28 September 2014

বসন পরো মা

সুস্নাত চৌধুরী


প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন কয়েকজন উলঙ্গ মেয়েমানুষ। শরীরে তখন সুতোটি পর্যন্ত নেই। না, মনোরমা দেবীর ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল মণিপুরের কথা বলছি না। এ আমাদের শহর কলকাতা আর তার আশপাশের ছবি। কোনও মারাত্মক ইস্যুতে প্রতিবাদ-টতিবাদও নয়। যাঁরা দাঁড়িয়ে, তাঁরা ভিখিরি-পাগলি জাতীয় রুগ্ন, খেতে-পরতে না পাওয়া কোনও সাপলুডো খেলোয়াড়ও নন। বরং ভরাযৌবনা। মাপা ফিগার।
এ দৃশ্য প্রতিবছর আমরা দেখি। দেখে, আরও দেখতে দেখতে রাস্তা দিয়ে হাঁটি। আমাদেরই ঘরের উমা, সম্পূর্ণ নগ্ন, তার উপর এসে পড়ছে সূর্যের আলো। সঙ্গে শত-শত পুরুষ মানুষের দৃষ্টি। মহিলারাও কি তাকান না, কেউ হয়তো আড়চোখে, একটু অস্বস্তি নিয়েই? দুর্গাপুজোর মাসখানেক আগে থেকেই এ আমাদের রোজকার অভিজ্ঞতা। পটুয়ার ঘরের আশপাশে ফুটপাত জুড়ে সারিবদ্ধ মাতৃমূর্তি। কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দেওয়া সারা। দেহের প্রতিটা ডিটেলিং নিখুঁত। নিটোল স্তন। সুস্পষ্ট স্তনবৃন্ত। গভীর নাভি। অমলিন ত্রিবলী। সুঠাম উরু। সব মিলে তাক লাগিয়ে দেওয়া শিল্পকর্ম! তবু, দেবী দুর্গার এই নগ্নমূর্তি কোথাও কি আমাদের অতিভক্তি আর আচারের দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন জাগায় না?
আমরা দেখেছি, বোধনের আগে পর্যন্ত মায়ের শ্রীমুখখানি ঢাকা থাকতে। হয় আনখশির টানা পর্দা, নয়তো নিদেনপক্ষে মুখটুকু কাপড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া। নইলে হয়তো ঘামতেলে নোংরা টেনে নেবে। কিংবা এ হয়তো প্রকাশিত হওয়ার আনুষ্ঠানিক আচার। অথবা নিছক একটা চমকের অপেক্ষাকে শেষপর্যন্ত জিইয়ে রাখা। কেমন হয়েছে এবারে মায়ের মুখটা? প্রশ্নটা গুনগুন করে দানা বেঁধে ওঠে, ঠেকে-ঠেকে নানা গুজব রটতে থাকে। উত্তরটা মহারানি ভিক্টোরিয়াও হতে পারে কিংবা শ্রীদেবী! অথবা গতবারের মতোই, চিরাচরিত। কিন্তু ষষ্ঠীর আগে এটুকু চর্মচক্ষে মিলিয়ে নিতে গেলেই পাপ! ঠিক যেন ছাঁতনাতলায় নববধূ, শুভদৃষ্টির লগ্নে মুখের সামনে পানপাতার আবরণ। এ সময় পাড়ার রক থেকে যদি রোমিওকণ্ঠে বাঁকা আওয়াজ ভেসে আসে --- ‘বাওয়া, এদের তো তিন বছরের সম্পক্কো, পাক্কা দু’বছরের অ্যাফেয়ার, আর শেষ ছ’মাসের অত্ত ফস্টিনষ্টি --- বডি-ফডি চিনে গেলে, একন লোকদ্যাকানো মুক ঢাকার আদিখ্যেতা কেন বাপু!’ তখন?
এভাবে ভাবলে কি ঠাকুর পাপ দেয়? দেয় নিশ্চয়ই, নইলে সমাজের জ্যাঠামশয়রা এসব শুনলেই রে-রে করে উঠবেন কেন! ‘ছিঃ ছিঃ, কী অলুক্ষুণে কথা! কী নোংরা মেন্টালিটি! স্বয়ং মা দুগ্গাকে নিয়েও এমন অশ্লীল শরীরী ইঙ্গিত! যত্তসব পারভার্ট…’। আবার নাস্তিক হাফ-আঁতেল হলে গম্ভীর হেসে বলবেন --- ‘নাবালক! একটা মাটির পুতুল নিয়ে এত কথা জাস্ট ননসেন্স!’ মোদ্দা ব্যাপার হল, এই ল্যাংটো নারীমূর্তি, তা তিনি মৃন্ময়ীই হোন বা চিন্ময়ী --- ভদ্রমহিলা এই এখন, পুজোর মুখে, আমাদের রাজপথে অলিতে গলিতে যেভাবে আছেন, যেখানে আছেন, তাতে আমাদের বড় একটা হেলদোল নেই। তাঁর জন্য হাতে গোনা পাঁচদিনের লাখ টাকা বাজেটে প্যান্ডেল আছে, ঝক্কাস লাইটিং আছে, বক্স-ফাটা ঝিনচ্যাক গান আছে --- শুধু তাঁর প্রাক-পুজো শালীনতা রক্ষার কনসেপ্টটুকু নেই।
ঠিক এগারো বছর আগে, ২০০৩ সালে, দুর্গাপুজোর মুখে কানাডার শতাব্দীপ্রাচীন দৈনিক ‘টরোন্টো স্টার’-এ ছাপা হয়েছিল ভারতীয় এই দেবীর উপর একটি প্রতিবেদন। সঙ্গে ছবি --- দশভুজার প্রতিমা নির্মাণ করছেন এক মৃৎশিল্পী। একেবারেই আমাদের চেনা দৃশ্য। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজ প্রায় শেষের পথে। কিন্তু, এ ছবি ছাপা হওয়া মাত্র বিশ্বের বহু জায়গায় কট্টর হিন্দুরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। তাঁদের বক্তব্য, দুর্গার নগ্ন ছবি ছেপে ঘোর অপমান করা হয়েছে। ওই সংবাদপত্রের অফিসেও কানাডাবাসী হিন্দুরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। দফতরের ইনবক্সে জমা হতে থাকে হাজার-হাজার ই-মেল। হিউম্যান রাইটস কমিশনে দায়ের হয় অভিযোগ। শেষমেশ নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পরিস্থি্তি সামাল দেয় সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ। আবার এই ঘটনাটিই যখন রিপোর্ট হিসেবে হিন্দুগন্ধী ওয়েবসাইটে উঠে আসে, তখনও সঙ্গে দুর্গার সেই নির্মীয়মান মূর্তির ছবি আপলোড করা থাকে। শুধু ছবির দু’জায়গায় সাঁটা হয়ে যায় দু’টি কালো স্টিকার --- ফটোশপ যতটুকু আব্রু জোগাতে সক্ষম আরকি! যদিও তাতে আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আন্ডারলাইনের মতোই লাগে।
এখন ব্যাপার হল, প্রবাসী ভারতীয় হিন্দুদের এই বিক্ষোভ ঠিক না ভুল, নৈতিক না অনৈতিক, সে বিতর্কে না ঢুকেও একথা বলা যায়, যদি কানাডার সংবাদপত্রটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হয়, তাহলে তার ঢের আগে শতগুণ বেশি প্রতিবাদ করা উচিত ছিল নিজের দেশে নিজেদের প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধেই। যে প্র্যাকটিস এক-দু’দিনের নয়, বহু বহু বছরের। কিন্তু আয়না নয়, আমাদের প্রিয় খেলনা তো চিরকালই আতস কাচ। অপরের ছোট খুঁতকেও যেখানে বড় করে দেখা যায়।
সেই অভ্যেসের বশেই বারবার আমরা হস্তক্ষেপ করেছি শিল্পীর স্বাধীনতায়। শিল্পীর কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ফতোয়া দিতে চেয়েছি। দিনের পর দিন রাস্তার উপর যে দেবীকে সকলের সামনে বেআব্রু করে রেখেছি, শিল্পীর ভাবনায় যখন তিনি কল্পনাতীত ভাবে বিবসনা হয়েও পরিপূর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ --- আমরা মেনে নিতে পারিনি। দুর্গার মতোই, সরস্বতী পুজোর মুখেও পূর্ণাবয়ব বাগদেবীর প্রতিমা খুলে আম নগ্ন থাকে থাকুক --- কিন্তু হুসেনের সরস্বতী নগ্ন হলে, দেশজুড়ে বিক্ষোভে সামিল হয়েছি --- তা যতই কমপ্লিট আর্টওয়ার্ক হোক না কেন! মার্কিন শিল্পী রবিন ফোলে যেমন বানিয়েছিলেন অর্ধনগ্ন দুর্গার একটি পুতুল। টপলেস। বিক্রি করার জন্য নিজের সাইটে পুতুলটির ছবিও আপলোড করেন তিনি। দিন কয়েকের মধ্যেই বন্যা বয়ে গেল প্রতিবাদী ইমেলের। কিছুদিন তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে নিজের অবস্থানেই অনড় ছিলেন ফোলে। পরে হাওয়া গড়বড় বুঝে, ফোলে ঘোষণা করেন, পুতুলটি তিনি বেচবেন না। ওয়েবসাইট থেকে মূল ছবিটিও সরিয়ে নেন। কিন্তু তার থাম্বনেল আজও ওয়েবে জ্বলজ্বল করছে! কোনও কোনও সংগঠন ফোলের বিরুদ্ধে স্বভাবতই তুমুল খাপ্পা। ফোলের অ্যাপ্রোচ অসংস্কৃত হতেই পারে, কিন্তু আমাদের ঘরের চারপাশেই এত এত উদোম দুর্গামূর্তি কেন, এতে সে প্রশ্নের জবাব মেলে না।
আবার কেউ বলতেই পারেন, নগ্নতায় কী যায় আসে? তুখোড় সব গ্রিক ভাস্কর্যে তো নগ্নতার ছড়াছড়ি। মনে রাখতে হবে, ভেনাস কি অ্যাফ্রোদিতের সঙ্গে কনসেপচুয়ালি দুর্গার অনেক ফারাক। যে দুর্গাকে ঘিরে আমরা উৎসবে মেতে উঠি, তিনি গৌরী, উমা। দেবী হয়েও, এই স্টোরি লাইনে তিনি ঘরের মেয়ে। বাপের বাড়ি এসেছেন। শুনতে যতই পাড়াগেঁয়ে লাগুক, বাপের বাড়ি সাউথ সিটির তিরিশ তলাতে হলেও, তা বাপের বাড়ি। তার একটা অন্যরকম ‘ইয়ে’ আছে! এতদিনের এই ফ্যামিলি ড্রামায় খামোখা কয়েকটা ‘এ’ মার্কা সিন ঢুকিয়ে দেওয়া কি উচিৎ কাজ? আর সবচেয়ে বড় কথা, আলটিমেটলি কিন্তু তাঁকে শাড়িটিই পরাবেন শিল্পী। অর্থাৎ যতক্ষণ না সেই বস্ত্রটুকু জুটছে, ততক্ষণ আক্ষরিক অর্থেই তিনি বিবস্ত্র। এটা প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব নয় --- কিন্তু তাদের পাপের ধারণাকে যেমন এক করা যায় না, তেমনই পবিত্রতার ধারণাও আলাদা। আমাদের মা কালীও তো নগ্ন। কিন্তু ভারী মজার ধাঁধা রয়েছে তাঁর রূপের বর্ণনায়! দক্ষিণাকালীর ধ্যানমন্ত্রে বলছে, তিনি ‘মুণ্ডমালাবিভূষিতাং’। অর্থাৎ তাঁর গলায় নরমুণ্ডের মালা। দৃশ্যত সে মালা তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গকে বহুলাংশে ঢেকে রাখে। ধ্যানমন্ত্রে আরও বলছে --- ‘শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীং’। সোজাকথায়, তিনি শবদেহের কাটা হাত দিয়ে নিজের কটিভূষণ রচনা করেছেন --- অনেকটা ওই মিনিস্কার্টের মতো। তাহলে? দিগ্বসনা কালীও কি আদৌ ততটা দিগ্বসনা?
কিন্তু পুজোর দিন কতক আগেও দেবী দুর্গা বিলক্ষণ দিগ্বসনা। প্রশ্ন হল, তখন আমাদের ভক্তিভাব আর শিল্প-সৌন্দর্য চেতনার মাঝখানে কোথাও কি জন্ম নেয় যৌনতার বোধ? ওই নিখুঁত গড়ন, ভোলাপচুয়াস ফিগার কি কোনও উত্তেজনার সৃষ্টি করে? এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে আমাদের পাপবোধের ধারণা। যাঁরা দেব-দেবী, তাঁদের নিয়ে ‘খারাপ কথা’ ভাবতে নেই! কামভাব জাগেই না, নাকি কামভাব জাগলেও তাকে গিলে নিতে হয়? ‘প্রথম শৈশবে সরস্বতী-মূর্তিকে আলিঙ্গন করা কি পাপ?’ এ প্রশ্নও তো ওঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এসব রিস্কি লাইনের সঙ্গে বাঙালি তো অপরিচিত নয়। আরেক ব্যতিক্রমী বাঙালি লেখক, যাঁর লেখা সেভাবে আম বাঙালির কাছে পৌঁছয়নি --- কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। এ বিষয়টিকেই আরও তীক্ষ্ণ করে তোলেন তিনি। নয়ের দশকের শুরুতে ‘আমার প্রেমিকারা’ উপন্যাসে যিনি ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে সরস্বতী প্রসঙ্গেই লেখেন --- ‘পান দু’খানা দু’গালে ছোঁয়াবার সময় ইচ্ছে করেই আমি পান ফেলে দিয়ে শুধু দুই হাত দু’গালে বুলিয়ে দিলুম একবার।… সেই থেকে আজও একইরকম চলছে।’ কৃষ্ণগোপালের লেখনিতে শ্যামার প্রসঙ্গ আরও মারাত্মক! ‘জোড়া ঢাক জোড়া কাঁসির উল্লাস গর্জনের মধ্যে দিয়ে, ধুনুচি নৃত্যের তাণ্ডবের পাশ দিয়ে, পঞ্চপ্রদীপের শিখার ওপর দিয়ে আমি এগিয়ে যাই ওর কাছে। এক পা শিবের পেটে আরেক পা শিয়ালের পিঠে দিয়ে আমি মুণ্ডমালায় চড়ে দাঁড়াই শ্যামার মুখোমুখি। বাঁ পায়ে জড়িয়ে ধরি ওর কোমর। কাঁধ ধরে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর আলতো করে দু’গাল দু’হাতে ধরি। নাকে নাক ঠেকাই, জিভের ডগায় জিভ। তিন চোখের পাতায় তিনটে চুমু খাই, চুমু খাই গলার ত্রিবলীরেখায়। ক্রমশ মিশে যাই শ্যামার ঘামতেল মাখা বুকের খাঁজে। বিপুল দুই স্তন আমাকে গায়েব করে নেয়। আমি চার বগলের গন্ধ শুঁকে শুঁকে ওর জিভটা মুখের মধ্যে নিয়ে আকণ্ঠ চুষতে থাকি। আমার দুই হাত লণ্ডভণ্ড করে ওর পাগলাঝোরা চুল। মড়মড় করে ওঠে পিষ্ট শিরদাঁড়া। অতএব শ্যামার নাভিমূলে একসময় আমার স্খলন হয়। ফ্যাটিগ্ড্ আমি লেপ্টে থাকি ওই বিশাল শরীরের মাঝখানে এই এতটুকু হয়ে।’ কিংবা সেই কবে, উনিশ শতকের ব্যঙ্গ-বিশারদ ঠাকুরদাস মুখুজ্জের ‘শারদীয় সাহিত্য’-তেও তো দেবী দুর্গার অর্ঘ্য হয়ে উঠেছিল প্রোভোকেটিভ পোশাক ---
'লও এই লিবারেল-লক্কাপেড়ে-সাড়ী, সূক্ষ্ম
সেমিজের সম্মোহন, রেডিকেল রস-ধাক্কা, ---'

আছে আরও পপুলার রেফারেন্স। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। শিবলিঙ্গের পাশে ঘুরে ঘুরে টাইটেল সং-এ লিপ মেলাচ্ছেন ব্লাউজ-বিহীন জিনাত আমন। লিঙ্গমুণ্ডে হাত বোলাচ্ছেন, নাক ঘষছেন...। এসব কি ইঙ্গিতবাহী নয়!
ঠাকুর-দেব্‌তার ব্যাপার মানেই আমিষের ছোঁয়া থাকবে না, এমন মিডিওকার যুক্তি তাই ধোপে টিঁকবে না। একতাল মাটি থেকে যখন গোটা দেহের আদল গড়ে তোলেন মৃৎশিল্পী, তখনও তাঁর শরীরে-মনে কি বিদ্যুৎ খেলে যায় না? তারাশঙ্করের কাহিনি অবলম্বনে ঋতুপর্ণের ‘অন্তরমহল’ ছবিতে যে প্রসঙ্গ উঠে আসে। দেবী প্রতিমার শরীর নির্মাণের সময় গেঁয়ো পটুয়ার মনে পড়তে থাকে দূর দেশে থাকা তাঁর স্ত্রীর কথা --- দুর্গার নির্মীয়মান মূর্তির সঙ্গে ইন্টারকাটে আসতে থাকে তাঁদের সদ্য অতীতের কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ঝলক। আর শেষমেশ নারী-পুরুষ সম্পর্কের চিররহস্যই আবার উঠে আসে একমাত্র সত্য হিসেবে। কে জানে, কোন অমোঘ আকর্ষণে সকলের অজান্তেই পটুয়ার হাতে দুর্গার মুখ হয়ে ওঠে হুবহু জমিদার বাড়ির ছোট বউ-এর আদলে। খোট্টা পোটো ব্রজভূষণ, যিনি ছবির শুরুতেই নিজ হাতে তৈরি গন্ধবিহীন মাটির চিংড়ি, ঝনঝন না-করা মাটির মোহর জমিদারমশাই-এর হাতে তুলে দিয়ে সার কথাটা বলেছিলেন --- ‘আগর আপ সোচ সাকতে হ্যায় তো সব মিলতা হ্যায়... বাস, আওয়াজ!’
সাংবাদিকতার সূত্রে বছর তিনেক আগে আলাপ হয়েছিল মালদহের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কাজের ফাঁকে মানবপুতুলের দলে পারফর্ম করতেন তিনি। মানুষই যেখানে পুতুলের মতো নাচে, পুতুলের মতোই যেন ডিজিটালি নড়াচড়া করে, যান্ত্রিক স্বরে কথা বলে। নারী চরিত্রটির পার্ট করতেন ওই ভদ্রলোক। শুনেছিলাম ছেলেবেলা থেকেই তাঁর হাবভাব, কথাবার্তা নাকি এইরকম মেয়েলি। বউ-বাচ্চা হওয়ার পরেও সেসব বদলায়নি। তিনিও লোকের ঠাট্টা-বিদ্রুপকে কোনওদিন পাত্তা দেননি। নিজের সত্ত্বাকেই সবচেয়ে আগে রেখেছেন। শুনে চমকে গিয়েছিলাম তাঁর পেশার বৃত্তান্ত। তিনি মৃৎশিল্পী। ঠাকুরের মূর্তি গড়েন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সেসব মূর্তি শুধুই দেবীর --- দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী! গণেশ, কার্তিক, বিশ্বকর্মার সেখানে কোনও ঠাঁই নেই! নিজের হাতে গড়া একের পর এক দেবী প্রতিমার শরীরে এ তো নিজের সুপ্ত নারীত্বকেই বারবার খুঁজে চলা। এখানে কি কোথাও যৌন চেতনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে না?
তাই পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা উদোম দুর্গার দিকে আমরা কামার্ত চোখ নিয়ে ফিরেই তাকাব না --- তা কি আর হয়! এখনও কেউ বলবেন, হয়। কারণ এই মূর্তি তো মায়ের। মা, দুর্গার। দেবীর দিকে হয়তো ও’চোখে তাকানো যায়, মায়ের দিকে কদাচ নয়। কিন্তু অদৃষ্টতাড়িত অয়দিপাউসের মায়ের সঙ্গে শোয়ার কাহিনি তো আমরা জানি। কিংবা শিবরাম চক্রবর্তীর ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’-র সেই অংশটি, যেখানে এক আকস্মিক বিকেলে কিশোর শিবরামকে সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়ে দিতে হচ্ছে তাঁর মাতৃস্থানীয়া --- ছেলেবেলার বান্ধবী রিনির মা-কে।
'আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি বুকের দিকে তোয়ালেটা সরিয়ে দিলেন 'এবার।'
তবু আমি হাত বাড়াই না দেখে তিনি একটু হেসে বললেন --- 'তোমার মনে পাপ ঢুকেছে দেখছি।'‌
পাপের কথায় রাগ হয়ে গেল আমার। আমি চোখ কান বুজে জোরে জোরে সাবান ঘষতে লাগলাম।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর। 'পায়ে মাখাও এবার।'
মাখাতে লাগলাম। কী সুন্দর সুগঠিত পা! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতই। বাবা বলতেন, দেবীর স্তবে পা থেকে বন্দনা শুরু করতে হয়। সরস্বতীর বেলায় কে যেন তা করেনি, তাই তাঁর কোপে সে নাকি গাধা বনে গেছল। আমি তার মর্মটা তখন বুঝতে পারি।'

তাহলে কি আমরা বড্ড ‘নিষ্পাপ’ বলেই দেবীকে শুধু স্নানের ঘরেই নগ্ন দেখি না, ফুটপাতেও দেখি! মূর্তি নির্মাণের টেকনিক্যাল দিকটিতেই কেবল নজর দিই --- রোদে-বাতাসে মাটিটা শুকিয়ে নিই। দেবী দুর্গা কি তবে শুধুই একটি পুতুল? মাটির খেলনা? এ প্রবাদ তো বহুদিনের --- ‘হিদুঁদের দুগ্গোপুজো, উপরে চিকন-চাকন, ভেতরে খড়ের বুজো’। সত্যিই আমাদের মাইন্ডসেট কি তবে এ কথাই বলে? তাঁকে যদি পূর্ণাঙ্গ নারী হিসেবেই না কল্পনা করতে পারলাম, সেই সম্মানই না দিতে পারলাম --- তাহলে কীসের প্রাণ প্রতিষ্ঠা! তাঁকে ‘মা’ ভাবা, ‘দেবী’ ভাবা --- এসব স্রেফ বাৎসরিক অভিনয়ের জন্য শত শত বছর আগে লিখে রাখা চিত্রনাট্যের অংশ বলেই মনে হয়।


সংবাদ প্রতিদিন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪

No comments:

Post a Comment