সুস্নাত চৌধুরী
ভোটের দিন তর্জনী উঁচিয়ে কথা বলা মানেই যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কিচাইন, এমনটা মোটেই নয়। ঠিকঠাক আঙুল তুললে নির্বাচন কমিশন বরং আপনাকে সাধুবাদই জানাবে। আপনার আঙুল, স্বাধীন গণতান্ত্রিক আঙুল। ভোটাধিকার প্রয়োগের সে একমাত্র প্রমাণ। ডাবল এক্সএল গণতন্ত্রের তুখোড় বিজ্ঞাপন। কারণ ততক্ষণে সেই তুলে ধরা আঙুল গৌরবের কালিমালিপ্ত। ওই একদিন কালি মাখার ব্যাপারে ফ্রম অম্বানি টু কামদুনি একই সারিতে। ভোটের লাইন। আর বাঁ হাতের তর্জনীতে জ্বলজ্বল ভোটের কালির টিপ।
এক চুটকি ‘কালি’ কি কিমত তুম কেয়া জানো রমেশ বাবু! সেদিনের নকশাল কিংবা আজকের মাওবাদীদের দিকে আঙুল তুলেই এমন প্রশ্ন আপনি করতে পারেন ভোটের দিন। নকশাল জমানার ইনারশিয়ায় দিনযাপন করা অনেকেই নাকি বলতেন --- ‘আমি কক্ষণও আঙুলে কালি মাখিনি’। যেসব বিপ্লব দাশগুপ্তদের নির্বাচনী রাজনীতিতে অবিশ্বাসের ভূতে পেয়েছে, ভবিষ্যত তাঁদের আর বুথে পায়নি। তাঁদের কাছে ভোটের কালি মানে কলঙ্ক। ওই অম্বানি থেকে কামদুনির আপামর ব্যান্ডের বাইরে এঁদের আদর্শগত অবস্থান। অবশ্য ভোটপুজোর এই পুণ্যতিথিতে কংরেজ-তিনোমূল-ছিপিএম ছেড়ে এমন অ-কালি দলের সমর্থক আর কতজনই বা! নইলে কি আর রাজধানী দিল্লির বুকে গত বছর এতটা সাড়া ফেলতে পারত ‘রক দ্য ভোট’ ক্যাম্পেন! জেন নেক্সটকে ভোট দেওয়ার জন্য চাগাতে এম টিভি’র পরিকল্পনা --- ভোটের পর ঝিনচ্যাক লাইভ কনসার্ট। সেই অনুষ্ঠানের গেটপাসটি ছিল খাসা --- কালিমাখা তর্জনী! নিজের নিজের আঙুল দেখিয়ে ভেতরে ঢোকা। আপনার আঙুলই আপনার পরিচয়। সেখানে এক চিলতে কালির দাগ মানেই... রকিং!
ভোটের কালি। পরিভাষায় ‘ইনডেলিবল ইঙ্ক’। অনপনেয় কালি। একটুকু ছোঁয়া লাগলেই হল, মুহূর্তে গেঁড়ে বসবে দাগ। তারপর বেশ ক’দিন নট নড়নচড়ন। ছাপ্পা ভোট রুখতে, একই ব্যক্তি যাতে একাধিকবার ভোট দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে মোক্ষম দাওয়াই। ফেয়ার ইলেকশনের জন্য ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনিবার্য পথ। চলতি লোকসভা ভোটেও তাই আমার-আপনার হাতে পড়ছে এই ফেয়ার অ্যান্ড আগলি অনপনেয় কালি।
কে বানায় ভোটের কালি
জেরক্স মেশিন থেকে ফাউন্টেন পেন, চাইনিজ ইঙ্ক থেকে ভুষি --- হরেক রকম কালি আপনি বাজারে পেতে পারেন, কিন্তু মাথা কুটে মরলেও ভোটের কালির দোয়াতটি জুটবে না। খোলা বাজারে এই কালি বিক্রিই হয় না। বরাত দিয়ে বানাতে হয়। বরাতজোর থাকলেও উপযুক্ত কার্যকারণ বা সরকারি শিলমোহর না দেখাতে পারলে সে কালি আদৌ আপনার হস্তগত হবে কিনা, বলা মুশকিল। এমনকী এই কালি বানানোর অথরিটিও রয়েছে গোটা দেশে মোটে দু’একটি সংস্থার হাতেই।
তার মধ্যে প্রধান মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড। সংক্ষেপে ‘এমপিভিএল’। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ভোটের কালি নির্মাতা। এবারের লোকসভা ভোটেও সারা দেশে কালি সাপ্লাই করেছে কর্নাটকের এই সংস্থাটিই। মাইসোরের এককোণে ষোলো একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই কারখানা। ১৯৩৭ সালে মাইসোরের রাজ পরিবারের আনুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংস্থা। তখন মাইসোরের মহারাজ চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওদইয়ার। শিল্পোদ্যোগী মানুষটি ঠিক করলেন, আশপাশের জঙ্গলকে কাজে লাগিয়ে বড়সড় আকারে মোম উৎপাদন করতে হবে। এককোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতার দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হল মাইসোর ল্যাক ফ্যাক্টরি। সেই মোম উৎপাদনের ট্র্যাডিশন আজও রয়েছে। ব্যালটে ভোট হলে, সেই ব্যালটবাক্স সিল করার সময়ও এই কারখানার মোমই ব্যবহার করা হত। আজও রোজ রাতে কারখানা বন্ধের সময় তালা দিয়ে সেই তালা নিজেদের বানানো মোমেই সিল করা হয়। ১৯৪৭ সালে কর্নাটক সরকার সংস্থাটিকে অধিগ্রহণ করে। পরিণত হয় পাবলিক সেক্টরে। শুরু হয় রং উৎপাদনও। সংস্থাটির নতুন নাম হয় মাইসোর ল্যাক অ্যান্ড পেন্টস লিমিটেড। ১৯৮৯ সালে আবার কিছু পরিবর্তন। তার পর থেকে মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড নামেই সংস্থাটি পরিচিত। বর্তমানে মোম ও নানা ধরনের রং ছাড়াও পালিশ, প্রাইমার, ডিস্টেম্পার, সিন্থটিক এনামেল ইত্যাদি তৈরি হয় এখানে। রীতিমতো লাভজনক একটি পাবলিক সেক্টর। নানাবিধ গবেষণা ও খাঁটি মালই এঁদের ইউএসপি। তবে আজও সংস্থাটি সবচেয়ে বেশি লাভ করে ভোটের কালি থেকেই।
১৯৬২ সালে দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রথম ব্যবহৃত হয় ভোটের কালি। সেই শুরু ইনডেলিবল ইঙ্ক প্রস্তুতি। তারপর দেশজুড়ে লোকসভা, বিধানসভা বা স্থানীয় নির্বাচনে নিরন্তর কালি জুগিয়ে আসা। দিন যত গড়িয়েছে, ভোটার তত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লাভও। গড়পড়তা একটা হিসেব বলছে, দেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ছশো কোটি ভোটারের হাতে দাগ ফেলেছে এই কালি। আর বিদেশেও এই সংস্থার কালি হাতে-মাখা ভোটারের সংখ্যাটা কম নয় --- চল্লিশ কোটি। হ্যাঁ, বহু দেশে ভোটের কালি রফতানি হয়েছে, হচ্ছেও, এই সংস্থা থেকে। নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক, কানাডা, মায় বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় এই কালি। কখনও আবার অনুদান হিসেবেও একেবারে গণতান্ত্রিক সৌজন্যে বিনি পয়সায় এই কালি দিয়েছে ভারত। তার ঠিকানা কখনও কম্বোডিয়া, কখনও আফ্রিকার লিসুটু।
লোকসভা ২০১৪
ক’দিন আগে পর্যন্তও নাওয়া-খাওয়ার সময় পাননি মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেডের দুই শতাধিক কর্মচারি। ওভার টাইম করে সামলাতে হচ্ছিল চলতি লোকসভা ভোটের জন্য কালি তৈরির কাজ। এক দফায় এত কালি এর আগে কখনও লাগেনি। দেশে এবার মোট ভোটার একাশি কোটিরও বেশি। ওয়েস্টেজ ধরে অর্ডার ছিল প্রায় বাইশ লক্ষ কৌটো কালির। দশ মিলিলিটারের একটি পাত্রের দাম দেড়শো টাকার কাছাকাছি --- মানে, প্রায় একত্রিশ কোটি টাকার বিক্রি।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে লেগেছিল প্রায় বিশ লাখ কৌটো কালি। কৌটোগুলি ছিল এবারের মতোই দশ এমএল-এর। কিন্তু ২০০৪ সালে কালির বরাত ছিল অনেক কম। পাঁচ মিলিলিটারের ছোটো কৌটো সেবার গিয়েছিল ১৭ লাখ মাত্র। শুধু ক্রমবর্ধমান ভোটারের সংখ্যা নয়, এই হিসেব আসলে নির্ভর করে কালি লাগানোর পদ্ধতির উপর। ২০১৪-র এই লোকসভায় দশ এমএল-এর একটি কৌটো খুললে গড়ে পাঁচশো জনের হাতে কালির দাগ পড়বে বড়জোর। কিন্তু আট-ন বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না। মনে করে দেখুন, তখন ভোট দিলে তর্জনীর নখ আর ত্বকের সন্ধিস্থলে একটি আড়াআড়ি দাগ পড়ত। আর এখন পড়ে লম্বা একটি দাগ, তর্জনীর প্রথম গাঁটটির আগের চামড়া থেকে নখের উপরিভাগ পর্যন্ত। স্বভাবতই কালি লাগে বেশি। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন এই নতুন নিয়ম চালু করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯-এ কালির প্রয়োজনও তাই এক লাফে এতটা বেড়ে যায়। শুধু সময়ের সঙ্গেই নয়, রাষ্ট্রভেদেও এই হিসেব বদলায়। কারণ কালি লাগানোর পদ্ধতি একেক দেশে একেক রকম। যেমন, ভারতে কালি লাগানো হয় কাঠি জাতীয় কোনও বস্তুর সাহায্যে, আবার আফগানিস্তানেই ভোটের কালি লাগানো হয় মার্কার পেন দিয়ে। এতে কালি খরচ হয় কম। কম্বোডিয়া বা মালদ্বীপে গোটা তর্জনীর উপরিভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয় কালিতে। আফ্রিকার কোনও কোনও দেশ যেমন বুরকিনা বা বুরুন্ডিতে ভোটের কালি লাগাতে ব্যবহৃত হয় ব্রাশ। তুরস্কে নজ্ল থেকে কালির ফোঁটা ফেলা হয় আঙুলে।
কালির কেমিস্ট্রি
কী থাকে ভোটের কালিতে? কেন তা কিছুতেই মোছে না? গোটাটাই রসায়নের খেলা। কিন্তু ধাঁ করে পুরো ইকুয়েশনটা বলে ফেলা সম্ভব নয়! ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরি এই সিক্রেট ফরমুলা তুলে দেয় মাইসোরের ওই কালি নির্মাণকারী সংস্থার হাতে। আজও তা গোপনই রয়েছে। দু-একজন বাদে সংস্থার কর্মীরাও পুরোপুরি জানেন না, আসলে ঠিক কী করে তৈরি হয় এই কালি। তবে, সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই কালি আসলে রুপোর এক রাসায়নির পদার্থ (সিলভার নাইট্রেট বা AgNO3) আর পাতিত জলের মিক্সচার। সঙ্গে কিছুটা অ্যালকোহল, যাতে চট করে শুকিয়ে যায় কালিটি। আর থাকে বিশেষ কিছু রং। এখন এই সিলভার নাইট্রেটই হচ্ছে আসল মক্কেল! চামড়ার প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সে ফেলে বিশেষ এক প্রকার অধঃক্ষেপ, যা এক্কেবারে সেঁটে যায় চামড়ার সঙ্গে। সিলভার নাইট্রেটের আধিক্য যত বেশি থাকবে, তত টেঁকসই হবে কালি। আমাদের দেশে সচরাচর আঠেরো শতাংশের কাছাকাছি থাকে সিলভার নাইট্রেটের ঘনত্ব, তাতে হপ্তা তিনেকের জন্য নিশ্চিন্তি! আর, কালি লাগানোর পর এক ছটাক অতিবেগুনি রশ্মি যদি তার উপর পড়ে, তবে তো রুপোয় সোহাগা! বেগুনি কালি রং বদলে কালচে-বাদামি হয়ে আরও চিপকে বসে আঙুলে।
তবে ভোটের কালির রংবাজি যে শুধু বেগুনিতেই, তা নয়। রেয়ার হলেও, অন্য রঙের ভোটের কালিও দেখা যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার সুরিনেম দেশটিতে এই কালির রং কমলা। ভোটারদের আকর্ষণ করতে একদা ডাচ কলোনি সুরিনেমের জাতীয় রঙের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই এই রং বদল।
মোছে না সে মোছে না
ভোট দিয়ে বেরিয়েই আঙুল থেকে কালির দাগটি ভ্যানিশ করে দেওয়া যায় কিনা জাদুকর সরকার জানেন না, কিন্তু শরদ পাওয়ার জানেন। নইলে কেন আর খুলে আম সমর্থকদের কালি মুছে বারবার ভোট দিতে বলে কমিশনের শো-কজ খাবেন! আসলে স্যাট করে ভোটের কালি তুলে ফেলাটা একটা মিথের মতো। কোনও কেমিস্ট্রি বইতে লিখবে না, কোনও প্রাইভেট টিউটর বুঝিয়ে দেবে না, মায় ইন্টারনেটও উপরচালাকির ভ্যান্তাড়া কষবে --- শুধু মাতব্বরের মতো ঠোঁট বেঁকিয়ে হাফ-ক্যাডার বন্ধুরা চিরকাল বলে আসবে --- হয়, হয়, জানতি পারো না! ভাবখানা এমন --- জানি বিলক্ষণ, কিন্তু তোমায় বলা চলে না কাকা! কেবল নিষিদ্ধ মন্ত্রের মতো ভোটের বাতাসে ফিসফিস ঘুরে বেড়াবে কাল্পনিক সব টোটকা। কেউ বলবে, পাতি টুথপেস্ট লাগিয়ে পনেরো মিনিট রাখতে হয়, তারপর দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আলতো ঘষলেই রং হাওয়া। অথবা, খানিক দুব্বো ঘাস তুলে তার রসটুকু লাগাতে হবে, তাতেই নাকি কালির জারিজুরি শেষ! কেউ বা আরও ক্রিয়েটিভ, তাদের টোটকা কখনও পেঁপে গাছের দুধ-রস, কখনও ব্লিচিং পাওডার আর ফিনাইলের মিক্সচার! কেউ আবার ভেবেচিন্তে জানাবে, এ তো সিম্পল, এক টুকরো সিরিষ কাগজ নিয়ে বার কয়েক ঘষলেই হল! কেউ বাতলাবে প্রকৃতই সৃজনশীল উপায় --- দেশলাই কাঠি জলে ভিজিয়ে শুধু তার বারুদটুকু কালির উপর ঘষতে হবে একশো আটবার। সর্বজ্ঞের ভাবখানি দেখিয়ে কেউ বলবে, আরও আগে থেকে নাকি মাঠে নামতে হয়! মানে, ভোট দিতে যাওয়ার আগেই হাতে স্বচ্ছ নেলপালিশ বা গঁদের আঠা লাগিয়ে নিতে হবে। তাতে একটা আস্তরণ পড়ে যাবে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। তারপর ভোট দিয়ে বেরিয়ে নেলপালিশ রিমুভার দিয়ে বা এমনিই ঘষে-ঘষে তুলে ফেললেই হল। ব্যস, হাত ধুয়ে, আবার দাঁড়িয়ে যাও! তবে, রাসায়নিক ও রাজনৈতিক এসব আনফেয়ারি টেলের মোরালে ঘাপটি মেরে থাকে দু’টি জিনিস। এক : সাংবিধানিক অপরাধ। দুই : আঙুলের দফারফা।
হাতকাটা কার্তিক
ভাগ্যিস পেটো বাঁধতে গিয়ে ফুটো মস্তান কার্তিকের বাঁ হাতটি ওড়েনি, নইলে ভোট দেওয়ার আগে অহেতুক টেনশন পোহাতে হত হাতকাটা কার্তিককে। বাঁ হাতই যদি না থাকে, তাহলে কোথায় আর বাঁ হাতের তর্জনী, কোথায়ই বা ভোটের কালির দাগ! আজ্ঞে না, এসব ক্ষেত্রেও স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কারো বাঁ হাতে তর্জনী না থাকলে, কালি লাগাতে হবে বাঁ হাতেরই অন্য কোনও আঙুলে। বাঁ হাতে যদি কোনও আঙুলই না থাকে, তাহলে ডান হাতের তর্জনী। সেটিও যদি না থাকে, তবে বাছতে হবে ডান হাতের মধ্যমা থেকে শুরু করে অন্য কোনও আঙুল। সে গুড়েও বালি হলে, মানে, ভোটারের কোনও হাতেই যদি আঙুল না থাকে, তাহলে দু’টি হাতই যেভাবে আছে, সেখানেই ভালো করে মাখাতে হবে ভোটের কালি।
বিতর্কিত কালি
ভোটের কালি চট করেই উঠে যাচ্ছে --- এমন অভিযোগ মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান কি কম্বোডিয়ায় অনেকবার শোনা গিয়েছে। কখনও এর কারণ হয়েছে ভুলবশত কালি বদলে যাওয়া, কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে কালিতে ভেজাল দেওয়া। এসব চিরাচরিত বিতর্কের বাইরে ভোটের কালি নিয়ে আরও নানা বিচিত্র প্রশ্নও কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে। এবারই অন্ধ্রপ্রদেশে ৩০ মার্চ থেকে ৭ মের মধ্যে অনেকগুলি ভোট হচ্ছে। ৩০ মার্চ ১৫৬টি জায়গায় পুরভোট হয়েছে, মাঝে পঞ্চায়েত ভোট, আবার ৩০ এপ্রিল ও ৭ মে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর নির্বাচন পড়ায় অনেকেই ঘোর দুশ্চিন্তায় --- লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের আগে যদি পুর বা পঞ্চায়েত ভোটের কালি আঙুল থেকে না ওঠে, তাহলে কী হবে? আবার ২০০৮-এ মালয়েশিয়ায় ইলডেলিবল ইঙ্ক চালু করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেও, নির্বাচনের চারদিন আগে তা বাতিল করতে হয়। কারণ, শেষবেলায় চোখে পড়ে, তখনও সেদেশের সংবিধানে এই আইনটিই হয়নি যে, কারো হাতে ভোটের কালি থাকলে সে আর ভোট দিতে পারবে না! আবার জিম্বাবোয়েতে দেখা গিয়েছে, ভোটের পরে কারো হাতে কালির দাগ না থাকলে, মিলিটারিই অত্যাচার চালিয়েছে। ভোট দাওনি কি মরেছো, সিধে কথা! বাংলাদেশে দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর নাকি উলটো ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের হাতে কালির দাগ রয়েছে, তাঁদের উপরই চলেছে নির্যাতন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ছত্তীশগড়ের বহু মানুষই যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, ভোটের পর তাঁদের আঙুলে যাতে কালি না লাগানো হয়। কারণ মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে তাঁরা যে সাড়া দেননি, তা বোঝা গেলে তো কপালে ঢের দুঃখ!
হাতে রইল ভোটের কালি তার চেয়ে, সকাল সকাল ভোট দিন। আপনি পাতি ভোটার, প্রতিশ্রুতি মাফিক ভোটের পর আর কিছু পান না-পান, দু’তিন সপ্তাহের জন্য কালির গ্ল্যামারটুকু আপনার আঙুলে অ্যাসিওর্ড। ভবিষ্যতে বায়োমেট্রিকের থ্রেট আছে বটে, আধার কার্ড একদিন আঁধারে ঠেলে দিতেই পারে ভোটের কালিকে, কিন্তু সে ঢের দেরি। তার আগে আপনি দিনভর, সপ্তাহভর, ভেজাল না থাকলে মাসভর গণতন্ত্রের স্মৃতি রোমন্থন করুন। দেখুন, দেখান। আপনি কক্ষণও ভাববেন না যে গণতন্ত্র আপনাকে প্রতারক ভেবেছে, কক্ষণও ভাববেন না যে আপনি ফের এসে ভোট দিতে পারেন সন্দেহ করে আপনার আঙুলে গণতন্ত্র কালি মাখিয়েছে। সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের দোহাই দিয়ে আপনি ঘুণাক্ষরেও গুনগুন করবেন না শ্যামাসঙ্গীত --- ও মা কালী, চিরকালই সঙ সাজালি এ সংসারে! কালির দিব্যি খেয়ে আপনি কেবল ভাববেন সেই বছর চারেকের ডেঁপো ছোঁড়াটির গপ্পো। মায়ের কোল থেকেই যে হেবি রেলায় চেঁচাচ্ছিল, ‘এইযো... আমি ভোট দিয়েছি’! তার কচি হাতে তখন ইনডেলিবল ইঙ্ক। পিছনে পালস পোলিও-র ব্যানার।
ভোটের কালি। পরিভাষায় ‘ইনডেলিবল ইঙ্ক’। অনপনেয় কালি। একটুকু ছোঁয়া লাগলেই হল, মুহূর্তে গেঁড়ে বসবে দাগ। তারপর বেশ ক’দিন নট নড়নচড়ন। ছাপ্পা ভোট রুখতে, একই ব্যক্তি যাতে একাধিকবার ভোট দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে মোক্ষম দাওয়াই। ফেয়ার ইলেকশনের জন্য ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনিবার্য পথ। চলতি লোকসভা ভোটেও তাই আমার-আপনার হাতে পড়ছে এই ফেয়ার অ্যান্ড আগলি অনপনেয় কালি।
কে বানায় ভোটের কালি
জেরক্স মেশিন থেকে ফাউন্টেন পেন, চাইনিজ ইঙ্ক থেকে ভুষি --- হরেক রকম কালি আপনি বাজারে পেতে পারেন, কিন্তু মাথা কুটে মরলেও ভোটের কালির দোয়াতটি জুটবে না। খোলা বাজারে এই কালি বিক্রিই হয় না। বরাত দিয়ে বানাতে হয়। বরাতজোর থাকলেও উপযুক্ত কার্যকারণ বা সরকারি শিলমোহর না দেখাতে পারলে সে কালি আদৌ আপনার হস্তগত হবে কিনা, বলা মুশকিল। এমনকী এই কালি বানানোর অথরিটিও রয়েছে গোটা দেশে মোটে দু’একটি সংস্থার হাতেই।
তার মধ্যে প্রধান মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড। সংক্ষেপে ‘এমপিভিএল’। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ভোটের কালি নির্মাতা। এবারের লোকসভা ভোটেও সারা দেশে কালি সাপ্লাই করেছে কর্নাটকের এই সংস্থাটিই। মাইসোরের এককোণে ষোলো একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই কারখানা। ১৯৩৭ সালে মাইসোরের রাজ পরিবারের আনুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংস্থা। তখন মাইসোরের মহারাজ চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওদইয়ার। শিল্পোদ্যোগী মানুষটি ঠিক করলেন, আশপাশের জঙ্গলকে কাজে লাগিয়ে বড়সড় আকারে মোম উৎপাদন করতে হবে। এককোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতার দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হল মাইসোর ল্যাক ফ্যাক্টরি। সেই মোম উৎপাদনের ট্র্যাডিশন আজও রয়েছে। ব্যালটে ভোট হলে, সেই ব্যালটবাক্স সিল করার সময়ও এই কারখানার মোমই ব্যবহার করা হত। আজও রোজ রাতে কারখানা বন্ধের সময় তালা দিয়ে সেই তালা নিজেদের বানানো মোমেই সিল করা হয়। ১৯৪৭ সালে কর্নাটক সরকার সংস্থাটিকে অধিগ্রহণ করে। পরিণত হয় পাবলিক সেক্টরে। শুরু হয় রং উৎপাদনও। সংস্থাটির নতুন নাম হয় মাইসোর ল্যাক অ্যান্ড পেন্টস লিমিটেড। ১৯৮৯ সালে আবার কিছু পরিবর্তন। তার পর থেকে মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড নামেই সংস্থাটি পরিচিত। বর্তমানে মোম ও নানা ধরনের রং ছাড়াও পালিশ, প্রাইমার, ডিস্টেম্পার, সিন্থটিক এনামেল ইত্যাদি তৈরি হয় এখানে। রীতিমতো লাভজনক একটি পাবলিক সেক্টর। নানাবিধ গবেষণা ও খাঁটি মালই এঁদের ইউএসপি। তবে আজও সংস্থাটি সবচেয়ে বেশি লাভ করে ভোটের কালি থেকেই।
১৯৬২ সালে দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রথম ব্যবহৃত হয় ভোটের কালি। সেই শুরু ইনডেলিবল ইঙ্ক প্রস্তুতি। তারপর দেশজুড়ে লোকসভা, বিধানসভা বা স্থানীয় নির্বাচনে নিরন্তর কালি জুগিয়ে আসা। দিন যত গড়িয়েছে, ভোটার তত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লাভও। গড়পড়তা একটা হিসেব বলছে, দেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ছশো কোটি ভোটারের হাতে দাগ ফেলেছে এই কালি। আর বিদেশেও এই সংস্থার কালি হাতে-মাখা ভোটারের সংখ্যাটা কম নয় --- চল্লিশ কোটি। হ্যাঁ, বহু দেশে ভোটের কালি রফতানি হয়েছে, হচ্ছেও, এই সংস্থা থেকে। নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক, কানাডা, মায় বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় এই কালি। কখনও আবার অনুদান হিসেবেও একেবারে গণতান্ত্রিক সৌজন্যে বিনি পয়সায় এই কালি দিয়েছে ভারত। তার ঠিকানা কখনও কম্বোডিয়া, কখনও আফ্রিকার লিসুটু।
লোকসভা ২০১৪
ক’দিন আগে পর্যন্তও নাওয়া-খাওয়ার সময় পাননি মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেডের দুই শতাধিক কর্মচারি। ওভার টাইম করে সামলাতে হচ্ছিল চলতি লোকসভা ভোটের জন্য কালি তৈরির কাজ। এক দফায় এত কালি এর আগে কখনও লাগেনি। দেশে এবার মোট ভোটার একাশি কোটিরও বেশি। ওয়েস্টেজ ধরে অর্ডার ছিল প্রায় বাইশ লক্ষ কৌটো কালির। দশ মিলিলিটারের একটি পাত্রের দাম দেড়শো টাকার কাছাকাছি --- মানে, প্রায় একত্রিশ কোটি টাকার বিক্রি।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে লেগেছিল প্রায় বিশ লাখ কৌটো কালি। কৌটোগুলি ছিল এবারের মতোই দশ এমএল-এর। কিন্তু ২০০৪ সালে কালির বরাত ছিল অনেক কম। পাঁচ মিলিলিটারের ছোটো কৌটো সেবার গিয়েছিল ১৭ লাখ মাত্র। শুধু ক্রমবর্ধমান ভোটারের সংখ্যা নয়, এই হিসেব আসলে নির্ভর করে কালি লাগানোর পদ্ধতির উপর। ২০১৪-র এই লোকসভায় দশ এমএল-এর একটি কৌটো খুললে গড়ে পাঁচশো জনের হাতে কালির দাগ পড়বে বড়জোর। কিন্তু আট-ন বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না। মনে করে দেখুন, তখন ভোট দিলে তর্জনীর নখ আর ত্বকের সন্ধিস্থলে একটি আড়াআড়ি দাগ পড়ত। আর এখন পড়ে লম্বা একটি দাগ, তর্জনীর প্রথম গাঁটটির আগের চামড়া থেকে নখের উপরিভাগ পর্যন্ত। স্বভাবতই কালি লাগে বেশি। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন এই নতুন নিয়ম চালু করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯-এ কালির প্রয়োজনও তাই এক লাফে এতটা বেড়ে যায়। শুধু সময়ের সঙ্গেই নয়, রাষ্ট্রভেদেও এই হিসেব বদলায়। কারণ কালি লাগানোর পদ্ধতি একেক দেশে একেক রকম। যেমন, ভারতে কালি লাগানো হয় কাঠি জাতীয় কোনও বস্তুর সাহায্যে, আবার আফগানিস্তানেই ভোটের কালি লাগানো হয় মার্কার পেন দিয়ে। এতে কালি খরচ হয় কম। কম্বোডিয়া বা মালদ্বীপে গোটা তর্জনীর উপরিভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয় কালিতে। আফ্রিকার কোনও কোনও দেশ যেমন বুরকিনা বা বুরুন্ডিতে ভোটের কালি লাগাতে ব্যবহৃত হয় ব্রাশ। তুরস্কে নজ্ল থেকে কালির ফোঁটা ফেলা হয় আঙুলে।
কালির কেমিস্ট্রি
কী থাকে ভোটের কালিতে? কেন তা কিছুতেই মোছে না? গোটাটাই রসায়নের খেলা। কিন্তু ধাঁ করে পুরো ইকুয়েশনটা বলে ফেলা সম্ভব নয়! ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরি এই সিক্রেট ফরমুলা তুলে দেয় মাইসোরের ওই কালি নির্মাণকারী সংস্থার হাতে। আজও তা গোপনই রয়েছে। দু-একজন বাদে সংস্থার কর্মীরাও পুরোপুরি জানেন না, আসলে ঠিক কী করে তৈরি হয় এই কালি। তবে, সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই কালি আসলে রুপোর এক রাসায়নির পদার্থ (সিলভার নাইট্রেট বা AgNO3) আর পাতিত জলের মিক্সচার। সঙ্গে কিছুটা অ্যালকোহল, যাতে চট করে শুকিয়ে যায় কালিটি। আর থাকে বিশেষ কিছু রং। এখন এই সিলভার নাইট্রেটই হচ্ছে আসল মক্কেল! চামড়ার প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সে ফেলে বিশেষ এক প্রকার অধঃক্ষেপ, যা এক্কেবারে সেঁটে যায় চামড়ার সঙ্গে। সিলভার নাইট্রেটের আধিক্য যত বেশি থাকবে, তত টেঁকসই হবে কালি। আমাদের দেশে সচরাচর আঠেরো শতাংশের কাছাকাছি থাকে সিলভার নাইট্রেটের ঘনত্ব, তাতে হপ্তা তিনেকের জন্য নিশ্চিন্তি! আর, কালি লাগানোর পর এক ছটাক অতিবেগুনি রশ্মি যদি তার উপর পড়ে, তবে তো রুপোয় সোহাগা! বেগুনি কালি রং বদলে কালচে-বাদামি হয়ে আরও চিপকে বসে আঙুলে।
তবে ভোটের কালির রংবাজি যে শুধু বেগুনিতেই, তা নয়। রেয়ার হলেও, অন্য রঙের ভোটের কালিও দেখা যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার সুরিনেম দেশটিতে এই কালির রং কমলা। ভোটারদের আকর্ষণ করতে একদা ডাচ কলোনি সুরিনেমের জাতীয় রঙের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই এই রং বদল।
মোছে না সে মোছে না
ভোট দিয়ে বেরিয়েই আঙুল থেকে কালির দাগটি ভ্যানিশ করে দেওয়া যায় কিনা জাদুকর সরকার জানেন না, কিন্তু শরদ পাওয়ার জানেন। নইলে কেন আর খুলে আম সমর্থকদের কালি মুছে বারবার ভোট দিতে বলে কমিশনের শো-কজ খাবেন! আসলে স্যাট করে ভোটের কালি তুলে ফেলাটা একটা মিথের মতো। কোনও কেমিস্ট্রি বইতে লিখবে না, কোনও প্রাইভেট টিউটর বুঝিয়ে দেবে না, মায় ইন্টারনেটও উপরচালাকির ভ্যান্তাড়া কষবে --- শুধু মাতব্বরের মতো ঠোঁট বেঁকিয়ে হাফ-ক্যাডার বন্ধুরা চিরকাল বলে আসবে --- হয়, হয়, জানতি পারো না! ভাবখানা এমন --- জানি বিলক্ষণ, কিন্তু তোমায় বলা চলে না কাকা! কেবল নিষিদ্ধ মন্ত্রের মতো ভোটের বাতাসে ফিসফিস ঘুরে বেড়াবে কাল্পনিক সব টোটকা। কেউ বলবে, পাতি টুথপেস্ট লাগিয়ে পনেরো মিনিট রাখতে হয়, তারপর দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আলতো ঘষলেই রং হাওয়া। অথবা, খানিক দুব্বো ঘাস তুলে তার রসটুকু লাগাতে হবে, তাতেই নাকি কালির জারিজুরি শেষ! কেউ বা আরও ক্রিয়েটিভ, তাদের টোটকা কখনও পেঁপে গাছের দুধ-রস, কখনও ব্লিচিং পাওডার আর ফিনাইলের মিক্সচার! কেউ আবার ভেবেচিন্তে জানাবে, এ তো সিম্পল, এক টুকরো সিরিষ কাগজ নিয়ে বার কয়েক ঘষলেই হল! কেউ বাতলাবে প্রকৃতই সৃজনশীল উপায় --- দেশলাই কাঠি জলে ভিজিয়ে শুধু তার বারুদটুকু কালির উপর ঘষতে হবে একশো আটবার। সর্বজ্ঞের ভাবখানি দেখিয়ে কেউ বলবে, আরও আগে থেকে নাকি মাঠে নামতে হয়! মানে, ভোট দিতে যাওয়ার আগেই হাতে স্বচ্ছ নেলপালিশ বা গঁদের আঠা লাগিয়ে নিতে হবে। তাতে একটা আস্তরণ পড়ে যাবে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। তারপর ভোট দিয়ে বেরিয়ে নেলপালিশ রিমুভার দিয়ে বা এমনিই ঘষে-ঘষে তুলে ফেললেই হল। ব্যস, হাত ধুয়ে, আবার দাঁড়িয়ে যাও! তবে, রাসায়নিক ও রাজনৈতিক এসব আনফেয়ারি টেলের মোরালে ঘাপটি মেরে থাকে দু’টি জিনিস। এক : সাংবিধানিক অপরাধ। দুই : আঙুলের দফারফা।
হাতকাটা কার্তিক
ভাগ্যিস পেটো বাঁধতে গিয়ে ফুটো মস্তান কার্তিকের বাঁ হাতটি ওড়েনি, নইলে ভোট দেওয়ার আগে অহেতুক টেনশন পোহাতে হত হাতকাটা কার্তিককে। বাঁ হাতই যদি না থাকে, তাহলে কোথায় আর বাঁ হাতের তর্জনী, কোথায়ই বা ভোটের কালির দাগ! আজ্ঞে না, এসব ক্ষেত্রেও স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কারো বাঁ হাতে তর্জনী না থাকলে, কালি লাগাতে হবে বাঁ হাতেরই অন্য কোনও আঙুলে। বাঁ হাতে যদি কোনও আঙুলই না থাকে, তাহলে ডান হাতের তর্জনী। সেটিও যদি না থাকে, তবে বাছতে হবে ডান হাতের মধ্যমা থেকে শুরু করে অন্য কোনও আঙুল। সে গুড়েও বালি হলে, মানে, ভোটারের কোনও হাতেই যদি আঙুল না থাকে, তাহলে দু’টি হাতই যেভাবে আছে, সেখানেই ভালো করে মাখাতে হবে ভোটের কালি।
বিতর্কিত কালি
ভোটের কালি চট করেই উঠে যাচ্ছে --- এমন অভিযোগ মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান কি কম্বোডিয়ায় অনেকবার শোনা গিয়েছে। কখনও এর কারণ হয়েছে ভুলবশত কালি বদলে যাওয়া, কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে কালিতে ভেজাল দেওয়া। এসব চিরাচরিত বিতর্কের বাইরে ভোটের কালি নিয়ে আরও নানা বিচিত্র প্রশ্নও কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে। এবারই অন্ধ্রপ্রদেশে ৩০ মার্চ থেকে ৭ মের মধ্যে অনেকগুলি ভোট হচ্ছে। ৩০ মার্চ ১৫৬টি জায়গায় পুরভোট হয়েছে, মাঝে পঞ্চায়েত ভোট, আবার ৩০ এপ্রিল ও ৭ মে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর নির্বাচন পড়ায় অনেকেই ঘোর দুশ্চিন্তায় --- লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের আগে যদি পুর বা পঞ্চায়েত ভোটের কালি আঙুল থেকে না ওঠে, তাহলে কী হবে? আবার ২০০৮-এ মালয়েশিয়ায় ইলডেলিবল ইঙ্ক চালু করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেও, নির্বাচনের চারদিন আগে তা বাতিল করতে হয়। কারণ, শেষবেলায় চোখে পড়ে, তখনও সেদেশের সংবিধানে এই আইনটিই হয়নি যে, কারো হাতে ভোটের কালি থাকলে সে আর ভোট দিতে পারবে না! আবার জিম্বাবোয়েতে দেখা গিয়েছে, ভোটের পরে কারো হাতে কালির দাগ না থাকলে, মিলিটারিই অত্যাচার চালিয়েছে। ভোট দাওনি কি মরেছো, সিধে কথা! বাংলাদেশে দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর নাকি উলটো ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের হাতে কালির দাগ রয়েছে, তাঁদের উপরই চলেছে নির্যাতন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ছত্তীশগড়ের বহু মানুষই যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, ভোটের পর তাঁদের আঙুলে যাতে কালি না লাগানো হয়। কারণ মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে তাঁরা যে সাড়া দেননি, তা বোঝা গেলে তো কপালে ঢের দুঃখ!
হাতে রইল ভোটের কালি তার চেয়ে, সকাল সকাল ভোট দিন। আপনি পাতি ভোটার, প্রতিশ্রুতি মাফিক ভোটের পর আর কিছু পান না-পান, দু’তিন সপ্তাহের জন্য কালির গ্ল্যামারটুকু আপনার আঙুলে অ্যাসিওর্ড। ভবিষ্যতে বায়োমেট্রিকের থ্রেট আছে বটে, আধার কার্ড একদিন আঁধারে ঠেলে দিতেই পারে ভোটের কালিকে, কিন্তু সে ঢের দেরি। তার আগে আপনি দিনভর, সপ্তাহভর, ভেজাল না থাকলে মাসভর গণতন্ত্রের স্মৃতি রোমন্থন করুন। দেখুন, দেখান। আপনি কক্ষণও ভাববেন না যে গণতন্ত্র আপনাকে প্রতারক ভেবেছে, কক্ষণও ভাববেন না যে আপনি ফের এসে ভোট দিতে পারেন সন্দেহ করে আপনার আঙুলে গণতন্ত্র কালি মাখিয়েছে। সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের দোহাই দিয়ে আপনি ঘুণাক্ষরেও গুনগুন করবেন না শ্যামাসঙ্গীত --- ও মা কালী, চিরকালই সঙ সাজালি এ সংসারে! কালির দিব্যি খেয়ে আপনি কেবল ভাববেন সেই বছর চারেকের ডেঁপো ছোঁড়াটির গপ্পো। মায়ের কোল থেকেই যে হেবি রেলায় চেঁচাচ্ছিল, ‘এইযো... আমি ভোট দিয়েছি’! তার কচি হাতে তখন ইনডেলিবল ইঙ্ক। পিছনে পালস পোলিও-র ব্যানার।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে ২০১৪
Casinos in the UK - How to find good games - GrizzGo
ReplyDeleteSo, what do we mean novcasino by “casinos febcasino.com in the UK”? gri-go.com to find a casino and live 1xbet 먹튀 casino games on nba매니아 a mobile phone device in 2021.