26 January 2015

হাজারটা শার্লি এবদো

সুস্নাত চৌধুরী



কার্টুন ১


কোনো কিছুর প্রতিবাদ করতে হলে তাকে হাস্যাস্পদ করে তোলার চেয়ে মাখন রাস্তা আর হয় না। গালাগালি বা গোলাগুলির চেয়ে ঢের বেশি কাজ হয় কাউকে লজিকালি খোরাক করে তুলতে পারলে। ক্ষমতার দম্ভ বা শক্তির ন্যায়হীনতা তখন বাধ্যত ধুলোতে হামাগুড়ি দেয় কলমের খোঁচায়, তুলির আঁচড়ে। পাল্টা ঘুরে দাঁড়ানো অন্তত তখনকার মতো তার পক্ষে আর সম্ভবই হয় না --- কারণ চোখা বুদ্ধির সূক্ষ্মরস তার ধূসর কোষে তো নেই-ই, সোনালি কোষাগারেও নেই। অগত্যা, ক্ষমতার চিরাচরিত প্র্যাকটিসে সেই গালাগালি বা গোলাগুলিকেই আঁকড়ে ধরে সে। বোকার মতো, বুদ্ধিকে কাউন্টার করতে যায় শক্তি দিয়ে। রাজা ও রানি তাই বরাবর হেরে এসেছে জোকারের কাছে। ভয় বা ভীতি আর যাকেই বাগে আনুক না কেন, হাস্যরসকে কখনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সেই হাস্যরস, যা শুধু হাসায় না, ভাবায়ও। কারণ তার উৎসবিন্দুতেই রয়েছে গভীর কোনও ভাবনা। সেই ভারী ভাবনাই যখন হালকা ঢঙে ভেসে ওঠে মজা-পুকুরে; বেশিটা ছবিতে, বাকিটা কথায় --- কার্টুনের জন্ম হয়। নিছক ঠেস দেওয়া বা হ্যাটা করা নয়, সার্থক কার্টুনের উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক। আলোর আড়ালে থাকা অন্ধকারকে সে আন্ডারলাইন করতে চায়। সোজা কথায়, কিন্তু বাঁকা ভঙ্গিতে। এই প্রতিবাদধর্মিতাই কার্টুনের মেরুদণ্ড। দণ্ডপ্রাপ্তির তোয়াক্কা সে করে না।

কার্টুন ২
চণ্ডীবাবু যেমন বলেছিলেন তাঁর 'কার্টুনের ইতিবৃত্ত' বইয়ের ভূমিকায় --- 'যুগোত্তীর্ণ সব কার্টুনেই আছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ভোরের পূরবী নয়, মেঘ গর্জনের সমতালে দীপক রাগিণী।' এ প্রতিবাদ নানা কিসিমের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় ক্ষমতার আস্ফালনকে পাবলিকলি নগ্ন করে দেওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা রাষ্ট্র বা শাসক বিরোধী। প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ওয়ালপোলের দানছত্রের প্রবণতাকে বিদ্ধ করে ছাপা হয়েছিল শিল্পীর নামহীন একটি কার্টুন। অষ্টাদশ শতকের সেই ছবিটি উল্লেখ্য এ কারণেই যে, সেখানে ওয়ালপোলের মুখ দেখানো হয়নি, আক্ষরিকভাবেই নগ্ন করে দেখানো হয়েছিল উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ! (কার্টুন ১) তবে, এ বিষয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন কার্টুনিস্ট ডেভিড লো। ইংল্যান্ডের কাগজে কাজ করেও, নাইটহুড পেয়েও, তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও বর্ণবিদ্বেষের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে কার্টুন এঁকেছেন। কখনওই চার্চিলের চামচাগিরি করেননি। উল্টে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল, রুজভেল্ট, এমনকী স্তালিনও নাকি প্রমাদ গুনতেন ওয়ান ফাইন মর্নিং তাঁদের নিয়ে ফের কী নতুন খোরাকই না রচনা করবেন লো! (কার্টুন ২)

কার্টুন ৩
সমালোচনা সইতে না-পারা রাষ্ট্রশক্তির খাঁড়াও বহুবার নেমে এসেছে, কিন্তু কার্টুনিস্টের হাতে শেকল পরানো যায়নি। ফরাসি বিপ্লবের পর নাগাড়ে রাজা লুই ফিলিপের প্রতিবাদ করছিল প্যারিসের 'লা কারিকাতুর' পত্রিকা। রাজাকে অবমাননার অভিযোগে সম্পাদক শার্লে ফিলিপঁ-র বিচার চলল। আত্মপক্ষ সমর্থনে ফিলিপঁ বললেন, যেকোনও কিছুর সঙ্গেই যেকোনও কিছুর মিল দেখানো সম্ভব! উদাহরণস্বরূপ কার্টুনের ঢঙে এঁকে দেখালেন একটি নাশপাতির সঙ্গে রাজার মুখের সাদৃশ্য। (কার্টুন ৩) ব্যাপার হল, ফরাসি স্ল্যাং-এ নাশপাতি বা 'la poire' বলতে বোঝানো হয় : মাথামোটা। কাজেই, ফিলিপঁ-র কারাবাস সেদিন আর ঠেকায় কে! একই সঙ্গে, এরপর তামাম ফ্রান্সে মহামান্য লুই ফিলিপের কথা এলেই 'মাথামোটা' নাশপাতির অনুষঙ্গ উঠে আসাকেও আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না রাজশক্তি। এদেশেও যেমন জরুরি অবস্থার সময়ে কার্টুনে শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর মুখাবয়ব হয়ে উঠেছিল রাক্ষুসির মতো। (কার্টুন ৪) তখনই শুরু হয় রাষ্ট্রের খবরদারি। সেন্সরের ছাড়পত্র পায় না আর কে লক্ষ্মণ কিংবা আবু আব্রাহামের তুখোড় সব কার্টুন। (কার্টুন ৫) কার্টুনে কার্টুনে রাজীব গাঁধীকেও তাড়া করে ফিরেছিল বোফর্স কামানের ছায়া। (কার্টুন ৬)

কার্টুন ৪

কার্টুন ৫

কার্টুন ৬

আজও অসীম ত্রিবেদীর মতো কার্টুনিস্টের লাগাতার ব্যঙ্গ বেশিক্ষণ নিতে পারে না রাষ্ট্র। কিন্তু কোণঠাসা করে তাঁদের প্রতিবাদী স্বরও চাপা দেওয়া যায় না। চারু রায় থেকে কুট্টি, পিসিয়েল থেকে সুফি --- পেটে খিল ধরিয়েছেন, মগজের খিল খুলে দিয়েছেন। আজও রসবোধের অভাব আর বোকামির হাতে হেনস্থা হতে হয় অম্বিকেশদের। কিন্তু তারপর আর কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় না মুকুলেই ঝরে না-পড়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়া তুমুল খিল্লিসমূহের। কেননা, রেলমন্ত্রক থেকে সারদা --- টাইমলাইন রিপিট্‌স ইটসেল্ফ। (কার্টুন ৭) 

কার্টুন ৭

শুধু ক্ষমতার আধিপত্যই নয়, সমাজকাঠামো ও সমাজের ভেতরে ঘটে চলা নানা কিছুও ধিকৃত হয়েছে কার্টুনে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিঁধেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আঁকলেন 'বিদ্যার কারখানা'। দেখালেন ভারী বইয়ের চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গ্র্যাজুয়েটদের। (কার্টুন ৮) বছর ষাটেক পরও সমান প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া এ ছবিই যেন অবিকল দৃশ্যায়িত হল পিংক ফ্লয়েড-এর গানে --- All in all it's just another brick in the wall! শিক্ষাযন্ত্র যেখানে খুদে পড়ুয়াদের পিষে তৈরি করল সুস্বাদু সসেজ। অসহযোগ আন্দোলনের সময় চিত্তরঞ্জন দাশের বিদেশি শিক্ষা বর্জনের ডাকে স্কুল-কলেজ খাঁ খাঁ করতে লাগল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিরোধিতা করলেন। এবার আশুতোষকে ব্যঙ্গ করে জোড়া-কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ। 'বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিযোগ --- Man proposes fire' ও 'বিশ্ববিদ্যালয়ে জলযোগ, God Disposes --- Sweets'। (কার্টুন ৯, কার্টুন ১০) এ ধরনের সামাজিক প্রেক্ষিত নিয়ে সব শিল্পীই কম-বেশি কাজ করলেও, বিশেষভাবে উল্লেখ্য গোয়ার কার্টুনিস্ট মারিও মিরান্ডা-র নাম। তাঁর কার্টুন প্রতিবাদী, কিন্তু মোলায়েম। গরম, কিন্তু নরম।

কার্টুন ৮
কার্টুন ৯
কার্টুন ১০













ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতাও উঠে এসেছে কার্টুনে। ষোড়শো শতকের প্রথমার্ধে পোপের বিলাসবহুল জীবনযাপনকে বিদ্ধ করেন শিল্পী লুকাস ক্রানাক। বন্ধু মার্টিন লুথারও রুখে দাঁড়ান ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। প্রচারপত্রে ছাপেন পোপ-বিরোধী দু'টি কার্টুন --- The Pope-Donkey of Rome (কার্টুন ১১) ও The Monk-Calf of Freiberg। অষ্টাদশ-উনিশ শতকে ধর্মান্ধতার প্রতিবাদ করেন স্পেনীয় শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়া। কাজেই, 'শার্লি এবদো' আজ নয়, আগেও ছিল। গুলি চালালে তাদেরও ঠান্ডা করা যেত না।

কার্টুন ১১

এমন উদাহরণ খুব বিরল নয়, যেখানে এক কার্টুনিস্ট তাঁর প্রিয়জনকেও রেয়াত করছেন না। সৎ কার্টুনিস্টের প্রতিবাদী সত্ত্বা এতটাই প্রবল। বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও স্যারেন্ডার নট ব্যানার্জি-কে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। বিলেতেও দেখি, কার্টুনিস্ট ভিকি লেবার পার্টির সমর্থক ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর্নেস্ট বেভান যখন লেবার পার্টির সরকারেরই প্রধানমন্ত্রী হলেন, ভিকি তাঁকে ছেড়ে কথা বলেননি। চণ্ডী লাহিড়ীর এক আবাল্য বন্ধু মন্ত্রী হওয়ার পর, তাঁকে নিয়ে কার্টুন আঁকেন চণ্ডী। তাতে সেই বন্ধু বিস্তর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব খোয়া গেলে রাতারাতি সেই তিনিই চণ্ডীর গুণগ্রাহী হয়ে পড়েন। সব দেশে, সব কালেই রাজনীতিকের অবস্থান বদলায়। প্রকৃত কার্টুনিস্টের বদলায় না। তুলি-কলম হাতে সে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে সম্ভাবনাময় সাদা পাতার সামনে। আইডিয়া ছাড়া তার কোনও বন্ধু নেই।


সহায়ক
কার্টুনের ইতিবৃত্ত, চণ্ডী লাহিড়ী
কার্টুন সংখ্যা, কিঞ্জল পত্রিকা, ১৯৮৫
দি গেমস অব এমারজেন্সি, আবু আব্রাহাম
কার্টুন পত্তর, www.cartoonpattor.in

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

No comments:

Post a Comment