছে কত দূর মিনতি করতেন, বলা মুশকিল! বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ইংরেজিতেই, ‘Rajmohan’s Wife’ দিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রথম দুটি গল্পই তো ছিল ইংরেজিতে। ‘Abstraction’ ও ‘Shades of Grey’। অতঃপর ফিরে আসা... কিন্তু সেই ফিরে আসাটুকু ছিল তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা। তাঁরা ফিরে না এলে বাংলায় কলম না ধরে ইংরেজিতেই চালিয়ে গেলে, সেটাও হত তাঁদেরই স্বাধীন সিদ্ধান্ত। কে কোন ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করবে, সে স্বাধীনতা তো সেই সাহিত্যিকেরই থাকবে। সে তার বাই ডিফল্ট মাতৃভাষাকে অস্বীকার করে বাই চয়েস অন্য কোনও ভাষার চৌকাঠ মাড়ালে, তাকে হাড়িকাঠ টু ফাঁসিকাঠ টানাহ্যাঁচড়া করা কি নিছক ভাষাতান্ত্রিক মৌলবাদ মাত্র নয়! আসল কথা হল, সেই লেখাটি আদৌ ‘লেখা’ পদবাচ্য হচ্ছে কি না, ঠিকঠাক উতরোচ্ছে কি না, তা তিনি যে ভাষাতেই খুশি লিখুন না কেন।
আবার উলটোটাও আছে। কিছুতেই আমরা মেনে নেব না অমিতাভ ঘোষ ‘ইংরেজ’। স্বীকার করব না ঝুম্পা লাহিড়ির ‘মাতৃভাষা’ বাংলা নয়। কিন্তু বেলজিয়ামের ফাদার দ্যতিয়েন ফরাসি ছেড়ে ছাঁকা বাংলায় রম্যরচনা লিখলে আমরা তাঁকে ‘বাঙালি’ বলেই মেনে নেওয়ার দাবি জানাই। উইলিয়াম কেরি থেকে উইলিয়াম রাদিচে তাঁরা গুণী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বটেই, কিন্তু তাঁদের দিকে তাকানোর সময় তাঁদের যোগ্যতা ব্যতিরেকেই এক ‘বাঙালি ইংরেজ’-এর সান্নিধ্য লাভের গর্ববোধই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে প্রকাশ পায়। বাপ্টিস্ট মিশনারি কেরি বাংলায় বই লিখলে, ব্রিটিশ সাহিত্যিক রাদিচে রবীন্দ্রনাথ আওড়ালে বাঙালি ধন্য ধন্য করে। কিন্তু শ্যাম আর কুল, দুটোই তো একই সঙ্গে রাখা যেতে পারে না! মাদার টেরেজাও ভারতীয় নোবেলজয়ী, আবার হরগোবিন্দ খোরানাও এ কেমন সমীকরণ!
অথচ সাহিত্যের দুনিয়ায় ভাষা-স্বাধীনতার এমন উদাহরণ বিরল নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জন্মেছিলেন কবি তরু দত্ত। লেখালিখি করেছেন ইংরেজি আর ফরাসিতে। মনে মনে তিনি ফরাসিই ছিলেন। তাঁর পরিচিতিই ছিল: জাতিতে হিন্দু, শিক্ষায় ইংরেজ, অন্তরে ফরাসি। কিংবা মিলান কুন্দেরা। চেক দেশে জন্মেও তিনি ফরাসি সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত হতে চেয়েছেন। তাঁর লেখালিখি ‘ফরাসি সাহিত্য’ হিসেবেই গণ্য হোক, এমনকী বইয়ের দোকানেও ফরাসি বইয়ের তাকেই তাঁর বইপত্র থাকুক আজও এমনই ইচ্ছে তাঁর। স্যামুয়েল বেকেট-এর নামও এই ব্র্যাকেটে ঢোকানো যায়। আয়ারল্যান্ড-এর নাগরিক হয়েও বহু কাজই তাঁর ফরাসি ভাষায়। ‘En attendant Godot’ হল ফরাসিতে লেখা সেই নাটকটি, ভাষান্তরে যেটি ‘Waiting for Godot’ নামে মুখে মুখে ফিরেছে।
ইতালীয় চিত্রনির্মাতা পিয়ের পাওলো পাসোলিনি প্রথম জীবনে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন। যে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ইতালীয় ভাষায় তিনি কথা বলতেন, সে ভাষায় নয়, কবিতাগুলি ছিল ইতালির গ্রাম্য ভাষা ফ্রিউল্যান-এ। এ জন্য পৃথক ভাবে এই ভাষার বিস্তর চর্চাও করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রথম বই ‘Versi a Casarsa’ ছিল সে ভাষাতেই লেখা। পণ্ডিতেরা বলেন, এ নাকি যুবক পাসোলিনির রাজনৈতিক অবস্থান। বটেই। কোণঠাসা ভাষাকে আগলে স্রোতের উলটো দিকে হেঁটে যাওয়ার স্বাধীনতাই বা এক জনের থাকবে না কেন? কেন এক জন এস.টি সংরক্ষণের বদান্যতা পাবেন, অথচ নিজের ভাষায় উচ্চশিক্ষার স্বাধীনতা পাবেন না? কেন তাঁকে পরীক্ষার খাতায় প্রামাণ্য বাংলাই লিখতে হবে? বিজাতীয় ঝড়-ঝঞ্ঝার থেকে নিজের ভাষাকে, তার প্রতিটি অক্ষরকে, শব্দকে, শব্দের মাঝের প্রতিটি বিমূর্ত শূন্যস্থানকেও মনে মনে সযত্নে আঁকড়ে থাকা সহজ কথা নয়।
কবীর সুমন যেখানে বলেন, ‘দরকার হলে আমি খুব প্রাদেশিক, রাষ্ট্র মানি না নিজের ভাষাকে ভুলে।’ আর ভুয়ো ভূপর্যটক মন্দার বোস বলেন, ‘বিদেশে গিয়ে আপনি যদি বাংলা ভুলতে চান তো তিন মাসেই ভুলতে পারেন, আর যদি না চান তো তিরিশ বছরেও ভুলবেন না।’ কিন্তু ভুললে তো চলবে না, এই ভুলতে চাওয়া কিংবা ভুলতে না-চাওয়া এ দুয়ের স্বাধীনতাই ব্যক্তিবিশেষের থাকা উচিত। তা সে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ময়েই হোক বা আচমকা খিস্তিতে। কিংবা ভাষার যাবতীয় সীমানা ভেঙে দেওয়া কোনও একটা ট্রিমেন্ডাস কবিতায়!


আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ আগস্ট ২০১৪

03 August 2014

-498A

সুস্নাত চৌধুরী


এই কথা বললে, শুধু ফেমিনিস্টরাই নন, লোকাল ট্রেনের মেল শভিনিস্ট ডেলি প্যাসেঞ্জাররাও হাঁ হাঁ করে উঠবেন। কিন্তু তথ্য বলছে, বছরের পর বছর ধরে এ দেশে যতগুলি বধূ নির্যাতনের মামলা হয়, তার প্রায় চোদ্দো আনার ক্ষেত্রেই অভিযোগ কিচ্ছুটি প্রমাণ করা যায় না। বেশির ভাগটাই নাকি ভুয়ো! স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অপদস্থ করার কৌশল। অথচ ১৯৮৩ সালে এই আইনের জন্মই তো হয়েছিল বরপণের দাঁত-নখ থেকে গৃহবধূদের রক্ষা করতে। তা হলে ব্যাপারটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল কী করে? আইনি পরিভাষায় এ আইনটি ‘অ-জামিনযোগ্য’, মানে, আদালতে হাজিরা না দিলে জামিনের আবেদন করা যায় না। এবং ‘কগ্নিজেবল’, অর্থাৎ কিনা অভিযুক্তকে জেলে পুরতে হলে আদালতের নির্দেশ বা নিদেনপক্ষে কোনও প্রাথমিক তদন্ত কিংবা ওয়ারেন্টেরও ধার ধারতে হয় না পুলিশকে। স্রেফ তোলো, আর পোরো! এই ‘সোজা’ রাস্তাটিকেই কাজে লাগাতে থাকলেন বহু ভদ্দরমহিলা। চোখে তাঁদের গ্লিসারিন— ‘সাজা’ মানে তো আর শুধু ‘পানিশমেন্ট’ নয়, ‘মেক-আপ’ও বটে! ব্যাপারটা এতটাই ব্যাপক যে, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টকে রায় দিতে হয়েছে, ৪৯৮এ ধারায় বধূ নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া মাত্রই পুলিশ আর হুটহাট অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে না। আগে প্রাথমিক তদন্ত করে দেখতে হবে গ্রেফতার করা আদৌ জরুরি কি না। এক দিন যা ঢাল ছিল, আজ যে তা অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বীকার করছে খাস সুপ্রিম কোর্ট। বছর নয়েক আগেও দেশের শীর্ষ আদালত এই আইনকে ‘লিগাল টেররিজ্ম’ আখ্যা দিয়েছিল। দেশের বহু হাইকোর্টেও বার বার সমালোচিত ৪৯৮এ-র ক্রমবর্ধমান এই অপব্যবহার।

ছবি: সুমন চৌধুরী
দেশে বা এই রাজ্যে আজও বহু নারীই যে চার দেওয়ালের আড়ালে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির হাতে প্রবল লাঞ্ছিত অত্যাচারিত হন, তা চরম সত্য। কিন্তু তার মানেই তো এটা হতে পারে না যে, সব স্বামীই প্রেম চোপড়া আর সব স্ত্রীই নিরুপা রায়। ভারত সরকারের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত বছর এ দেশে গড়ে প্রতি ৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে এক জন করে স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৩ সালে ভারতে বিবাহিত পুরুষের আত্মহত্যার সংখ্যা আত্মঘাতী বিবাহিত মহিলার দ্বিগুণেরও বেশি। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার অনুপাতটাও প্রায় একই রকম। গত বছর ২১,০৯৬ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন কেবল পারিবারিক ঝামেলা থেকে চিরমুক্তি পেতে। পাশাপাশি, একই কারণে আত্মঘাতী মহিলা ১১,২২৯ জন। সব ক’টি আত্মহত্যাই দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এই তথ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পুরুষও কোনও অংশে কম চাপে নেই। থাকার কথাও কি ছিল?
৪৯৮এ-র রাস্তায় হাঁটা কী হারে বাড়ছে, ২০১২ আর ২০১৩ সালের তুলনাই তা বলে দেয়। মাত্র এক বছরে বৃদ্ধির হার ১১.৫%-এরও বেশি। সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গেই। অথচ এ রাজ্যে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ২.৩% ক্ষেত্রে। গোটা দেশেই, বিগত বছরগুলির মতো ২০১৩ সালেও, এই ধারায় বেশির ভাগ মামলারই কোনও গতি হয়নি। দেশ জুড়ে দোষী সাব্যস্ত করা গিয়েছে মাত্র ১৬% ক্ষেত্রে।
এ কথা হয়তো সত্যি যে, আজও অনেক নির্যাতিতাই ৪৯৮এ-র নামটুকুও শোনেননি। অনেকে থানা-পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারেন না। কিংবা ৪৯৮এ দায়ের করলেও চার দেওয়ালের অন্ধকারে ঘটে চলা অত্যাচার প্রমাণ করাও সব সময় সহজ হয় না; মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে তো আরওই নয়। কিন্তু তাতে তো ভুয়ো মামলাকারী ধান্দাবাজ স্ত্রীদের অস্তিত্বটা মুছে যায় না। শাস্তি না চেয়ে সুরক্ষা চাইলে, অনেকে তো ৪৯৮এ-র বদলে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আইনেও মামলা করতে পারতেন। অনেকে তো ঝক্কি পুইয়ে মামলাটুকুও আর করেন না— এই ৪৯৮এ ঠুকলেন বলে— স্রেফ এমন থ্রেট-এর উপর শ্বশুরবাড়িকে রেখেই কাজ হাসিল করেন। ‘নন বেলেব্ল’ আর ‘কগ্নিজেবল’-এর সাঁড়াশি আক্রমণকে অস্ত্র বানিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে ‘দু’দিনের শ্বশুরবাড়ি’ থেকে মওকা বুঝে মোটা অঙ্ক হাতিয়ে নেওয়া, কোনও অবৈধ সম্পর্ক ফাঁস হয়ে গেলে পালটা চাপ সৃষ্টি, প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে ডিভোর্সের পথ সুগম করা, স্বামীকে তার বাপ-মা’কে ছেড়ে আলাদা সংসার পাততে বাধ্য করা, কিংবা বিবাহপূর্ব অসুস্থতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত কোনও গোপন সত্য প্রকাশ হয়ে গেলে তার পালটা— এমন হরেক কারণই নাকি ৪৯৮এ অপব্যবহারের নেপথ্যে থাকে, বলছে এ নিয়ে কাজ করা একাধিক এনজিও। এমনকী স্রেফ ৪৯৮এ কাজে লাগাবেন অদূর ভবিষ্যতে, এমন মতলবেও নাকি ইদানীং কোনও কোনও মহিলা বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন।
কলকাতার হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং ‘পীড়িত পুরুষ পতি পরিষদ’-এর কর্ণধার রাধিকানাথ মল্লিকের বক্তব্য এ বিষয়ে একই। তাঁদের সাফ কথা— আর পাঁচটা আইনের সঙ্গে ৪৯৮এ-কে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এই আইনের সঙ্গে সমাজ জড়িয়ে, পরিবার জড়িয়ে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বহু নির্দোষ স্বামী। মিথ্যে অভিযোগে তাঁর নিকটজনেরাও সমান ভাবে হেনস্থা হচ্ছেন। জেল খাটছেন, চাকরি খোয়াচ্ছেন, অপমানে ধ্বস্ত হচ্ছেন, কেউ বা এ জীবনটাই শেষ করে দিচ্ছেন। বৃদ্ধ, শিশু, এমনকী পরিবারের অন্য মহিলারাও পার পাচ্ছেন না। শুধু ২০১৩ সালেই ৪৭,৪৭১ জন মহিলা গ্রেফতার হয়েছেন এই আইনে। কারাবাসী সেই ননদটির কথা ভাবুন, এক দিন যে নতুন বউদির দিকে সৌজন্যের হাতই বাড়িয়ে দিয়েছিল। হয়তো সামনেই তার বিয়ে, কথা চলছে। কিংবা একটা চাকরির কল আসার প্রতীক্ষায় সে। এ বার সেই স্বপ্নমাখা ভবিষ্যতে বেশ খানিকটা অন্ধকারই গাঢ় হয়ে এল না? বহু ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি যে কষ্ট পাচ্ছে, সে একটি শিশু, নিজেরই সন্তান। শুধু তাই নয়, সামগ্রিক ভাবে কলুষিত হচ্ছে দেশের আইনব্যবস্থা। গুচ্ছের ভুয়ো কেসের ঠেলায় আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, অহেতুক দীর্ঘায়িত হচ্ছে অনেক ‘সত্যিকারের’ বধূ নির্যাতনের মামলা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ ঘোষণা করেছে, এ দেশে বয়স্কদের নিগ্রহের অন্যতম বড় কারণ ৪৯৮এ-র অপব্যবহার। মার্কিন প্রশাসন, কানাডা প্রশাসন আজ তাঁদের নাগরিকদের এই আইনের ‘ব্যথা’ মনে করিয়ে সতর্ক করছে, দু’বার ভেবে দেখতে বলছে, কোনও ভারতীয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার আগে!
এখন ‘সেভ বেঙ্গলি ফ্যামিলি’-র মতো সংস্থা বলছে পরিবার বাঁচিয়ে রাখার কথা। ভুয়ো ৪৯৮এ-র শিকার অসহায় স্বামীদের পাশে দাঁড়াতে মাস কয়েক আগেই মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে ‘সেভ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি’-র কলকাতা শাখা ‘হৃদয়— নেস্ট অব ফ্যামিলি হারমনি’। আইনি পরামর্শ পেতে দেশের ৫০টি শহরের ৫০টি এনজিও-র তথ্য সেখানে মিলবে। অনলাইন পরামর্শ, এ সংক্রান্ত যাবতীয় খবরাখবর কিংবা ভুয়ো ৪৯৮এ-র ভুক্তভোগীদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছে www.498a.org। হয়তো এই সব পুং-সংস্থার কিছু বক্তব্য যুক্তিরহিত ভাবেই তীব্র নারীবিদ্বেষী ঠেকবে, কিন্তু গোটাটাই যে লিঙ্গ-পক্ষপাতের অসারতায় পূর্ণ, এমনটাও নয়।
এত এত ভুয়ো ৪৯৮এ দায়ের হওয়ার নেপথ্যে দুষ্ট মহিলাদের হাত নেই— এমন একটা ‘প্রায়-স্বতঃসিদ্ধ’ ঝুড়ি-কোদাল সহযোগে প্রমাণে নারীবাদী সমাজকর্মী ও আইনজীবী ফ্লেভিয়া অ্যাগনেস-এর মন্তব্য প্রায়শই উদ্ধৃত হয়— নিম্ন আদালতের কিছু উকিল ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশই নাকি ৪৯৮এ ব্যবহারে মূল কালপ্রিট। আবার একই সঙ্গে যুক্তি দেওয়া হয়— ৪৯৮এ-র ক্ষেত্রে চার্জশিট দেওয়ার মাত্রা যথেষ্ট উচ্চ, মানে, পুলিশ তদন্ত চালিয়ে অভিযোগ যথাযথ মনে করেছে এবং চার্জশিট দিয়েছে। অর্থাৎ, একই পুলিশ যুগপৎ সৎ ও অসৎ! শ্রডিংগারের বেড়ালের মতো এখানে দুর্বোধ্য কোয়ান্টাম ফিজিক্স কাজ করতে পারে, ৪৯৮এ পারে কি!
অতঃ কিম? বিবাহের ঠিক পরেই যে স্বামীটি মনেপ্রাণে বাঁচতে চেয়েও ধনেপ্রাণে মরতে বসে, তাকে অক্সিজেন দেবার উপায়? তার সব বুকে-ব্যথা তো গ্যাস অম্বল থেকে হয়নি— কিছু বেদনার জন্ম প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকে আসা আকস্মিক আঘাতে, কিছু বা তজ্জনিত হার্ট অ্যাটাকে! কেউ বলছেন, ‘৪৯৮বি’ নামে পুরুষের অধিকার নিয়ে আইন প্রণয়ন হোক। বিচারপতি মলিমথ কমিটি পরামর্শ দিয়েছে, ৪৯৮এ-কে জামিনযোগ্য (বেলেব্ল) ও মীমাংসাযোগ্য (কম্পাউন্ডেব্ল) করার। আইনটিকে আগাগোড়া ঠান্ডাঘরে পাঠাতেও চাইছেন অনেকে। কেউ বলছেন, ৪৯৮এ থাকুক, কিন্তু বদলাক— এ ধারায় মামলা করার আগে বাধ্যতামূলক করা হোক কাউন্সেলিং। তাঁরা একমত, সময় বদলেছে, যুগের সঙ্গে আইনেরও বদল দরকার— পারস্পরিক কলহের কেন্দ্রে আজ আর শুধু পণের গয়না কি ক্যাশটুকুই নেই— চ্যাট আছে, ফেসবুকও আছে। আসলে, আমাদের বোঝার সময় এসেছে— আইপিসি ৪৯৮এ সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়।
আর, একটু মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে— গত শতকের শেষ দিকে মার্কিন সমাজকর্মী ওয়ারেন ফ্যারেল-এর ঠাট্টা-ছলে বলা খাঁটি কথাটির প্রতি: In the past quarter century, we exposed biases against other races and called it racism, and we exposed biases against women and called it sexism. Biases against men we call humor.

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ আগস্ট ২০১৪