30 December 2013

তুই তুমি আপনি

সুস্নাত চৌধুরী



ছবি: সুমন চৌধুরী

ভিখিরিকে আপনি কখনও আপনি বলে ডেকেছেন? রিকশাওলা, তা তিনি আপনার বাপের বয়সি হলেও আপনার রিফ্লেক্স আপনাকে আপনি বলা থেকে আটকেছে। আপনি তেমন মাতব্বর টাইপ্‌স হলে, তুইতোকারি করেছেন হেলায়, রেলায়। ‘ওয়, হট এখান থে...’ কিংবা ‘কীরে, কে যাবি রে’। খুব সমাজ-সচেতন সুনাগরিক হলেও বলেছেন --- ‘এ নাও গো, ছেলের চিকিচ্ছে করিও’ কিংবা ‘আচ্ছা বাবা, তোমায় পাঁচ টাকা বেশি ভাড়াই দেব, একটু জোরে টানো এবার’। আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি বাবা-বাছা করেছেন, ওই মানুষটির ভালোও চেয়েছেন হয়তো, কিন্তু কক্ষণও কোনওদিনও তুমি-র উপরে উঠতে পারেননি। অথচ ওই অশিক্ষিত ছোটলোক ভিখিরি কি রিকশাওলারা কিন্তু আগাগোড়া আপনাকে আপনি-ই বলে এসেছেন --- আপনি কেরানি না প্রোমোটার, অধ্যাপক না আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বিচার করেননি।
আপনার আদরের লাল টুকটুকে নতুন গাড়িটিকে যখন পনেরো দিনের মাথায় হালকা ঘষে দিয়েছে বেয়াক্কেলে রিকশা, আপনার অন্তর থেকে খুব থাপ্পড় পেলেও আপনি নিজেকে আটকেছেন। কিন্তু চিৎকার করতে দ্বিধা করেননি --- ‘অ্যাই, দেখে চালাতে পারিস না’! আবার মাস খানেকের মাথায় যখন ছোট্ট চুমু খেয়েছে রঙচটা হলুদ ট্যাক্সি, আপনি একই ভাবে চেঁচিয়ে উঠেছেন, একই অভিব্যক্তি ছিল আপনার, শুধু তুই-টা বদলে গিয়েছিল তুমি-তে --- ‘আরে ভাই, দেখে চালাও’! আর যখন টোকাটা মারল আপনার চেয়ে আরও লাখ দুয়েক বেশি দামের একটা সেদান, আপনি তখনও রাস্তা-টাস্তা আটকে সে-গাড়ির ড্রাইভার কাম মালিকের সঙ্গে জোর একচোট ক্যাচাল বাধিয়েছেন। কিন্তু, আপনি-র নীচে আপনি নামেননি --- ‘দ্যোর মশাই, দেখে চালাতে পারেন না’! বাইরে একই রকম চোখ রাঙাচ্ছেন, ভেতরেও একই খিস্তি দিচ্ছেন প্রত্যেককে, কিন্তু আপনা থেকেই আপনার মুখ দিয়ে কখনও বেরোচ্ছে তুই, কখনও তুমি, কখনও আপনি। ব্যক্তিভেদে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ফারাক যে এভাবে আমাদের থেকে স্রেফ সম্বোধনের তারতম্য আদায় করে নেয়, তাকে আমাদের ‘শিক্ষা’ বা ‘সংস্কৃতি’ না বলে ‘রিফ্লেক্স’ বলাই বোধহয় ঠিক হয়। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সমাজ যে রিফ্লেক্সকে একেবারে গভীরে পুঁতে দেয়। স্বতঃসিদ্ধের মতো যা চলে আসে, যাকে ঘিরে কোনও প্রশ্নই আর অ্যাফোর্ড করা যায় না। সন্ধের মহানগরে বেকার টাইম খেতে থাকা বাসটিতে সওয়ার হয়ে যখন বিরক্ত হয়ে ওঠেন অফিস-ফেরতা সুশিক্ষিত ভদ্র যুবকটি, তিনিও তো দুমদুম চাপড় মেরে চল্লিশোর্ধ ড্রাইভার আর কন্ডাকটারকে উদ্দেশ করে হেঁকে ওঠেন --- ‘আরে, টান না রে ভাই... আর কত প্যাসেঞ্জার তুলবি...’। এক বাস মানুষের কারো মনেই কি তখন প্রশ্ন জাগে, যে, ক্রিয়াপদগুলি ‘টানুন’ কিংবা ‘তুলবেন’ হলে বাসটা একটু জোরে চললেও চলতে পারত? এখানে অবশ্য ছোট্ট একটু ব্যতিক্রম আছে। আদেশ বা নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তুইতোকারি অনেক সময়ই অপরিহার্য। তা একেবারেই কাউকে খাটো করা নয়, বরং সেই নির্দেশকে জোরদার করা। চরম মোহনবাগান-সমর্থকটি যখন উত্তেজিত হয়ে কাৎসুমির উদ্দেশে বলেন, ‘চল... চল... বলটা বাড়া এবার...’ --- কিংবা, টেনশনে ভরা স্লগ ওভারে যখন ক্লাস সিক্সের ছোঁড়াটিও টিভির পর্দায় কোহলি কি ধোনির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘আরে এটা মারতে পারলি না...’ --- তখন সেখানে অপমানের ছিটেফোঁটাও থাকে না। যেমন থাকে না, ‘চল রে চল সবে ভারতসন্তান’ গাইবার সময়। ‘চলুন’ বা ‘চলো’ বললে, গানটি মাঠে মারা যায়। মঞ্চে তো মারা যায়ই!
কিন্তু, দিন বদলের স্বপ্ন দেখা তরুণ নেতাটি যখন ঢুকে যান গ্রাম বাংলার ধান খেত পেরিয়ে, চাষিভাইদের একজোট করে বপন করতে থাকেন তাঁর সৎ রাজনৈতিক বিশ্বাসের বীজ --- কেমন বক্তৃতা করেন তখন? ‘এই জমি তোমাদের, এক চিলতে মাটিও তোমরা ছাড়বে না...’। না হয় তাঁরা মার্ক্স-এঙ্গেলস-মাও পড়েননি, চাষভুসো খেটে-খাওয়া মানুষ --- তাই বলে ষাটোর্ধ্ব-সত্তরোর্ধ্ব মানুষগুলোর বরাতে কখনও আপনি জুটবে না? এককালে রক্তচোষা জমিদার তাঁদের তুই বলে এসেছেন, পরবর্তীতে সত্যি-সত্যিই পাশে দাঁড়ানো বাবুরাও তাঁদের গড়পড়তা তুমি-র উপরে জায়গা দিতে পারলেন না।
কাকে তুই বলতে হবে, কাকে তুমি বা আপনি --- তা নির্ধারণ করতে আরেকটা বড় ফ্যাক্টর বয়স। কলেজ লাইফে দেখেছি, দাড়ি-টাড়ি কেটে বেরোলে মেয়েরা একটু তাকাত বটে, কিন্তু অচেনা লোকে তুমি-তুমি বলত। তাতে আঁতে লাগলে --- কাল ছিল গাল খালি, আজ চুলে যায় ভরে! ছেলেদের দাড়ি, মেয়েদের শাড়ি --- আনজান পাবলিকের থেকে বহু আকাঙ্ক্ষিত আপনি, আপনিই আদায় করে নিত! নইলে মনে হত, আমি তো তাঁদের আপনি-আজ্ঞে করছি, কিন্তু জাস্ট কয়েক বছর আগে ঘটনাচক্রে জন্মে গিয়েছে বলে অচেনা-আধাচেনা কিছু মানুষ নির্দ্বিধায় তুইতোকারি করে যাবে? মাগনা! কখনও কি আমাদের সবারই এই রোখ চেপে যায় না --- রাস্তা-ঘাটে যে আমায় তুই বলবে, আমিও শালা তাকে তুই বলব!
সত্যজিৎ রায়ের অনুকূল তো ঠিক এমনটাই করত। নিকুঞ্জবাবুর রোবট-চাকর। নিকুঞ্জবাবুর বন্ধু বিনয় পাকড়াশি নিজের চাকরদের তুইতোকারি করেই অভ্যস্ত। আড্ডা মারতে এসে একদিন অনুকূলকেও তুই বলে ফেললেন। ‘তাতে অনুকূল গম্ভীর ভাবে বলে, আমাকে তুই বললে কিন্তু তোকেও আমি তুই বলব।’ কতকটা একই চাল ছিল তারিণীখুড়োরও। ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’-এ গেরুয়াধারী বাবাজি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী চাস তুই?’ এই প্রশ্নে খচে যাওয়ার কাহিনি বর্ণনা করছেন খুড়ো স্বয়ং --- ‘বাবাজিদের এই হোলসেল তুইতোকারির ব্যাপারটা আমি মোটে বরদাস্ত করতে পারি না। তাই এনার প্রশ্ন শুনে ধাঁ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। বললাম, “রাজার অনুরোধে তোর সঙ্গে দেখা করতে এলাম”।’ এরপর খুড়ো যা বলছেন, তা ভারী ইন্টারেস্টিং! বাবাজি নাকি এই জবাবে মোটেই বিরক্ত বা বিচলিত হননি, তুইতোকারিও চালিয়ে গিয়েছিলেন। বরং সঙ্গে যা-যা বলেছিলেন এবং করেছিলেন, তাতে স্বয়ং তারিণীখুড়োই ফিদা! ‘মনে-মনে বললাম, বাবাজির ক্ষমতা অসীম, কারণ আমার কাছ থেকে “তুই” থেকে “আপনি” সম্বোধন আদায় করে নিতে লেগেছে ঠিক দু মিনিট।’
ব্যাপারটা এমনই। প্রশ্নটা যদি সম্মান জানানোরই হয় --- তবে তা যথাযথ ক্ষেত্রে আপনা-আপনিই চলে আসা উচিৎ। তার জন্য সমাজের ঠিক করে দেওয়া কোনও প্যারামিটারের প্রয়োজন পড়ে না! তখন ক্লাস, হায়ারার্কি, সোশ্যাল স্টেটাস, সিটিসি --- এসব বিচার করে ব্যাকরণ বই দেখে মুখস্ত করতে হয় না, কাকে কী বলে ডাকব। উপেন্দ্রকিশোরের ‘উকুনে বুড়ির কথা’ সমাজ-নির্ধারিত এই সিস্টেমের চমৎকার এক উদাহারণ। সেখানে শুরু থেকেই সকলের সঙ্গে সকলের --- বুড়ি-বক, বক-নদী, নদী-হাতি, হাতি-গাছ, গাছ-ঘুঘু... সব সম্পর্কই তুইতোকারির। কিন্তু ঘুঘু যেই রাখালের সঙ্গে কথা বলছে, তাকে তুমি বলছে। উল্টোদিকে রাখাল কিন্তু বলছে তুই। আবার রাজার বাড়ির দাসী রাখালকে বলছে তুই, রাখাল তাকে বলছে তুমি। মজার কথা, তবে স্বাভাবিকই, গোটা গল্পে আপনি সম্বোধন জুটছে কেবল রানিমা আর রাজামশাই-এর!
এই ট্র্যাডিশন আজও। ফ্যালাসিটাও শুরু হয় এখান থেকেই। বাংলা খবরের কাগজে বা নিউজ চ্যানেলের ভয়েজ ওভারে দেখেছি, ছোটখাটো চোর-ছ্যাঁচোড়দের ক্ষেত্রে তুচ্ছার্থে ‘সে’, ‘তাকে’ এইসব শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অপরাধী যেই চার্লস শোভরাজ, বিন লাদেন বা দাউদ ইব্রাহিমের মতো রাঘব-বোয়াল, তখন বলা হয় ‘তিনি’, স-চন্দ্রবিন্দু ‘তাঁআঁকে’! মানে, একটি চুনোপুঁটির চেয়ে অনেক-অনেক বেশি ঘৃন্য ও মারাত্মক অপরাধে যিনি দোষী, তাঁর জন্য বরাদ্দ বেশ-খানিক সম্মান। আবার ধরা যাক, বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরেও নির্দেশ থাকে কতকটা এরকম --- ‘যা জান, লেখো’। সেই নির্দেশই বদলে যায় স্কুল সার্ভিসের মতো চাকরির পরীক্ষায় --- ‘যা জানেন, লিখুন’। এখন যে পড়ুয়াটি বিএ-তে অকথ্য ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতেই পারলেন না, পড়া-টড়া আর হবে না ভেবে এসএসসি দিয়ে চাকরির চেষ্টা করলেন --- আর যিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে ইস্কুলে ঢোকার চেষ্টা না-করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেন --- তাঁদের বৈপরীত্যটা ভাবুন। এই সিস্টেমে প্রথমজনের কপালে জুটল আপনি, আর ভাল রেজাল্ট করেও দ্বিতীয়জন পড়ে রইলেন তুমি-র ক্যাটাগরিতেই! আগে থেকেই ধরে নিয়ে সম্বোধনের ফ্যালাসি আরও আছে। ১৩৪০ সনের শ্রাবণ সংখ্যার ‘বিচিত্রা’-এ অবিকল এই বিষয়টি নিয়েই একটি বিতর্ক চলে। ব্যক্তির পোশাক-আশাকের উপর কীভাবে সম্বোধন নির্ভর করে, তা বোঝাতে শুরুতেই এক গভীর গোলমালের কথা ফাঁদেন সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বৈঠকখানার কাজ করতে করতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে --- পরিধানে পরিচ্ছন্ন ধুতি, দেহে সদ্য-ধৌত ছিটের শার্ট, পায়ে কালো রঙের বার্ণিশ করা পাম্‌প্‌ শু এবং মাথায় হাল ফ্যাশনে ছাঁটা বারো-আনা চার-আনা চুলের মধ্যে সযত্ন-রচিত টেরি। ব্যস্ত হয়ে বলি, “ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসুন?” অপরিচিত ব্যক্তির মুখে বিহ্বলতার গ্লানি ফুটে ওঠে, কুণ্ঠিত স্বরে সে বলে, “আজ্ঞে আপনাদের চাকর রাস্তা থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিলে। কে চুল ছাঁট্‌বেন।” ‘আপনি’ শব্দের অপ-প্রয়োগে বিরক্ত হয়ে উঠি। নাপিতের ক্ষৌর দ্রব্যের বাক্সটি দৃষ্টি-গোচর না হওয়াতেই এই দুর্ঘটনা!’ এমন দুর্ঘটনা আজও আমাদের জীবনে কম ঘটে না। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পরামানিককে আপনি বলাটা ‘অপপ্রয়োগ’ হতে যাবে কেন? বরং যথার্থ অপপ্রয়োগের একটি নিদর্শন তার আধঘণ্টা পরেই ঘটছে লেখকের জীবনে। ‘পদ শব্দে চেয়ে দেখি একটি লোক ঘরে ঢুকেছে, মলিন বসন, পায়ে অর্ধছিন্ন জুতা, মাথার চুল রুক্ষ। ভ্রুকুঞ্চিত ক’রে তাকিয়ে বলি, “কি চাও?” লোকটি একটু সঙ্কুচিত হয়ে বলে, “শ্যামবাজারের দিকে কাজ ছিল, এসেছিলাম, বঙ্কিম আপনাকে একখানা চিঠি দিতে দিয়েছে।” তেমনি ভুকুঞ্চিত ক’রে বলি, “কে বঙ্কিম?” লোকটি একটু বিস্মিত হয়ে বলে, “১৭ নং ঈশ্বর দত্ত লেনের বঙ্কিম সেন।” শুনে লাফিয়ে উঠি, “তাই বল! আমাদের বঙ্কিমবাবু?” লোকটি মৃদু হেসে বলে, “কিন্তু আমাদের বঙ্কিমবাবু ত নয়, আমাদের বঙ্কিমই।”’ মলিন পোশাকের এই মানুষটি যে স্বনামধন্য সাংবাদিক (‘দেশ’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক) বঙ্কিমচন্দ্র সেনের দাদা হতে পারেন, তা ভাবতেই পারেননি লেখক! তুমি-র এমন অপপ্রয়োগে তখন চূড়ান্ত ফল্‌স পজিশনে। ‘লজ্জায় কুণ্ঠায় বিমূঢ় হয়ে যাই এবং প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ‘আপনি’ সম্বোধনের ধারা বর্ষণ করতে থাকি। কিন্তু তখন তীর ছোঁড়া হয়ে গেছে, তখন আর ধনুক সাম্‌লে লাভ কি?’
সম্বোধনের এমন আরও ধাঁধা আছে অন্য জায়গাতেও। প্রশ্নটা যখন নৈকট্যের... আপনি, তুমি না তুই --- কোনটা কাছের, কোনটা দূরের? কী বলে ডাকব কাছের মানুষকে? প্রশ্নটাকে যদি আমাদের কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে ফেলি, তাহলে একটা ছবি উঠে আসে। যে সহকর্মীর সঙ্গে একেবারেই ফরম্যাল সম্পর্ক, তিনি আমার উপরে থাকুন বা নীচে, তাঁকে আমরা সচরাচর আপনি-ই বলি। একটু ঘনিষ্ঠ যাঁরা, তাঁরা তুমি। আর কলিগ হয়েও যাঁরা প্রায় জিগরি দোস্তে পর্যবসিত, ক্যান্টিন থেকে পানশালার সাথী, তাঁরা স্রেফ তুই। কিন্তু এমন সহজ একটা সমীকরণ দিয়ে কি সব অঙ্ক মেলে! আজ থেকে আধা শতক আগেও তো বাবাকে আপনি বলার রেওয়াজ ছিল। সেসব আপনি-বাবারা কি আজকের তুমি-বাবার চেয়ে খারাপ মানুষ ছিলেন, না কম শ্রদ্ধেয় বা কম ভালবাসার লোক ছিলেন? স্বামীকেও তো সেসময় আপনি বলাই ছিল স্ত্রীদের রীতি। তখনও সবচেয়ে কাছের মানুষটি কি তিনিই ছিলেন না? তুই-তুমি-আপনির চলতি কনভেনশন এসবের ব্যাখ্যা চট করে দিতে পারে না।
শুনেছি, স্লোভাক ভাষাতেও নাকি সম্বোধনের এই পার্থক্য আছে। তা অবশ্য আমাদের মতো ত্রিস্তরীয় নয়, দ্বিস্তরীয়। আপনি হল ‘ভি’ (ফরম্যাল ইউ), আর তুমি বা তুই হল ‘তি’ (ইনফরম্যাল ইউ)। সেসব দেশের অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হামেশাই দেখা যায়, পরিচয়ের দিনকয়েকের মধ্যেই পড়ুয়াদের সঙ্গে অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সম্বোধনের পরিবর্তন। শুরু হয় ‘ভি’ দিয়ে, তারপর যেসব ছাত্রছাত্রীরা অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন, তাঁদের অধিকার জন্মায় ‘তি’ ডাকের। আর আপনি নয়, সেই ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে ওই মাস্টারমশাই বা দিদিমণি তখন তুমি। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিটা অবশ্য এখনও এতটা ইনফরম্যাল নয়। তবে, নৈকট্য আর সম্বোধনের আরও আশ্চর্য এক খেলা দেখেছিলাম স্কুলজীবনে। আমাদের মফস্বলের ইস্‌কুলে গেম্‌স টিচার ছিলেন দেবজ্যোতি সাহা। ছাত্রদরদী মানুষ। প্রায়, প্রায় কেন, একেবারেই, বন্ধুর মতোই মিশতেন ছাত্রদের সঙ্গে। কোন লেফট ব্যাকের প্রেমঘটিত সমস্যা, কোন লেগ স্পিনারের পরীক্ষার হলে বসে কিচ্ছু মনে পড়ছে না, কিংবা এমনিই কোনও ল্যাদোস ছাত্র মাইনের টাকায় আলুকাবলি খেয়ে ফেলেছে --- রণে বনে জঙ্গলে এবং পরীক্ষার হলে সহায় একমাত্র তিনি! ছাত্রদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয় এই মানুষটিকে গোটা স্কুল আর ‘স্যার’ বলে ডাকত না। তাঁর ডাকনামেই হয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিচয় --- ‘বাবলুদা’। সঙ্গে, তুমি! তিনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষক, যাঁকে আপনি বলা হত না। মজাটা এখানেই। গোটা স্কুলে, ব্যাচের পর ব্যাচ এটাই রীতি থাকলেও, একটা ব্যতিক্রম ছিল। আমাদের স্কুল টিমে যারা খেলত, অর্থাৎ যারা তাঁর সবচেয়ে কাছের ছাত্র, তিনিও যাদের সবচেয়ে কাছের শিক্ষক --- তারা কিন্তু চিরকাল তাঁকে ‘স্যার’-ই বলে এল। এবং, আপনি!
আবার নৈকট্য কখনও আপনি-কে তুই-এও এনে ফেলে। শ্যামাসঙ্গীত। ‘তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি, তবে আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই’। ‘তুই নাকি মা দয়াময়ী, শুনেছি ওই লোকের মুখে’। কিন্তু, নৈকট্য গভীর গভীরতর হলে এই তুই-ই আবার বদলে যায় তুমি-তে। ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দিব্যি তুইতোকারি চলল, ওয়ান ফাইন মর্নিং হয়ে গেল তুমি! আরও কাছাকাছি আরও কাছে এসো। প্রোপোজ করার পরক্ষণ থেকেই তুমি-তুমি বললে নাকি শরীর জুড়ে শিহরণ! পুরোনো অভ্যেস বয়ে নিয়ে যাওয়াও অবশ্য বিরাট ঝক্কি; সে প্রায় সমাজবিপ্লব! মানে, প্রেমিক-প্রেমিকা যখন স্বামী-স্ত্রী, তখনও তুইতোকারি চলতে থাকলে আর রক্ষে নেই। ফুলশয্যের আগে থেকেই আত্মীয়-পড়শিদের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর শুরু! বিয়ের পর দু’জনে দু’জনকে তুমি বলতে হবে। বলতে হবে মানে, বলতেই হবে। নইলে নাকি পরস্পরকে ঠিক সম্মান দেখানো হয় না। সমাজের এসব ব্যাকরণ যে মানবে না --- সে হয় আঁতেল, নয় ঋতুপর্ণ!
অথচ জীবনের খেলা কেমন বিচিত্র --- যখন কোত্থাও আর কেউ নেই, শুধু আবেগ আর প্রবৃত্তি আছে, তখন বহু ক্ষেত্রেই বিবাহিত সম্পর্কের এসব সম্বোধন আপনা-আপনিই বদলে যায়। বন্ধুবান্ধবের ‘ওইসব’ গল্প থেকে বুঝেছি (এ তথ্যের কোনও গ্যারান্টি দিতে পারব না), এমনিতে যাঁদের তুমি-র সম্পর্ক, সেইসব ঘন সময়ে, ঘামঝরা মুহূর্তে অনেকেই পরস্পরকে তুই বলেন। তবে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমি অন্তত একটি দম্পতিকে চিনি, এমনিতে যারা তুইতোকারি চালায় কিন্তু সেইসব মাখন-সময়ে বলে ওঠে --- তুমি... তুমি...!
কাজেই, দুটো মানুষের নৈকট্য বা দুটো মানুষের দূরত্বের গায়ে প্রথামাফিক একটা করে সর্বনামের টিকিট আটকে আলাদা-আলাদা খাপে পুরে রাখা যায় না। তবু আমরা সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাই। নিয়ম আঁকড়ে থাকি। সে ডাকে কেউ অপমানিত হলেন কিনা, আমাদের ভাবতে বয়ে গেছে। সে সম্বোধন আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত কিনা, আদৌ আমরা কনসার্নড নই। বরং, ঋতুপর্ণ ঘোষ কেন সব্বাইকে তুই-তুই করতেন, কেন মুনমুন সেন-কে ‘মুনদি, তুই...’ বলতেন --- এ নিয়ে বাঙালির অনেক বেশি মাথাব্যথা। শোনা কথা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নাকি সক্কলকে আপনি বলতেন। তা নিয়েও কৌতুহল ছিল বিস্তর। অবশ্য সুনীতিবাবু নিজেই নাকি ভাষাতাত্ত্বিকের জবাব শুনিয়েছিলেন --- সম্বোধন বদলালে তো ক্রিয়াপদও বদলাতে হয়, সে বিস্তর বখেরা, তাই এক আপনি-তেই স্থির থাকা শ্রেয়! এক সময় এমনই একটা যুক্তি ছিল বটে --- ইংরেজির ইউ-এর মতোই কোনও একটি কমন সম্বোধন বাংলাতেও চালু করা। ব্যস, হলেই, তুই-তুমি-আপনি-র জটিলতা থেকে রেহাই! তখন অনেকেই সওয়াল করেছিলেন আপনি-র স্বপক্ষে। তবে, ‘বিচিত্রা’-র ওই পূর্বোক্ত বিতর্কে ভারী আশ্চর্য এক প্রস্তাব রেখেছিলেন এক লেখক। মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য ছিল, বাঙালির একমাত্র সম্বোধন-শব্দটি হোক --- ‘তাত’! তিনি লিখছেন, “‘তাত’ শব্দের অর্থ পিতা, পবিত্র ব্যক্তি ও স্নেহ পাত্র। সুতরাং সকলকে ‘তাত’ বলা চলতে পারে।”
একটিমাত্র সম্বোধন-শব্দ বাংলার ক্ষেত্রে ঘোর অবাস্তব বলেই মনে হয়। তবু যদি সত্যিই কখনও এমন হয়, এ ভাষায় সবাই সবাইকে আপনি বলছে! উকুনে বুড়ি বককে, বক নদীকে, নদী হাতিকে, হাতি গাছকে, গাছ ঘুঘুকে, ঘঘু রাখালকে...। কিন্তু সেদিনও, একজন ধর্ষকের রিফ্লেক্স কি পারবে একজন ধর্ষিতাকে আপনি বলতে? একজন ধর্ষিতাই বা অন্তর থেকে কী সম্বোধন করবেন একজন ধর্ষককে?


আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩

18 November 2013

‘সুলভ’

সুস্নাত চৌধুরী


ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ফ্রি কিংবা একটাকা
নিশিডাকেরও বাড়া হিসিডাক। ডাক এলে, জিপার-সর্বস্ব পুং, আপনি যেকোনও ওয়ালেই পোস্ট করতে পারেন। তবে, দেওয়ালে মা দুগ্গা আর বাবা লোকনাথের টাইল দেখলে ব্যক্তিগত পোস্টাপিস খুলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে ডাকঘরে। তোমার ডাকে সাড়া দিতেই, বহে গেছে...! আপনি কেগেল এক্সারসাইজের বিস্ময় বালক, উসেইনতর গতিতে পৌঁছে যাবেন ওই দূরে --- কংক্রিটের আধখাওয়া অকর্পোরেট কিউবিকলে। বলে লাভ নেই, ইটের ধাপে আপনি পা রাখতে পারবেন না; কেননা আপনার আগের জন রাখেননি। কারণ, তার আগের জনও রাখেননি। তার আগের জনও...। বিনে পয়সার পৌনপুনিকতা কাটাতে চাইলে আপনি খুঁজবেন এ এলাকায় দুর্লভ একটি সুলভ। কমপ্লেক্স তো বটেই ব্যাপারটা। তার ওপর গ্যাঁটগচ্চা আছে। খুচরোর আকালে পার্সে কয়েন না থাকলে রবিঠাকুর কয়েনই শেষ পারানির কড়ি। ‘দ্বারী মোদের চেনে না যে, বাধা দেয় পথের মাঝে, বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি, লও ভিতরে ডেকে ডেকে’। মুক্ত। ধারা।
আপনিও চেনেন না বিন্দেশ্বর পাঠককে। পদ্মভূষণ, ১৯৯১। একটাকায় মুক্তির কারিগর। আপনার ওয়াটার-লু যুদ্ধের বিরুদ্ধেই তাঁর ‘সুলভ আন্দোলন’। সেই ১৯৭০-এ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন সুলভ ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস অর্গানাইজেশন। আপনি জানেন না তিনি ডবল এমএ। পিএইচডি, ১৯৮৫, পটনা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বেচারার বিদ্যালয় হয়তো ছিল আপনারই মতো। ফার্স্ট আর ফিফ্‌থ পিরিয়ডে মিস বললে তবেই, গুটিগুটি বাথরুম যাওয়া। নইলে চেপে বসে থাকো। সেই আপনার পাবলিক টয়লেটে হাতেমাটির হাতেখড়ি। আপনার মতো এহেন চাপের ব্যাকগ্রাউন্ডই হয়তো বিন্দেশ্বরকে আন্দোলনের পথে ঠেলেছিল। কিন্তু, আপনি? বান্ধবীদের ড্রেস না তলপেটের যাতনা, কী থেকে জন্ম নিল আপনারও বিপ্লবী চেতনা? জন হেনরির হাতুড়ির মতো প্রতিবাদের ভাষায় হিজিবিজি আঁকলেন আর লিখলেন। গ্রাফিতি। ১৯৬৬-তে বার্কলের অ্যালান দুন্দে ‌যাকে ডাকলেন ‘ল্যাট্রিনালিয়া’ বলে। রেস্টরুমের আঁকিবুকি। দিন যত গড়াল, মাইনাস করার দেওয়ালে এঁকে চললেন একের পর এক ‘প্লাস’। নিজের নামের সঙ্গে জুড়তে থাকলেন সেই সব ডাকসাইটে সুন্দরীর নাম, যাঁদের বাসস্টপে তিনমিনিট, কিন্তু স্বপ্নে সারারাত দেখেছেন। আপনার যৌন একাকিত্ব ‘অমুক + তমুক’-এর নিরামিশ গ্রাফিতিতে মেশাল আমিশ মশলা। কথায়-ছবিতে সেই দেওয়াল পত্রিকায় উঠে এল স্মার্ট যৌনতার কথা। সুনির্বাচিত স্ল্যাং। কাঁচা হুমকি। আপনার চোখে তখন অবদমিত কামনার চশমা। ভেবে দেখার প্রশ্নই ওঠে না, কোন পাঠিকা বা পাঠকের জন্য এই অমর সৃষ্টি। শুধু নিজেকে একটু আড়ালে রেখে, আর-পাঁচজনের সামনে স্বরচিত রূপকথার মোরাল শোনাতে চাইছিলেন। মাঝখান থেকে সারা পৃথিবীর তাবৎ ইন্টেলেকচুয়াল সমাজবিজ্ঞানীরা হেদিয়ে পড়লেন দেওয়ালের কানে-কানে বলা সেইসব কথা আর ছবি নিয়ে। ব্যাপারটা এতদূরই এগোল আবিশ্ব, গাল পেড়ে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২০০৫-এ নাকি তাদের একটি ওপিনিয়ন কলামের নামই দিয়ে দিল How to Earn Your Pee h.D!
এত ফুটেজ খাওয়া সেই আপনিও মোক্ষম আনইজি ফিল করলেন যখন চরকসুশ্রুতধন্বন্তরীবিধানরায়তর প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হলেন স্বয়ং ডঃ ডি কে লোধ‍। টাইফয়েড-ভাইরাল-ম্যালেরিয়া-জন্ডিসে অভ্যস্ত, বড়জোর ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়ার নাম শুনেছেন। এডস-ও সই। তাবলে, বিচিত্র সব উপসর্গে অতিবিচিত্র আধা-তত্সম আধা-বিদেশি রোগের বিজ্ঞাপন! স্যরি, রোগ-উপশমেরই বিজ্ঞাপন। এসব আপনাকে তো লাজুক করে তুলবেই। তাই ইস্কুলের মতো কাটাকুটি কিংবা মেনপয়েন্ট-মেনপয়েন্ট খেলার প্রশ্নই ওঠে না। বরং আপনাকে না ‘প্যারুরেসিস’ রোগ খেয়ে ফেলে, সেদিকে লক্ষ রাখলেন আপনি। এ এক বিশেষ কিসিমের স্ফিংটেরিক ফোবিয়া। আর কেউ থাকলেই আটকে যাওয়া। হেব্বি পাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই বেরোচ্ছে না। ভাগ্যিস, এহেন প্রকাশ্য গোপনরোগের টোটকা আপনি জেনে গিয়েছিলেন! ওইখানে দাঁড়িয়ে কোনও কথা বা চোখাচোখি নয়; পারলে দু-পাশে ফাঁকা খোপ রেখে জায়গা নির্বাচন; অহেতুক দেরি নয়; কোনও ইমোশন-টিমোশন তো একেবারেই নয়। আর যদি স্মুথলি সব কিছু চলে, সেই ঝরনাতলার নির্জনে, সার্কাসের বেঁটে জোকারের মতো পিছু ফিরে নীচু হয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতেই পারেন --- একটি বুটের টোয়ের আগায় একটি শিশিরবিন্দু।


একটাকা + একটাকা = দু’টাকা
এখানে আর বসা-দাঁড়ানো লিঙ্গ বৈষম্য নেই। নারী-পুরুষ সমান-সমান। বিল গেটসও বসেই ডাউনলোড করেন। তবে, সারকথা বুঝিয়েছিলেন গোপাল ভাঁড়। ছোট কাজ না হলে বড় কাজ হয় না। তাই পার কাজ একটাকা করে মোট দু’টাকা, চলতি রেট। অবশ্য ‘ছোট বাইরে’-র নামে ঢুকে, আপনি চলে যেতেই পারেন ‘বড়’ ভেতরে! কেউ টের না পেলেই হল। খুচরো বাঁচানোর আরও পদ্ধতি আছে। ধরুন, আপনি ধর্মতলায়। ডাক এসেছে। সুলভের দিকে হাঁটবেন, নাকি স্মার্টলি সাহেব-সুবোর মতো গটগট বেগে এন্ট্রি নেবেন ওবেরয়দের গ্র্যান্ডাকঘরে? আকাচা শার্টেও আপনি এদিক-সেদিক তাকান, ঢুকে যান ওয়াশরুমে। দারোয়ান সেলাম ঠুকবে। কিংবা, বাংলায় ফিরে এসো, বাবা। আপনি নন্দন চত্বরে, খুচরো অটুট রেখে ঢুকে পড়ুন বাংলা আকাদেমির একতলায়। ঢুকে, এখনও, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও, একটু বামপন্থী হয়ে দু-পা এগোলেই, মুক্তির সন্ধান। আপনি পাঠক না-হন, ও-চত্বরে ঘোরাঘুরি যখন, লেখক-কবি-সম্পাদক কিছু তো একটা হবেনই। অতএব, বাংলা ভাষায় করা আপনার অধিকার।
যদি ভাবেন নগদে পে করে ঢুকলেও অধিকার জন্মায়, ভুল ভাবছেন। ছুটন্ত আপনি অগ্রিম দু’টাকা দিয়ে পড়িমড়ি ঢুকেছেন। গুডলাক, কোথাও কিছু ভাসছে না। নড়বড়ে ছিটকিনিটা যদিও টালিগঞ্জের সেটের মতো, ধাক্কা দিলেই যাতে খুলে যায়, সেভাবেই বানানো। তবু তাকে ম্যানেজ করে, ইজ্জত বাঁচিয়ে আপনি জাস্ট বসেছেন, একটা শান্তি আপনাকে ঘিরে ধরবে-ধরবে করছে... আআআ! সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া। ‘দাদা, আর কতক্ষণ?’ বাইরে গোটা কলকাতার একসঙ্গে পেয়েছে। দ্বার খোল, দ্বার খোল। অথবা, শৌচাগারের পাংচুয়াল কেয়ারটেকার আপনাকে জানান দিচ্ছেন, দু’টাকায় কেনা টাইম খতম। আপনি ইসবগুল নাকি সিঙ্গাপুরি, এই কোষ্ঠকঠিন পৃথিবীর তাতে থোড়াই কেয়ার। সে বিশ্বাসই করবে না, পাবলিক টয়লেট আসলে বিয়ের মতো। যারা এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে আছে, তারা চায় যেন-তেন ভেতরে ঢুকতে। সে বুঝবেই না, যারা ভেতরে আছে, তারাও মরিয়া বাইরে বেরোতে। যেন আপনি জয়রাম রমেশের দলে, শৌচাগারকেই মন্দির ভেবেছেন। উল্টে সে সতর্কীকরণ লিখে রাখবে দেওয়ালে --- নো লাউড ফিলোজফিকাল থিঙ্কিং।

তিনটাকা
চানঘর। বারাণসী-গঙ্গাসাগরের মতো স্নানের স্থানমাহাত্ম ও স্থানের স্নানমাহাত্ম এখানে নেই। এই বাথপার্টি প্রলেতারিয়েতদের। তুরস্কের কেতাদুরস্ত ‘হামাম’ বা রাশিয়ার গণস্নানঘর ‘বান্যা’-র মতো কিছু এক্সপেক্ট করা একেবারেই ভুল হবে। আপনার সুড়সুড়ি থাকলে, তা-ও এখানে মিটবে না। দিওনসুসের মন্দিরে নারী-পুরুষের নগ্নস্নান কিংবা ক্যালিগুলা-বাত্স্যায়নের দৃশ্যকল্পে গা-ভাসালেও, গা ভিজবে না। আপনার পিপিং টম দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ‘পানি মে খুদকো সমেটে হু’ গাইতে থাকা স্যাঁতস্যাতে মন্দাকিনিকে খুঁজে পাবে না। সত্যম শিবম সুন্দরম-এর ভেজা জিনাত আমান গ্রিলের ওপাশ থেকে হাস্কি গলায় বলবে না ‘মোরি চুনারিয়া লিপটি যায়ে’। কোনও হেমেন মজুমদারও তাঁর জল-রঙা ক্যানভাস এগিয়ে দেবেন না। তবু, শহরের ধুলো-ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত আপনি, শরীর আনচান করলে এখানে চান করতেই পারেন।

অনুভব করিনি, তবু বলছি
হি, শি --- ঈশ্বরের বানানো দুই রকমের জন্য দুই রকমেরই ব্যবস্থা। তবু প্রকৃতির ডাকঘরের ‘স্যানিটেশন’ পুরুষদের নয়, ছুটি না-পাওয়া মহিলাদের জন্য। একটাকা দু’টাকা তিনটাকায় সেই ডাকমাশুলের হিসেব হয় না। অনুভব করিনি, অনুমান করেছি, তাই বলছি। অনুরোধও করছি, আপনাকে কিন্তু কেউ বলেনি, ‘রক্ত দাও, স্বাধীনতা দেব’ --- তাই আপনি ফ্রি থাকতে চান থাকুন, ফ্রিডম উপভোগ করুন; কিন্তু যেখানে-সেখানে ফেলে-ছড়িয়ে আসবেন না, প্লিজ।

বেগতিক = বেগ + গতি
গতি যখন আছেই, তখন আর ‘বেগ’ মানে স্পিড নয়, ট্রাবল। হ্যাঁ, সেইসব পাবলিক টয়লেটের কথা বলছি, যখন আপনি গতিশীল, আর অনেকক্ষণ ধরে বেগ পেয়ে, এবার বেগতিক বুঝছেন। তারপর যেতে যেতে যেতে... এবং এতক্ষণ দূরপাল্লার বাসে খেতে খেতে খেতে... না, এমতাবস্থায় নদীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আপনার নেই, নদীর পাড়ে কাজ সারার প্রশ্নও নেই। বরং আপনার গন্তব্য বহরমপুর হলে কৃষ্ণনগর, দিঘা হলে মেচেদা --- এতটা পথ পেরোলে তবে হল্ট বলা যাবে। বাস থামলেই গুঁতিয়ে নামুন, পড়িমড়ি ছুটুন। কৃষ্ণনগরে সরপুরিয়া কিংবা মেচেদায় সিঙাড়ার অর্ডার দিন, সঙ্গে বিনি পয়সায় হালকা হয়ে আসুন। ব্যবস্থা এমনই, আপলোড করলে, ডাউনলোড ফ্রি।
ব্যাপারটা ট্রেনে হলে অবশ্য অন্যরকম। লোকাল ট্রেনে জার্নি যদি লম্বাতর হয়, আপনার হাতে জাস্ট কোনও অপশন নেই। সরপুরিয়াও নেই, সিঙাড়াও নেই। প্যাকেটে বাদাম বা খোসাছাড়ানো ডিমসেদ্ধর দিকেও আপনি আর লোলুপ নজরটি ফেলতে পারবেন না। কাপড়ে-চোপড়ে হওয়া থেকে বাঁচতে কোনও মতে চুপচাপ বসে, ঠায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাবতে-ভাবতে স্টেশন গুনতে লাগবেন ডিসেন্ডিং অর্ডারে। অডারে আপনার রুমাল-সর্বস্ব গোটা কম্পার্টমেন্টের কী হাল, সেদিকে না হয় ভুলেও তাকাবেন না। এ যেন জীবনের দীর্ঘতম ‌যাত্রা। গন্তব্য এলে, তারপর, সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি (কার্টসি : গোপাল ভাঁড়)! অবশ্য দূরপাল্লার ট্রেনে আপনার জন্য টোটাল অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে। ঝক্কাস! দরজায় ঘটাং-ঘট লক, চিকনাই স্টিলের কমোড (নীচে ফুটো), ঝরঝরে ফ্ল্যাশ, গুটখা-ওলা বেসিন। এখন প্রশ্ন হল একটাই, দুললে কি আপনার হয়?
কিংবা, মোশন বাড়লে কি আপনার মোশন লুজ হয়ে আসে? তাহলেও চিত্তির। বিমানে উঠলে করবেন কী! ঘনঘন যাওয়া তো বিসদৃশ ঠেকবে। আরে বাবা, মার্কিন মুলুকেই মাঝারি দরের বিমানে পঞ্চাশ জন প্রতি একটি করে ল্যাভাট্রি থাকে। লম্বা পথে অত ইয়ে ওরা ফেলবেই বা কোন চুলোয়? ট্রেনের মতো সে তো আর বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া চলে না! অবশ্য চলত এক কালে। তিরিশের দশকে বিলিতি সুপারমেরিন স্ট্র্যানরের বায়ুযানটিতে ছিল এমনই এক মুক্ত শৌচাগার। উড়তে-উড়তে তার ঢাকনাটি যখন খুলে দেওয়া হত, জন্মদিনের বেলুন ফেটে চকচকে কাগজের মতো নীচে সব ছড়িয়ে পড়ত, বাতাসের ধাক্কায় শোনা যেত একরকম শিসের আওয়াজ। সেই থেকে যানটির বদনামই হয়ে যায় --- ‘হুইসলিং শিটহাউস’। কিংবা জলপথও আপনার কিসমতে শুধু যাওয়া-আসা শুধু স্রোতে ভাসা হবে না। বাইচান্স আপনি যদি সাবমেরিনে সওয়ার হন, সে শৌচাগারটি ব্যবহার করতেই রীতিমতো একজন ইঞ্জিনায়ারকে ডাক পাঠাতে হবে! এতই নাকি জটিল তার অপারেশন। একটু ভুলচুক হলেই আপনার বাহ্যটি আর বাহ্য থাকবে না, সটান এসে মাখামাখি হবে সাবমেরিনের গায়েই। অতএব, আপনি হরাইজেন্টাল গতিতে থাকলে ভার্টিকাল বেগের কথাটা বিলক্ষণ মাথায় রাখুন।

আসুন, অন্যরকম করে করি
আসলে বলতে চাইছি, প্রকৃতির ডাক যখন, ব্যাপারটা কি মানুষের অধিকারের মধ্যেই পড়ে না? হালকা হওয়ার অধিকার। রাইট টু ফ্রি। ফ্রি-তেই তো হওয়া উচিত তবে। নিদেনপক্ষে রেটটা একটু কমুক। অন্যভাবে করুন না, মদনদা যেরকম করতে চেয়েছিলেন আরকি, বাসভাড়া না বাড়িয়ে বাসের গায়ে বিজ্ঞাপন সেঁটে দাও। অবশ্য বইমেলার মতো নয়। ‘বানান যখন ভাবায়’ শীর্ষক প্রদর্শনী। কোনওটার গায়ে লেখা --- GENTS TO LET! কোনওটার আবার --- LADIES TOY LET! এই না হলে মিলন মেলা! আমি বলছি, এসব নয়, এক্কেবারে অন্যরকম করে করুন। ধরুন, আসছে ১৯ নভেম্বর বিশ্ব শৌচাগার দিবসে টয়লেটে-টয়লেটে যদি উত্তর-আধুনিকদের ‘শক আর্ট’-এর প্রদর্শনী করা যায়। অনেকটা ২০০৮-এ নিউইয়র্কে যেমন করেছিলেন শিল্পী আন্দ্রে সেরানো। ‘শিট’ ফটোগ্রাফ এক্সিবিশন। কিংবা ১৯৬১-তে মিলানের পিয়েরো মানজোনি-র কৌটোভরা ‘আর্টিস্ট’স শিট’। ‘থার্টিগ্রাম নেট, ফ্রেশলি প্রিজার্ভড’। দেদার বিকিয়েছিল শিল্পীর সত্যি-সত্যি ক্রিয়েশন! আবার নিউজিল্যান্ডের জন কাজিনস। ১৯৮৪-তে সুরে মাতালেন এডিনবরা ফেস্টিভ্যাল। টানা সাত ঘণ্টা ধরে জল খেলেন আর লাইভ মূত্রত্যাগ করলেন সাতটি ড্রামের উপর। সা নি ধা পা মা গা রে। ভরা সন্ধ্যায় এই মূত্রশিল্পীর আশ্চর্য জলতরঙ্গ সেদিন প্রমাণ করেছিল, মানুষের ভেতরেই রয়েছে প্রকৃত হারমনি। যে শহরে জলই শোভন, জলসা এমন হতে পারে সেখানেও। এসব বাণিজ্য আরও স্ট্রেটকাট করা যায়। ১৮৭০ পর্যন্ত বিলেতে যা চলেছে। লন্ডনের স্ট্রিটকর্নার থেকে পিপে-পিপে মূত্র তোলা হত জাহাজে। তারপর জাহাজ যেত হুইটবি। ভেতরে টলটল করছে ফটকিরি তৈরির অপরিহার্য কাঁচামাল। এসব করে টু-পাইস এলে, পাবলিকের ব্লাডারে পাস্কালের সূত্রও একটু কম চাপ দিত।
আর শুধু অর্থকরী নয়, অর্থবোধকও। ১৯১৭-এ ফরাসি দাদাইস্ট মার্সেল দিউশাঁ-র আর্ট ওয়ার্ক ছিল ‘ফাউন্টেন’। স্রেফ একটা পোর্সেলেন ইউরিনালকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন স্টুডিওতে। এখন দেখার, কতটা উচ্চতায় রেখেছিলেন সেই মূত্রাধার। জলের সমোচ্চশীলতা মেনে, ঢ্যাঙা আর গেঁড়ের তো এক জায়গায় দেননি ঠাকুর! তাহলে কোন অ্যাপ্রক্সিমেশন তুলে ধরেছিল শিল্পীর চোখ? গার্নার আর গাওস্কর পাশাপাশি দাঁড়ালে কোথায় হবে গুড লেংথ? কোথাকার জল তখন কোথায় গড়াবে? এসব বিতর্কিত সময়ে, আপনি, এতক্ষণ চেপে রাখার পর, বড়জোর পুরন্দর ভাটের কবিতার ডাকে সাড়া দেবেন...

চারদিকে ছনছন
সারা গায়ে ঘিনঘিন
থই থই ছপছপ
ইউরিন! ইউরিন!

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ নভেম্বর ২০১৩

19 August 2013

কে সি পাল

সুস্নাত চৌধুরী


সূর্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে, পৃথিবী মোটেই তার চার দিকে ঘুরছে নাওয়ান ফাইন মর্নিং এই সহজ কথাটা সত্যি হয়ে দেখা দিলে আমার-আপনার কৌন সা মহাভারত অশুদ্ধ হবে? দিনের বেলা ট্রেনে সেই একই রকম ভিড় থাকবে... রাতের বেলা মিনিমাম তিন পেগ না হলে ঘুম আসবে না... মাস ফুরোলে মাইনে চার আনা বাড়বে না... বছর ঘুরলে অন্যের ইনক্রিমেন্ট দেখে আগের মতোই জ্বলুনি ধরবে...যেমন খাচ্ছেন, বাথরুম যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে শুচ্ছেন, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছেন কিংবা পিরিয়ড এলে কষ্ট পাচ্ছেন, শীতকালে পিকনিক করছেন, গ্রীষ্মকালে ঘামছেন অবিকল তেমনটাই চলতে থাকবে। আপনি ইশকুলের ভূগোল টিচার না হলে, জাস্ট কিচ্ছু যাবে-আসবে না। অথচ সেই মানুষটাকে আমি দেখেছি, আপনারাও অনেকে দেখেছেন, স্রেফ এই একটা কারণে নিজের জীবনটা যিনি খরচ করে দিয়েছেন। আপাতত ঘর-বাড়ি-পেনশন হারিয়ে গত দু’বছর ধরে কলকাতার ফুটপাতে দিন কাটাচ্ছেন। রাত কাটাচ্ছেন।
‘পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে, কিন্তু বার্ষিক গতি নেই। আহ্নিক গতি আছে বলেই দিন-রাত্রি হয়। আর ঋতু পরিবর্তন হয় সূর্যের বার্ষিক গতির জন্য।’ রাসবিহারী মোড়ে ফুটপাতের ওপর বসে বলছিলেন কার্তিকবাবু। কার্তিকচন্দ্র পাল। কে সি পাল। হাওড়া স্টেশন চত্বর কিংবা কলকাতার বহু দেওয়ালে, ব্রিজে, ল্যাম্পপোস্টে, দেওয়ালে যাঁর গ্রাফিত্তি আপনারা দেখেছেন। নিজের হাতের লেখায় তাঁর তত্ত্বের ওয়ান-লাইনার, বা ছবি-টবি দিয়ে ভাল করে এঁকে তত্ত্বটার বিশদ ব্যাখ্যা। কৌতূহলবশে বইমেলা থেকে নগদ দশ টাকা বা খুচরো এক টাকায় হয়তো বা তাঁর থিসিসও সংগ্রহ করেছেন। ই-নাগরিকরা হয়তো গুগ্‌ল-বুকস-এ তাঁর বইটির নাম দেখে থাকবেন। এর পর বাকিটা আপনার মনে হতেই পারে...
‘বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।
...ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট
সংক্ষেপে বলিতে গেলে, হিং টিং ছট্।’
কথা হচ্ছিল সেই কে সি পাল-এর সঙ্গে। পাশেই তাঁর থাকার জায়গা। থাকার জায়গা মানে, নিদেন পক্ষে নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির যে দশ ফুট বাই দশ ফুট জোটে, তা-ও নয়। ফুটপাতের রেলিঙের সঙ্গে বাঁধা, মাথা আর কুঁকড়েমুকড়ে দেহ গোঁজার একটা ঠাঁই। চওড়া বড়জোর দু-আড়াই ফুট, লম্বাতেও ছ-সাত ফুটের বেশি হবে না। শুয়ে পড়লে, পাশ ফেরার জায়গাটুকুও মেলা দায়। এর ভেতরেই সব কিছু। রান্নাবান্না, পড়াশোনা। এখানেই কে সি পালের রোজকার দিনরাত্রি, সারা বছরের ঋতু পরিবর্তন।


ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ফুটপাতের একটি ছাউনি মাত্র, কিন্তু নিজের আইডিয়ায় তাকে গড়ে তুলেছেন কার্তিকবাবু। চার দিকে কোনও প্লাস্টিক শিট কিংবা তেরপল দিয়ে বানানো দেওয়ালের আপাত সুরক্ষা নেই। বরং ছোট ছোট পিচবোর্ড বা প্লাস্টিকের টুকরো জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে পরদা। কোনওটায় লেখা তাঁর থিয়োরি, কোনওটায় তাঁর সৌরমণ্ডলের মডেল, কোনওটায় আমজনতার উদ্দেশে বক্তব্য, আবার কোনওটায় বিজ্ঞানীদের প্রতি তির্যক মন্তব্য। নিজের তত্ত্ব দিয়েই নিজের ঘর গড়েছেন তিনি। আক্ষরিক ভাবেই নিজের আইডিয়ার ভেতর বেঁচে রয়েছেন। যেন সেই বিদেশি ছবিতে দেখা পাদরির ঘর, যে ঘরের দেওয়াল জুড়ে সাঁটা বাইবেলের পাতা। যেন এক বর্ম, এক রক্ষাকবচ যেন এ ঘরে কোনও ক্রমেই না ঢুকে পড়তে পারে শয়তান! এ পৃথিবীতে অন্তত একটি ঘর আছে, যে ঘরে পৃথিবী স্থির, তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে সূর্য!
সাংবাদিকতার সূত্রেই বছর পাঁচেক আগেও এক বার গিয়েছিলাম ওঁর বাড়ি। হাওড়া শহরে। মনে আছে, পাকা বাড়ি। সামনে কিছুটা জমি। সে সব ছেড়ে এই ফুটপাত কেন? উত্তরে বুঝলাম, নেপথ্যে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক সমস্যা। হয়তো রয়েছে তাঁর এই একান্ত ব্যক্তিগত ‘সত্য’-র পিছনে সব কিছু ভুলে ছুটে চলাও। এই ‘পাগলামি’ আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! প্রতি মাসে পেনশনের কয়েক হাজার টাকাও নাকি তিনি আর হাতে পান না। জোটে মোটে পাঁচশো টাকা। ‘ইচ্ছে করলে কোর্টে যেতে পারতাম, কিন্তু সে আমি পছন্দ করি না।’ তা হলে চলে কী করে? হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দিলেন কার্তিকবাবু ‘মাসে পাঁচশো মানে, দিনে সতেরো টাকার মতো করে দাঁড়াচ্ছে। মোটামুটি খরচ ওতেই চলে যায়। দু’টাকা লাগে সকালে চা খেতে, দু’টাকা লাগে পায়খানা করতে। নস্যির জন্য সামান্য খরচ। বাকি টাকায় রান্নাবান্না। এ ছাড়াও তো বই বিক্রির টাকা থেকে লাভ থাকে।’ আমার বেসিক-পিএফ-ইএমআই-মুদিখানার জটিল সুদকষায় অভ্যস্ত মস্তিষ্কে এত সরল পাটিগণিত ঢুকছিল না। তিনি বলতে থাকেন ‘মা মারা যাওয়ার পরে গ্রামের বাড়িটাও বিক্রি করে দিই এক আত্মীয়কে। সেখানেও আশি হাজার পাঁচশো টাকা পাওনা। আড়াই বছর হয়ে গেল, কিন্তু আমি চুপ করে আছি, দেখি কবে দেয়। এখন যদি আমি ঝগড়ার মধ্যে যাই, আমার প্রচারের কাজটায় ভাটা পড়ে যাবে।’
আমি একটু কেয়ারিং হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু ফুটপাতে এ ভাবে থাকাটা কতটা সেফ?’ কার্তিকবাবু বলেন, ‘আমি তো এ সব খুলে রেখেই চলে যাই। তবে হ্যাঁ, আমার মোবাইলটা এখান থেকেই চুরি হয়ে গিয়েছে। তার পর দুজন আমাকে ফ্রি-তে ফোন দিতে চেয়েছে, বইমেলায়। আমি নিইনি। কেননা, যার ইন্টারেস্ট থাকবে, সে আমার কাছে আসবে। আমি যদি এত পরিশ্রম করে থাকি, এত পয়সা খরচ করে থাকি, সে দুটো মিনিট আর দশ-বিশ টাকা খরচ করে আসতে পারবে না? আমি রাস্তায় থাকি, এখানে অনেক পাতাখোর গাঁজাখোর ঘুরে বেড়ায়। তাদের এক দিন কম পড়লে, হয়তো আমাকে মেরে দিয়ে ফোনটা নিয়ে চলে যাবে। তখন, আমার এই আবিষ্কারের কী হবে? ফোন-টোন আমার চাই না। তবু, রাতে শোওয়ার সময় আমি মাথার কাছে একটা ছুরি নিয়ে শুই...’
‘আমার জীবনের কথা লিখে কী হবে, আমার তত্ত্বটা নিয়ে লিখুন।’ জানতে চেয়েছিলাম ওঁর পড়াশোনা কাজকর্ম সম্পর্কে। দ্বিতীয় বার অনুরোধে বলতে শুরু করলেন। জন্ম হাওড়ার আমতার আনুলিয়া গ্রামে। ১৯৪২ সালে। পড়াশোনা গ্রামেই। একটু বেশি বয়সেই ভরতি হন এআরবি হাইস্কুলে। ক্লাস থ্রি-তে। পয়সার দরকার, অতএব ক্লাস এইট-এই প্রথাগত শিক্ষায় ইতি। এলেন কলকাতা। কখনও মোটর-মেকানিকের কাজ, কখনও গড়িয়াহাটে আলু-পেঁয়াজ বিক্রি। এ সময়ই ডাক এল মিলিটারি থেকে। সেটা ১৯৬২। ভারত-চিন যুদ্ধ। প্রথমে উত্তরপ্রদেশের ফতেহ্‌গড়। রাজপুত রেজিমেন্টে কাটল দু’বছর। তার পর প্যারাশুট রেজিমেন্টের হাবিলদার। টানা পনেরো বছর। এই ’৬২ সালেই সন্ধে বা রাতে ডিউটির সময় সন্ধ্যাতারার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হঠাত্‌ই মনে প্রশ্ন দানা বাঁধে। চার মাস পর্যবেক্ষণের পর জোরদার হয় সন্দেহ। স্রেফ এক হাত লম্বা একটি পাইপ জানালার সঙ্গে বেঁধে চলে নজরদারি। কখনও তা ধ্রুবতারার দিকে তাক করা, কখনও সপ্তর্ষিমণ্ডলের কোনও তারার দিকে, কখনও আবার দিনের বেলায় পাইপের ফুটোয় সূর্য! প্রাপ্ত ফলের ওপর নির্ভর করে চলতে থাকে বিশ্লেষণ। দেখতে দেখতে কেটে যায় বারো বছর। ১৯৭৪ সালে তিনি নিশ্চিত হন পৃথিবী স্থির, সূর্যই ঘুরছে তাকে কেন্দ্র করে।
হাত-টাত নেড়ে, প্রায় ডেমনস্ট্রেট করার ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন কার্তিকবাবু। দেখছিলাম, এক জন সত্তরোর্ধ্ব মানুষেরও কী ভয়ংকর প্রাণশক্তি থাকতে পারে। সব সময় যেন ফুটছেন। ‘এই ছবিটায় আসতে আমার বারো বছর লেগে গেল। তার পর এই তত্ত্বকে যখন ভূগোল বইয়ের যে-কোনও প্রশ্ন করেছি, সব উত্তর পেয়ে গিয়েছি। এ বার আমি দেখলাম, আমার থিয়োরিটাকে দাঁড় করাতে গেলে আমাকে তো ইতিহাস জানতে হবে। আপনি যদি আমাকে টলেমির থিয়োরি জিজ্ঞেস করেন, আর আমি বলতে না পারি, তা হলে তো আমি বেওকুফ বনে যাব! সে সময় আগ্রা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি আমাকে ফ্রি-তে নানা বইপত্র পড়ার সুযোগ দিল।’ চলল ক্লাস এইট ড্রপ-আউট ছাত্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ। গ্যালিলিয়ো, অ্যারিস্টট্ল, কোপার্নিকাস, টলেমি, আর্যভট্ট...। একই সঙ্গে তিনি শুরু করে দিলেন প্রচার।
দু’মাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন। হাজার কপি করে ছাপিয়ে নিতেন তাঁর তত্ত্ব। বিলোতেন স্কুলে স্কুলে। এ সময়ই উত্তরপ্রদেশের ‘অমর উজালা’ সংবাদপত্রে সবিস্তার ছাপা হল তাঁর গবেষণার কথা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে তা আসতেই শুরু হল সমস্যা। বিনা অনুমতিতে সাক্ষাত্‌কার দেওয়ায় সার্ভিস রেকর্ডে পড়ল লাল কালির দাগ। আরও দু’বার রেড এন্ট্রির পর শো-কজ করা হল কার্তিকবাবুকে। ‘আমি বলে দিলাম, চাকরি করব না, আমি কোনও জবাব দিতে চাই না। আমার প্রচারেরও অসুবিধে হচ্ছিল। নিয়ম আছে, শো-কজের এক মাসের মধ্যে জবাব না দিলে অটোমেটিক আউট করে দেওয়ার। আমাকেও আউট করে দিল। আমি খুশিই হলাম। সেটা ১৯৭৯। ফিরে এলাম। এসে, এক বছর আমি আমার বই বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি... চার ছেলেমেয়ে... সকাল সাতটায় বেরোতাম, বারোটায় বাড়ি ফিরতাম... খেয়েদেয়ে আবার বেরোতাম, রাত দশটায় ফিরতাম! তার পর, ১৯৮০ সালে আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি পাই। রিটায়ার করি ২০০৫-এ। তখন পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম। আমার বউ...’ সেই সম্বলটুকুও হারানোর কথা বলতে থাকেন আবার। কিন্তু সেখানে কোনও আক্ষেপ বাসা বাঁধার সময় পায় না। কেন না, তত ক্ষণে আবার তিনি ঘুরে গিয়েছেন তাঁর তত্ত্বের দিকে। সেই তত্ত্ব প্রচারের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন।
‘এখন তো শুধু দু’ঘণ্টা লেকচার করি। বাসে বাসে। সকাল ন’টা থেকে এগারোটা। দু’ঘণ্টায় আমি পঞ্চাশ টাকার বিক্রি করে দেব। তাও তো এখন দাম কমিয়ে দিয়েছি। এক টাকা আর পাঁচ টাকা। আগে দশ টাকা ছিল, এখন পাতা কমিয়েছি। পুরো ইতিহাস দিলে আমার খরচ বেড়ে যাচ্ছিল। মানুষ তো মোদ্দা জিনিসটা জানতে চায়। ইতিহাস তারা জানতে চায়, যারা আমার সঙ্গে তর্ক করবে। তারা তো ইতিহাস পড়লেই জানতে পারবে, আমার বই পড়ার দরকার নেই। তা ছাড়া কিছু কিছু বিশেষ জায়গায় আমি এমনিতেই বিলি করি, পয়সা নিই না। ইংলিশ বইটা ফরেনারদের জন্য ফ্রি। তবে ফরেনাররা সবাই তো আর পণ্ডিত নয়, তাদের মধ্যেও আমাদের মতো গাধা আছে! কেউ হয়তো পড়তে চাইল না। নিল না-নিল, বয়ে গেল! যে নিল নিউ থিয়োরি: দ্য সান গোজ অ্যারাউন্ড দি আর্থ ওয়ান্স ইন আ ইয়ার, চ্যালেঞ্জ ফর অল সায়েন্টিস্ট অল ওভার দি ওয়ার্ল্ড ইংলিশে বলে দিলাম।’ এক লাখ টাকার চ্যালেঞ্জ। এক জন ফুটপাতবাসীর। তাঁর ফুটপাতের বাসার গায়েই একটা বোর্ডে বড় বড় করে লেখা!
পালটা বিরোধিতার মুখেও অনেক বার পড়তে হয়েছে। কখনও ফোনে হুমকি এসেছে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব! কখনও চিঠি। সে সব চিঠি নিজের বইতেও ছেপেছেন কার্তিকবাবু। তাঁর পাওয়া প্রথম চিঠিটি ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ লেখা। শুরুর দু’কথার পর প্রেরক লিখছেন ‘...আমার মনে হচ্ছে আপনি একটি দু’পেয়ে গরু। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আপনার গাঁজা খাওয়া কি অভ্যাস আছে? আপনার যদি নেশায় গাঁজা কম পড়ে, তা হলে দয়া করে জানাবেন। আমরা আপনার মাথার ছিট ছাড়াবার জন্য সযত্নে গাঁজা পাঠিয়ে দেব।’ আবার, ৩/৪/৮১ তারিখে আর এক জন তাঁকে লিখছেন ‘...একটি কথা বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয় যে আপনি কি রাঁচীর পাগলখানার একজন প্রাচীন সভ্য ছিলেন? তাহা না হইলে এই ধরণের মস্তিষ্কের উর্ব্বরতা কোথা হইতে আসিল? অতএব আমরা ইহাই সাব্যস্ত করিলাম যে, আপনি গাঁজা খাইয়া থিয়োরীটি উদ্ভাবন করিয়াছেন, অতএব আপনার প্রাপ্য পুরস্কার হলো একটি সুদীর্ঘ ঘুঁটের মালা।’ আবার প্রচারের সময় সরাসরি প্রতিবাদের সামনেও পড়তে হয়েছে। কেউ সরব হয়েছে বইমেলায় তাঁর ক্যানভাসিং-এর সময়, কেউ চলতি বাস থেকে তাঁকে নামিয়ে দিতে চেয়েছে। কখনও আবার প্রতিবাদ আরও দু-এক ডিগ্রি কড়া। ‘এক বার দু’জন আমাকে বলল, প্রোফেসরের কাছে নিয়ে যাব। বলে, লালবাজারে ধরে নিয়ে গেল। লালবাজার বলল এটা আমাদের আন্ডারে নয়। তার পর নিয়ে গেল হেয়ার স্ট্রিট থানায়। সেখানে ডায়েরি লিখল। অফিসার বলল ‘আরে, এনার একটা বক্তব্য আছে, বলছেন। আপনাদের ভাল লাগে শুনুন, না হলে শুনবেন না। আপনাদের তো জোর করে কেউ দিচ্ছে না বইটা।’ আমায় ছেড়ে দিল। আর এক বার হয়েছিল শিয়ালদার কাছে। এক জন প্রোফেসর জনা দশেক ছাত্র এনেছে। আমি তখন আমেরিকা থেকে আসা চিঠিগুলো ঝুলিয়ে রাখতাম। ওরা চেষ্টা করছিল কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলার। আমি ছিঁড়তে দিইনি, আমাকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে গেল শিয়ালদার কাছে একটা পুলিশ ফাঁড়িতে। অফিসারকে বললাম আমি একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছি, সেটাই প্রচার করছি, এরা আমায় ফালতু ধাক্কা মেরে এখানে নিয়ে এল। অফিসার বললেন দেখুন, আপনি একা, এরা দশ জন। আপনি আর আসবেন না এখানে। আমি বললাম ঠিক আছে। বলে, কেটে পড়লাম। আর যেতাম না ওখানে। এক বছর অন্তর এক দিন করে যেতাম, পর দিন দল বেঁধে এলেও আমাকে আর দেখতে পেত না!’
কে সি পাল-কে আমার তখন ফ্যাতাড়ু মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে একটা চোরা থ্রেট। পাগল-ছাগল ইমেজের একটা মানুষ রাসবিহারীর ফুটপাত থেকে গোটা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তাবত্‌ বিজ্ঞান যখন ‘ঘোরো ঘোরো ঘোরো’ বলে পৃথিবীর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, তিনি উলটো দিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক কথায় ‘স্টপ’ বলে সব থামিয়ে দিচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে আঙুল তুলে বলছেন, ‘একটা ছবি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি আমার থিয়োরির ভুল ধরার, পারিনি। কারও ক্ষমতা নেই এর ভুল ধরার।’ তাঁর কথায় কথায় রাম-শ্যাম-যদুর মতো উঠে আসছেন টলেমি, কোপার্নিকাস, পিথাগোরাস, অ্যারিস্টট্ল, কেপ্‌লার। অনায়াসে কাউকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউ কিঞ্চিত্‌ নম্বরও পাচ্ছেন। ‘কোপার্নিকাস, গ্যালিলিয়ো ভুল করেছিলেন, সেই ভুলটাই এখন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ পড়ছে। আমার থিয়োরিটা যে দিন স্বীকৃতি পাবে, সে দিন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ আমার কথাটাই মানবে।’
ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, একটা প্রশ্ন ওঁকে করা হল না দেওয়ালে, পোস্টারে উনি শুধু সাদা আর কালো রং-ই কেন ব্যবহার করেন? খরচের কারণে? না কি সাদা-কালোর বৈপরীত্যটা আসলে সত্য আর মিথ্যার মতোই বলে। একটা লড়াই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের। হ্যাঁ বনাম না। চল্লিশ বছর হতে চলল, যে লড়াইয়ে তিনি একাই একটা পক্ষ। উলটো দিকে আমি, আপনি, মনমোহন সিংহ, বারাক ওবামা, বিড়লা তারামণ্ডল, কেনেডি স্পেস সেন্টার... সব্বাই। গোটা দুনিয়া। তবু এক দিন এক মুহূর্তের জন্যও এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েননি ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই প্রাক্তন সদস্যটি। তিনি জানেন, তাঁকে নিয়ে সর্বত্র ব্যঙ্গ করা হয়। আড়ালে নয়, সামনেই লোকে হাসে, বইমেলায় ঘিরে ধরে হ্যারাস করে, কখনও তাঁর প্রচার শুনে খিস্তি মেরে চলে যায়, তবু সমান তেজ নিয়ে লড়ে গিয়েছেন তিনি। সামান্য ট্যারা কথা, তা সে শাশুড়ির মুখ থেকেই হোক বা বসের মুখ থেকে বঙ্গললনা আর বাঙালি বীরপুঙ্গবদের আধরাতের ঘুম কেড়ে নেয়। সেই জাতে এমন এক মানুষ সত্যিই বিরলতম, যিনি হাজারও অপমান, যাবতীয় বাধা সত্ত্বেও নিজের প্রতিপাদ্যে অবিচল থাকতে পারেন বছরের পর বছর।
তত্ত্বটা ঠিক না ভুল, সত্যিই ‘নাসা’ এক দিন তাঁর কথা মেনে নেবে কি না, ছেড়ে দিন। সেই লোকটার কথা ভাবুন, যাঁর ছেলেমেয়েরা অবধি স্কুলে গিয়ে যা পড়ে আসছে, তা তাদের বাবার কথাকে সরাসরি প্রলাপ বলে প্রমাণ করে। তবু সেই লোকটা তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়ছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, সেই বিশ্বাসটা শুধু তক্তপোশে শুয়ে শুয়ে লালন করলে চলে না। সেটা প্রচারের জন্য গোটা শহর জুড়ে নিজের হাতে লেখাগুলো লিখতে হয়, পাতাগুলো নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়ে ছাপতে হয়, বাস্তব পৃথিবীতে সরাসরি গলার শির ফাটিয়ে তা জোরে জোরে বলতে হয়। জীবনের প্রতিটি দিন মাস বছর মুহূর্ত, শরীর মন শক্তি আশা, সব এই একটা প্রোজেক্টে নিংড়ে নিংড়ে খরচা করে ফেলতে হয়। এবং এই সমস্তটাই করতে হয় পুরোপুরি জেনে, যে, পৃথিবীতে এক জনও তাঁর পক্ষে নেই, এক জনও না, এবং গলা দিয়ে রক্ত উঠে এলেও এক জনও তাঁর পক্ষে চলে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এই রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে একটা লোক একাত্তর বছর বয়সে এতটুকু অপ্রসন্ন নন। একটা কথাতেও কোনও হতাশা ধরা পড়ে না। ক্রোধ, ক্ষোভ, বিলাপ, আর্তনাদ যা প্রায় সব বাঙালি নিত্য ভাতে মেখে খায়, তা তাঁর মধ্যে প্রবেশাধিকারই পায়নি। তিনি জান লড়িয়ে দিচ্ছেন শুধু তাঁর তত্ত্বটা আঁকড়ে। অন্তত এই জায়গায়, ডেডিকেশন আর টেনাসিটির প্রশ্নে, তিনি আমাদের ইতিহাসের অতিমানবিক চরিত্রগুলির সঙ্গে তুলনীয় নন কি? তিনি লড়াইটা কি গ্যালিলিয়োর চেয়ে কম লড়ছেন? তিনি আরও অপেক্ষা করতে রাজি। তাঁর স্থির বিশ্বাস, এক দিন না এক দিন তিনি জিতবেনই। না, কথাটা ঠিক হল না তিনি জানেন, এই লড়াইয়ে সৃষ্টির আদি থেকেই তিনি জিতে রয়েছেন। তাঁর তত্ত্বই ষোলো আনা অভ্রান্ত, নির্ভুল। এই বিশ্বাসই তাঁর পুঁজি। এই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁর এই বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু নেই। আসলে কে কার চার দিকে ঘুরল, তাতে শেষ অবধি কিস্যু যায়-আসে না।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট ২০১৩

15 July 2013

কে সি নাগ

সুস্নাত চৌধুরী


ইস্কুল যেতে পেটব্যথা হবে। পরীক্ষার হলে ঘাম দিতে থাকবে। তেল মাখা বাঁশে উল্লাসে উঠেছে মাংকি! প্রোপোজ-টোপোজ ঘুচিয়ে ম্যাথস-এর কোচিং-এ প্রেস্টিজ ফুটো হবে। কেননা চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে তত ক্ষণে সব জল বেরিয়ে যাচ্ছে, আর উপরের কোন ব্যাটাচ্ছেলে খুলে দিয়েছে কল! এমতাবস্থায় কোনটে চাই, ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, সেটুকু ধরতেই মাথা গুলিয়ে গ। এই কিংকতর্ব্যবিমূঢ়তারই আদি পিতা কে সি নাগ।
আবার, কে সি নাগ একটা চ্যালেঞ্জের নাম। তেমন জুতসই একটা অঙ্কের সমাধান কারও কনফিডেন্সের ফুসফুসটা আরও ফুলিয়ে দেয়। এক-একটা অনুশীলনী যত গড়িয়ে আসতে থাকে, খেলা তত জমে। উনতিরিশ, তিরিশ, একত্রিশের দাগের অঙ্কগুলো যেন এক একটা হার্ডল, টপকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে সাঁইসাঁই রেস জেতার উল্লাস।



ছবি: সুমন চৌধুরী

ছাত্রজীবন, শিক্ষকজীবন
১৮৯৩ খ্রি.। ১৩০০ বঙ্গাব্দ। রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশবচন্দ্র নাগ। বাবা রঘুনাথ, মা ক্ষীরোদাসুন্দরী। শৈশবেই পিতৃহারা হন কেশব। সন্তানদের মানুষ করতে শুরু হল ক্ষীরোদাসুন্দরীর লড়াই। কেশবচন্দ্রের পড়াশোনার শুরু স্থানীয় বাংলা স্কুলে। গুড়াপে তখন ওই একটিই স্কুল। তার পর ক্লাস সেভেন থেকে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়। রাত থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়া, তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে প্রতি দিন স্কুল যাওয়া। হেঁটেই ফেরা। ক্লাস নাইনে ভরতি হলেন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। ১৯১২ সালে সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া। এ বার রিপন কলেজ। বিষয় বিজ্ঞান। এই সময় থেকেই প্রাইভেট টিউশনি শুরু করে দেন কেশবচন্দ্র। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগেই পাশ করলেন আইএসসি।



কেশবচন্দ্র নাগ
যে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক দিন ছাত্র ছিলেন, সেখানেই শুরু করলেন শিক্ষকতা। যোগ দিলেন থার্ড মাস্টার হিসেবে। সংসারের ভার তখন কাঁধে, চাকরি ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার চেষ্টা চলল। বিজ্ঞান নয়, যদি কলা বিভাগেও স্নাতক হওয়া যায়! অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করলেন কেশবচন্দ্র। এ বার ডাক এল অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার, সেই ছাত্রবেলার কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে। সেখানেও কিছু দিন শিক্ষকতা করলেন তিনি। তার পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল। এ সময়ই অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে কেশবচন্দ্রের সুখ্যাতির কথা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছয়। মানুষ চিনতে তিনি ভুল করেননি। মিত্র ইনস্টিটিউশন ভবানীপুরে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসা হয় কেশবচন্দ্রকে। রসা রোডে মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। তত দিনে তাঁর জীবনের কেন্দ্রে কেবল একটিই শব্দ গণিত। এই মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নেন কেশবচন্দ্র। মেসবাড়ি ছেড়ে ১৯৬৪ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনের নতুন বাড়িতে। আজও যে বাড়িতে ‘কেশবচন্দ্র নাগ’ লেখা নেমপ্লেটটি উজ্জ্বল! তাঁর শিক্ষকজীবনের শেষার্ধ কেটেছে কলকাতায়। তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু, অন্তরের টানে বারে বারে ফিরে গিয়েছেন হুগলির গুড়াপে, তাঁর মাটির কাছে।

বই লেখা
বই লেখার কথা দূর কল্পনাতেও ছিল না। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। সেখানে তাঁর অগ্রজ সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায়। তাঁর বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’। আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকরা। কেশবচন্দ্রও হয়ে ওঠেন সেই আড্ডার অন্যতম। শরৎচন্দ্রই নাকি তাঁকে প্রথম বলেন গণিতের বই লেখার কথা। তখন কেশবচন্দ্র বিষয়টাকে বড় একটা পাত্তা দেননি। তার পর এক দিন তাঁকে প্রায় চেপেই ধরেন কবিশেখর। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের জন্য বই লেখার কথা বলেন। ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ প্রবন্ধে সে কথোপকথনের একটা ইঙ্গিত রেখেছেন লেখক চিত্তরঞ্জন ঘোষাল। কালিদাসবাবু বলেন ‘ক্লাসে যেভাবে অঙ্ক শেখাও, আর ছেলেরা যেভাবে চুপ করে ওই শুকনো খড়কুটো গোগ্রাসে গেলে, দেখে তো মনে হয় ভাই যে তুমি গল্প লেখা শেখাচ্ছো। তাহলে নিজে লিখতে পারবে না কেন?’ শুরু হল পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। তখন তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। প্রকাশিত হল ‘নব পাটীগণিত’। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। কেশবচন্দ্র নাগের সেই ‘কে সি নাগ’ হয়ে ওঠার শুরু। বছর কয়েকের মধ্যেই তামাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও অনুমোদিত হল।
আক্ষরিকই, অপাঠ্য বই লিখেও অনেকের কপালে সাহিত্যিক-সুলেখকের তকমা জোটে। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের রচয়িতাকে ‘লেখক’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্র্যাকটিসে নেই। ল্যাডলিমোহনের কেমিস্ট্রি বা সিআরডিজি-র ফিজিক্স অনেক বাজারি গপ্পো-কবিতার চেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে, বেশি মানুষের ‘কাজে’ লেগেছে। তবু তাঁদের আমরা লেখক বলি না। কে সি নাগের ক্ষেত্রেও ‘পাঠক’-এর অবস্থানটা সেরকমই। ভুললে চলবে না, কে সি নাগকে অঙ্কের বই লিখতে বলছেন কবি আর কথাশিল্পী। শরৎচন্দ্র মজা করেই তাঁকে ডাকছেন ‘গণিত-শিল্পী’ বলে! কে সি নাগের সেই সব অঙ্কবইয়ে কি তবে কোনও মৌলিকত্ব নেই? তাঁকে পুরোদস্তুর ‘লেখক’-এর তকমা দেওয়া কি উচিত নয়?
ঘটনাচক্রে কেশবচন্দ্রের মেসে এক দিন এসে পড়েন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল। টেবিলের উপরেই ছিল কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা। দেখামাত্রই চমকে ওঠেন পরেশবাবু। কোন অঙ্ক কোন উপায়ে করলে সহজেই বোধগম্য হবে ছাত্রদের, তার হরেক রকম টেকনিক লিখে রাখা পাতার পর পাতায়। সেই খাতাটি বইয়ের আকারে ছাপার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে একেবারেই রাজি হননি কেশবচন্দ্র। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, অঙ্কের কি হেল্প-বুক হয়, না শিক্ষকদের জন্য গাইডবুক হবে এটি? শেষমেশ কেশবচন্দ্রকে রাজি করাতে সফল হন প্রকাশক। ১৯৪২। প্রকাশিত হল অঙ্কের সহায়িকা ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। বেরনো মাত্রই বইটির চাহিদা হয়েছিল আকাশছোঁয়া।
একে একে তাঁর আরও বই প্রকাশিত হতে থাকে। ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। পাকিস্তান বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী লিখেছিলেন ‘পাক ম্যাথমেটিক্স’। দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ব্রেল সংস্করণও। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মার্টিন বার্ড স্নাইডার কে সি নাগের বইগুলির বিষয়ে বলেছিলেন, ‘দ্য থিয়োরিটিকাল ট্রিটমেন্ট অব দ্য সাবজেক্ট ইন দিজ বুকস ওয়্যার সুপিরিয়র টু দ্যাট ফাউন্ড ইন সিমিলার বুকস ইন দ্য ইউএসএ’।

অ-গণিত প্রতিভা
গণিতের বাইরেও অগণিত ক্ষেত্রে অবিচল যাতায়াত ছিল কেশবচন্দ্রের। ছেলেবেলাতেই তাঁর ভেতর জনসেবার বীজ রোপণ করেছিলেন প্রতিবেশী জিতুদা জিতেন্দ্রনাথ রায়। পরে যিনি হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ মহারাজ। এক কথায় তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্রের মেন্টর। তাঁর প্রতিটি কথা জীবনভর মন্ত্রের মতো পালন করতেন কেশবচন্দ্র। তাঁর আয়োজনেই উপনিষদ, বেদ-বেদান্তের চর্চা। শ্রীশ্রীসারদামায়ের প্রত্যক্ষ শিষ্যত্বও নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। সমাজসেবা আর অধ্যাত্মচিন্তা একযোগে চলেছে, শিক্ষকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
ব্যক্তিগত ডায়েরি ‘রত্ন-বেদী’-তে লিখে গিয়েছেন বহু কবিতা, ভক্তিমূলক গান। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসিকতার কথাও। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য যেখানে যে মন্তব্যটি মনে ধরেছে, টুকে রেখেছেন এই খাতায়। আর খাতার উপরে লিখে রেখেছেন ‘বিনা অনুমতিতে পাঠ নিষেধ’! ১৯২৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত টানা এই অভ্যাস চালিয়েছেন। এ ছাড়াও কেশবচন্দ্র বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বামী অভেদানন্দের বহু ইংরেজি বক্তৃতা। অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার লেখাও।
গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও শামিল হয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। তাঁর বই তত দিনে বাজারে ঝড় তুলে দিয়েছে। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন গ্রামে। ধনেখালি থানা কংগ্রেসের তখন তিনি সভাপতি। চলল মিছিল, আন্দোলন। পুলিশ গ্রেপ্তার করল কেশবচন্দ্রকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দিন কাটতে লাগল জেলখানায়। গুজব রটল ইংরেজরা চাইছে কেশবচন্দ্রকে গুম করে দিতে! অবশেষে তিনি ছাড়া পেলেন বেশ কয়েক মাস পর। ফিরে এসে ফের যোগ দিলেন গাঁধীজির অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আন্দোলনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান। ভোটে দাঁড়াতে বলেন। সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কেশবচন্দ্র।
কেশবচন্দ্রের আরও এক আগ্রহের জায়গা ছিল খেলার মাঠ। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস সবেতেই সমান আগ্রহ। ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য। বয়সকালে মাঠে যেতে পারতেন না, রেডিয়োয় সম্প্রচার শুনতেন। আর পাটিগণিত থেকে শিফ্ট করে যেতেন জ্যামিতিতে! রিলে শুনতে শুনতেই কাগজে আঁক কেটে বুঝতেন ও বুঝিয়ে দিতেন মাঠের এক একটা মুভমেন্ট।
১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫। রেডিয়োয় চলছে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী। কানপুরে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট। কেরিয়ারের শুরুতেই তিন নম্বর সেঞ্চুরিটি হাঁকাচ্ছেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। টানটান রোমাঞ্চ। উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেশবচন্দ্র। সেরিব্রাল। আরও দু’বছর পর থেমে গেল সব অঙ্ক। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭।

স্যরের ছাত্ররা
তালিকাটা স্বভাবতই বেশ লম্বা। তারকাখচিতও বটে। চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বিকাশ রায়। রঞ্জিত মল্লিক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ গ্রন্থে (চিত্তরঞ্জন ঘোষাল সম্পাদিত ও ‘গ্রন্থ সম্পুট’ প্রকাশিত) কলম ধরেছিলেন তাঁর এই সব কৃতী ছাত্ররা। নিজেদের মাঠে যাঁরা সব হিসেব এক্কেবারে মিলিয়ে দিয়েছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গণিতবিদ হয়েও বেদ-উপনিষদে কেশববাবুর যে টান, তাতেও এ দুইয়ের নিকটাত্মীয়তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।’ সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলছেন, ‘ছাত্রদের সাহায্য করতে (শুধু অঙ্কে নয়, যে কোনও ব্যাপারে) তাঁর দিনে রাত্রে কোনো সময়েই কিছুমাত্র অনাগ্রহ বা উদ্যমের অভাব ছিল না। এবং সে সাহায্যের মধ্যে কোনো দেনাপাওনার সম্পর্কের লেশমাত্র ছিল না।’ সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘অবাক হয়েছিলাম, যাঁকে দেখে ভয় হোত, কড়া ধাতের মানুষ বলে মনে হোত সেই কেশববাবু স্যারই যখন গান করার উৎসাহ দিতেন আমাকে।’ তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিতে দেখেছেন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। তিনি লিখছেন, ‘তাঁরই প্রেরণায় উপলব্ধি করলাম অঙ্ক কত সহজ অঙ্ক একটা ম্যাজিক অঙ্কের মধ্যেও সাহিত্য-শিল্প আছে।’ আবার গুড়াপ সুরেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের স্মারকগ্রন্থে লিখছেন অভিনেতা বিকাশ রায় ‘মোটা চশমার আড়ালে গম্ভীর মুখের ছায়ায় একজোড়া সহানুভূতি-ভরা চোখ আমরা দেখেছিলাম, আমরা ভাল কিছু করতে পারলে সেই চোখে উৎসাহ জ্বলে উঠতো, আমাদের দুষ্টুমি দেখে সেই চোখে মৃদু ভর্ৎসনার সঙ্গে সামান্য indulgence ফুটে উঠতো।’

অঙ্ক মেলে না
আমি-আপনিও কি কে সি নাগের ছাত্র নই? কে সি নাগ বহু মানুষের কৈশোরের এক অনিবার্য স্মৃতি। এক আইকন। তিনিই আমাদের পাঠ্যক্রমের একমাত্র অরণ্যদেব। অথচ বইয়ের টাইটেল পেজে নামের পাশে ডিগ্রি লিখতেন না তিনি। আজও তাঁর বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত রয়্যালটির টাকার একটা বড় অংশ চলে যায় দুটি চ্যারিটি ফান্ডে। একটি তাঁর নিজের নামে, অন্যটি তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীমণির নামে। এখনও প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হয় গুড়াপে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের উদ্যোগে। আয়োজিত হয় কেশবচন্দ্র নাগ স্মারক বক্তৃতা। এ বারও হয়েছে। কিন্তু সে খবর আমরা ক’জন রাখি? ক’টা টিভি ক্যামেরা যায় সেখানে? হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে জাস্ট দু’পা হাঁটলেই কে সি নাগের কলকাতার বাড়ি। পাড়ার মেয়েটিও আগে জন্মদিনে প্রণাম করে যেতেন বৃদ্ধ কে সি নাগ’কে বলছিলেন তাঁর বড় ছেলে দেবীপ্রসাদ নাগ। এখন মেয়েটি ইচ্ছে করলেই হয়তো মানুষটির স্মৃতি উদযাপনে অনেক কিছু করতে পারেন।
আমাদের অবশ্য প্রণাম-ট্রনাম খুব ভাল আসে না। পাটিগণিতের মতোই, বেশ গুলিয়ে গেছে। এই নল দিয়ে ঢুকছিল শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধ আর ওই নল দিয়ে খরচ করে ফেলছিলাম ফুর্তিময় বিন্দাস মুহূর্ত, হাতে রইল যেন কী?





আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ জুলাই ২০১৩

03 July 2013

গাঁধীজির পাশেই গাই ফকস

সুস্নাত চৌধুরী


ভি ফর ভিনিগার’-ই আজকের ব্রাজিলে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মহাত্মা গাঁধী ও গাই ফকসকে। হাজার হাজার মানুষের হাতে গাঁধীজির ছবি, মুখে গাই ফক্সের মুখোশ। সেই গাই ফকস, চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে, যাঁর নামে প্রতি ৫ নভেম্বরের রাত্রি উদ্যাপিত হয়ে আসছে বিলেত জুড়ে। ‘গাই ফকস নাইট’। ‘গানপাউডার প্লট’-এর অন্যতম চক্রী। ১৬০৫ সালে রাজা প্রথম জেমসকে হত্যা ও ব্রিটেনের পার্লামেন্ট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে ক্যাথলিকদের একটি দল। বারুদের বিপুল মজুত দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন দলের অন্যতম সদস্য গাই ফকস। কিন্তু ৫ নভেম্বর তিনি ধরা পড়ে যান। মৃত্যুদণ্ড হয় তাঁর। ফক্সের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছিল, ফক্সের গ্রেফতারি বচ্ছরকার উদ্যাপন— তবু তামাম বিশ্বে মিথ হয়ে বেঁচে রয়েছেন গাই ফকস। তাঁর মুখের আদল সহজ মুখোশে বদলে নিয়েছে মানুষ— সেজেছে সরু গোঁফ আর ছুঁচলো দাড়িতে। সে মুখে অম্লান হাসি। যে হাসি স্পর্ধার। অ্যানার্কির মধ্যে যে কমিকাল ভায়োলেন্স আছে, তা ফুটে ওঠে এই হাসিতে। মুখের ছাঁদে কোথাও যেন এসে পড়ে রবিন হুডের অনুষঙ্গও। মুখের উপর মুখোশ মানেই সব মানুষের এক হয়ে যাওয়া, এই মুখোশ সেই সাম্যের সঙ্গে জুড়ে নেয় প্রতিরোধের আগুন, প্রতিবাদের ভাষা।


গাই ফক্সের মুখোশ আগেও বহুবার দেখেছে বিশ্ব। গত বছরই পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে দেখা গিয়েছিল গাই ফক্সের মুখোশ পরা একঝাঁক সদস্যকে। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ইন্টারনেট সেন্সারশিপ বিষয়ক অ্যান্টি-কাউন্টারফেইটিং ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা অ্যাক্টা-র। ‘হ্যাকিং’ ও ‘অ্যাক্টিভিজম’-এর জোড়কলম ‘হ্যাকটিভিজম’-এ যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁদের আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যানোনিমাস-এর লোগোও হয়ে উঠেছে গাই ফক্সের মুখোশ। ভারত সরকারও যখন টরেন্ট, ফেসবুক বা টুইটারের উপর থাবা বসাতে চাইছিল, আঘাত করতে চাইছিল দেশবাসীর ই-স্বাধীনতায়, তখনও মুম্বই বা বেঙ্গালুরুতে বিক্ষোভ-জমায়েতে প্রতিবাদীদের মুখে উঠে এসেছিল স্লোগান। সঙ্গে এই মুখোশ। আঁকা হয়েছিল এমন ছবিও— স্বয়ং মহাত্মা গাঁধী মুখে পরে নিচ্ছেন অ্যানোনিমাস-এর লোগো, গাই ফক্সের মুখোশ। আজ আবার ব্রাজিলের রাস্তায় একসঙ্গে দেখা গেল গাঁধী ও ফকসকে।
বছর দুই আগে, অণ্ণা হাজারে যখন রামলীলা ময়দানে অনশনে, তখন এক আশ্চর্য ছবি দেখা গিয়েছিল রিও-র কোপাকাবানা বিচে। শামিল হয়েছিলেন একদল ব্রাজিলীয়; মাথায় ছিল গাঁধী-টুপি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতবাসীর লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। সালভাদোরের রংচঙে কার্নিভালেও পথে নামতে দেখা যায় একদল মানুষকে, যাঁদের পরনে থাকা সাদা পোশাক। নিজেদের তাঁরা বলেন— ‘ফিলহোদ দে গাঁধী’, অর্থাৎ গাঁধীর সন্তান। গাঁধীর সঙ্গে ব্রাজিলের সম্পর্কের আরও একটি উদাহরণ নারীবাদী লেখিকা মারিয়া লাসেরদা দে মউরা। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে গাঁধীর প্রসঙ্গ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রাজিলের আমজনতা আবার হাতিয়ার করে নিলেন মহাত্মাকে।
তা হলে কি কোথাও একটা মিলছে না? একটা দ্বিচারিতার মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটছে ভি ফর ভিনিগার মুভমেন্ট? আপাতভাবে দেখলে দ্বিচারিতা রয়েছে বটেই। ব্রাজিলবাসীর এই আন্দোলন কোথাও শান্তিপূর্ণ অবস্থান— সেখানে গান, বাজনা, সাম্বা। আবার কোথাও ভয়াবহ হিংসাত্মক চেহারা তার। চলছে অবাধ ভাঙচুর, লুঠপাট। মনে হবে, একই মুদ্রার এক পিঠে হিংসা, অন্য পিঠে অহিংসা।
আসলে শুধু ড্রিবল আর মাপা পাসের সৌন্দর্য দিয়েই ম্যাচ জিততে চায় না ব্রাজিল, কড়া ট্যাকলও চায়। ফেয়ার প্লে নয়, চ্যাম্পিয়নের ট্রফির দিকেই তাদের নজর। প্রেসিডেন্ট দিল মা রউসেফের যাবতীয় ঢোঁকগেলা প্রতিশ্রুতিকে উড়িয়ে দিয়ে আজ এতদিন পর তারা নানা ভাবে যেটা বলতে চাইছে— হ্যাঁ, সেটা আমাদেরও খুব চেনা স্লোগান— মানছি না, মানব না।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ জুলাই ২০১৩

01 July 2013

বেওসা

সুস্নাত চৌধুরী


অন্যকে নিয়ে বাঙালি খুব ইয়ার্কি মারতে পারে। মাড়ওয়ারিকে ‘মেড়ো’ বলতে পারলে সে খুশি হয়। আরও খুশি হয় অন্যের দক্ষতাকে তার ডায়ালেক্টেই খাটো করতে পারলে। ব্যবসাকে ‘বেওসা’ বলার কোনও মতে এক পিস সুযোগ পেলে বাঙালির প্রাদেশিক অন্তরাত্মা জুড়োয়। কেননা, নিজে সে চিরকাল বাড়ি থেকে মুখস্থ করে গিয়ে লিখে এসেছে ‘বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার’ শীর্ষক কোটেশনসমৃদ্ধ বাংলা রচনা। তার পর পাশ-টাশ দিয়ে বেকারের সংখ্যা দাঁড় করিয়েছে এক্স প্লাস ওয়ানে। তার পর সুখতলা খুইয়ে চাকরি খুঁজেছে ওই ‘মেড়ো’-র আন্ডারেই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসা শুরু করার মুরোদ তার নেই।
অথচ অনেক বাঙালি দেবতা তাকে চাবকে বলেছিলেন, ব্যবসা ধর! বহু দিন আগে কলেজপাড়ায় বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন এক বাঙালি ইন্টেলেকচুয়াল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত প্রেস অ্যান্ড ডিপোজিটরি। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে পার্টনার হিসেবে ছাপাখানা বসিয়েছিলেন। সেই ব্যবসা কত দূর সিরিয়াস ছিল, বুঝতে পারা যায় বিদ্যাসাগরের লেখনী থেকেই। তর্কালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছয়, তর্কালঙ্কারের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর ‘শিশুশিক্ষা’-র কপিরাইট বাবদ টাকা মেরে দিয়েছেন, এমন কথাও রটে। রটান তর্কালঙ্কারের জামাই যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ। ব্যবসার এই টানাপোড়েন আইন-আদালত পর্যন্তও গড়ায়। ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর যে ‘পরস্বহারী’ নন, তা প্রমাণ করতে শেষমেশ ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’ নামক গোটা একখানি পুস্তিকাই লিখে ফেলতে হয় লেখক বিদ্যাসাগরকে। না, ব্যবসা করতে, নিজের ব্যবসায়ী সত্তাকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে তাঁর প্রেস্টিজে লাগেনি।

ছবি: সুমন চৌধুরী

লেখক শংকরকে এক বার নাকি তাঁর এক গুজরাতি বন্ধু বলেছিলেন, ‘নিজেদের বেনিয়া বলতে আপনারা অপমান বোধ করেন, অথচ দেখুন মহাত্মা গাঁধীকে, কথায় কথায় নিজের বেনিয়াত্ব ঘোষণা করতেন।’ শংকরের বিশ্বনাথ বোসকে দিয়ে যে-কথা বলিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান, তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে পার, কিন্তু সওদা করবে কী করে?’ ‘জনঅরণ্য’-র সোমনাথের উদ্দেশে বলেছিলেন ওই বিশুদা। আর এক বছর ধরে চাকরি খুঁজে হয়রান সোমনাথ যখন বাড়িতে জানাল, সে ব্যবসা করবে, তার বাবা মন্তব্য করেছিলেন— ‘এটা যেহেতু মেনে নেওয়ারই যুগ, তুই ব্যবসা করলেও সেটা আমি মেনে নেব।’ বোঝা যায়, বাঙালি মাস্ যেটুকু ব্যবসার দিকে হেঁটেছিল, তার অধিকাংশটাই বাধ্যত। অগতির গতি। একখানি কেরানির চাকরিও যদি তার আগেভাগে জুটত, হার্গিস সে ব্যবসার দিকে পা বাড়াত না।
ব্যবসার প্রতি বাঙালির এই দৃষ্টিভঙ্গির কথা সম্প্রতি ফের উঠে এল ‘গয়নার বাক্স’ ছবিতে। ঠাটবাট বজায় রাখতে গিয়ে যখন জমিদার বংশের ঘটিবাটি বেচা চলছে পুরোদমে, তখন ঘুরে দাঁড়াতে বাড়ির ছোট বউ আর ছোট ছেলে দিল শাড়ির দোকান। ব্যবসার ক্যাপিটাল এল ভূত-পিসিমার গয়না বন্ধক রেখে। খাট-পালঙ্ক বাসনকোসন বেচে খেতে যাঁদের আপত্তি নেই, তাঁরা কিন্তু যথারীতি উঁচু নাক ঢের কুঁচকোলেন। বে-রোজগেরে কর্তামশাই খবর পেয়েই বললেন— ‘আমাগো বংশের পোলা দোকানদারি করতে বইছে? কুলাঙ্গার!’ পিরিয়ড পিস হোক বা হালফিলের কাহিনি— এই চারিত্র বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। ‘বং কানেকশন’। এই আধুনিক সময়েরই প্রেক্ষাপট। প্রবাসী অ্যান্ডি কলকাতা আসার পর তার ভাইদা (জেঠতুতো দাদা) তাকে নিজের বাবার কথা বলছে— ‘আমার বাপটা শালা সারা জিন্দেগি কেরানিগিরি করে চালিয়ে গেল, বললে আবার রেগে যায়!... (আমায়) ব্যবসা করতে দেবে না বলে তো শালা একটা পয়সা ধার দিল না। সেন বাড়ির ছেলেরা নাকি ব্যবসা করে না, করলে জাত যায়!’
কিন্তু বাঙালির ইতিহাস এই কথা বলে না। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগে বাঙালি বংশপরম্পরায় বাণিজ্য করেছে। সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তাম্বুলবণিকদের একটা বড় অংশ বাংলার। ধনপতি সওদাগরের কাহিনি, চাঁদ সওদাগরের কাহিনি গড়ে উঠেছে এই মাটিতেই। পরবর্তী কালে দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, নকুড় ধর, রামদুলাল দে সরকারের মতো লোকজনের মধ্যেও ব্যবসায়ী প্রবণতার ঘাটতি ছিল না। সে যুগেই মাড়ওয়ার থেকে এসে এ রাজ্যে ব্যবসা ফেঁদে কোটি-কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন জগৎ শেঠ। ব্যবসায়ী বলতে আজ যে মাড়ওয়ারি শ্রেণিকে দূর থেকে দেখে বাঙালি, তাকে ঠিকঠাক হিংসে করারও সে দম পায় না। তখন কিন্তু মাড়ওয়ারিদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছিল সে। তা হলে বাঙালি জাতি সেই টেনাসিটি ধরে রাখতে পারল না কেন? হয়তো বেহিসেবি ভোগবিলাসের জন্য, হয়তো দূরদর্শিতার অভাবে ভুল বিনিয়োগে, হয়তো সহজেই আত্মসন্তুষ্ট হয়ে ওঠার কারণে।
উনিশ শতকের সংবাদপত্রগুলি জগদ্দল বাঙালিকে তেড়ে গাল দিয়েও নড়াতে পারেনি। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখছে, ‘তাঁহাদের ধনে বিদেশের লোক বড়মানুষ হইতেছে, রঙ্গে রত্নে অনঙ্গ দেশ ঐশ্বর্যশালী হইতেছে, বঙ্গমাতা এক্ষণে কেবল কতকগুলি মুটে ও চাকর প্রসব করিতেছেন।’ ‘সোমপ্রকাশ’ লিখছে, ‘প্রকৃতপক্ষে চাকুরীর এখন যেরূপ দুরবস্থা তাহার অপেক্ষা সামান্য মুদির দোকান করিয়া দিনাতিপাত করা ভাল। আমাদিগের সমাজে অলস অপদার্থ ও অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা অধিক বলিয়াই এরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে, ...যাবৎ লোকের মন হইতে চাকুরী প্রবৃত্তি বিদূরীত হইয়া দেশের উন্নতির চেষ্টা ও স্বাধীন কার্যে প্রবৃত্তি না জন্মিবে তাবৎ প্রকৃত উন্নতির সম্ভাবনা নাই...।’

দশটা-পাঁচটার কেরানি-জীবনই বাঙালির অভীষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বটতলার ‘কেরানি-দর্পণ’ নাটকে দেখি, আপিসে ঢোকার মুখে এক ভিনরাজ্যের কুলি বলছে— ‘ক্যারে বাবু, ক্যা ফুটানি কর্তা তু, তোরা মাফিক্ বাবু হাম্ বাহুত্ দেখা হ্যায় দশ্ পনেরা রূপেয়া মে হাম দো তিনঠো করাণী রাখনে সেকতা...’! তবু এই ডালহৌসি স্কোয়ারই যেন বাঙালির একমাত্র লক্ষ্য। কালপেঁচা লিখেছিলেন এমনই এক ব্যাংক-কেরানি ভজহরিবাবুর কাহিনি। তহবিল তছরুপের অভিযোগে তাঁর চাকরি যায়। তবু রোজ বেলা দশটার মধ্যে নাকে-মুখে গুঁজে আপিস পৌঁছে যেতেন তিনি। দাঁড়িয়ে থাকতেন গেটের ঠিক বাইরে। যদি ওই দোতলা থেকে কোনও মতে বড়বাবুর দূরদৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ে। ভজহরিবাবুর জীবনে দূরদৃষ্টি বলতে ছিল এই অসম্ভব কল্পনাটুকুই। কালপেঁচা লিখছেন, ‘কলকাতা শহরের লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরুপদ্রব কেরানীর মূর্তিমান প্রতিনিধি ভজহরিবাবু। জীবনের কোন আশা নেই, ভরসা নেই, কোন ইচ্ছা নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই, কোন বিদ্বেষ নেই, অভিযোগ নেই।’ চাকরির জন্য, কেরানি-সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য যে স্ট্রাগ্ল যে কম্প্রোমাইজ বাঙালি করেছে, আজও করছে, তার ভগ্নাংশও যদি ব্যবসার জন্য করত, জাতটা অনেক উপরে উঠত। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখাতে তার আপত্তি নেই, ব্যবসার জন্য ব্যাঙ্কে লোনের অ্যাপ্লিকেশন করতে সে দু’বার ভাবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরির পরীক্ষা থাকলে রেকর্ড ভিড় হয় ট্রেনে-বাসে। ব্যবসার জন্য ভিড় করতে হলে এই বাঙালির অধিকাংশই আস্তে আস্তে কেটে পড়ে আজও। ডালহৌসি স্কোয়ার বড় জোর শিফ্ট করে যায় সেক্টর ফাইভে। গড়ে ওঠে কর্পোরেট কেরানিকুল। রিসেশনের ভূত ইঞ্জিনিয়ারদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, হাজার-হাজারের হাতে কোনও প্রোজেক্ট নেই, তবু ব্যবসা ফাঁদতে ভয়।
আসলে বাঙালি বিশ্বাসই করে ফেলছিল, শুধু ধর্মতলায় কর্মখালি নয়; মুশকিল আসানও উড়ে মালিই! নানা রাজ্যের লোক এ রাজ্যে এসে ব্যবসা করে টাকা কামিয়ে লাল হয়ে গেল। বাঙালি তাদের হ্যাটা করল, আর চাকরগিরি করেই কাটিয়ে দিল কয়েকশো বছর। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘বাঙালীর ধ্বংসের কারণ’ প্রবন্ধের শুরুতেই বলছেন— ‘আমরা যাহাদিগকে মেড়ো, ছাতুখোর ইত্যাদি আখ্যা দিয়া থাকি, তাহারাই সুদূর রাজপুতানার মরুপ্রান্ত হইতে রেলপথ হইবার পূর্বে পদব্রজে লোটাকম্বল সম্বল করিয়া, সত্যসত্যই ২/৪ পয়সার ছাতু খাইয়া, এই বাংলাদেশের বুকের উপর আসিয়া বসিয়াছে এবং শতবর্ষ ধরিয়া ক্রমান্বয়ে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য আয়ত্ত করিয়াছে। তবুও আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাহাদের পারদর্শিতার কথা উপলব্ধি করিতে পারি না। আমরা দু’পাতা Shakespeare, Milton এর পদ আওড়াইয়া বা Differential Calculus এর পাতা উল্টাইয়া গর্বে স্ফীত হইয়া পড়ি, এবং মাড়োয়ারী প্রভৃতি অ-বাঙালী ভ্রাতাগণকে হীন ও মুরুব্বীয়ানার চক্ষে দেখি।’

ব্যবসা না করার এই যুক্তিকে খণ্ডন করতে দীর্ঘ দিনই বাঙালির কমন দুটি অজুহাত। প্রথমত, ব্যবসার টাকা সে পাবে কোথায়? হক কথা! তার পূর্বপুরুষ তো লকার-ভরা ধনসম্পদ রেখে যাননি। স্বল্প পুঁজির ব্যবসার রাস্তায় তো হাঁটতেই পারত মধ্যবিত্ত বাঙালি; কিন্তু সেখানে তার পাহাড়প্রমাণ ইগো। ‘বাঙালীর শক্তি ও তাহার অপচয়’ প্রবন্ধে প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন এই কথাই। ‘ছোট্ট ঘর ভাড়া লইয়া পশ্চিমা অশিক্ষিত লোক বিদ্যুতের যোগে গমপেষা কল চালায়। কলিকাতার অলিতে গলিতে এই প্রকার কত আছে। ইহারা মাসে ৭০/৭৫ টাকা উপার্জন করে। চতুর ও তীক্ষ্নবুদ্ধিবিশিষ্ট বাঙালীর সন্তান এই ব্যবসায় করে না। মূলধনের অভাবে নাকি বাঙালীর পক্ষে সম্ভব হয় না। অথচ এই প্রকার ব্যবসায়ে অতি সামান্য মূলধনের প্রয়োজন হয়।’ জাস্ট টাকার অঙ্কটা বদলে নিলে, এ সব কথা আজও ষোলো আনা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। বাঙালির দ্বিতীয় অজুহাত— ব্যবসার চেষ্টা করেও বাই চান্স ধাক্কা খেলে, ব্যর্থ হলে, সে উঠে দাঁড়াবে কী করে? এ কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু বাঙালিই তো শুধু ব্যবসায় ফ্লপ করে না, সব দেশের মানুষই করে। তা হলে তারা পারে কী করে? কারণ তারা লেগে থাকতে পারে। লড়ে যেতে পারে। সেই কবে, ‘সোমপ্রকাশ’ পত্র লিখছে— ‘...বোম্বাইবাসীরা সেরূপ নহে। দুর্ভাগ্যক্রমে একবার ক্ষতিগ্রস্থ হইলেও বসিয়া না পড়িয়া কপাল ঠুকিয়া আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কাহারও সাহায্য ভাগী হইয়া বাণিজ্য কার্যে রত হয় এবং অসাধারণ অধ্যবসায় বলে অল্প দিনেই ক্ষতি পূরণ করিয়া লয়।’ আর বাঙালি? সে এক বার পড়ে গেলে নিজের মায়ায় বুক ভাসিয়ে হাঁটুর ফুলোয় হাত বোলায় আর ডেকে ডেকে নাকে কেঁদে বলে, ‘এই হাঁটুটাঁ ছঁড়েঁ গেঁল বঁলেঁ, বুঁঝলেঁন, নঁইঁলেঁ...’!

এর পর নিজের অক্ষমতাটাকে সে একটা টুইস্ট দিল। নিজেকে বুঝিয়ে ছাড়ল, ব্যবসায়ী মানেই খারাপ লোক। এ দিকে, বাঙালি তো ভীষণ ভাল লোক। উঁচু ঘরের, খাঁটি চরিত্রের! গম্ভীর হয়ে সে রটাল, উচ্চবিত্ত মানেই অসৎ। তার প্রিয় খিস্তি হল— ‘বড়লোকের ব্যাটা!’ বড়লোক ব্যবসায়ীগুলো বোকা, মূর্খ, ভোঁদকা। ‘বিরিঞ্চিবাবা’-র কেসটাই ধরুন না, বাঙালিকে তিনি শোনাচ্ছেন বুদ্ধ, আইনস্টাইনের কাহিনি। যুক্তিবাদী বাঙালি তাঁর ঢপবাজি ধরেও ফেলছে। কিন্তু ১৯১৪-য় নিয়ে গিয়ে যাঁকে তিনি জলের দরে লোহা কিনিয়ে দিচ্ছেন, তিনি মেকিরাম আগরওয়ালা। বোকাসোকা অবাঙালি। ‘পরশ পাথর’ বানাতে গিয়ে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও টাইটেলের পরই পরদা জুড়ে লিখে দিচ্ছেন— ‘ইহাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়বিশেষের প্রতি সচেতন ভাবে কটাক্ষ হয় নাই’। কাদের কথা ভেবে এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ? কৃপানন্দ কাচালু? যে শেঠজি ছবিতে অ্যাপিয়ার করেই বলছেন— ‘বেটার নেভার দ্যান লেট’! বাঙালি দর্শক তাকে দেখে হেব্বি মজা পায়, কিন্তু ভুলে যায়, বাঙালি কেউকেটাদের নিজেদের বাড়িতে ডেকে বিনি পয়সায় দেদার মাল খাওয়ানোর ক্ষমতা রাখে এই শেঠজি। বাঙালি এই শক্তপোক্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে নম্বর দিতে চায় না। মনে করতে চায়, এই সব লোক লটের দরে হয় বোকা, নয় ধান্দাবাজ! নইলে বাঙালির নিজের ভিতই টলে যাবে। এত পড়াশোনা, এত ফুকো-দেরিদা করেও লক্ষ্মীর কৃপা থেকে বঞ্চিত থাকার জ্বালা এ ভাবেই জাস্টিফাই করে সে। নিজেকে দারুণ সৎ ও মহৎ হিসেবে দেখতে চায়। যেন গরিব থাকাটা অপরিসীম গৌরবের! 
বাংলা মেনস্ট্রিম ছবিতেও দেখুন, নায়ক বা নায়িকার ভিলেন-টাইপ বাবা মানেই তাঁর বিরাট ব্যবসা, অগাধ সম্পত্তি। ধরুন, ‘দেয়া নেয়া’— উত্তমকুমার অভিনীত প্রশান্ত চরিত্রটির কাজকম্ম না-করে সর্ব ক্ষণ গান গাইতে চাওয়াকেই গ্লোরিফাই করে দেখানো হল। তাঁর বাবা বি কে রায় (কমল মিত্র) ব্যবসার ক্ষতি নিয়ে সরব হওয়ায় তাঁকে তুলে ধরা হল বেরসিক, রাগী, কিছুটা দুষ্টু লোক হিসেবেই। আবার ‘পথে হল দেরি’— মল্লিকার (সুচিত্রা সেন) বাবা বিরাট ধনী শ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি বিশ্বাস) জয়ন্তর (উত্তমকুমার) ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘তোমরা কী, জমিদার না ব্যবসাদার?’ এই প্রশ্নটিই যেন বাঙালি দর্শকের কাছে মিস্টার বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরিচালকের খাটো করে দেখানোর হাতিয়ার! তা হলে কি বাংলা ছায়াছবিতে ব্যবসাকে পজিটিভ আলোয় দেখানোই হয়নি? বিলক্ষণ হয়েছে। হীরেন নাগের ‘সাবরমতী’। দুঃখের কথা একটাই, সে ছবিতে উত্তমকুমার অভিনীত প্রধান চরিত্রটির নাম— শঙ্কর সারাভাই। আর ছবির শুরুতেই পরদা জুড়ে ক্যাপশন— ‘শিল্পনগরী আমেদাবাদের পটভূমিকায় রচিত’! এমনি এমনি কি আর সানন্দে থাকে ন্যানো!
বাঙালি তাই নিজ বংশগৌরব ব্যাখ্যানে চির কালই ‘তাসের দেশ’-এর ছক্কার মতো সদাগরকে বলে এসেছে, সৃষ্টিকার্যে মগ্ন ব্রহ্মা বিকেলের দিকে প্রথম যে হাই তুললেন, সেই পবিত্র হাই থেকেই তার জন্ম! সাধে কি আর সে এত দিন সরকারি চেয়ার-টেবিলে ধুলোময় ফাইলের পাহাড়ের সামনে বসে মন্ত্রের মতো আওড়েছে— ‘হা-আ-আ-আই।/ হাতে কাজ নাই।/ দিন যায় দিন যায়।/ আয় আয় আয় আয়।/ হাতে কাজ নাই’?


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ জুন ২০১৩

22 April 2013

ঝি লোকাল

সুস্নাত চৌধুরী


থ্রি ফোর ফাইভ ওয়ান থ্রি। থ্রি ফোর ফাইভ ওয়ান ফাইভ। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ফুটানিকে এক ধাক্কায় শুইয়ে দিতে পারে এই দু’টি সংখ্যা। অন্তত সাউথ ক্যালকাটা বলতে যে দক্ষিণ কলকাতাটিকে বোঝানো হয় ‘এলিট’, ‘পশ’ এ সব বিশেষণ যে স্থানবাচক বিশেষ্যর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি আয়তনে ফুলে-ফেঁপে দ্রুত বাড়তে থাকা সেই বেলুনটিকে ছোট্ট আলপিনের মতো নিমেষে ফুস করে চুপসে দিতে পারে ওরা।
আপ ক্যানিং-শিয়ালদা লোকাল। লোকে বলে ‘ঝি লোকাল’। ‘লোকে’ মানে, যাঁরা কলকাতায় থাকেন। পয়সা দিয়ে যাঁরা ‘ঝি’ রাখতে পারেন, সেই সব দাদা-বউদিদের কাছে এটাই ট্রেনগুলির ডাকনাম। আদরের। এমন ট্রেন অবশ্য আরও দু-তিনটি আছে। ভাবলে অবাক লাগে, চোখে না দেখলে ঠাহর হতে চায় না, গোটা একটা ট্রেন, বগির পর বগি, ঠাসা ‘কাজের লোক’-এ। কাজের মাসিতে, কাজের দিদিতে। এক-দেড় ঘণ্টার রেলপথ পেরিয়ে রুজি-রুটির সন্ধানে তাঁদের শহরে আসা।
ঘুম থেকে ওঠা প্রায় মধ্য রাতে। চটজলদি নিজের ঘরের কিছু কাজ সেরে ফেলা। তার পর বেরিয়ে পড়া। অটো কিংবা ভ্যান। না পোষালে, পায়ে পায়ে স্টেশন। ধরতে হবে চারটে বত্রিশের আপ ক্যানিং-শিয়ালদা লোকাল। না হলে, তার পরের গাড়ি, পাঁচটা কুড়ি। এদেরই নম্বর দুটো গোড়ায় লিখলাম। কিন্তু রাত সাড়ে তিনটের আগে থেকেই একটু একটু করে ভিড় বাড়তে থাকে ক্যানিং স্টেশনে। যাঁদের মান্থলি নেই, সেই সব ‘ডব্লিউ টি’-দের জন্য একেবারে প্রথম ট্রেনটিই সেফ। তিনটে পঞ্চাশ। থ্রি ফোর ফাইভ ওয়ান ওয়ান।
সকলের পরনেই ছাপা শাড়ি। একটু ন্যাতানো, যেন কথা শুনবে। চটজলদি কাজে সুবিধে হবে। আর প্রায় প্রত্যেকের হাতেই একটা করে নাইলনের থলি। যেন ইউনিফর্ম। কে জানে, কী থাকে তার ভেতর! তার পর ট্রেনে উঠে বসে পড়া। ক্যানিং থেকে উঠলে তবু বসার জায়গা মেলে। পরের স্টেশন তালদি থেকে রে-রে করে আরও এক দল। তখন কামরায় কামরায় গাদাগাদি ভিড়। কেউ মেঝেতেই বসে পড়েন। কেউ কোনও মতে দাঁড়িয়ে।


ছবি: সুমন চৌধুরী

ঘড়িতে তখন ভোর চারটে আটত্রিশ কিংবা পাঁচটা ছাব্বিশ। গোটা ট্রেনটা তখন বাইরে থেকে দেখতে মেয়েদের স্কুলবাসের মতো। শতকরা পঁচানব্বই জন মহিলা। গড়পড়তা একই ছাঁচে ঢালা। প্রায় প্রত্যেকেই চলেছেন অন্যের বাড়ি ‘ঝি-গিরি’ করতে।
ঢুলুনি চলছে, কলকল কথাও। ‘আমার চায়নার মোবাইলে কী জোস্সে অ্যালাম হয়!’ এক-একটা ডায়লগ শুনে মনে হয়, কত ভেবে খাপে-খাপ বসিয়েছেন চিত্রনাট্যকার! আবার, ‘চা করে গালে তুলে দিতে হয় গা!’ ভাবি, এই খিস্তি কাকে? যাঁকে ঘরে রেখে এলেন, তাঁকে? না, যাঁর বাড়ি যাচ্ছেন, তাঁকে?
অনেকেরই স্বামী কিছু করেন না। বা যেটুকু করেন, সংসার চলে না। কেউ মুরগির দোকানে মুরগি কাটেন, বদলে মাইনে নেন না। প্রত্যহ দু’বোতল চোলাই নেন। কেউ ছোটখাটো দোকান চালান, কেউ লক-আউট হওয়া কারখানার ‘প্রাক্তন’ শ্রমিক। সুতরাং, নিজের সংসারের দায়িত্ব এঁদের তুলে নিতে হয়েছে নিজের কাঁধেই। উপায় একটাই ট্রেনে চড়ে বসা। ঝি লোকাল। ঝি লোকাল তাঁদের ভাত দেবে। ঝি লোকাল তাঁদের সন্তানকে বড় করার খরচ জোগাবে। তাঁর আদরের সোয়ামিটিকে, যে তাঁকে হপ্তায় অন্তত দু’দিন মদ খেয়ে বেদম পেটায়, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে, তাঁর ওষুধ কিনে দেবে। এই যে এক-ট্রেন নারী, এঁরা ফেমিনিজ্ম-এর নাম শোনেননি কোনও কালে। মাথার ওপর ঘোমটা দেওয়া উচিত কি না, বুকের ওপর ওড়না অপমানকর কি না, ‘মেয়েছেলে’ শব্দটা অশালীন কি না এ সব প্রশ্ন, বিতর্ক এঁদের থেকে শত হাত দূরে কোথাও হচ্ছে হয়তো। এঁদের জীবনে মোমবাতি মিছিল নেই, শাহবাগ নেই। কিন্তু, সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্য এঁদের কোনও লেডিজ কম্পার্টমেন্ট লাগে না, নির্ধারিত লেডিজ সিট লাগে না, শতাংশের হিসেবে সংরক্ষণ লাগে না। লেডিজ স্পেশাল ‘মাতৃভূমি লোকাল’ নয়, এঁরা জানেন প্রতি দিন কী ভাবে দুটো-তিনটে সাধারণ লোকাল ট্রেনকেও এই পুরুষতন্ত্রের মাঝখান থেকে হাইজ্যাক করে ‘ঝি লোকাল’ বানিয়ে ফেলা যায়!
আপনি যদি ‘ভদ্রমহিলা’ হন, কিংবা পুরুষ হন, ভদ্র বা অভদ্র যে কোনও শ্রেণির এই ট্রেনে উঠলে কিঞ্চিৎ ভয়-ভয় করবে। হংসমধ্যে বকো যথা আপনি কোথা থেকে এলেন, কোথায়ই বা যাবেন, গুলিয়ে যেতে থাকবে। এতটাই পাওয়ারফুল, প্রায় অ্যাগ্রেসিভ ওঁদের বডি-ল্যাংগোয়েজ। দিনরাত এতখানি লড়ে নিতে হলে সেটা বোধহয় বাধ্যতামূলক ভাবেই আসে। হয়তো ওঁরাও আপনাকে সন্দেহের চোখে নজর করবেন। ‘আপনার তো এখানে থাকার কথা ছিল না’ গোছের অর্থ সে চাউনির। কে জানে, শ্রেণিশত্রু হিসেবেও দেখতে পারেন। একটু আড়ষ্ট হয়ে, ওঁদের চোখে চোখ না দিয়ে, মাথা নিচু করে বা মুখ ঘুরিয়েই কাটবে আপনার রেলযাত্রা।


কানও আপনি খুলে রাখতে পারবেন না। কেননা ওঁদের আলোচনাও আপনার মরমে পশিবে। বার বার উক্ত ‘মুকাজ্জিবাবু’ কি ‘চ্যাটাজ্জিবউদি’-র সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ফেলবেন। ‘কত বার বল্লাম, তবু একটা কবেকার কাপড় দিল, স্সাড়ি না ন্যাকড়া!’ অথবা ‘দ্যায় তো দু-কানা রুটি, তাও যেন সুক্নো চামড়া। বলে দিইচি টিপিন লাগবে না, একসো টাকা বাড়িয়ে দিন। তার বেলা রাজি হচ্চে না, স্‌ল্‌লা হারামি!’ আপনার রুচিশীল কান লাল হয়ে উঠবে। কিন্তু, ওঁরা নাগাড়ে উগরে দিতে থাকবেন নিজেদের ক্ষোভ। স্পষ্ট ভাষায় মনিবের সমালোচনা, মালকিনের কাটাছেঁড়া। স্বাভাবিক। ওই ট্রেনই ওঁদের প্রতি দিনের টিম মিটিং-এর ক্লাব হাউস, রোজকার রঁদেভু। 
তার পর ওঁরা নেমে পড়বেন বাঘা যতীন কি যাদবপুর স্টেশনে। পিছু ফিরে না তাকিয়ে সার বেঁধে হনহন করে এগিয়ে যাবেন। সংসার টানতে অন্তত চার-পাঁচ বাড়ি কাজ করতেই হয়। কারও ঠিকে কাজ, কারও কাজ রাঁধুনির। একটার পর একটা। মধ্যবিত্ত গেরস্তর কাছে এঁরা নেসেসারি ইভিল। ভদ্দরবাবুবিবি এঁদের গিলতে পারেন না, ওগরাতে তো নয়ই। এক দিন কামাই হলেই ত্রাহি ত্রাহি রব। লাইনে ফাটল দেখা দিলে রেলমন্ত্রীর গুষ্টি উদ্ধার। ইলেকট্রিক তারে কলাপাতা পড়লে রাজনৈতিক রংবাজির বাপ-মা তোলন। শিক্ষিত আধুনিক বাঙালির এই ‘ঘরোয়া’ বিপ্লব নীতির প্রশ্নে নয়, জাস্ট আজ কাজের লোক আসবে না বলে! বালিগঞ্জ, যাদবপুর, গড়িয়া দক্ষিণ কলকাতার একটা বড় অংশ সে দিন টলমল করে। ঘরদোর আলুথালু পড়ে থাকে। অফিসে লেট হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না হয়তো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা শহর থমকে যায়, স্রেফ দুটো ট্রেন মাঝরাস্তায় আটকে পড়েছে বলে!
অথচ এঁদের কাজকে কেউ এতটকু সম্মান দিতে রাজি নন। ‘ঝি লোকাল’ শব্দবন্ধটিও সেই অমর্যাদার বোধকে বহন করে। বাড়ির কিছু খুঁজে না পাওয়া গেলেই প্রথম সন্দেহ কাজের লোকের ওপর। বিনা দ্বিধায় তো বটেই, বিনা প্রমাণেই চলে জিজ্ঞাসাবাদ, চোটপাট। আবার, তাঁদের রোজগারকেও স্বীকৃতি দেয় না এ সমাজ। জিডিপি-তে এর কোনও উল্লেখ থাকে না। এত সব অপ্রাপ্তির হিসেব অবশ্য ওঁরা কষেন না। নাকমুখ গুঁজে কাজ করতে করতে কখন দেড়টা-দুটো বেজে যায়। আবার ফেরার ট্রেনের জন্য পা চালানো। ডাউন শিয়ালদা-ক্যানিং লোকাল। না, এই ট্রেনগুলো তখন আর ঝি লোকাল নয়। তখন ঘরে ফিরছে লক্ষ্মী। সে কারও ঘরের মেয়ে, কারও ঘরের বউ।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ এপ্রিল ২০১৩

13 March 2013

অনুখিস্তি, অণুকিস্তি

সুস্নাত চৌধুরী


‘শালা’, ‘বাঞ্চো...’ উচ্চারণে ঝাল নেই তবু বলে যাও নুন-তেল-লঙ্কার ঝাঁঝ আর মেলে না টাগরায়, আমি ভাবি ব্যক্তিগত জীবনের ডায়েরি থেকে উঠে আসা মুখখারাপের কথা, আর ধনে-প্রাণে বানিয়ে ফেলি কথার কথা, ডায়ালেক্ট... বোতলে মিশিয়ে নিই ভদকা, নাম দিই ‘ম্যানকাইন্ড’, ব্রোনোউস্কি উঠে আসেন উচ্চমাধ্যমিক থেকে, পেটার বিকসেলসম নামকরণের মাহাত্ম্যে পুলিশের সামনে গলায় ফুয়েল ঢেলে বলে উঠি এই হল পৃথিবীর ‘টেকনোলজি ফর ম্যানকাইন্ড’... ‘বড়োভাই’ বলে ডাকি বাবাকে... নুঙ্কুকে বলি ‘ছোটোখোকা’... আর সোনাগাছির কাছে ট্যাক্সি দাঁড়ালে ডাকি ‘স্বজন’, ‘স্বজন’... কেননা ঠাকুরদা তারপর বাবা ক্যান্সার হয়ে মরে গেল, কাল বাদে পরশু আমারও হবে তাই মোড়ের দোকান থেকে ‘খেমোথেরাপি’ করাই... একখিলি খেমো পান একশো বিশ... স্লো-পয়সন... মৃত্যুর তাড়া নেই আমার... আবার তোমার সঙ্গে দেখা হলে ‘হ্যালো’ নয়, চেঁচিয়ে উঠব সাইকেল থেকে হাত নেড়ে ‘ওয় বাপি’ কি ‘ওয় বাবলু’... আমার লেক্সিকানে যার মানে --- ‘বন্ধু কী খবর বল, কতদিন দ্যাখা হয়নি’।