সুস্নাত চৌধুরী
ঘামে-ডিওতে, বিয়ারে-ঘোলেতে লেবড়ে আমাদের ভাবখানা যেন গত বছরটা বিদেয় হয়ে বাঁচিয়েছে – আর নতুন বছরটা জাস্ট আসছিল না বলে! নববর্ষ এসে গিয়েছে, ব্যস, নো টেনশন। সংক্রান্তি কাটিয়ে রাইমা টু মাইমা এবার সকলে দুধে-ঘিয়ে ভাসব – পরীক্ষায় সাপ্লি থাকবে না, অফিসে লেটমার্ক থাকবে না, ফুটপাতে বিপিএল থাকবে না, কেবল ইডেনে আইপিএল থাকবে। ট্রেন চললে ভিড় হবে না, গরমকালে ঘাম হবে না, বৃষ্টি হলে জল হবে না, শুধু চ্যানেল চ্যানেলে সপ্তদিবানিশি মেগা সিরিয়াল আর মেগা সিরিয়াল হবে। তাহলে কথা হচ্ছে গিয়ে, নতুন বছরে কি আর হালকার ওপর লাইট করে এক-আধটা সুচারু ম্যাসাকারও হবে না? সে হবে তো হবে। বড়জোর উগ্রপন্থীরা ক্যাসুয়ালি বিস্ফোরণ ঘটাবে; দেশপ্রেমীরা বিন্দাস দেশদ্রোহীদের কোতল করবে; প্রতিদিন একটা করে ধর্ষণ মাখন হেড লাইন হবে; কিছু নৃসংশ হত্যা সংবাদমাধ্যম বাই-ডিফল্ট চেপে যেতে বাধ্য হবে; এবং লঙ্কা যে অ্যাকুয়ার করবে, মেক-আপ ছাড়া তাকে ডিট্টো রাবণের মতোই দেখতে লাগবে। আর, কেউ হয়তো কমোডে বসে হালকা সুরে গুনগুনাবে... ‘পালটায় সাল, বলো, দিনগুলো পালটাবে কবে?’
তাবলে কি প্রেম দেব না! একশোবার দেব। ইট’স আ হান্ড্রড পারসেন্ট ল্যভ। রাত পোহাতেই ঝিংকুনাকুড় নেচেছি। চ্যানেলে-চ্যানেলে বর্ষবরণের কনফেটি ফাটিয়েছি। গয়নার দোকানে গিয়ে আদেখলের মতো কোল্ড ড্রিংক, মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার বাগিয়েছি। ভুল ছন্দে ন্যাকা-ন্যাকা অকবিতায় উইশ এসএমএস করেছি। ফেবু ভরিয়ে দিয়েছি সেলফিপানা চাঁদবদন আর নোলা সক্সকে রোমান হরফে – হ্যাপিনেস ইজ সেলেব্রেটিং একলা বৈশাখ উইথ মাই ফেভারিট লুচি, বেগুনভাজা অ্যান্ড মাটনকষা। এইসা মেমফুর্তি না হলে কি আর এই বছরটা তত নতুন-নতুন দেখতে লাগবে! তারপর নয় বছর শুরুর খোঁয়ারি কাটলে আগের মতোই কেউ ঘুষ খাবে, কেউ জুস খাবে, কারো ভাগ্য হোঁচট খাবে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন।
অভিধানে তো নতুন মানে, নব। নব মানে, ৯। আর, নয় মানে, না। কাজেই এখন যদি বলি, নতুন বছর বলে আসলে কিছুই হয় না। দিন-ক্ষণের হিসেব রাখতে হয়, তাই এই এককের গণনা পদ্ধতি মেনে চলা। সেই ধান্দাতেই আদ্যোপান্ত নিজেদের বানানো কৃত্রিম এক সূচক হিসেবে সে-এককের শুরুটাকে হালকা হাইলাইট করে নেওয়া। কিন্তু কোনটা সেই প্রকৃত শুরু? কোন সূচনাবিন্দু থেকে সূর্যকে চক্কর কাটতে থাকল পৃথিবী? কেন এইটেই হবে বছরের পয়লা, এখান থেকেই শুরু হবে গোনা, উবু দশ কুড়ি...? আসলে দুনিয়া জুড়ে বিবিধ গোষ্ঠী যে যার ব্যাখ্যা ও সুবিধে মতো ধরে নিয়েছে নববর্ষের দিন, ছেপে গিয়েছে ক্যালেন্ডার। লগ্ন তো সম্রাটের হাতে, পঞ্জিকা কী বলে, কী এসে-যায় তাতে! আর সব অব্দ মুছে-টুছে দিয়ে পয়লা আশ্বিন থেকে যেমন শুরু হয়েছিল হিরকাব্দ, কতকটা সেইরকমই নয় কি? অথচ সেসব ম্যানুফ্যাকচার্ড পয়লা তারিখগুলি এক পাক করে ঘুরে এলে আমরা আবিশ্ব মেতে উঠেছি গভীর আদিখ্যেতায়।
তার মানে এই নয় যে জীবন থেকে হাসি, ফুর্তি, আমোদ-আহ্লাদ মুছে দিতে হবে। সেসব বিলক্ষণ থাকবে। ছিলও তো। ছিল বলেই, ‘আর ঠিক একদিন পর আচ্ছে দিন আনেওয়ালা হ্যায়’ – এই কাউন্টডাউনের মতো খিল্লিকর আর কিছু হতে পারে না। এবং তারই জন্য পেরিয়ে-আসা অতীতকে ‘পুরাতন’ বলে দেগে দেওয়া, তাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে ‘ব্র্যান্ড নিউ’-এর ক্লিশে আমোদগেঁড়েমি চালিয়ে যাওয়া অহেতুক ঠেকে। প্রকৃত প্রস্তাবে নতুন-পুরোনো কনসেপ্টটাই যখন এখানে অর্থহীন, তখন কেন এই ফর শো বর্ষবরণ? ফেলে আসা বছরটায় কি মনে রাখার মতো কিছুই ঘটেনি, কোনো স্বপ্নই কি ছিল না সেই বেঁচে থাকায়, তাহলে এই ক’দিনেই কীভাবে তাতে এত জং পড়ে গেল যে বাতিলের দলে না ফেলে দিলেই নয়! উদ্ভট শোনাতে পারে, কিংবা হেঁয়ালির মতো। কিন্তু কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত যদি আজ আরেকটা নববর্ষে এসে না পৌঁছোতাম! কোন ক্ষতিটা হত যদি এই নতুন বছরটা আদপেই নতুন বছর না হত! তার চেয়ে বরং গেল-বছর যেখানে থেমেছিলাম, এ বছর সেখান থেকেই শুরু করব। মেতে থাকব জীবনের অনন্ত যাত্রায়। যেখানে নতুন বলে কিছু নেই, কারণ পুরোনো বলে কিছু হয় না। বড়জোর মাঝে আসে এক-আধটা ক্ষণিকের বিরতি। তখন এটুকুই আওড়ে নেওয়া যায় –
‘তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না – নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে-কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।’
ছুটি, সংবাদ প্রতিদিন, ১৭ এপ্রিল ২০১৬
No comments:
Post a Comment