15 November 2015

কে বিনে কে ঢুকে গেল

সুস্নাত চৌধুরী



পে-স্লিপ একটা গোপন ব্যাপার। অনেকটা গোপনাঙ্গের মতোই। আছে সবাই জানে; কেমন তার বহর, বাইরে থেকেই মোটামুটি একটা আঁচও করতে পারে, কিন্তু খোলাখুলি সেসব আলোচনার যো নেই। এইচআর-শ্লীলতার মানা! কাজেই, কাজের জায়গায় কলার তুলতে গেলে পে-স্লিপকে আস্তিন থেকে বের করার বদলে খামে ঢুকিয়ে রাখাই বিধেয়। উদ্দেশ্য যদি কর্মক্ষেত্রের ভেতর দেখনদারিত্বই হয়, তবে সে কাজে ইস্তেমাল করতে হয় 'কেবিন' নামক ক্ষমতার অলিন্দটিকে। অলিন্দ, অথচ যা ঘেরা। হয়তো স্বচ্ছ, তবু চারদিকের সেই উলম্ব কাচের নাম তো দেওয়ালই।
কেবিনের তাই এত নম্বর। জন্মগত প্রতিভা হোক বা ডোনেশন-গত এমবিএ – কিছু না কিছুর একটা জোরে অফিসের হাতে-গোনা কিছু মানুষই পারেন নিজের কেবিনটি বাগিয়ে নিয়ে জাঁকিয়ে বসে সেই নম্বর জীবনের খতিয়ানে জমা করে নিতে। অসংখ্য জুল-জুল চোখের ছানাবড়া থেকে গড়িয়ে পড়া নোনতা রসের চোটে ফ্লোর-ম্যাট্রেস তখন রসাতলে। শুধু তিনিই নিস্পৃহ, দেমাকি হাসির স্মৃতিটুকু ঠোঁটে ঝুলিয়ে ভেসে থাকেন বাতাসে। কেবিনে। এঁদের মতো ভার্টিকালি নয়, কিন্তু হরাইজেন্টালি ভেসে বেড়িয়ে, কেবিনের থ্রু দিয়েই আরেক দল লোকও নিজের নম্বর বাড়িয়ে নেন। তাঁরা নিজের কেবিন জোটাতে পারেন না বটে, কিন্তু বসের কেবিনটি বশে আনতে বিশেষ সময় নেন না। সেখানে তাঁদের নিত্য আসা-যাওয়া। দরকারে-অদরকারে, কাপ্পুচিনোয়-লিকারে, সিঙ্গাড়ায়-বার্গারে তাঁরা ঢোকেন আর বেরোন... বেরোন আর ঢোকেন। স্বভাবতই সেসব চাক্ষুষ করতে করতে জমাট হতাশায় চারপাশের ছানাবড়াগুলি আরও রসসিক্ত হয়ে ওঠে। জন্ম নিতে থাকে একঘেঁয়ে কিছু রূপকথা। ক্লান্তিকর কর্পোরেট রাজনীতি। সেসবের কেন্দ্রে ঘুরপাক খায় কেবিনের কল্পলোক।
কেবিন হল উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক ফাঁপা আয়তঘনক। অ্যাপ্রাইজাল কি ছাঁটাই, বোনাস কি ইনসেন্টিভ – সব বিধিলিপিই রচনা হয় কেবিনের অন্তরমহলে। কাজের কাজ যেমন সেখানে হয় বটে, তেমনই তার মেঝেও অনেক ক্ষেত্রে অনুগতজনের দাক্ষিণ্যে দিনকেদিন হয়ে ওঠে মসৃন আর তেলতেলেতর। গোড়ালি ফেলে হাঁটতে হয়, নইলে স্লিপস্লিপারি বদহজমের সম্ভাবনা থাকে সমূহ। আর বাইরে যেহেতু নেমপ্লেট উজ্জ্বল সুস্পষ্ট হরফে, অভ্যাসবশে কেবিনটিকে অনেকে নিজের বলেই ঠাওরে নেন। কিন্তু নিজের বলে কি কিছু হয় রে পাগলা! একটু হাওয়া মারলেই হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে ছুটে আসা বল সুইং করতে শুরু করে। খেলা তখন ঘুরবেই। কালের নোটিশে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো কেবিনেরও মালিক বদল হয়। আবার নতুন করে শুরু হয় ভার্টিকাল ও হরাইজেন্টাল ভেসে বেড়ানোর খেলা। নতুন আফশোস। নতুন রূপকথা।
তাই যদ্দিন থাকে, তদ্দিনই কেবিন যেন এক সব পেয়েছির দেশ। এক আশ্চর্য প্রদীপ। সেই কেবিনের সাপেক্ষে পারস্পরিক অবস্থান বদলের এক অবদমিত বাসনাই কাজ করে কেবিনের বাইরের অগুনতি চেয়ারে, টেবিলে, কিউবিকলে। ঠিক যেমন দেখি আলাদিন-এর অ্যানাগ্রামে অনিলদা-র মধ্যেও। নক না করে ঘরে ঢোকায় মিস পম্পাকে বিগ বস মিস্টার পাকড়াশির পাকড়ে ধরা দেখে ফেলা আর প্রদীপের দৈত্যর স্বপ্ন-উড়ানে চেপে সেই অবস্থান বদলে নেওয়া। সুবিশাল সেই কল্পচেম্বারে অনিলদাই তখন দাবড়ানি দেন অধীনস্ত হয়ে পড়া পাকড়াশিকে – 'সারাদিন মিস পম্পার ফিগার মাপলেই চলবে, সেলস ফিগার আপডেট করবে কে?' আসলে এ সেই চির-আফশোসেরই শট-ডিভিশন – আমাদেরও নাকি হব্‌বে, কে জানে বাবা কব্‌বে!
কিন্তু, ব্যক্তিগত ভাবে দেখেছি, যার পাঁচে হয় না, তার পনেরোতেও হয় না। ২০০৫ থেকে ২০১৫, পাক্কা দশ বছর ঠায় কেবিনপানে ঝাড়ি মেরে এ আমার অভিজ্ঞতা। কেবিন বখতিয়ার খিলজি সবাই হতে পারে না। কেবিন জয় করতে তো পারেই না, বসের কেবিনে ঢুকে বকবক আসর ফাঁদতে পারার মতো কেবিন বয়ও হতে পারে না সবাই। সর্বভারতীয় এক মিডিয়া হাউসেই দেখেছিলাম, পদাধিকার বলে প্রাপ্য কেবিন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আমারই এক ঊর্ধ্বতন। প্রোমোশন নিয়েছিলেন, ইনক্রিমেন্ট নিয়েছিলেন, কেবিন নিতে পারেননি। লাজুক হয়ে বলেছিলেন, তাঁর অস্বস্তি হবে। বেত্তান্ত শুনে তখন মনে হয়েছিল, এই অস্বস্তিও সেই কেবিনের বাইরে বসে বসে পুঞ্জিভূত হতাশারই বাইপ্রোডাক্ট। চূড়ান্ত মিডিওক্রেসিরই নমুনামাত্র। মাটিতে পা রেখে চলা মানে তো আর চিরকাল খালি পায়ে মাঠে গিয়ে পায়চারি করা নয়! সেই অফিসেই দেখেছিলাম একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, কোনো কেবিনেই কোনো দরজা ছিল না। সেভাবেই গোটা ইন্টিরিয়রের নকশাটি করা। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল, উপরতলা আর নীচতলার মধ্যে যাতে দূরত্ব তৈরি না হয়, তাই এই সিদ্ধান্ত। আরও একটি যুক্তি ছিল অনেকটা এইরকম – যেন স্বচ্ছতা বজায় থাকে, কেবিনের 'ভিতর' নিয়ে যাতে স্পষ্ট ধারণা থাকে 'বাহির'-এর। সেসব স্বচ্ছ ভারতের আগের কথা। ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে কেবিনের স্বচ্ছতা নিয়ে আমার ধারণা আজও অস্বচ্ছই রয়ে গিয়েছে।
আবার আরেক ডালে বসে দেখেছিলাম, কেবিন না পাওয়ার ঘটনা পৌঁছেছিল চাকরিতে ইস্তফা পর্যন্ত। অগ্রজ এক সাংবাদিককে পলিটিক্যাল এডিটর পদে উন্নীত করা হয়। অধিক বেতনের চেয়েও তার জোরাল দাবি ছিল একটি কেবিনের জন্য! সে কেবিন তিনি পাননি। অগত্যা ছেড়েই দেন চাকরি। একই সংস্থায় দেখেছি, অন্য এক সাংবাদিকের ক্ষেত্রে অবশ্য কেবিন-বরাত শিকে ছিঁড়তে। সংবাদ প্রযোজনার বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন তিনি। অভ্যন্তরীণ একটি ছোটখাট গোলমালের কারণে ইস্তফা দেন। সে ইস্তফা গৃহীত হয়নি। কিন্তু অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েও যখন তাঁকে রাজি করানো যাচ্ছে না কিছুতে, তখনই নাকি তাঁর সামনে ফেলা হয় কেবিনের টোপ। এক ছোবলে ছবি! পরদিন সকালেই তিনি সুড়সুড় করে এসে নতুন কেবিনে ঢুকে বসেন। আর চাকরি ছাড়ার নাম করেননি। কেবিন নিয়ে দেমাকের প্রসঙ্গে শুনেছিলাম একটি সংবাদপত্রের বাইরের ঘরের ভেতরের কথা। তার রিসেপশনিস্ট ছিলেন যে মহিলা, চিরকাল তাঁর তুমুল রেলার কারণই ছিল যে সেই অফিসে একমাত্র তাঁরই নাকি কেবিন রয়েছে। জনে জনে সে কথা ফলাও করে বলেও বেড়াতেন। বলা বাহুল্য, গোটা ফ্রন্ট অফিসটিকেই তিনি তাঁর কেবিন ঠাওরে ছিলেন!
সম্ভাবনা আমারও ছিল। আমি চিরকালই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনাময়। অনেকটা জাপানের মতো। উদিত সূর্যের দেশ। সূর্য উঠছে তো উঠছেই... কোনোদিনই আর মধ্য গগনে এল না! আমার সম্ভাবনাও সম্ভাবনা হয়েই রয়ে গিয়েছে। তাই চূড়ান্ত সম্ভাবনাময় আমি আজও কোনো কেবিনে ঢুকতে পারলাম না। না পারলাম বুকের দমে প্রেমিকাকে নিয়ে রেস্তোরাঁর গোপন কেবিনে সেঁধাতে, না পারলাম মেডিক্লেমের জোরে সুপার স্পেশালিটির একান্ত কেবিনে ফুটফুটে নার্সদের শুশ্রূষা পেতে। হট্টগোলের বেঞ্চিতে আমাকে চা-টোস্ট দিয়ে বসিয়ে রেখে একে-একে কতজনই না ঢুকে গেল কেবিনে। অঞ্জনের গলায় কেবল শুনেই গেলাম –
ফিরে ফিরে সাতদিন
দাসবাবুর এ কেবিন
কত প্রেমালাপে যায় ভরে,
জায়গা নেই যে কোনো
আমাদের অন্য
তিনশো বছরের শহরে, এই তিনশো বছরের শহরে...


'দাস কেবিন'-এর পর্দা-টানা সেটুকু জায়গাও আমার জোটেনি। জেনারেল বেডে মশার চুম্বন আমার জন্য বরাদ্দ রইল। ঠিক যেমন কেবিনের ভেতর থেকে বাকি অফিসটা কেমন দেখতে লাগে, আজও জানা হল না। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, লেখাটির শেষ লাইনে পৌঁছে, এটা আশীর্বাদ না অভিশাপ, নাকি নেহাতই মধ্যবিত্ত থট-প্রসেস, কিছুতেই ডিসাইড করতে পারছি না।

রোববার, সংবাদ প্রতিদিন, ১৫ নভেম্বর ২০১৫

07 June 2015

‘কী করে মানবী হলাম’

সুস্নাত চৌধুরী



‘আমাকে জীবনে যা সইতে হয়েছে, সেটা ভাবা যায় না। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছি। জেনার-এর কাছে এটা হয়তো জীবন নিয়ে একটা ‘এক্সপেরিমেন্ট’, আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। আমি ট্রান্সজেন্ডার হয়েই জন্মেছিলাম, আর আমাকে সেটা প্রতিষ্ঠা করতে হত। তাই, এটা কোনও পরীক্ষা নয়, এ যেন আমার জীবনটা একটা গন্তব্যে পৌঁছচ্ছে। আমার জীবনই ছিল একটা অ্যাকশন, একটা দৌড়। ব্রুস জেনার অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় দৌড়েছেন, আমার স্ট্রাগলটাই ছিল সেই প্রতিযোগিতা। ওঁর ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম: দৌড়ের শেষে উনি হয়তো বসন্ত-বাতাস আনলেন! হয়তো কী ভাবে অবসর-জীবনটা কাটাবেন, ঠিক করলেন। যখন আর ঘাম-ঝরানো পরিশ্রম নেই, সেই সময়টা উনি নারীত্বকে দিলেন।’ ফোনে বলছিলেন মানবী, যিনি সোমনাথ থেকে হয়ে উঠেছেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই মুহূূর্তে দুনিয়া তোলপাড় হচ্ছে আমেরিকার ব্রুস জেনার-কে নিয়ে, যিনি হয়ে উঠেছেন কেটলিন জেনার। ১৯৭৬-এর সামার অলিম্পিকে ডেকাথলন-এর পুরুষ বিভাগে গোল্ড মেডালিস্ট যিনি, তিনিই এই সপ্তাহে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ পত্রিকার সুন্দরী কভার-গার্ল! লিঙ্গ পরিবর্তন করে, আর তা খোলাখুলি দাপিয়ে ঘোষণা করে, দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পঁয়ষট্টি বছরের এই ‘সদ্য তরুণী’। তাঁকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন বারাক ওবামা। টুইটারে রেকর্ড সময়ে তাঁর এক মিলিয়ন ফলোয়ার হচ্ছে, যা বিশ্বে আজ অবধি কারও হয়নি! সারা বিশ্বের মিডিয়া হামলে পড়ে বলছে, ধন্যি মেয়ে! কী সাহস! কেউ কেউ অবশ্য ভুল করে ‘ধন্যি ছেলে’ বলে ফেলছে, তারা আবার বকুনি খাচ্ছে!
কিন্তু মার্কিন এই অ্যাথলিটের ঢের আগেই তো এমন কাণ্ড ঘটেছে এই পোড়া বাংলায়। সামাজিক প্রেক্ষিত বিচার করলে, লোকজনের হ্যাটা দেওয়ার হিসেব কষলে, ঘরে-বাইরে নানা প্রতিবন্ধকতার গোদা দেওয়ালগুলোয় চোখ রাখলে, ‘সোমনাথ’ থেকে ‘মানবী’ হওয়ার সেই লড়াইকে কোনও অংশে কম তো বলা যায় না-ই, বরং আরও এগিয়ে রাখতে হয়। ব্রুস জেনার ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে উঠছেন আমেরিকায়, ভারতের তুলনায় যে-সমাজ অনেকটা উদার ও প্রগতিশীল। তা ছাড়া তিনি বিখ্যাত মানুষ। তাঁর অনুরাগীর সংখ্যাও প্রচুর। আর সোমনাথ ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে উঠছেন এমন একটা সমাজে, যেখানে সেই রূপান্তরের পর দেশের রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন জানাবার প্রশ্ন ওঠে না, প্রতিবেশীর টিটকিরির সম্ভাবনাটা তিনশো গুণ বেড়ে যায়!
মানবীকে প্রশ্ন করলাম, জেনারের খবরটা শুনে কেমন লাগছে? বললেন, ‘এক জনের কতটা পৌরুষ থাকলে তিনি অন্য পুরুষদের হারিয়ে একটা খেলায় জিততে পারেন! সেই রকম এক জন মানুষ যখন পরিবর্তিত হন, নারী হয়ে ওঠেন, তখন তো সত্যিই ভাবায় ব্যাপারটা। এই রকম একজন হার্ডকোর পুরুষ, জীবনে একটা পর্যায়ে এসে মেয়ে হয়ে গেলেন, এটা বোধহয় ওদের দেশ বলেই সম্ভব।’
আর এই দেশে? এই রাজ্যে? কী ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল সোমনাথ/মানবীকে? ‘উচ্চশিক্ষার পর আমি যখন শিক্ষকতায় গিয়েছি, জানি না কেন আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামের একটি কলেজে। আমার বাড়ির কাছাকাছিও অনেক কলেজ ছিল, সেখানেও আমি চাকরি পেতে পারতাম। পাইনি। কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত আমার যে লড়াইটা, সেটা কোনও মনুষ্য-সমাজে ঘটে বলে আমার মনে হত না— শিক্ষিত সমাজ তো ছেড়েই দিন! আমার অধ্যাপনা-জীবনে আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তুমি মরো! আর যদি না মরো, আত্মহত্যা যদি না করো, তাহলে তোমার এই বেঁচে থাকাটা হবে চরম দুর্বিষহ একটা যন্ত্রণা। আমি যে কলেজে পড়াতাম, সেই কলেজের অধ্যাপকরা দলবদ্ধ ভাবে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। মানে, সব কিছুতেই যেন আমি অচল, কোনও রকম কমিটিতে আমাকে রাখা হয়নি, এক্সটার্নাল হিসেবে কখনও অন্য কলেজে পাঠানো হয়নি, উপরন্তু আমার সব রকম ন্যায্য প্রাপ্তিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ওখানে পড়াতে গেলে আমাকে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে, কিন্তু সেটা যাতে না পাই, তার জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছে। ওখানকার একটি ছেলেকে এমন ভাবে তৈরি করেছে, সে আমার সঙ্গে প্রেম করেছে, আমাকে বিয়ে করেছে, তার পর সুপ্রিম কোর্ট অবধি লড়ে গিয়েছে, যাতে আমাকে ফাঁসিয়ে আমার চাকরিটা পেতে পারে, যাতে আমি জেলে ঢুকি। এমন বহু ঘটনা। তারা আমাকে ডাইনি ভাবত। তা প্রমাণ করার চেষ্টাও করত।’
তবে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অন্য রকম। তারা কী বলে ডাকত, স্যর না ম্যাম, মাস্টারমশাই না দিদিমণি? বললেন, ‘ওখানকার উচ্চারণে এ-কার’এর জায়গায় বসে য-ফলা আ-কার, য-ফলা আ-কার’এর জায়গায় বসে এ-কার। কাজেই আমাকে ‘সের’ বলানোরও চেষ্টা হয়েছে। তবে ছাত্রছাত্রীরা আমায় ‘মেডাম’ বলে ডাকাতেই অভ্যস্ত ছিল।’ বললেন তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কের কথাও— ‘একেবারে নিরন্ন গ্রামের ছেলেপুলেরা আমাদের কলেজটায় আসত। সেখানে দুটো ভাগ ছিল। এক দল হল ইউনিয়নের ছাত্রছাত্রী, যে ইউনিয়নটা শিক্ষকরাই চালান গ্রামে। আমি গ্রামের কথা বলছি, শহরে থেকে বিষয়টা বোঝা মুশকিল। আর এক দল ছিল, যাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক পড়াশোনা করতে চায়, তাদের কাছে আমার ভীষণ রকম গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু তাদের কোনও ‘say’ নেই, তারা কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না। তারা শুধু চোখের জল ফেলতে পারে। সে রকম একটা মান্যতা বা সমর্থন আমি তাদের থেকে আদায় করেছিলাম।’
ছোটবেলা থেকেই এই স্ট্রাগলের শুরু? ‘যখন ছোট ছিলাম, যখন যৌনতা বুঝতাম না, কোনও মানুষের দুই ঠ্যাঙের ফাঁকে যে একটা জিনিস থাকে, যাকে এক্সটার্নাল জেনিটাল বলে, যেটা আমাদের জন্মের কারণ, সে নিয়ে ভাবতাম না, কারণ সে বিষয়ে আরও অনেক পরে আমার উৎসাহ জন্মানোর কথা— আমার চেয়ে বড় যারা, তারা কিন্তু আমার সেই শৈশবেই খেলার ছলে সে কথা দিব্যি জানিয়ে দিয়েছিল। যখন পিছন ফিরে দেখি, বুঝি, কী সমাজে আমি জন্মেছিলাম। তার পর ক্রমশ যখন আমার কৌতূহল বাড়ল এবং আমার একটা যৌন অভিমুখ তৈরি হল, তখন আবার সেই বড়রাই বলল, এটা ভুল। তখন আমার মনে হল, এটা কি আমার ভুল? না কি গোটা পরিবারের ভুল, গোটা সমাজের ভুল, গোটা রাষ্ট্রের ভুল, দেশের ভুল? এ বার রাষ্ট্র এক দিকে, আর আমি এক দিকে হলাম। শুরু হল আমার নিজের অনুসন্ধান। আমার কথা যাতে কেউ শোনে, তার জন্য যে ক্ষমতার দরকার, সেই ক্ষমতা পাওয়ার জন্য যে পথের দরকার, তার খোঁজ। নিজের সঙ্গেই নিজের অনেক কথাবার্তা, তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকল। তার পর একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যেখানে আমি প্রতিটা মুহূর্তেই তথাকথিত যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তার আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠলাম। তারা আমাকে ক্রমাগত বলল, তুমি এত কথা বলছ কেন? নিজেকে লুকিয়ে নাও। তুমি মুখে যা বলবে, সেটা তুমি কখনওই বিশ্বাস করবে না। সমাজের এই শিক্ষাগুলো আমি নিতে পারলাম না। আমি ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ হয়ে উঠলাম...’
তাঁর যাদবপুরের শিক্ষাজীবন অবশ্য ততটা কষ্টের ছিল না, বন্ধু ছিল সেখানে। পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেনের মতো মানুষের আশীর্বাদ। কথায় কথায় বললেন, ‘এই তো আমার যাদবপুরের এক বান্ধবী এসেছিল, ও বলছিল, তোমাকে নিয়ে তখন সবাই বলত, তোর ওই পুরুষ-বন্ধুটা এ রকম মেয়েদের মতো করে কেন! তবে আমার ডিপার্টমেন্টের টিচারদের কাছে সে রকম আঘাত পাইনি। বন্ধুবান্ধব বা আশপাশের লোকজন হয়তো বলার চেষ্টা করেছে, আমি ‘অড’। কিন্তু তখন যাদবপুরে বলা হত— ‘অড ইজ মড’! ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষিত মানুষজন থাকত বলেই হয়তো, কিছুটা হলেও আমি একা থাকার জায়গা পেতাম। লাইব্রেরিতে একটা বই নিয়ে একা বসে থাকতে পারতাম।’
কলেজে পড়াতে পড়াতে কী ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লিঙ্গ পরিবর্তনের? ‘আমার শরীরটা যে আমার শরীর নয়, সেটা তো আমি অনেক দিনই বুঝতে পেরেছিলাম। তার থেকে মুক্তির একটা প্রয়াস আমার মধ্যে ছিল। পুনর্জন্মে বিশ্বাস করলে নয় চাইতাম, মরে গিয়ে যেন পরজন্মে নারী হয়ে জন্মাই। এর পর শুনলাম, আধুনিক বিজ্ঞানে এর একটা ট্রিটমেন্ট থাকলেও থাকতে পারে। তখন এক চিকিৎসক আমার লেখালিখি দেখে যোগাযোগ করেন। আমাকে বলেন, যাঁদের নিয়ে আমি কাজ করি, লেখালিখি করি, ওঁরা তাঁদের চিকিৎসা করতে পারেন। ট্রিটমেন্টটা কিন্তু সেই অবস্থায় একটা নিরীক্ষার স্তরে ছিল, একেবারেই ফুলপ্রুফ ছিল না। সেই দিক থেকে আমার এই সিদ্ধান্তের ভীষণ একটা গুরুত্ব ছিল, তাকে হয়তো মহানুভবতাই বলা চলে; কারণ আমি ডাক্তারকে বলেছিলাম, আমার শরীরটা নিয়ে আপনি পরীক্ষা করতে পারেন।’


মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়
এই পরিবর্তন তাঁর জীবনকে নিজের গন্তব্যে নিয়ে গিয়েছে। তাতে বিভিন্ন ভাবে সুবিধে হয়েছে কি তাঁর জীবন যাপনের? ‘লিঙ্গ পরিবর্তন করার আগে আমি যে ভাবে চলতাম, যে ভাবে সাজতাম, যে ভাবে কথা বলতাম, তাতে লোকে বলত, ছেলেটা খুব মেয়েলি। আর চেঞ্জ করার পর আমি যখন সত্যিকারের মেয়ে হয়ে এলাম, তখন লোকে বলল, বাবা, এ মহিলা তো ভীষণ পুরুষালি! তবে, ‘মেয়েলি পুরুষ’-এর থেকে বোধহয় ‘পুরুষালি মহিলা’-র গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা বেশি। কারণ ‘পৌরুষ’ ব্যাপারটাই ভীষণ ‘সম্মানের’! আর আমার রোজকার ইন্টারঅ্যাকশনের জায়গা থেকেও একটা সুবিধে হল— যে টিচাররা ‘সোমনাথ’ থাকার জন্য সুযোগ পেতেন আমাকে শারীরিক নির্যাতন করার, হাত চেপে ধরার, আরও অনেক কিছু করার, তাঁরা ‘মানবী’-কে মহিলা হওয়ার কারণে আর শারীরিক নির্যাতন করতে পারলেন না!’
তবে, সমাজের আঘাত হানার খেলা এত কিছুর পরেও বন্ধ হয়নি, তার রূপ বদলেছে মাত্র। মানবী অবশ্য দমেননি। তাঁর স্পষ্ট কথা— ‘মানুষজন কে কী বলল, আমি কোনও দিনই কান দিইনি। আমি জানি, আমি রোজগার করলে খেতে পারব, পরিবারকে খাওয়াতে পারব। আর রোজগার না করলে উপোস করে থাকব। কাজেই, কে কী বলল, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার প্রেম হয়েছে, তখন আমি বিশ্বাস করেছি, আবার বিশ্বাসভঙ্গও হয়েছে।’
‘অনেকেরই হয়, আমারও হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গের জন্য তো সেই মানুষটা দায়ী, আমি তো দায়ী নই। ব্যাপার হল, আমরা মুখে বলি ‘প্রেম’, আসলে তো যৌনতা। সেটা যা হয়, তেমনই হয়েছে।’ এতটুকু বলে গাইতে শুরু করলেন সুরেলা কণ্ঠে... ‘অলি বারবার ফিরে যায়... অলি বারবার ফিরে আসে...’
সম্প্রতি কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ-এর প্রধান হয়েছেন। এক জন ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে বিরলতম ঘটনা। কেমন লেগেছিল এই খবর পেয়ে? ‘যখন জানলাম, একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল— যাক, এ বার হয়তো কুড়ি বছরের দহনজ্বালা থেকে মুক্তি পাব!’ কিন্তু যদি আগের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হয়? সাফ কথা তাঁর, ‘যদি বিয়ের পর ডিভোর্স হয়, তার পর আবার বিয়ে হয়, সেই বরটাও যদি খারাপ হয়, তা হলে আবার ডিভোর্স করার চেষ্টা করব! তবে, সেটা হবে না। কারণ আন্তর্জাতিক স্তরে আমি এখন একটি বিরাট বিস্ময়। হলে গোটা পৃথিবীর সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ ঋতুপর্ণ ঘোষ নাকি তাঁকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর পত্রিকার নাম ‘অবমানব’ কেন? ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন মানুষগুলো অবমানব?’ তখন মানবী কী বললেন? ‘বললাম, দেখুন, আমি যদি ওঁদের ‘মহামানব’ বলি, ওঁরা কি সেই মর্যাদা পাবেন? কখনও পাবেন না। সামাজিক ক্ষেত্রে যে ভাবে ওঁদের দেখা হয়, সেই অর্থেই অবমানব। অবমানব না হলে তো ওঁদের নিয়ে পত্রিকা করারও কোনও মানে ছিল না!’ বছর কুড়ি হল চলছে ‘অবমানব’। বললেন পত্রিকা শুরু হয়েছিল কী ভাবে— ‘নবনীতা দেবসেন আমাকে বলেছিলেন এ ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে। কিন্তু আমি দেখলাম কেউ এ নিয়ে কাজ করাতেই রাজি হচ্ছেন না। কারও কাছে পাত্তাই পাচ্ছি না। তখন আমার পত্রিকাটি করার ভাবনা আসে। সবে কলেজে চাকরি পেয়েছি। সে সময় পত্রিকা প্রকাশিত হল। উনিশটা কমপ্লেন লেটার গিয়েছিল সরকারি স্তরে।’ তার পর পালটা প্রশ্নে জানতে চাইলেন— ‘কেন, আপনার আপত্তি আছে এই নাম নিয়ে?’
বললাম, না, নাম নিয়ে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আজকের রাস্তাঘাটে অনেক ট্রান্সজেন্ডারের বাড়তি দেখনদারি নিয়ে, হাবভাব নিয়ে প্রশ্ন জাগা, এমনকী বিরক্তি জাগাও কি খুব অস্বাভাবিক? এ কথা ঠিক, তাঁদের ‘মগা’, ‘ছক্কা’ বলে অপমান করার অধিকার কোনও হেটরোসেক্সুয়ালের নেই। কিন্তু, যাঁরা সমকামী বা লিঙ্গ-রূপান্তরিত, তাঁদেরও কি এই আন্ডারলাইন করা উচ্চ গ্রামের আচরণের বাড়তি অধিকার আছে? যৌন সত্তার জন্য অন্যকে নিচু ভাবার মানসিকতা যেমন অশ্লীল, তেমনই সমকামী বা রূপান্তরকামী বলেই যদি কেউ নিজেদের অন্যদের চেয়ে লাউড ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটাও কি বৈষম্যের কথাই বলে না? মানবী বললেন, ‘লাউড ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কোনও বিধার্মিকের মনে হতে পারে, ধর্ম যখন করছে ওরা, এত চিল্লাচ্ছে কেন! এত দিন ওঁদের অত্যাচার করে এসেছেন তো, এখন ওঁদের স্বাধীনতা দেখলে আপনাদের মনে হবে লাউড।'


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ জুন ২০১৫

17 May 2015

সলমন প্রসঙ্গে অভিজিৎ : ভুল? বিলকুল?

সুস্নাত চৌধুরী


সলমন খানকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা শুনিয়েছিল আদালত। তামাম বলিউড সেদিন কোথাও অশ্রু কোথাও গ্লিসারিনে স্যাঁতসেঁতে। আর ঠিক তখনই কহানি মে টুইট! হুড় হুড় দাবাং দাবাং ভঙ্গিতে মাঠে নামলেন গায়ক অভিজিৎ। তাঁর ছোট ছোট বাক্যগুলি গোটা দেশেরই বড্ড কানে লাগছিল। বড় আলটপকা যেন। অতঃপর সোশ্যাল নেটওয়ার্কও স্বাভাবিক কারণেই অভিজিৎ-কে ঝেড়ে কাপড় পরাতে দেরি করেনি। সোনাক্ষী সিংহ, বাবুল সুপ্রিয় কিংবা ঋষি কপূরের মতো অনেকেই তাঁর মন্তব্যের উপযুক্ত বিরোধিতায় সরব হন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩, ১৫৩-এ, ৫০৪ এবং ৫০৬ নম্বর ধারায় নাকি এফআইআরও দায়ের হয় বিহারের কোনও একটি জেলা আদালতে।
কী টুইট করেছিলেন সে দিন অভিজিৎ? ‘কুত্তা রাস্তায় শোবে, কুত্তার মতোই মরবে। রাস্তা গরিবদের বাপের সম্পত্তি নয়। এক বছর আমার কোনও বাড়িঘর ছিল না, কখনও রাস্তায় শুইনি।’ এ বক্তব্যের রেশ ধরেই তার পর এমন আরও কয়েকটি টুইট করেন। যে ভঙ্গিতে শিল্পী অভিজিৎ এই মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলেন, তা বেসুরোই ছিল। হয়তো এর নেপথ্যে গভীর কোনও স্বার্থ, হীন ধান্দাবাজির বীজও আছে; চট করে বলা মুশকিল। কিন্তু ব্যক্তি অভিজিৎ ভট্টাচার্যকে যদি সাময়িক সরিয়ে রাখি, তা হলে তাঁর এই মন্তব্যের কনটেন্টকে কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? বরং সলমনের সাজা প্রসঙ্গে টুইট থেকে বাইট আ-বলিউড যে যেখানে যা কপচেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সমর্থনযোগ্য মনে হয় অভিজিতের এই মন্তব্যকেই।



আদালত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, সেই রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সলমনই স্টিয়ারিং-এ ছিলেন। সুতরাং সলমন সম্ভবত তাঁর প্রাপ্য সাজাই পাচ্ছেন, পাওয়া উচিতও। কিন্তু কথা হচ্ছে, দুর্ঘটনাটি তো নেহাতই যান্ত্রিক কারণেও হতে পারত। ব্রেক ফেল হতে পারত, টায়ার বার্স্ট করে গাড়ি ফুটপাতে উঠে যেতে পারত। কিংবা নিছক ড্রাইভারের বোকামি কিংবা ভুলবশত, মানুষমাত্রেরই যেমন ভুল হয় আর কী, পুকুরপাড়ে পা পিছলে যায়, স্টেপ আউট করতে গিয়ে বলের ফ্লাইট মিস হয়, সেই রকমও কিছু ঘটতেই পারত! অর্থাৎ দুর্ঘটনা যদি একই ঘটত, অথচ সলমন মদ্যপ অবস্থায় না থাকতেন, সে ক্ষেত্রে? সলমনের সাজা হয়তো খানিক কম হত, কিন্তু নুরুল্লা মেহবুব শরিফের প্রাণ কি বাঁচত? আবদুল্লা রউফ শেখ কি জীবনে আর দু-পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারতেন? সেই ২০০২ সালে গোটা দেশে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৮৪,৬৭৪ জনের। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাটাও প্রতি বছরই বাড়ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সালে গড়ে প্রতি দিন ৩৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়। রোজ আহত হয়েছেন ১২৮৭ জন। এত এত দুর্ঘটনার, এত এত মৃত্যুর সবগুলি নিশ্চয়ই ড্রাইভারের দোষে নয়। কেবল মদ্যপান করে গাড়ি চালানোর কারণে তো নয়ই। এ কথা ঠিক, বেশির ভাগের জন্য ড্রাইভারই দায়ী, কিন্তু পথ দুর্ঘটনা মানেই ড্রাইভার ভিলেন, তা ঠিক নয়। সরকারি খতিয়ান বলছে, ২০১১ সালে ভারতে যে সংখ্যক পথ দুর্ঘটনা হয়, তার মধ্যে ২২.৫% ক্ষেত্রে ড্রাইভারের দোষ ছিল না। অর্থাৎ, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সেখানে কাজ করেছিল পথচারীর দোষ, যান্ত্রিক গোলযোগ, খারাপ রাস্তা, খারাপ আবহাওয়া ইত্যাদি অনেক কিছু। আর থাকে মদ্যপানের প্রসঙ্গ। কমিউনিটি এগেনস্ট ড্রাঙ্কেন ড্রাইভিং (ক্যাড)-এর মতো সংস্থার বক্তব্য যথার্থ। বহু দুর্ঘটনার নেপথ্যেই রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত নেশাগ্রস্ততা। সারা বিশ্বেই এটি এখন বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু পরিমিত মদ্যপান আর বেহেড মাতাল হয়ে যাওয়া তো এক জিনিস নয়। দুর্ঘটনা ঘটলেই মদের বোতলকে কাঠগড়ায় তোলার সুযোগ খোঁজা কি এক প্রকার বায়াস্‌ড অপচেষ্টা নয়? স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের সঙ্গে তুমুল মনোমালিন্য, অফিসে কোণঠাসা অবস্থান, সহকর্মীদের অবিরাম হ্যাটা— এক কথায়, জীবনযুদ্ধে বিচ্ছিরি ভাবে ক্রমশ হেরে যেতে থাকা— এ সবেও তো কত সময়ই মাথার ঠিক থাকে না। চালককে তো সে সবও কয়েক মুহূর্তের জন্য বেখেয়াল করে দিতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। ২০১৩ সালের নিরিখে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র আর একটি তথ্য বলছে, সন্ধে ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পথ দুর্ঘটনার খবর মিলেছে। ৭৪,৪১১টি। কাজেই নেশাতুর রাতের নিশিডাক শুনতে পাওয়ার ঢের আগেও যে সময় ঘনিয়ে আসে, সে সম্ভাবনাকেও কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
পথ দুর্ঘটনা ঘটলে, তা তো পথেই ঘটবে, ড্রয়িং রুমে বা খেলার মাঠে নয়। কাজেই পথে বা পথের পাশে যিনি রয়েছেন, সচেতন থাকাটা তাঁরও দায়িত্ব। আর সেখানে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে থাকাটা কি নিজের মৃত্যুকেই আমন্ত্রণ জানানো নয়? রাস্তা বা ফুটপাত যেমন কখনওই উচ্চবিত্তের 'বাপের সম্পত্তি' নয়, একই ভাবে সত্যিই তো নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত কোনও কাউকেই তাঁর পিতৃদেবও সেটি গত বারের জন্মদিনে গিফ্‌ট করেননি। রাস্তার ধারে ফুটপাত দখল করে এক জন শোবেন কেন? কলকাতার বহু ফুটপাত ধরে হাঁটার চেষ্টা করুন, করদাতা হয়েও কোনও মতে দু’পা এগিয়েই মনে হবে, এই ফুটপাতে হাঁটার কোনও অধিকার আপনার নেই। মনে রাখা উচিত, ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে না-পারাটাও কিন্তু দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ, ফুটপাতে ঘর-বাঁধা, পথকে আরও দুর্ঘটনাপ্রবণ করে তুলছে। এক, পথে-হাঁটা মানুষজনের ঝুঁকি ‌বাড়ছে। দুই, পথের পাশে বসবাসকারীদের জীবন তো সর্বদা বিপন্ন থাকছেই। এই দখলদারিও কি আগাগোড়া অনুচিত বেআইনি কাজ নয়? ফুটপাত জুড়ে, এমনকী ফুটপাত ছাপিয়ে রাস্তা ছুঁই-ছুঁই অজস্র ঝুপড়ির অবস্থানকে যদি সমর্থন করতে হয়, তা হলে তো ফুটপাতের বেআইনি হকারদেরও মেনে নেওয়া উচিত। এই হকাররাও তো পেটের টানে, বাধ্যতই সেখানে বসছেন। হাতিবাগান কি গড়িয়াহাটের বেদখল হওয়া ফুটপাত নিয়ে তবে আর হা-হুতাশ কেন!
শখ করে কেউ ফুটপাতে ঘর বাঁধেন না, ঠিক। বাধ্য হয়েই এক-ফালি জায়গা দখল করে ছিঁড়ে-আনা ফ্লেক্স টাঙিয়ে ঘর সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। দুর্ঘটনায় পা-হারানো আবদুল্লা রউফ শেখ তো কাজ করতেন আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারিতে। তাদের কর্মচারীকেই বা বেকারির সামনের ফুটপাতে নিশিযাপন করতে হত কেন? সে দায় তো তারাও এড়াতে পারে না। রাতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থেকে যাঁর প্রাণ গেল, তাঁর সুরক্ষার দায়িত্ব কি রাষ্ট্রেরও ছিল না? মাথার উপর ছাদও কিন্তু এক অর্থে আমাদের মৌলিক অধিকার। যে দেশ তার নাগরিকের মাথায় ছাদ দিতে পারে না, তার আইনই যদি সেই নাগরিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিচার চালায়, একটু তলিয়ে ভাবলে তাকে কত দূর নিরপেক্ষ বলা যায়? সলমন যেমন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তেমনই মুম্বই কর্পোরেশনেরও কি এই দুর্ঘটনার জন্য সমান দায় নেই? দায় নেই ৬৮ বছরের স্বাধীন ভারতের?
‘নবান্ন’ নাটকে বুভুক্ষু মানুষ আর কুকুরকে একই ডাস্টবিনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। দেখিয়েছিলেন ক্ষুধার যন্ত্রণা। এ দেশে আজও কুকুর-মানুষে ফারাকটা বাড়েনি। অথচ এ সত্যিটা আমরা মেনে নিতে পারি না। ‘পথের পাঁচালী’ হোক বা ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’— দারিদ্র নিয়ে ব্যবসার অভিযোগ তুলি। অথচ ‘কুত্তে কি মওত’-ও কুকুরের সব সময় হয় না। ‘কুত্তা’-র মতো মরণ যে আসলে আমাদেরই ভবিতব্য, আমরা যারা ঘুমিয়ে রয়েছি মহান ভারতের ফুটপাতে কিংবা বেডরুমে, তা আর এক বার বুঝিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক এই মন্তব্য।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ মে ২০১৫

05 April 2015

প্রক্সি কয়েদি

সুস্নাত চৌধুরী


মুরলীপ্রসাদ শর্মার হয়ে মেডিকালের এন্ট্রান্সে যিনি বসেছিলেন, তাঁর নাম আসলে ডক্টর রুস্তম পাভরি। হলে ঢোকার আগে সেই জালি ক্যান্ডিডেটকে মাত্র কয়েক মিনিটের মেক-ওভারে কলার-তোলা রংচঙে শার্টের বোতাম খোলা রেখে আর চুল ব্যাকব্রাশ করে স্রেফ একটু মুন্নাভাই-প্রতিম লুক দিতে হয়েছিল। পরীক্ষায় মুন্নাভাই প্রক্সি পেলেও, টাডা-র কেসে অবশ্য সে পথে হাঁটেননি সঞ্জয় দত্ত। কিন্তু তাঁর সাজন-তুতো ভাই-এর গাড়ি টায়ার ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারানোর মামলা পাক্কা এক যুগ পর আবার যে দিকে মোড় নিয়েছে, তাতে পাবলিক তুমুল বিস্ময়ে। অনেক নিন্দুক অনেক কিছু বলছে। আর সেই সূত্রে উঠে আসছে এমন গল্পগুজবের কথা, যেখানে এক জন লোক অপরাধ করার পর, সে অন্যকে গিয়ে বলছে, ভাই, তুই মিথ্যে বলে সব দোষ তোর কাঁধে নিয়ে নে, বদলে তোর ফ্যামিলিকে আমি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেব, তোর মেয়ের বিয়ের হিল্লে করে দেব।
১৯৯৯ সালে, বিজনেস স্কুলের পড়ুয়া বিত্তশালী পরিবারের ছেলে সঞ্জীব নন্দার বিএমডব্লিউ কেড়ে নেয় ছ’জনের জীবন। সে ঘটনার আদলেই বছর দুয়েক আগে নির্মিত হয়েছে ‘জলি এলএলবি’। সে ছবিতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো ও হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত রাহুল দেওয়ানের হয়ে কেস সাজাতে গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ যথারীতি বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘যত নষ্টের গোড়া’ ড্রাইভারকে। আদালতে সওয়াল করতে গিয়ে জাঁদরেল আইনজীবী সেই যুক্তিতেই যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন। শেষমেশ এই মিথ্যাচার ব্যর্থ হচ্ছে দূর গ্রামে পড়ে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। সেই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তিনিই একমাত্র জীবিত, অথচ পুলিশ রেকর্ড-মতে আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে!



দুর্ঘটনার পর মালিকের হয়ে প্রক্সি দিতে রাজি হয়েছেন এমন ‘সৎ’ ড্রাইভার চলচ্চিত্র আরও দেখেছে। তুরস্কের ছবি ‘থ্রি মাংকিজ’। থমথমে ছবিটি শুরুই হয় একটি গাড়ি দুর্ঘটনা দিয়ে। বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা সার্ভেট ফিরছিলেন নির্বাচনী প্রচার সেরে। ক্লান্ত শরীরে, বুজে আসা চোখে ড্রাইভ করছিলেন নিজেই। সহসা দুর্ঘটনা। এক পথচারীর মৃত্যু। ভয় পেয়ে পালালেন সার্ভেট। ভোটের মুখে এ খবর জানাজানি হলে তাঁর ভরাডুবি নিশ্চিত, অগত্যা মাঝ রাতে ঘুম-ভাঙানিয়া রিং-টোন বেজে উঠল ড্রাইভার এয়ুপ-এর ফোনে। মনিবের কথা মতো ছুটে গেলেন এয়ুপ। সার্ভেট বোঝালেন, মোটে তো মাস ছয়েক, বড়জোর এক বছরের মামলা; তার পর জেল থেকে বেরোলেই মোটা বকশিশ। এই ‘ডিল’ মেনে জেলে ঢুকলেন এয়ুপ। ন’মাসের কারাবাস। তারই মধ্যে সার্ভেটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন এয়ুপের স্ত্রী। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময়ও ঘরের পরিস্থিতিটা স্পষ্ট ছিল না এয়ুপের কাছে। হঠাৎই তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর ডাক পড়ল থানায়। পুলিশ জানাল, সার্ভেটকে হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর ছবির শেষাংশটি এক আশ্চর্য বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। ছেলে ইসমাইল মা’কে জানায়, খুনটি সে-ই করেছে। এয়ুপ তখন এক হতদরিদ্র ব্যক্তিকে বেছে নেন, তাঁকে সেই কথা বলেন, এক রাতে তাঁকে যা বলেছিলেন তাঁর মনিব। নিজের ছেলের অপরাধ অন্যের কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রস্তাব রাখেন হতভাগ্য এয়ুপ।
শুধুই টাকার লোভ নয়, কখনও আরও বড় কিছুও হয়তো থাকে অন্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অপরাধী সাজার এই খেলায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘আমি সে ও সখা’ সিনেমাটি হয়েছিল সত্তরের দশকে। সে ছবিতে দেখি, অর্থের মোহে ভুল করে ফেলা বন্ধু প্রশান্তকে (অনিল চট্টোপাধ্যায়) বাঁচাতে পুলিশের হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন নির্দোষ সুধীর (উত্তমকুমার)। সাত বছর সশ্রম কারদণ্ডের আদেশ হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন। এর মূলে কি সুধীরের বড় হয়ে ওঠায় প্রশান্তর পরিবারের যে ভূমিকা, সেই ঋণশোধ; না কি প্রকৃত বন্ধুত্বের চিরন্তন কোনও সংজ্ঞা! কোন পরিতৃপ্তির বশে পারে এক জন মানুষ, অন্যের কালির দাগ নিজের শার্টে লাগাতে? এ ছবিই যখন হিন্দিতে বানান হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, সেই ‘বেমিসাল’-এও এ সব প্রশ্নই জেগে ওঠে। অমিতাভ বচ্চনের লিপে যেখানে কিশোরকুমার গেয়ে ওঠেন— ‘মুঝে দোস্তোঁ সে শিকায়ত হ্যায় শায়দ, মুঝে দুশমনো সে মহব্বত হ্যায় শায়দ’। এমনকী খলনায়কের মতো কাজকর্মে, চোখমুখের তেমনই রিঅ্যাকশনে দর্শককে বোকা বানাতে চান, আর বন্ধুকে বাঁচাতে মিথ্যে কাগজপত্র বানিয়ে নিয়ে থানায় এসে সব দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নেন অমিতাভ। পুলিশ তাঁকে ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’ বললে, জবাব দেন ‘থ্যাংক ইউ’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সোনাই আর পরি-র ট্র্যাজিক প্রেমের ছবি ‘মনপুরা’-র কাহিনিও শুরু হয় এমনই এক অপরাধ ও তার দায়ভার গ্রহণে নিরপরাধ কাউকে রাজি করানোর মধ্যে দিয়ে। গাজি সাহেবের মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে গভীর রাতে একটি খুন করে বসে। ছেলেকে বাঁচাতে অপরাধী সাজিয়ে বাড়ির কাজের লোক সোনাই-কে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সুদূর দ্বীপেও তার সন্ধান পেয়ে যায় পুলিশ। সোনাইয়ের জেল হয়। মনিবের পরিবারকে রক্ষা করতে কয়েক মাসের এই অভিনয় সে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বদলে তার গোটা জীবনটাই ক্রমশ ছারখার হয়ে যায়। ‘অল্প বয়সে পিরিতি করিয়া, হয়ে গেল জীবনেরও শেষ।’ তার মনের মানুষ পরি-র সঙ্গেও ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন গাজি সাহেব। জামিনে ছাড়া পেয়ে সোনাই যে দিন ফেরে একটি বার পরিকে দেখার জন্য, জানতে পারে সে আত্মহত্যা করেছে। একই বিয়োগান্ত কাহিনি নিয়ে এই বাংলাতেও ছবি বানিয়েছেন অঞ্জন দাস। ‘অচিন পাখি’।
শুধুই জল-মাটি-বাতাসের নরম আবহে নয়, বিরল হলেও এমন সহজ মানবিক অবস্থানের দেখা মেলে অর্থ, ক্ষমতা আর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এ প্যাঁচানো ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট ড্রয়িংরুমেও। মধুর
ভান্ডারকর-এর ‘কর্পোরেট’-এ নিশিগন্ধা দাশগুপ্ত (বিপাশা বসু) বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেহগল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-কে। কোম্পানিকে ধসের হাত থেকে রক্ষা করতে গেলে সেহগল পরিবারের বাইরের কাউকে বিরাট কেলেঙ্কারির দায় নিতে হত। রাজি হয়ে যান সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিশি। টাকার লোভ নয়, সংস্থার স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর। এর পর এনকোয়ারি কমিশন তাঁকে হেফাজতে নেয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও, অন্য রকম বোঝাপড়া হয়ে যায় উপরমহলে। বলির পাঁঠা হন নিশি।
তবে, সবচেয়ে বিস্ময় জাগে যখন ব্যক্তিগত স্বাের্থর কথা না ভেবে দাগি ক্রিমিনালরাই এই মানবিকতার শরিক হন। জরাসন্ধর ‘লৌহকপাট’-এ এমনই এক চরিত্র বদরউদ্দীন মুন্সী। সে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত। সে দিন ছিল এক বিত্তশালী সীতানাথ দত্তের মেয়ের বিয়ে। রাতে আক্রমণ করল তার ডাকাত দল। টাকাপয়সা সোনাদানা নিয়ে ফেরার পথে বদরউদ্দীনের চোখে পড়ে গেল তেতলার বন্ধ ঘরে লুকিয়ে রাখা ফুটফুটে কনেটি। গায়ে অন্তত হাজার দশেক টাকার জড়োয়ার গয়না। বদরউদ্দীনের শরীর থেকে তখন লোভ নামক বস্তুটি ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। বদলে ভেসে উঠছে তার আদরের নূরজাহানের মুখ— আট বছর আগে যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল সে, তার পর আর যে-মেয়ে ফিরে আসেনি। সেই কনের দামি গয়নায় হাত ছোঁয়াতে না পেরে ছুটে বেরিয়ে আসে বদরউদ্দীন। খানিক পরে আবার ফিরে গিয়ে দেখে তারই দলের এক জন মেয়েটিকে ধর্যণ করেছে। তার সদ্যবিবাহিত স্বামীকে খুন করেছে। বদরউদ্দীনের সব কিছু গুলিয়ে যায়। সে দিনই দুর্বল কিছু বরযাত্রী তাকে ধরে ফেলে। তার পর অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতাল। সেখানেই হাকিম ডেকে স্ব-ইচ্ছায় সে জবানবন্দি দেয়। জানায়, সে-ই এই খুন ও ধর্ষণ করেছে। এর পর জরাসন্ধ বলছেন, ‘একটা কথা শুধু বুঝতে পারছিনে। অপরাধী তার কৃত-অপরাধ স্বীকার করেছে, এটা নতুন নয়, অদ্ভুত কিছুও নয়। কিন্তু যে-অপরাধ সে করেনি, তারই বোঝা স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে হাকিম ডেকে হলপ করে বলেছে, এটা আমি করেছি— এরকম তো কখনো শুনিনি। এর মধ্যে বাহাদুরি থাকতে পারে, কিন্তু একে সৎসাহস বলে না।’
আজকের দুনিয়াতেও এমন প্রক্সি হরবখত ঘটে চলেছে। তা সে কলেজের গার্জেন কলে ভাড়াটে বাপ-মা নিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালের ভর্ৎসনা খাওয়ানোই হোক, বা কলকাতার পাতাখোরদের ভাষায় ‘পাঁচাইন’ কেসে অন্যের হয়ে দু-তিন দিনের জন্য জেল খাটাই হোক। ডেলি তিন-চারশো টাকায় রোজগার তাতে মন্দ না! বিহারেও নাকি কেউকেটাদের হয়ে জেলে ‘দাখিল’ হতে নির্দিষ্ট লোক পাওয়া যায়। জেল খাটাই নাকি তাদের পেশা। শোনা যায়, বাংলাদেশেও নাকি চার-পাঁচ বছর, এমনকী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কেসেও নকল আসামির সন্ধান মিলেছে। এককালীন দু’লক্ষ ও মাসিক পাঁচ হাজার টাকা চুক্তিতে বছর কয়েক আগেই একটি ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবনের প্রক্সি দেওয়া শুরু করেন ঢাকার এক রিকশাওয়ালা। পরে ধরাও পড়ে যান। আবার দিনাজপুরের যে সব এলাকায় বেআইনি মাদকচক্রের রমরমা, সেখানেও নাকি এমন লোক আছে, কেউ মাদক সংক্রান্ত মামলায় ফাঁসলে, তাঁর হয়ে ‘প্রফেশনালি’ জেল খেটে দেন। বাস্তবের এই দুনিয়াকে বিলক্ষণ চিনত, কাজেই ‘হযবরল’-র ন্যাড়া কোনও দিনই বোকা ছিল না। আসামি নেই দেখে তাকে যখন ভুলিয়ে-ভালিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল, সে যথার্থই ভেবেছিল, ‘আসামীরাও বুঝি পয়সা পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না’!


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ এপ্রিল ২০১৫

26 January 2015

হাজারটা শার্লি এবদো

সুস্নাত চৌধুরী



কার্টুন ১


কোনো কিছুর প্রতিবাদ করতে হলে তাকে হাস্যাস্পদ করে তোলার চেয়ে মাখন রাস্তা আর হয় না। গালাগালি বা গোলাগুলির চেয়ে ঢের বেশি কাজ হয় কাউকে লজিকালি খোরাক করে তুলতে পারলে। ক্ষমতার দম্ভ বা শক্তির ন্যায়হীনতা তখন বাধ্যত ধুলোতে হামাগুড়ি দেয় কলমের খোঁচায়, তুলির আঁচড়ে। পাল্টা ঘুরে দাঁড়ানো অন্তত তখনকার মতো তার পক্ষে আর সম্ভবই হয় না --- কারণ চোখা বুদ্ধির সূক্ষ্মরস তার ধূসর কোষে তো নেই-ই, সোনালি কোষাগারেও নেই। অগত্যা, ক্ষমতার চিরাচরিত প্র্যাকটিসে সেই গালাগালি বা গোলাগুলিকেই আঁকড়ে ধরে সে। বোকার মতো, বুদ্ধিকে কাউন্টার করতে যায় শক্তি দিয়ে। রাজা ও রানি তাই বরাবর হেরে এসেছে জোকারের কাছে। ভয় বা ভীতি আর যাকেই বাগে আনুক না কেন, হাস্যরসকে কখনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সেই হাস্যরস, যা শুধু হাসায় না, ভাবায়ও। কারণ তার উৎসবিন্দুতেই রয়েছে গভীর কোনও ভাবনা। সেই ভারী ভাবনাই যখন হালকা ঢঙে ভেসে ওঠে মজা-পুকুরে; বেশিটা ছবিতে, বাকিটা কথায় --- কার্টুনের জন্ম হয়। নিছক ঠেস দেওয়া বা হ্যাটা করা নয়, সার্থক কার্টুনের উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক। আলোর আড়ালে থাকা অন্ধকারকে সে আন্ডারলাইন করতে চায়। সোজা কথায়, কিন্তু বাঁকা ভঙ্গিতে। এই প্রতিবাদধর্মিতাই কার্টুনের মেরুদণ্ড। দণ্ডপ্রাপ্তির তোয়াক্কা সে করে না।

কার্টুন ২
চণ্ডীবাবু যেমন বলেছিলেন তাঁর 'কার্টুনের ইতিবৃত্ত' বইয়ের ভূমিকায় --- 'যুগোত্তীর্ণ সব কার্টুনেই আছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ভোরের পূরবী নয়, মেঘ গর্জনের সমতালে দীপক রাগিণী।' এ প্রতিবাদ নানা কিসিমের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় ক্ষমতার আস্ফালনকে পাবলিকলি নগ্ন করে দেওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা রাষ্ট্র বা শাসক বিরোধী। প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ওয়ালপোলের দানছত্রের প্রবণতাকে বিদ্ধ করে ছাপা হয়েছিল শিল্পীর নামহীন একটি কার্টুন। অষ্টাদশ শতকের সেই ছবিটি উল্লেখ্য এ কারণেই যে, সেখানে ওয়ালপোলের মুখ দেখানো হয়নি, আক্ষরিকভাবেই নগ্ন করে দেখানো হয়েছিল উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ! (কার্টুন ১) তবে, এ বিষয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন কার্টুনিস্ট ডেভিড লো। ইংল্যান্ডের কাগজে কাজ করেও, নাইটহুড পেয়েও, তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও বর্ণবিদ্বেষের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে কার্টুন এঁকেছেন। কখনওই চার্চিলের চামচাগিরি করেননি। উল্টে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল, রুজভেল্ট, এমনকী স্তালিনও নাকি প্রমাদ গুনতেন ওয়ান ফাইন মর্নিং তাঁদের নিয়ে ফের কী নতুন খোরাকই না রচনা করবেন লো! (কার্টুন ২)

কার্টুন ৩
সমালোচনা সইতে না-পারা রাষ্ট্রশক্তির খাঁড়াও বহুবার নেমে এসেছে, কিন্তু কার্টুনিস্টের হাতে শেকল পরানো যায়নি। ফরাসি বিপ্লবের পর নাগাড়ে রাজা লুই ফিলিপের প্রতিবাদ করছিল প্যারিসের 'লা কারিকাতুর' পত্রিকা। রাজাকে অবমাননার অভিযোগে সম্পাদক শার্লে ফিলিপঁ-র বিচার চলল। আত্মপক্ষ সমর্থনে ফিলিপঁ বললেন, যেকোনও কিছুর সঙ্গেই যেকোনও কিছুর মিল দেখানো সম্ভব! উদাহরণস্বরূপ কার্টুনের ঢঙে এঁকে দেখালেন একটি নাশপাতির সঙ্গে রাজার মুখের সাদৃশ্য। (কার্টুন ৩) ব্যাপার হল, ফরাসি স্ল্যাং-এ নাশপাতি বা 'la poire' বলতে বোঝানো হয় : মাথামোটা। কাজেই, ফিলিপঁ-র কারাবাস সেদিন আর ঠেকায় কে! একই সঙ্গে, এরপর তামাম ফ্রান্সে মহামান্য লুই ফিলিপের কথা এলেই 'মাথামোটা' নাশপাতির অনুষঙ্গ উঠে আসাকেও আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না রাজশক্তি। এদেশেও যেমন জরুরি অবস্থার সময়ে কার্টুনে শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর মুখাবয়ব হয়ে উঠেছিল রাক্ষুসির মতো। (কার্টুন ৪) তখনই শুরু হয় রাষ্ট্রের খবরদারি। সেন্সরের ছাড়পত্র পায় না আর কে লক্ষ্মণ কিংবা আবু আব্রাহামের তুখোড় সব কার্টুন। (কার্টুন ৫) কার্টুনে কার্টুনে রাজীব গাঁধীকেও তাড়া করে ফিরেছিল বোফর্স কামানের ছায়া। (কার্টুন ৬)

কার্টুন ৪

কার্টুন ৫

কার্টুন ৬

আজও অসীম ত্রিবেদীর মতো কার্টুনিস্টের লাগাতার ব্যঙ্গ বেশিক্ষণ নিতে পারে না রাষ্ট্র। কিন্তু কোণঠাসা করে তাঁদের প্রতিবাদী স্বরও চাপা দেওয়া যায় না। চারু রায় থেকে কুট্টি, পিসিয়েল থেকে সুফি --- পেটে খিল ধরিয়েছেন, মগজের খিল খুলে দিয়েছেন। আজও রসবোধের অভাব আর বোকামির হাতে হেনস্থা হতে হয় অম্বিকেশদের। কিন্তু তারপর আর কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় না মুকুলেই ঝরে না-পড়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়া তুমুল খিল্লিসমূহের। কেননা, রেলমন্ত্রক থেকে সারদা --- টাইমলাইন রিপিট্‌স ইটসেল্ফ। (কার্টুন ৭) 

কার্টুন ৭

শুধু ক্ষমতার আধিপত্যই নয়, সমাজকাঠামো ও সমাজের ভেতরে ঘটে চলা নানা কিছুও ধিকৃত হয়েছে কার্টুনে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিঁধেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আঁকলেন 'বিদ্যার কারখানা'। দেখালেন ভারী বইয়ের চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গ্র্যাজুয়েটদের। (কার্টুন ৮) বছর ষাটেক পরও সমান প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া এ ছবিই যেন অবিকল দৃশ্যায়িত হল পিংক ফ্লয়েড-এর গানে --- All in all it's just another brick in the wall! শিক্ষাযন্ত্র যেখানে খুদে পড়ুয়াদের পিষে তৈরি করল সুস্বাদু সসেজ। অসহযোগ আন্দোলনের সময় চিত্তরঞ্জন দাশের বিদেশি শিক্ষা বর্জনের ডাকে স্কুল-কলেজ খাঁ খাঁ করতে লাগল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিরোধিতা করলেন। এবার আশুতোষকে ব্যঙ্গ করে জোড়া-কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ। 'বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিযোগ --- Man proposes fire' ও 'বিশ্ববিদ্যালয়ে জলযোগ, God Disposes --- Sweets'। (কার্টুন ৯, কার্টুন ১০) এ ধরনের সামাজিক প্রেক্ষিত নিয়ে সব শিল্পীই কম-বেশি কাজ করলেও, বিশেষভাবে উল্লেখ্য গোয়ার কার্টুনিস্ট মারিও মিরান্ডা-র নাম। তাঁর কার্টুন প্রতিবাদী, কিন্তু মোলায়েম। গরম, কিন্তু নরম।

কার্টুন ৮
কার্টুন ৯
কার্টুন ১০













ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতাও উঠে এসেছে কার্টুনে। ষোড়শো শতকের প্রথমার্ধে পোপের বিলাসবহুল জীবনযাপনকে বিদ্ধ করেন শিল্পী লুকাস ক্রানাক। বন্ধু মার্টিন লুথারও রুখে দাঁড়ান ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। প্রচারপত্রে ছাপেন পোপ-বিরোধী দু'টি কার্টুন --- The Pope-Donkey of Rome (কার্টুন ১১) ও The Monk-Calf of Freiberg। অষ্টাদশ-উনিশ শতকে ধর্মান্ধতার প্রতিবাদ করেন স্পেনীয় শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়া। কাজেই, 'শার্লি এবদো' আজ নয়, আগেও ছিল। গুলি চালালে তাদেরও ঠান্ডা করা যেত না।

কার্টুন ১১

এমন উদাহরণ খুব বিরল নয়, যেখানে এক কার্টুনিস্ট তাঁর প্রিয়জনকেও রেয়াত করছেন না। সৎ কার্টুনিস্টের প্রতিবাদী সত্ত্বা এতটাই প্রবল। বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও স্যারেন্ডার নট ব্যানার্জি-কে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। বিলেতেও দেখি, কার্টুনিস্ট ভিকি লেবার পার্টির সমর্থক ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর্নেস্ট বেভান যখন লেবার পার্টির সরকারেরই প্রধানমন্ত্রী হলেন, ভিকি তাঁকে ছেড়ে কথা বলেননি। চণ্ডী লাহিড়ীর এক আবাল্য বন্ধু মন্ত্রী হওয়ার পর, তাঁকে নিয়ে কার্টুন আঁকেন চণ্ডী। তাতে সেই বন্ধু বিস্তর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব খোয়া গেলে রাতারাতি সেই তিনিই চণ্ডীর গুণগ্রাহী হয়ে পড়েন। সব দেশে, সব কালেই রাজনীতিকের অবস্থান বদলায়। প্রকৃত কার্টুনিস্টের বদলায় না। তুলি-কলম হাতে সে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে সম্ভাবনাময় সাদা পাতার সামনে। আইডিয়া ছাড়া তার কোনও বন্ধু নেই।


সহায়ক
কার্টুনের ইতিবৃত্ত, চণ্ডী লাহিড়ী
কার্টুন সংখ্যা, কিঞ্জল পত্রিকা, ১৯৮৫
দি গেমস অব এমারজেন্সি, আবু আব্রাহাম
কার্টুন পত্তর, www.cartoonpattor.in

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫