08 November 2014

Lovelect : উলু উলু, ইলু ইলু

সুস্নাত চৌধুরী




তখন টেক্সটিজ নেই। আমি ও আমার বাবা ইমোটিকনের নাম শুনিনি। কিন্তু ক্লাস ফাইভ, এ সেকশন, সব্বাই জেনে গেল ইলু কা মতলব আই লভ ইউ। কেমিস্ট্রি চালু হতে তখনও তিন বচ্ছর... তবু সংকেত, চিহ্ন। পুরোপুরি অ্যাব্রিভিয়েটেভ মুণ্ডমাল নয়, আইএলওয়াই নয়... তবু সবাই জানে। কেননা ক-দিন আগেই আমাদের মজা-পুকুরে ঘাই মেরেছেন সুভাষ! সওদাগর। ততদিনে কার্বাইড-ত্বরান্বিত কিশোর, শ্রেণি পঞ্চম। তবু, সেবার লক্ষ্মী। কান্ত। পেয়ারে ঈষৎ লাল। ১৯৯১, সেবার, ইলু কা মতলব আইএলইউ।
ইলু বোঝার আগেই বটে বাঙালি উলু জেনে যায়। আমরাও। বুঝিনি সেদিন। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, সশব্দে, খোলাখুলি অথচ সংকেতে সেক্সের ডাক। রিচুয়াল, পবিত্র। মা-জেঠিমা। সঙ্গে আমিও। যে জিভ সিটি-তে মুখড়া লেখে পাড়ায়, উলু তার ক্লাইম্যাক্স ছাতনাতলায়। পৃথক শুধু মেকানিজমটুকু। যে মেয়ে-ব্যাং শোবে এবার, সে নিজেই ডাকে। মানুষ গণতান্ত্রিক, পরোপকারী। অ্যাডাল্ট দু-জন আইনানুগ লাগাবে, সে-ফূর্তিতে বাকিরা। উলু। এই উলুধ্বনি নাকি থ্রি পয়েন্ট ফাইভ হার্ৎজ ব্রেন ওয়েভ জেনারেট করে। মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাল জাইরাস, ওই মেমারি সেন্টার টাইপের, সেখানে তা নাকি হেভি ধাক্কা মারে! স্মৃতি-ফৃতি ঘেঁটে দেওয়া ক্যাচড়া। সে-শব্দের জানান দেওয়া এমন! তাবলে ভাববেন না ফাইনম্যান-টাইনম্যান হায়ার ফিজিক্স কি সাঁতরার বায়োলজি প্লাস-টু থেকে ঝাড়ছি। এ আমার টরেন্টীয় টলিগাঁ। ডক্টর হাজরা টু কুশল হাজরা। মাইনর একচিলতে দৃশ্যে যেখানে চিনা না জাপানি সহপাঠিনীটি বিদায়ের শেষবেলায় তাঁর স্বভাষায় প্রেমপত্র তুলে দিয়ে যায় গুজরাতি হিন্দি ইংরেজি আর আধ-বাংলা জানা ভালোবাসার সুদূর ভারতীয়টির হাতে, সে-ভাষা যে কিছুমাত্র বুঝবে না, জেনেই। প্রেরকের অর্থবহ বাক্য যেখানে প্রাপকের কাছে অ্যাবস্ট্রাক্ট কয়েকটা ছবি। এই ব্যর্থ প্রেমের ভাষা সংকেতে সফল। এবং কোনওদিনও তা ডিকোড করা হল কি না, সেটাও আর বিচার্যই নয়।
ব্যাপার হল, প্রেম হোক বা কাম, তার আহ্বানে সাংকেতিকতার পথে হাঁটতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সেফ লাগে। তাতে বেশ একটা কবিতা-কবিতা ফিলও হয়, গানের মতো মনে হয়। সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না আমাদের। সহজ কথা সহজ করে বলতে বাধে। নইলে যেন কাজ হয়ই না, কামও নাকি হয় না। কিন্তু রুবি রায়ের অ্যাঙ্গেল থেকে যদি দ্যাখা যায়, তিনি তো বলতেই পারেন অসময়ে --- 'এঃ হেঃ, আমি তো ধরতেই পারিনি! তুমি খামোখা কবিতায় ডাকতে গেলে কেন সেদিন... স্ট্রেটকার্ট বলতে পারলে না ভাই একটিবারের জন্য! খামোখা কবিতায় কেন ডাকলে...'। এই রিস্ক আছেই। তাই, কে কার উপর কত্‌তোটা ডাইং সেটা আদৌ ডিপেন্ড করে না সাগরে কতটা জল লাইং, আকাশে কোন পাখি ফ্লাইং কিংবা বাগানে মৌমাছি কেমন গায়িং --- তার উপর। ডিপেন্ড করে, আদৌ বলে উঠতে পারা গেল কিনা আলটিমেটলি --- 'তানে প্রেম কারু ছু... ছু... ছু...'! তারপরও অবশ্য বংললনা পটাতে গুজ্জুকেও বিদ্যেসাগর-তক্কোলঙ্কার আওড়াতে হতে পারে। সেসব ব্যতিক্রম। কবেকার পুঁথির শোলোক তোমার মতোই অশ্রুমতী... সাধু সাধু! চলিত চলিত!
আর, ভ্যানতাড়া না কষে সোজাসুজি প্রোপোজ করলে কেমন হয়? উল্টোদিক থেকে ঠাটিয়ে থাপ্পড়ের চান্স ফ্যাক্টরটা কাটিয়ে দিতে পারলে, ব্যাপারটা জমে যেতেই পারে। ঘটকের ঘটকালিতে যেমন প্রেমের দৃশ্য তৈরি হয় আরকি --- 'একটা গোটা জলজ্যান্ত মেয়ে, সে কিনা এসে বলছে, বিয়ে করব..., ভালোবাসি...!' কিংবা সত্যব্রতকে দেওয়া বুঁচকীর জবাবের মতোও হতে পারে --- 'যাঃ'। 'যাঃ মানেই হ্যাঁ:'! আসলে, ছবির শেষে আর খেলার শুরুতে, ওই 'লভ-অল' সিচুয়েশনে কেবল শ্যামই বলতে পারে তার রাধাকে --- 'আমি জানতাম তুমি আসবে, তাই অপেক্ষা করছিলাম।' সিম্পল। কিন্তু সাইড ক্যারেকটারদের ক্ষেত্রে গপ্পোটা অন্য। সিধু তো আর এই গোদা বাক্যে ভরসা রাখতে পারবে না! তাকে পচা পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বলতেই হবে, 'তুমি আমাকে বলো, উত্তমকুমার...'। বেসুরে গাইতে হবে, 'আলো আমার আলো ওগো...'। কিংবা লালুকে ভুলভাল আওড়াতে হবে আগে থেকে মুখস্থ করা --- 'চুল তার কবেকার ('অন্ধকার' মিসিং!) বিদিশার নিশা... গন্ধ তার...'। এই বিলাপ শুধু বসন্তের নয়, প্রেমগলির ঘুপচিতে ষড়ঋতুরই কলার টিউন। অতএব, এইচএস লেটার রাইটিং-এর নোটবইটির পাশেই ফুটপাতে বিকোবে প্রেমপত্রের চটিবুক। রোমান্টিক এসএমএসের কালেকশন। শায়েরি সংগ্রহ। চিঠিটি লিখতে পাড়ার সেসব অল্প সিনিয়র কি ক্লাসের ঈষৎ বেঁড়ে-পাকাটির হেল্প-টেল্পও কি একই গোত্রে ফেলা যায় না! যে সাপ্লাই করতে পারবে একটা প্রামাণ্য প্রেমের ভাষা। বানান ভুল কম, ইনক্লুডিং কয়েকটি জব্বর কোটেশন। এবং জনশ্রুতি থাকবে, ইহা পরীক্ষিত, প্রমাণিতও!
তাহলে এখানে সত্যি কথাটা কি আদৌ থাকে? থাকে হয়তো ঠিকই, কিন্তু মনের কথা চাপা পড়ে যায় মন-মন বাজে শব্দের তলায়। মজা হল, প্রেমের প্রস্তাবনায় সবচেয়ে কেঠো আর সার কথাটা বলতেই আমাদের সবচেয়ে অস্বস্তি হয়, ন্যাকান্যাকা লাগে। অথচ ভেবে দেখতে গেলে, এই বাক্যবন্ধটিই সর্বাপেক্ষা সাহসী। 'আমি তোমাকে ভালোবাসি' --- সত্যিই তো, এই ওয়ান-লাইনারটা বাঙালি আর বলে কই! বড়ো জোর বলে, বলে মানে লেখে, টেক্সট করে বা মেল, ওই... 'আই লভ ইউ'। এই যে মলাট চাপানো, তা মোটেই কেবল বিষয়ে আটকে থাকে না, তার প্রকাশভঙ্গিতেও প্রভাব ফেলে। শুরুতে বাইকে স্টার্ট দেওয়ার মতো হয়তো একটা গলা খাঁকরি, তারপর শুরু হবে এই পথ যদি না...! শুধুই প্রোপোজ-পর্বে নয়, এমনকী প্রেমের মাঝরাস্তাতেও এসব প্রবণতার বাম্পার থাকে। কথা বলার সময় ভাষা বদলে যায়, স্বর বদলে যায়। শব্দ নির্বাচন প্রভাবিত হয়। যে ভাষায় যে ভঙ্গিতে আর পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে দেদার আড্ডা চলে, বিশেষ কারো সঙ্গে নিভৃত আলাপে একটু হলেও বদল আসবেই। একটা অন্য ভাষা, প্রায় একটা ইডিওলেক্ট তৈরি হয়ে যায় যেন। যে স্বভাবতই একটু প্রগল্‌ভ, অজান্তেই নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা চালায়। যে মুখচোরা, দু-কথা বেশি বলে হয়তো নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে। কথায়-কথায় যার 'দুঃ বাঁআঃ', সে নিজেকে সোবার দেখাবেই। অন্তত প্রথম-প্রথম... তারপর মাঠ বুঝে খেলা! আপাতভাবে মনে হতে পারে, এই সব যুক্তি মান্ধাতার বাবা ও মায়ের প্রণয়কালের, আজ আর খাটে না। জানি না, ক্ষেত্র সমীক্ষার বক্স-বক্স তো খেলিনি, তাই গা-ছুঁয়ে বলতে পারব না। তবে অন্য একটা ব্যাখ্যা কপি-পেস্ট করতে পারি। বছর খানেক আগে এক বাংলা দৈনিকে 'তুই তুমি আপনি' শিরোনামে লিখেছিলাম ---
নৈকট্য গভীর গভীরতর হলে এই তুই-ই আবার বদলে যায় তুমি-তে! ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দিব্যি তুইতোকারি চলল, ওয়ান ফাইন মর্নিং হয়ে গেল তুমি! বোঝো, প্রোপোজ করার পর ক্ষণ থেকেই তুমি-তুমি বললে নাকি শরীর জুড়ে অলৌকিক শিহরন! আসলে ওই মুহূর্ত থেকে তো আর বন্ধু নয়, তারা চলে গেছে ‘স্বামী-স্ত্রী’ মোড-এ! আর বিয়ের পরেও তুইতোকারি চললে তো আর রক্ষে নেই। আত্মীয়-পড়শিদের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরে টেকা দায়!
অথচ জীবনের খেলা এমন বিচিত্র --- যখন কোথাও আর কেউ নেই, শুধু আবেগ আর প্রবৃত্তি আছে, তখন বহু ক্ষেত্রেই দাম্পত্য সম্পর্কের এ সব সম্বোধন আপনা-আপনিই বদলে যায়। বন্ধুবান্ধবের ‘ওই সব’ গল্প থেকে বুঝেছি, এমনিতে যাদের তুমি-র সম্পর্ক, সেই সব ঘন সময়ে, ঘামঝরা মুহূর্তে অনেকেই পরস্পরকে ‘তুই’ বলে। এতে হরমোন তীব্রতর হয়!
(আবাপ, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩)

যদিও বন্ধুদের মুখে শোনা এসব রেফারেন্স যে ধ্রুব সত্য, তা-ও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারব না। তবে এ-কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমি অন্তত একটি দম্পতিকে চিনি, এমনিতে যারা তুইতোকারি চালায় বিলকুল, কিন্তু সেইসব মাখন-সময়ে বলে ওঠে --- 'তুমি... তুমি...'! এ অবশ্য বিবাহ-উত্তর কালের ছোট্ট কেস স্টাডি। বিবাহ-পূর্ববর্তী প্রেমও এসব অদল-বদল সয়ে নিলে আর কবিতা থাকে না, ঢাউস কাব্যোপন্যাস হয়ে ওঠে! সে প্রেমের পথ মোড়া থাকে দৌপদীর শাড়ির মতো অনন্ত সব সংলাপে। শব্দে শব্দে শব্দে। কথার পিঠে কথায়। গানের ধুয়ার মতো ঘুরে ফিরে আসে হয়তো একই প্রসঙ্গ। অকিঞ্চিৎকর বিষয়ই বিস্ময়ে মুগ্ধ করে সেসব কথোপকথনে। ঘোর ব্যক্তিগত হয়েও যে-কথা আদতে নৈর্ব্যক্তিক। স্বকীয়, কিন্তু সর্বজনীন। কিছুই যেখানে কথার কথা নয়, তাই কোনও কথাই আর ফুরোতে চায় না। 'A Lover's Discourse - Fragments' গ্রন্থে সংলাপের যে প্রবহমানতাকে ধরেছেন রলাঁ বার্ত, এক প্রেমিকের ভাষ্যে। কোথাও লিখছেন, 'I cannot keep from thinking, from speaking; no director is there to interrupt the interior movie I keep making of myself, someone to shout, Cut! ' (অনুবাদ : রিচার্ড হাওয়ার্ড), কোনও জায়গায় তুলে আনছেন ফরাসি কবি ফ্রাঁসিস পোঁশ-এর পঙ্‌ক্তি --- 'I speak and you hear me, hence we exist'। ওই... 'আমি যেন বলি, আর তুমি যেন শোনো / জনমে জনমে তার শেষ নেই কোনো। / দিনের কাহিনী কত, রাত চন্দ্রাবলী / মেঘ হয়, আলো হয়, কথা যাই বলি।' কিংবা 'আমি শুনবো শুনবো, তুমি বলবে। সন্ধ্যাবেলায়...'।
এত কথা, তবু নৃতত্ত্বের অনেক গবেষকই আজ বলছেন, মুখের কথায় চিঁড়ে ভেজে না। প্রেমের প্রশ্নে শরীরী ইঙ্গিতই নাকি ঢের বেশি কার্যকরী। ননভার্বালেই মানুষ বেশি আস্থা রাখে। তাহলে কি ঘুরে-ফিরে সেই সংকেত! অচানক চোখ মারা? শ্বদম্তে ঠোঁট কামড়ানো? সংকেত হলেও, এসব বড্ড অতুল বেদাদে স্টাইল। তার চেয়ে স্রেফ চোখে চোখ ভালো। আমার চোখে রাখো চোখ, কথার অবসান হোক। কাব্যে কৌশল থাকতে পারে, কথায় মারপ্যাঁচ। নীরবতা নিরপেক্ষ। নিখাদ। সে সংকেত হতে পারে, কিন্তু সাংকেতিক নয়। প্রতারক নয়। বরং সবচেয়ে সত্য। দুটো মানুষের মাঝখানে এই স্তব্ধতাই হয়তো বিশুদ্ধ প্রেমের ভাষা। না-বলেও যে অনেক কিছু বলে দিয়ে যায়, আজও। তুই না বুঝিস বয়েই গেল, আমার চোখে সকাল হয়।


দেশের আগামীকাল, নভেম্বর ২০১৪

28 September 2014

বসন পরো মা

সুস্নাত চৌধুরী


প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন কয়েকজন উলঙ্গ মেয়েমানুষ। শরীরে তখন সুতোটি পর্যন্ত নেই। না, মনোরমা দেবীর ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল মণিপুরের কথা বলছি না। এ আমাদের শহর কলকাতা আর তার আশপাশের ছবি। কোনও মারাত্মক ইস্যুতে প্রতিবাদ-টতিবাদও নয়। যাঁরা দাঁড়িয়ে, তাঁরা ভিখিরি-পাগলি জাতীয় রুগ্ন, খেতে-পরতে না পাওয়া কোনও সাপলুডো খেলোয়াড়ও নন। বরং ভরাযৌবনা। মাপা ফিগার।
এ দৃশ্য প্রতিবছর আমরা দেখি। দেখে, আরও দেখতে দেখতে রাস্তা দিয়ে হাঁটি। আমাদেরই ঘরের উমা, সম্পূর্ণ নগ্ন, তার উপর এসে পড়ছে সূর্যের আলো। সঙ্গে শত-শত পুরুষ মানুষের দৃষ্টি। মহিলারাও কি তাকান না, কেউ হয়তো আড়চোখে, একটু অস্বস্তি নিয়েই? দুর্গাপুজোর মাসখানেক আগে থেকেই এ আমাদের রোজকার অভিজ্ঞতা। পটুয়ার ঘরের আশপাশে ফুটপাত জুড়ে সারিবদ্ধ মাতৃমূর্তি। কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দেওয়া সারা। দেহের প্রতিটা ডিটেলিং নিখুঁত। নিটোল স্তন। সুস্পষ্ট স্তনবৃন্ত। গভীর নাভি। অমলিন ত্রিবলী। সুঠাম উরু। সব মিলে তাক লাগিয়ে দেওয়া শিল্পকর্ম! তবু, দেবী দুর্গার এই নগ্নমূর্তি কোথাও কি আমাদের অতিভক্তি আর আচারের দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন জাগায় না?
আমরা দেখেছি, বোধনের আগে পর্যন্ত মায়ের শ্রীমুখখানি ঢাকা থাকতে। হয় আনখশির টানা পর্দা, নয়তো নিদেনপক্ষে মুখটুকু কাপড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া। নইলে হয়তো ঘামতেলে নোংরা টেনে নেবে। কিংবা এ হয়তো প্রকাশিত হওয়ার আনুষ্ঠানিক আচার। অথবা নিছক একটা চমকের অপেক্ষাকে শেষপর্যন্ত জিইয়ে রাখা। কেমন হয়েছে এবারে মায়ের মুখটা? প্রশ্নটা গুনগুন করে দানা বেঁধে ওঠে, ঠেকে-ঠেকে নানা গুজব রটতে থাকে। উত্তরটা মহারানি ভিক্টোরিয়াও হতে পারে কিংবা শ্রীদেবী! অথবা গতবারের মতোই, চিরাচরিত। কিন্তু ষষ্ঠীর আগে এটুকু চর্মচক্ষে মিলিয়ে নিতে গেলেই পাপ! ঠিক যেন ছাঁতনাতলায় নববধূ, শুভদৃষ্টির লগ্নে মুখের সামনে পানপাতার আবরণ। এ সময় পাড়ার রক থেকে যদি রোমিওকণ্ঠে বাঁকা আওয়াজ ভেসে আসে --- ‘বাওয়া, এদের তো তিন বছরের সম্পক্কো, পাক্কা দু’বছরের অ্যাফেয়ার, আর শেষ ছ’মাসের অত্ত ফস্টিনষ্টি --- বডি-ফডি চিনে গেলে, একন লোকদ্যাকানো মুক ঢাকার আদিখ্যেতা কেন বাপু!’ তখন?
এভাবে ভাবলে কি ঠাকুর পাপ দেয়? দেয় নিশ্চয়ই, নইলে সমাজের জ্যাঠামশয়রা এসব শুনলেই রে-রে করে উঠবেন কেন! ‘ছিঃ ছিঃ, কী অলুক্ষুণে কথা! কী নোংরা মেন্টালিটি! স্বয়ং মা দুগ্গাকে নিয়েও এমন অশ্লীল শরীরী ইঙ্গিত! যত্তসব পারভার্ট…’। আবার নাস্তিক হাফ-আঁতেল হলে গম্ভীর হেসে বলবেন --- ‘নাবালক! একটা মাটির পুতুল নিয়ে এত কথা জাস্ট ননসেন্স!’ মোদ্দা ব্যাপার হল, এই ল্যাংটো নারীমূর্তি, তা তিনি মৃন্ময়ীই হোন বা চিন্ময়ী --- ভদ্রমহিলা এই এখন, পুজোর মুখে, আমাদের রাজপথে অলিতে গলিতে যেভাবে আছেন, যেখানে আছেন, তাতে আমাদের বড় একটা হেলদোল নেই। তাঁর জন্য হাতে গোনা পাঁচদিনের লাখ টাকা বাজেটে প্যান্ডেল আছে, ঝক্কাস লাইটিং আছে, বক্স-ফাটা ঝিনচ্যাক গান আছে --- শুধু তাঁর প্রাক-পুজো শালীনতা রক্ষার কনসেপ্টটুকু নেই।
ঠিক এগারো বছর আগে, ২০০৩ সালে, দুর্গাপুজোর মুখে কানাডার শতাব্দীপ্রাচীন দৈনিক ‘টরোন্টো স্টার’-এ ছাপা হয়েছিল ভারতীয় এই দেবীর উপর একটি প্রতিবেদন। সঙ্গে ছবি --- দশভুজার প্রতিমা নির্মাণ করছেন এক মৃৎশিল্পী। একেবারেই আমাদের চেনা দৃশ্য। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজ প্রায় শেষের পথে। কিন্তু, এ ছবি ছাপা হওয়া মাত্র বিশ্বের বহু জায়গায় কট্টর হিন্দুরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। তাঁদের বক্তব্য, দুর্গার নগ্ন ছবি ছেপে ঘোর অপমান করা হয়েছে। ওই সংবাদপত্রের অফিসেও কানাডাবাসী হিন্দুরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। দফতরের ইনবক্সে জমা হতে থাকে হাজার-হাজার ই-মেল। হিউম্যান রাইটস কমিশনে দায়ের হয় অভিযোগ। শেষমেশ নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পরিস্থি্তি সামাল দেয় সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ। আবার এই ঘটনাটিই যখন রিপোর্ট হিসেবে হিন্দুগন্ধী ওয়েবসাইটে উঠে আসে, তখনও সঙ্গে দুর্গার সেই নির্মীয়মান মূর্তির ছবি আপলোড করা থাকে। শুধু ছবির দু’জায়গায় সাঁটা হয়ে যায় দু’টি কালো স্টিকার --- ফটোশপ যতটুকু আব্রু জোগাতে সক্ষম আরকি! যদিও তাতে আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আন্ডারলাইনের মতোই লাগে।
এখন ব্যাপার হল, প্রবাসী ভারতীয় হিন্দুদের এই বিক্ষোভ ঠিক না ভুল, নৈতিক না অনৈতিক, সে বিতর্কে না ঢুকেও একথা বলা যায়, যদি কানাডার সংবাদপত্রটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হয়, তাহলে তার ঢের আগে শতগুণ বেশি প্রতিবাদ করা উচিত ছিল নিজের দেশে নিজেদের প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধেই। যে প্র্যাকটিস এক-দু’দিনের নয়, বহু বহু বছরের। কিন্তু আয়না নয়, আমাদের প্রিয় খেলনা তো চিরকালই আতস কাচ। অপরের ছোট খুঁতকেও যেখানে বড় করে দেখা যায়।
সেই অভ্যেসের বশেই বারবার আমরা হস্তক্ষেপ করেছি শিল্পীর স্বাধীনতায়। শিল্পীর কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ফতোয়া দিতে চেয়েছি। দিনের পর দিন রাস্তার উপর যে দেবীকে সকলের সামনে বেআব্রু করে রেখেছি, শিল্পীর ভাবনায় যখন তিনি কল্পনাতীত ভাবে বিবসনা হয়েও পরিপূর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ --- আমরা মেনে নিতে পারিনি। দুর্গার মতোই, সরস্বতী পুজোর মুখেও পূর্ণাবয়ব বাগদেবীর প্রতিমা খুলে আম নগ্ন থাকে থাকুক --- কিন্তু হুসেনের সরস্বতী নগ্ন হলে, দেশজুড়ে বিক্ষোভে সামিল হয়েছি --- তা যতই কমপ্লিট আর্টওয়ার্ক হোক না কেন! মার্কিন শিল্পী রবিন ফোলে যেমন বানিয়েছিলেন অর্ধনগ্ন দুর্গার একটি পুতুল। টপলেস। বিক্রি করার জন্য নিজের সাইটে পুতুলটির ছবিও আপলোড করেন তিনি। দিন কয়েকের মধ্যেই বন্যা বয়ে গেল প্রতিবাদী ইমেলের। কিছুদিন তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে নিজের অবস্থানেই অনড় ছিলেন ফোলে। পরে হাওয়া গড়বড় বুঝে, ফোলে ঘোষণা করেন, পুতুলটি তিনি বেচবেন না। ওয়েবসাইট থেকে মূল ছবিটিও সরিয়ে নেন। কিন্তু তার থাম্বনেল আজও ওয়েবে জ্বলজ্বল করছে! কোনও কোনও সংগঠন ফোলের বিরুদ্ধে স্বভাবতই তুমুল খাপ্পা। ফোলের অ্যাপ্রোচ অসংস্কৃত হতেই পারে, কিন্তু আমাদের ঘরের চারপাশেই এত এত উদোম দুর্গামূর্তি কেন, এতে সে প্রশ্নের জবাব মেলে না।
আবার কেউ বলতেই পারেন, নগ্নতায় কী যায় আসে? তুখোড় সব গ্রিক ভাস্কর্যে তো নগ্নতার ছড়াছড়ি। মনে রাখতে হবে, ভেনাস কি অ্যাফ্রোদিতের সঙ্গে কনসেপচুয়ালি দুর্গার অনেক ফারাক। যে দুর্গাকে ঘিরে আমরা উৎসবে মেতে উঠি, তিনি গৌরী, উমা। দেবী হয়েও, এই স্টোরি লাইনে তিনি ঘরের মেয়ে। বাপের বাড়ি এসেছেন। শুনতে যতই পাড়াগেঁয়ে লাগুক, বাপের বাড়ি সাউথ সিটির তিরিশ তলাতে হলেও, তা বাপের বাড়ি। তার একটা অন্যরকম ‘ইয়ে’ আছে! এতদিনের এই ফ্যামিলি ড্রামায় খামোখা কয়েকটা ‘এ’ মার্কা সিন ঢুকিয়ে দেওয়া কি উচিৎ কাজ? আর সবচেয়ে বড় কথা, আলটিমেটলি কিন্তু তাঁকে শাড়িটিই পরাবেন শিল্পী। অর্থাৎ যতক্ষণ না সেই বস্ত্রটুকু জুটছে, ততক্ষণ আক্ষরিক অর্থেই তিনি বিবস্ত্র। এটা প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব নয় --- কিন্তু তাদের পাপের ধারণাকে যেমন এক করা যায় না, তেমনই পবিত্রতার ধারণাও আলাদা। আমাদের মা কালীও তো নগ্ন। কিন্তু ভারী মজার ধাঁধা রয়েছে তাঁর রূপের বর্ণনায়! দক্ষিণাকালীর ধ্যানমন্ত্রে বলছে, তিনি ‘মুণ্ডমালাবিভূষিতাং’। অর্থাৎ তাঁর গলায় নরমুণ্ডের মালা। দৃশ্যত সে মালা তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গকে বহুলাংশে ঢেকে রাখে। ধ্যানমন্ত্রে আরও বলছে --- ‘শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীং’। সোজাকথায়, তিনি শবদেহের কাটা হাত দিয়ে নিজের কটিভূষণ রচনা করেছেন --- অনেকটা ওই মিনিস্কার্টের মতো। তাহলে? দিগ্বসনা কালীও কি আদৌ ততটা দিগ্বসনা?
কিন্তু পুজোর দিন কতক আগেও দেবী দুর্গা বিলক্ষণ দিগ্বসনা। প্রশ্ন হল, তখন আমাদের ভক্তিভাব আর শিল্প-সৌন্দর্য চেতনার মাঝখানে কোথাও কি জন্ম নেয় যৌনতার বোধ? ওই নিখুঁত গড়ন, ভোলাপচুয়াস ফিগার কি কোনও উত্তেজনার সৃষ্টি করে? এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে আমাদের পাপবোধের ধারণা। যাঁরা দেব-দেবী, তাঁদের নিয়ে ‘খারাপ কথা’ ভাবতে নেই! কামভাব জাগেই না, নাকি কামভাব জাগলেও তাকে গিলে নিতে হয়? ‘প্রথম শৈশবে সরস্বতী-মূর্তিকে আলিঙ্গন করা কি পাপ?’ এ প্রশ্নও তো ওঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এসব রিস্কি লাইনের সঙ্গে বাঙালি তো অপরিচিত নয়। আরেক ব্যতিক্রমী বাঙালি লেখক, যাঁর লেখা সেভাবে আম বাঙালির কাছে পৌঁছয়নি --- কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। এ বিষয়টিকেই আরও তীক্ষ্ণ করে তোলেন তিনি। নয়ের দশকের শুরুতে ‘আমার প্রেমিকারা’ উপন্যাসে যিনি ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে সরস্বতী প্রসঙ্গেই লেখেন --- ‘পান দু’খানা দু’গালে ছোঁয়াবার সময় ইচ্ছে করেই আমি পান ফেলে দিয়ে শুধু দুই হাত দু’গালে বুলিয়ে দিলুম একবার।… সেই থেকে আজও একইরকম চলছে।’ কৃষ্ণগোপালের লেখনিতে শ্যামার প্রসঙ্গ আরও মারাত্মক! ‘জোড়া ঢাক জোড়া কাঁসির উল্লাস গর্জনের মধ্যে দিয়ে, ধুনুচি নৃত্যের তাণ্ডবের পাশ দিয়ে, পঞ্চপ্রদীপের শিখার ওপর দিয়ে আমি এগিয়ে যাই ওর কাছে। এক পা শিবের পেটে আরেক পা শিয়ালের পিঠে দিয়ে আমি মুণ্ডমালায় চড়ে দাঁড়াই শ্যামার মুখোমুখি। বাঁ পায়ে জড়িয়ে ধরি ওর কোমর। কাঁধ ধরে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর আলতো করে দু’গাল দু’হাতে ধরি। নাকে নাক ঠেকাই, জিভের ডগায় জিভ। তিন চোখের পাতায় তিনটে চুমু খাই, চুমু খাই গলার ত্রিবলীরেখায়। ক্রমশ মিশে যাই শ্যামার ঘামতেল মাখা বুকের খাঁজে। বিপুল দুই স্তন আমাকে গায়েব করে নেয়। আমি চার বগলের গন্ধ শুঁকে শুঁকে ওর জিভটা মুখের মধ্যে নিয়ে আকণ্ঠ চুষতে থাকি। আমার দুই হাত লণ্ডভণ্ড করে ওর পাগলাঝোরা চুল। মড়মড় করে ওঠে পিষ্ট শিরদাঁড়া। অতএব শ্যামার নাভিমূলে একসময় আমার স্খলন হয়। ফ্যাটিগ্ড্ আমি লেপ্টে থাকি ওই বিশাল শরীরের মাঝখানে এই এতটুকু হয়ে।’ কিংবা সেই কবে, উনিশ শতকের ব্যঙ্গ-বিশারদ ঠাকুরদাস মুখুজ্জের ‘শারদীয় সাহিত্য’-তেও তো দেবী দুর্গার অর্ঘ্য হয়ে উঠেছিল প্রোভোকেটিভ পোশাক ---
'লও এই লিবারেল-লক্কাপেড়ে-সাড়ী, সূক্ষ্ম
সেমিজের সম্মোহন, রেডিকেল রস-ধাক্কা, ---'

আছে আরও পপুলার রেফারেন্স। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। শিবলিঙ্গের পাশে ঘুরে ঘুরে টাইটেল সং-এ লিপ মেলাচ্ছেন ব্লাউজ-বিহীন জিনাত আমন। লিঙ্গমুণ্ডে হাত বোলাচ্ছেন, নাক ঘষছেন...। এসব কি ইঙ্গিতবাহী নয়!
ঠাকুর-দেব্‌তার ব্যাপার মানেই আমিষের ছোঁয়া থাকবে না, এমন মিডিওকার যুক্তি তাই ধোপে টিঁকবে না। একতাল মাটি থেকে যখন গোটা দেহের আদল গড়ে তোলেন মৃৎশিল্পী, তখনও তাঁর শরীরে-মনে কি বিদ্যুৎ খেলে যায় না? তারাশঙ্করের কাহিনি অবলম্বনে ঋতুপর্ণের ‘অন্তরমহল’ ছবিতে যে প্রসঙ্গ উঠে আসে। দেবী প্রতিমার শরীর নির্মাণের সময় গেঁয়ো পটুয়ার মনে পড়তে থাকে দূর দেশে থাকা তাঁর স্ত্রীর কথা --- দুর্গার নির্মীয়মান মূর্তির সঙ্গে ইন্টারকাটে আসতে থাকে তাঁদের সদ্য অতীতের কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ঝলক। আর শেষমেশ নারী-পুরুষ সম্পর্কের চিররহস্যই আবার উঠে আসে একমাত্র সত্য হিসেবে। কে জানে, কোন অমোঘ আকর্ষণে সকলের অজান্তেই পটুয়ার হাতে দুর্গার মুখ হয়ে ওঠে হুবহু জমিদার বাড়ির ছোট বউ-এর আদলে। খোট্টা পোটো ব্রজভূষণ, যিনি ছবির শুরুতেই নিজ হাতে তৈরি গন্ধবিহীন মাটির চিংড়ি, ঝনঝন না-করা মাটির মোহর জমিদারমশাই-এর হাতে তুলে দিয়ে সার কথাটা বলেছিলেন --- ‘আগর আপ সোচ সাকতে হ্যায় তো সব মিলতা হ্যায়... বাস, আওয়াজ!’
সাংবাদিকতার সূত্রে বছর তিনেক আগে আলাপ হয়েছিল মালদহের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কাজের ফাঁকে মানবপুতুলের দলে পারফর্ম করতেন তিনি। মানুষই যেখানে পুতুলের মতো নাচে, পুতুলের মতোই যেন ডিজিটালি নড়াচড়া করে, যান্ত্রিক স্বরে কথা বলে। নারী চরিত্রটির পার্ট করতেন ওই ভদ্রলোক। শুনেছিলাম ছেলেবেলা থেকেই তাঁর হাবভাব, কথাবার্তা নাকি এইরকম মেয়েলি। বউ-বাচ্চা হওয়ার পরেও সেসব বদলায়নি। তিনিও লোকের ঠাট্টা-বিদ্রুপকে কোনওদিন পাত্তা দেননি। নিজের সত্ত্বাকেই সবচেয়ে আগে রেখেছেন। শুনে চমকে গিয়েছিলাম তাঁর পেশার বৃত্তান্ত। তিনি মৃৎশিল্পী। ঠাকুরের মূর্তি গড়েন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সেসব মূর্তি শুধুই দেবীর --- দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী! গণেশ, কার্তিক, বিশ্বকর্মার সেখানে কোনও ঠাঁই নেই! নিজের হাতে গড়া একের পর এক দেবী প্রতিমার শরীরে এ তো নিজের সুপ্ত নারীত্বকেই বারবার খুঁজে চলা। এখানে কি কোথাও যৌন চেতনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে না?
তাই পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা উদোম দুর্গার দিকে আমরা কামার্ত চোখ নিয়ে ফিরেই তাকাব না --- তা কি আর হয়! এখনও কেউ বলবেন, হয়। কারণ এই মূর্তি তো মায়ের। মা, দুর্গার। দেবীর দিকে হয়তো ও’চোখে তাকানো যায়, মায়ের দিকে কদাচ নয়। কিন্তু অদৃষ্টতাড়িত অয়দিপাউসের মায়ের সঙ্গে শোয়ার কাহিনি তো আমরা জানি। কিংবা শিবরাম চক্রবর্তীর ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’-র সেই অংশটি, যেখানে এক আকস্মিক বিকেলে কিশোর শিবরামকে সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়ে দিতে হচ্ছে তাঁর মাতৃস্থানীয়া --- ছেলেবেলার বান্ধবী রিনির মা-কে।
'আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি বুকের দিকে তোয়ালেটা সরিয়ে দিলেন 'এবার।'
তবু আমি হাত বাড়াই না দেখে তিনি একটু হেসে বললেন --- 'তোমার মনে পাপ ঢুকেছে দেখছি।'‌
পাপের কথায় রাগ হয়ে গেল আমার। আমি চোখ কান বুজে জোরে জোরে সাবান ঘষতে লাগলাম।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর। 'পায়ে মাখাও এবার।'
মাখাতে লাগলাম। কী সুন্দর সুগঠিত পা! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতই। বাবা বলতেন, দেবীর স্তবে পা থেকে বন্দনা শুরু করতে হয়। সরস্বতীর বেলায় কে যেন তা করেনি, তাই তাঁর কোপে সে নাকি গাধা বনে গেছল। আমি তার মর্মটা তখন বুঝতে পারি।'

তাহলে কি আমরা বড্ড ‘নিষ্পাপ’ বলেই দেবীকে শুধু স্নানের ঘরেই নগ্ন দেখি না, ফুটপাতেও দেখি! মূর্তি নির্মাণের টেকনিক্যাল দিকটিতেই কেবল নজর দিই --- রোদে-বাতাসে মাটিটা শুকিয়ে নিই। দেবী দুর্গা কি তবে শুধুই একটি পুতুল? মাটির খেলনা? এ প্রবাদ তো বহুদিনের --- ‘হিদুঁদের দুগ্গোপুজো, উপরে চিকন-চাকন, ভেতরে খড়ের বুজো’। সত্যিই আমাদের মাইন্ডসেট কি তবে এ কথাই বলে? তাঁকে যদি পূর্ণাঙ্গ নারী হিসেবেই না কল্পনা করতে পারলাম, সেই সম্মানই না দিতে পারলাম --- তাহলে কীসের প্রাণ প্রতিষ্ঠা! তাঁকে ‘মা’ ভাবা, ‘দেবী’ ভাবা --- এসব স্রেফ বাৎসরিক অভিনয়ের জন্য শত শত বছর আগে লিখে রাখা চিত্রনাট্যের অংশ বলেই মনে হয়।


সংবাদ প্রতিদিন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪

15 August 2014

ভাষার স্বাধীনতা

সুস্নাত চৌধুরী


ভদ্রজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় স্বপ্ন দেখেন, সেটাই তাঁর মাতৃভাষা। ইতরজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় গালাগাল দেন, মাতৃভাষা সেটাই। বাঙালি ফ্যাতাড়ু-শিরোমণি গোপাল ভাঁড় ‘শঁড়া অন্ধা’র রিফ্লেক্স অ্যাকশনে এ থিয়োরি মানিয়ে ছেড়েছেন। কাজেই, গোধূলি লগ্নে কর্পোরেট কিউবিক্ল থেকে জানলার কাচ ভেদ করে স্বপ্নবিহ্বল দৃষ্টিতে যে বঙ্গনাগরিক হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো অস্তাচলগামী সূর্যটিকে দেখে ‘ওয়াও’ বলে উঠছেন, তিনি নির্দ্বিধায় ‘অবাঙালি’। গোবরে পা পড়লে তাই তিনি ‘ধুস শালা’ বলেন না, রিফ্লেক্সেই ‘শিট’ বলেন। এখন ব্যাপার হল, এই অবিচল অবাঙালিয়ানা নিয়ে তাঁর জীবনে ফোঁটামাত্র চাপ নেই; যত চাপ আমাদের, একদা ভাষা-শহিদ বাঙালির। মুখ ভেংচে আমরা এঁকে ‘ট্যাঁশ’ বলব, ‘টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার’ বলব।


এক দিন শ্রী মধুসূদন দত্তকেও যে কথা শুনতে হয়েছিল ‘মাইকেল’ হওয়ার ফলস্বরূপ। ইংরেজি সাহিত্যে তেমন কলকে পেলে তিনিও দাসকে মনে রাখার জন্য মায়ের কাছে কত দূর মিনতি করতেন, বলা মুশকিল! বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ইংরেজিতেই, ‘Rajmohan’s Wife’ দিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রথম দুটি গল্পই তো ছিল ইংরেজিতে। ‘Abstraction’ ও ‘Shades of Grey’। অতঃপর ফিরে আসা... কিন্তু সেই ফিরে আসাটুকু ছিল তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা। তাঁরা ফিরে না এলে বাংলায় কলম না ধরে ইংরেজিতেই চালিয়ে গেলে, সেটাও হত তাঁদেরই স্বাধীন সিদ্ধান্ত। কে কোন ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করবে, সে স্বাধীনতা তো সেই সাহিত্যিকেরই থাকবে। সে তার বাই ডিফল্ট মাতৃভাষাকে অস্বীকার করে বাই চয়েস অন্য কোনও ভাষার চৌকাঠ মাড়ালে, তাকে হাড়িকাঠ টু ফাঁসিকাঠ টানাহ্যাঁচড়া করা কি নিছক ভাষাতান্ত্রিক মৌলবাদ মাত্র নয়! আসল কথা হল, সেই লেখাটি আদৌ ‘লেখা’ পদবাচ্য হচ্ছে কি না, ঠিকঠাক উতরোচ্ছে কি না, তা তিনি যে ভাষাতেই খুশি লিখুন না কেন।
আবার উলটোটাও আছে। কিছুতেই আমরা মেনে নেব না অমিতাভ ঘোষ ‘ইংরেজ’। স্বীকার করব না ঝুম্পা লাহিড়ির ‘মাতৃভাষা’ বাংলা নয়। কিন্তু বেলজিয়ামের ফাদার দ্যতিয়েন ফরাসি ছেড়ে ছাঁকা বাংলায় রম্যরচনা লিখলে আমরা তাঁকে ‘বাঙালি’ বলেই মেনে নেওয়ার দাবি জানাই। উইলিয়াম কেরি থেকে উইলিয়াম রাদিচে তাঁরা গুণী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বটেই, কিন্তু তাঁদের দিকে তাকানোর সময় তাঁদের যোগ্যতা ব্যতিরেকেই এক ‘বাঙালি ইংরেজ’-এর সান্নিধ্য লাভের গর্ববোধই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে প্রকাশ পায়। বাপ্টিস্ট মিশনারি কেরি বাংলায় বই লিখলে, ব্রিটিশ সাহিত্যিক রাদিচে রবীন্দ্রনাথ আওড়ালে বাঙালি ধন্য ধন্য করে। কিন্তু শ্যাম আর কুল, দুটোই তো একই সঙ্গে রাখা যেতে পারে না! মাদার টেরেজাও ভারতীয় নোবেলজয়ী, আবার হরগোবিন্দ খোরানাও এ কেমন সমীকরণ!
অথচ সাহিত্যের দুনিয়ায় ভাষা-স্বাধীনতার এমন উদাহরণ বিরল নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জন্মেছিলেন কবি তরু দত্ত। লেখালিখি করেছেন ইংরেজি আর ফরাসিতে। মনে মনে তিনি ফরাসিই ছিলেন। তাঁর পরিচিতিই ছিল: জাতিতে হিন্দু, শিক্ষায় ইংরেজ, অন্তরে ফরাসি। কিংবা মিলান কুন্দেরা। চেক দেশে জন্মেও তিনি ফরাসি সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত হতে চেয়েছেন। তাঁর লেখালিখি ‘ফরাসি সাহিত্য’ হিসেবেই গণ্য হোক, এমনকী বইয়ের দোকানেও ফরাসি বইয়ের তাকেই তাঁর বইপত্র থাকুক আজও এমনই ইচ্ছে তাঁর। স্যামুয়েল বেকেট-এর নামও এই ব্র্যাকেটে ঢোকানো যায়। আয়ারল্যান্ড-এর নাগরিক হয়েও বহু কাজই তাঁর ফরাসি ভাষায়। ‘En attendant Godot’ হল ফরাসিতে লেখা সেই নাটকটি, ভাষান্তরে যেটি ‘Waiting for Godot’ নামে মুখে মুখে ফিরেছে।
ইতালীয় চিত্রনির্মাতা পিয়ের পাওলো পাসোলিনি প্রথম জীবনে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন। যে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ইতালীয় ভাষায় তিনি কথা বলতেন, সে ভাষায় নয়, কবিতাগুলি ছিল ইতালির গ্রাম্য ভাষা ফ্রিউল্যান-এ। এ জন্য পৃথক ভাবে এই ভাষার বিস্তর চর্চাও করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রথম বই ‘Versi a Casarsa’ ছিল সে ভাষাতেই লেখা। পণ্ডিতেরা বলেন, এ নাকি যুবক পাসোলিনির রাজনৈতিক অবস্থান। বটেই। কোণঠাসা ভাষাকে আগলে স্রোতের উলটো দিকে হেঁটে যাওয়ার স্বাধীনতাই বা এক জনের থাকবে না কেন? কেন এক জন এস.টি সংরক্ষণের বদান্যতা পাবেন, অথচ নিজের ভাষায় উচ্চশিক্ষার স্বাধীনতা পাবেন না? কেন তাঁকে পরীক্ষার খাতায় প্রামাণ্য বাংলাই লিখতে হবে? বিজাতীয় ঝড়-ঝঞ্ঝার থেকে নিজের ভাষাকে, তার প্রতিটি অক্ষরকে, শব্দকে, শব্দের মাঝের প্রতিটি বিমূর্ত শূন্যস্থানকেও মনে মনে সযত্নে আঁকড়ে থাকা সহজ কথা নয়।
কবীর সুমন যেখানে বলেন, ‘দরকার হলে আমি খুব প্রাদেশিক, রাষ্ট্র মানি না নিজের ভাষাকে ভুলে।’ আর ভুয়ো ভূপর্যটক মন্দার বোস বলেন, ‘বিদেশে গিয়ে আপনি যদি বাংলা ভুলতে চান তো তিন মাসেই ভুলতে পারেন, আর যদি না চান তো তিরিশ বছরেও ভুলবেন না।’ কিন্তু ভুললে তো চলবে না, এই ভুলতে চাওয়া কিংবা ভুলতে না-চাওয়া এ দুয়ের স্বাধীনতাই ব্যক্তিবিশেষের থাকা উচিত। তা সে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ময়েই হোক বা আচমকা খিস্তিতে। কিংবা ভাষার যাবতীয় সীমানা ভেঙে দেওয়া কোনও একটা ট্রিমেন্ডাস কবিতায়!


আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ আগস্ট ২০১৪

03 August 2014

-498A

সুস্নাত চৌধুরী


এই কথা বললে, শুধু ফেমিনিস্টরাই নন, লোকাল ট্রেনের মেল শভিনিস্ট ডেলি প্যাসেঞ্জাররাও হাঁ হাঁ করে উঠবেন। কিন্তু তথ্য বলছে, বছরের পর বছর ধরে এ দেশে যতগুলি বধূ নির্যাতনের মামলা হয়, তার প্রায় চোদ্দো আনার ক্ষেত্রেই অভিযোগ কিচ্ছুটি প্রমাণ করা যায় না। বেশির ভাগটাই নাকি ভুয়ো! স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অপদস্থ করার কৌশল। অথচ ১৯৮৩ সালে এই আইনের জন্মই তো হয়েছিল বরপণের দাঁত-নখ থেকে গৃহবধূদের রক্ষা করতে। তা হলে ব্যাপারটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল কী করে? আইনি পরিভাষায় এ আইনটি ‘অ-জামিনযোগ্য’, মানে, আদালতে হাজিরা না দিলে জামিনের আবেদন করা যায় না। এবং ‘কগ্নিজেবল’, অর্থাৎ কিনা অভিযুক্তকে জেলে পুরতে হলে আদালতের নির্দেশ বা নিদেনপক্ষে কোনও প্রাথমিক তদন্ত কিংবা ওয়ারেন্টেরও ধার ধারতে হয় না পুলিশকে। স্রেফ তোলো, আর পোরো! এই ‘সোজা’ রাস্তাটিকেই কাজে লাগাতে থাকলেন বহু ভদ্দরমহিলা। চোখে তাঁদের গ্লিসারিন— ‘সাজা’ মানে তো আর শুধু ‘পানিশমেন্ট’ নয়, ‘মেক-আপ’ও বটে! ব্যাপারটা এতটাই ব্যাপক যে, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টকে রায় দিতে হয়েছে, ৪৯৮এ ধারায় বধূ নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া মাত্রই পুলিশ আর হুটহাট অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে না। আগে প্রাথমিক তদন্ত করে দেখতে হবে গ্রেফতার করা আদৌ জরুরি কি না। এক দিন যা ঢাল ছিল, আজ যে তা অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বীকার করছে খাস সুপ্রিম কোর্ট। বছর নয়েক আগেও দেশের শীর্ষ আদালত এই আইনকে ‘লিগাল টেররিজ্ম’ আখ্যা দিয়েছিল। দেশের বহু হাইকোর্টেও বার বার সমালোচিত ৪৯৮এ-র ক্রমবর্ধমান এই অপব্যবহার।

ছবি: সুমন চৌধুরী
দেশে বা এই রাজ্যে আজও বহু নারীই যে চার দেওয়ালের আড়ালে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির হাতে প্রবল লাঞ্ছিত অত্যাচারিত হন, তা চরম সত্য। কিন্তু তার মানেই তো এটা হতে পারে না যে, সব স্বামীই প্রেম চোপড়া আর সব স্ত্রীই নিরুপা রায়। ভারত সরকারের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত বছর এ দেশে গড়ে প্রতি ৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে এক জন করে স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৩ সালে ভারতে বিবাহিত পুরুষের আত্মহত্যার সংখ্যা আত্মঘাতী বিবাহিত মহিলার দ্বিগুণেরও বেশি। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার অনুপাতটাও প্রায় একই রকম। গত বছর ২১,০৯৬ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন কেবল পারিবারিক ঝামেলা থেকে চিরমুক্তি পেতে। পাশাপাশি, একই কারণে আত্মঘাতী মহিলা ১১,২২৯ জন। সব ক’টি আত্মহত্যাই দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এই তথ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পুরুষও কোনও অংশে কম চাপে নেই। থাকার কথাও কি ছিল?
৪৯৮এ-র রাস্তায় হাঁটা কী হারে বাড়ছে, ২০১২ আর ২০১৩ সালের তুলনাই তা বলে দেয়। মাত্র এক বছরে বৃদ্ধির হার ১১.৫%-এরও বেশি। সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গেই। অথচ এ রাজ্যে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ২.৩% ক্ষেত্রে। গোটা দেশেই, বিগত বছরগুলির মতো ২০১৩ সালেও, এই ধারায় বেশির ভাগ মামলারই কোনও গতি হয়নি। দেশ জুড়ে দোষী সাব্যস্ত করা গিয়েছে মাত্র ১৬% ক্ষেত্রে।
এ কথা হয়তো সত্যি যে, আজও অনেক নির্যাতিতাই ৪৯৮এ-র নামটুকুও শোনেননি। অনেকে থানা-পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারেন না। কিংবা ৪৯৮এ দায়ের করলেও চার দেওয়ালের অন্ধকারে ঘটে চলা অত্যাচার প্রমাণ করাও সব সময় সহজ হয় না; মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে তো আরওই নয়। কিন্তু তাতে তো ভুয়ো মামলাকারী ধান্দাবাজ স্ত্রীদের অস্তিত্বটা মুছে যায় না। শাস্তি না চেয়ে সুরক্ষা চাইলে, অনেকে তো ৪৯৮এ-র বদলে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আইনেও মামলা করতে পারতেন। অনেকে তো ঝক্কি পুইয়ে মামলাটুকুও আর করেন না— এই ৪৯৮এ ঠুকলেন বলে— স্রেফ এমন থ্রেট-এর উপর শ্বশুরবাড়িকে রেখেই কাজ হাসিল করেন। ‘নন বেলেব্ল’ আর ‘কগ্নিজেবল’-এর সাঁড়াশি আক্রমণকে অস্ত্র বানিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে ‘দু’দিনের শ্বশুরবাড়ি’ থেকে মওকা বুঝে মোটা অঙ্ক হাতিয়ে নেওয়া, কোনও অবৈধ সম্পর্ক ফাঁস হয়ে গেলে পালটা চাপ সৃষ্টি, প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে ডিভোর্সের পথ সুগম করা, স্বামীকে তার বাপ-মা’কে ছেড়ে আলাদা সংসার পাততে বাধ্য করা, কিংবা বিবাহপূর্ব অসুস্থতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত কোনও গোপন সত্য প্রকাশ হয়ে গেলে তার পালটা— এমন হরেক কারণই নাকি ৪৯৮এ অপব্যবহারের নেপথ্যে থাকে, বলছে এ নিয়ে কাজ করা একাধিক এনজিও। এমনকী স্রেফ ৪৯৮এ কাজে লাগাবেন অদূর ভবিষ্যতে, এমন মতলবেও নাকি ইদানীং কোনও কোনও মহিলা বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন।
কলকাতার হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং ‘পীড়িত পুরুষ পতি পরিষদ’-এর কর্ণধার রাধিকানাথ মল্লিকের বক্তব্য এ বিষয়ে একই। তাঁদের সাফ কথা— আর পাঁচটা আইনের সঙ্গে ৪৯৮এ-কে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এই আইনের সঙ্গে সমাজ জড়িয়ে, পরিবার জড়িয়ে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বহু নির্দোষ স্বামী। মিথ্যে অভিযোগে তাঁর নিকটজনেরাও সমান ভাবে হেনস্থা হচ্ছেন। জেল খাটছেন, চাকরি খোয়াচ্ছেন, অপমানে ধ্বস্ত হচ্ছেন, কেউ বা এ জীবনটাই শেষ করে দিচ্ছেন। বৃদ্ধ, শিশু, এমনকী পরিবারের অন্য মহিলারাও পার পাচ্ছেন না। শুধু ২০১৩ সালেই ৪৭,৪৭১ জন মহিলা গ্রেফতার হয়েছেন এই আইনে। কারাবাসী সেই ননদটির কথা ভাবুন, এক দিন যে নতুন বউদির দিকে সৌজন্যের হাতই বাড়িয়ে দিয়েছিল। হয়তো সামনেই তার বিয়ে, কথা চলছে। কিংবা একটা চাকরির কল আসার প্রতীক্ষায় সে। এ বার সেই স্বপ্নমাখা ভবিষ্যতে বেশ খানিকটা অন্ধকারই গাঢ় হয়ে এল না? বহু ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি যে কষ্ট পাচ্ছে, সে একটি শিশু, নিজেরই সন্তান। শুধু তাই নয়, সামগ্রিক ভাবে কলুষিত হচ্ছে দেশের আইনব্যবস্থা। গুচ্ছের ভুয়ো কেসের ঠেলায় আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, অহেতুক দীর্ঘায়িত হচ্ছে অনেক ‘সত্যিকারের’ বধূ নির্যাতনের মামলা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ ঘোষণা করেছে, এ দেশে বয়স্কদের নিগ্রহের অন্যতম বড় কারণ ৪৯৮এ-র অপব্যবহার। মার্কিন প্রশাসন, কানাডা প্রশাসন আজ তাঁদের নাগরিকদের এই আইনের ‘ব্যথা’ মনে করিয়ে সতর্ক করছে, দু’বার ভেবে দেখতে বলছে, কোনও ভারতীয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার আগে!
এখন ‘সেভ বেঙ্গলি ফ্যামিলি’-র মতো সংস্থা বলছে পরিবার বাঁচিয়ে রাখার কথা। ভুয়ো ৪৯৮এ-র শিকার অসহায় স্বামীদের পাশে দাঁড়াতে মাস কয়েক আগেই মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে ‘সেভ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি’-র কলকাতা শাখা ‘হৃদয়— নেস্ট অব ফ্যামিলি হারমনি’। আইনি পরামর্শ পেতে দেশের ৫০টি শহরের ৫০টি এনজিও-র তথ্য সেখানে মিলবে। অনলাইন পরামর্শ, এ সংক্রান্ত যাবতীয় খবরাখবর কিংবা ভুয়ো ৪৯৮এ-র ভুক্তভোগীদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছে www.498a.org। হয়তো এই সব পুং-সংস্থার কিছু বক্তব্য যুক্তিরহিত ভাবেই তীব্র নারীবিদ্বেষী ঠেকবে, কিন্তু গোটাটাই যে লিঙ্গ-পক্ষপাতের অসারতায় পূর্ণ, এমনটাও নয়।
এত এত ভুয়ো ৪৯৮এ দায়ের হওয়ার নেপথ্যে দুষ্ট মহিলাদের হাত নেই— এমন একটা ‘প্রায়-স্বতঃসিদ্ধ’ ঝুড়ি-কোদাল সহযোগে প্রমাণে নারীবাদী সমাজকর্মী ও আইনজীবী ফ্লেভিয়া অ্যাগনেস-এর মন্তব্য প্রায়শই উদ্ধৃত হয়— নিম্ন আদালতের কিছু উকিল ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশই নাকি ৪৯৮এ ব্যবহারে মূল কালপ্রিট। আবার একই সঙ্গে যুক্তি দেওয়া হয়— ৪৯৮এ-র ক্ষেত্রে চার্জশিট দেওয়ার মাত্রা যথেষ্ট উচ্চ, মানে, পুলিশ তদন্ত চালিয়ে অভিযোগ যথাযথ মনে করেছে এবং চার্জশিট দিয়েছে। অর্থাৎ, একই পুলিশ যুগপৎ সৎ ও অসৎ! শ্রডিংগারের বেড়ালের মতো এখানে দুর্বোধ্য কোয়ান্টাম ফিজিক্স কাজ করতে পারে, ৪৯৮এ পারে কি!
অতঃ কিম? বিবাহের ঠিক পরেই যে স্বামীটি মনেপ্রাণে বাঁচতে চেয়েও ধনেপ্রাণে মরতে বসে, তাকে অক্সিজেন দেবার উপায়? তার সব বুকে-ব্যথা তো গ্যাস অম্বল থেকে হয়নি— কিছু বেদনার জন্ম প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকে আসা আকস্মিক আঘাতে, কিছু বা তজ্জনিত হার্ট অ্যাটাকে! কেউ বলছেন, ‘৪৯৮বি’ নামে পুরুষের অধিকার নিয়ে আইন প্রণয়ন হোক। বিচারপতি মলিমথ কমিটি পরামর্শ দিয়েছে, ৪৯৮এ-কে জামিনযোগ্য (বেলেব্ল) ও মীমাংসাযোগ্য (কম্পাউন্ডেব্ল) করার। আইনটিকে আগাগোড়া ঠান্ডাঘরে পাঠাতেও চাইছেন অনেকে। কেউ বলছেন, ৪৯৮এ থাকুক, কিন্তু বদলাক— এ ধারায় মামলা করার আগে বাধ্যতামূলক করা হোক কাউন্সেলিং। তাঁরা একমত, সময় বদলেছে, যুগের সঙ্গে আইনেরও বদল দরকার— পারস্পরিক কলহের কেন্দ্রে আজ আর শুধু পণের গয়না কি ক্যাশটুকুই নেই— চ্যাট আছে, ফেসবুকও আছে। আসলে, আমাদের বোঝার সময় এসেছে— আইপিসি ৪৯৮এ সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়।
আর, একটু মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে— গত শতকের শেষ দিকে মার্কিন সমাজকর্মী ওয়ারেন ফ্যারেল-এর ঠাট্টা-ছলে বলা খাঁটি কথাটির প্রতি: In the past quarter century, we exposed biases against other races and called it racism, and we exposed biases against women and called it sexism. Biases against men we call humor.

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ আগস্ট ২০১৪

04 May 2014

ভোটের কালি

সুস্নাত চৌধুরী


ভোটের দিন তর্জনী উঁচিয়ে কথা বলা মানেই যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কিচাইন, এমনটা মোটেই নয়। ঠিকঠাক আঙুল তুললে নির্বাচন কমিশন বরং আপনাকে সাধুবাদই জানাবে। আপনার আঙুল, স্বাধীন গণতান্ত্রিক আঙুল। ভোটাধিকার প্রয়োগের সে একমাত্র প্রমাণ। ডাবল এক্সএল গণতন্ত্রের তুখোড় বিজ্ঞাপন। কারণ ততক্ষণে সেই তুলে ধরা আঙুল গৌরবের কালিমালিপ্ত। ওই একদিন কালি মাখার ব্যাপারে ফ্রম অম্বানি টু কামদুনি একই সারিতে। ভোটের লাইন। আর বাঁ হাতের তর্জনীতে জ্বলজ্বল ভোটের কালির টিপ। 
এক চুটকি ‘কালি’ কি কিমত তুম কেয়া জানো রমেশ বাবু! সেদিনের নকশাল কিংবা আজকের মাওবাদীদের দিকে আঙুল তুলেই এমন প্রশ্ন আপনি করতে পারেন ভোটের দিন। নকশাল জমানার ইনারশিয়ায় দিনযাপন করা অনেকেই নাকি বলতেন --- ‘আমি কক্ষণও আঙুলে কালি মাখিনি’। যেসব বিপ্লব দাশগুপ্তদের নির্বাচনী রাজনীতিতে অবিশ্বাসের ভূতে পেয়েছে, ভবিষ্যত তাঁদের আর বুথে পায়নি। তাঁদের কাছে ভোটের কালি মানে কলঙ্ক। ওই অম্বানি থেকে কামদুনির আপামর ব্যান্ডের বাইরে এঁদের আদর্শগত অবস্থান। অবশ্য ভোটপুজোর এই পুণ্যতিথিতে কংরেজ-তিনোমূল-ছিপিএম ছেড়ে এমন অ-কালি দলের সমর্থক আর কতজনই বা! নইলে কি আর রাজধানী দিল্লির বুকে গত বছর এতটা সাড়া ফেলতে পারত ‘রক দ্য ভোট’ ক্যাম্পেন! জেন নেক্সটকে ভোট দেওয়ার জন্য চাগাতে এম টিভি’র পরিকল্পনা --- ভোটের পর ঝিনচ্যাক লাইভ কনসার্ট। সেই অনুষ্ঠানের গেটপাসটি ছিল খাসা --- কালিমাখা তর্জনী! নিজের নিজের আঙুল দেখিয়ে ভেতরে ঢোকা। আপনার আঙুলই আপনার পরিচয়। সেখানে এক চিলতে কালির দাগ মানেই... রকিং!
ভোটের কালি। পরিভাষায় ‘ইনডেলিবল ইঙ্ক’। অনপনেয় কালি। একটুকু ছোঁয়া লাগলেই হল, মুহূর্তে গেঁড়ে বসবে দাগ। তারপর বেশ ক’দিন নট নড়নচড়ন। ছাপ্পা ভোট রুখতে, একই ব্যক্তি যাতে একাধিকবার ভোট দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে মোক্ষম দাওয়াই। ফেয়ার ইলেকশনের জন্য ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনিবার্য পথ। চলতি লোকসভা ভোটেও তাই আমার-আপনার হাতে পড়ছে এই ফেয়ার অ্যান্ড আগলি অনপনেয় কালি।

কে বানায় ভোটের কালি
জেরক্স মেশিন থেকে ফাউন্টেন পেন, চাইনিজ ইঙ্ক থেকে ভুষি --- হরেক রকম কালি আপনি বাজারে পেতে পারেন, কিন্তু মাথা কুটে মরলেও ভোটের কালির দোয়াতটি জুটবে না। খোলা বাজারে এই কালি বিক্রিই হয় না। বরাত দিয়ে বানাতে হয়। বরাতজোর থাকলেও উপযুক্ত কার্যকারণ বা সরকারি শিলমোহর না দেখাতে পারলে সে কালি আদৌ আপনার হস্তগত হবে কিনা, বলা মুশকিল। এমনকী এই কালি বানানোর অথরিটিও রয়েছে গোটা দেশে মোটে দু’একটি সংস্থার হাতেই।
তার মধ্যে প্রধান মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড। সংক্ষেপে ‘এমপিভিএল’। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ভোটের কালি নির্মাতা। এবারের লোকসভা ভোটেও সারা দেশে কালি সাপ্লাই করেছে কর্নাটকের এই সংস্থাটিই। মাইসোরের এককোণে ষোলো একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই কারখানা। ১৯৩৭ সালে মাইসোরের রাজ পরিবারের আনুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংস্থা। তখন মাইসোরের মহারাজ চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওদইয়ার। শিল্পোদ্যোগী মানুষটি ঠিক করলেন, আশপাশের জঙ্গলকে কাজে লাগিয়ে বড়সড় আকারে মোম উৎপাদন করতে হবে। এককোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতার দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হল মাইসোর ল্যাক ফ্যাক্টরি। সেই মোম উৎপাদনের ট্র্যাডিশন আজও রয়েছে। ব্যালটে ভোট হলে, সেই ব্যালটবাক্স সিল করার সময়ও এই কারখানার মোমই ব্যবহার করা হত। আজও রোজ রাতে কারখানা বন্ধের সময় তালা দিয়ে সেই তালা নিজেদের বানানো মোমেই সিল করা হয়। ১৯৪৭ সালে কর্নাটক সরকার সংস্থাটিকে অধিগ্রহণ করে। পরিণত হয় পাবলিক সেক্টরে। শুরু হয় রং উৎপাদনও। সংস্থাটির নতুন নাম হয় মাইসোর ল্যাক অ্যান্ড পেন্টস লিমিটেড। ১৯৮৯ সালে আবার কিছু পরিবর্তন। তার পর থেকে মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড নামেই সংস্থাটি পরিচিত। বর্তমানে মোম ও নানা ধরনের রং ছাড়াও পালিশ, প্রাইমার, ডিস্টেম্পার, সিন্থটিক এনামেল ইত্যাদি তৈরি হয় এখানে। রীতিমতো লাভজনক একটি পাবলিক সেক্টর। নানাবিধ গবেষণা ও খাঁটি মালই এঁদের ইউএসপি। তবে আজও সংস্থাটি সবচেয়ে বেশি লাভ করে ভোটের কালি থেকেই।
১৯৬২ সালে দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রথম ব্যবহৃত হয় ভোটের কালি। সেই শুরু ইনডেলিবল ইঙ্ক প্রস্তুতি। তারপর দেশজুড়ে লোকসভা, বিধানসভা বা স্থানীয় নির্বাচনে নিরন্তর কালি জুগিয়ে আসা। দিন যত গড়িয়েছে, ভোটার তত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লাভও। গড়পড়তা একটা হিসেব বলছে, দেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ছশো কোটি ভোটারের হাতে দাগ ফেলেছে এই কালি। আর বিদেশেও এই সংস্থার কালি হাতে-মাখা ভোটারের সংখ্যাটা কম নয় --- চল্লিশ কোটি। হ্যাঁ, বহু দেশে ভোটের কালি রফতানি হয়েছে, হচ্ছেও, এই সংস্থা থেকে। নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক, কানাডা, মায় বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় এই কালি। কখনও আবার অনুদান হিসেবেও একেবারে গণতান্ত্রিক সৌজন্যে বিনি পয়সায় এই কালি দিয়েছে ভারত। তার ঠিকানা কখনও কম্বোডিয়া, কখনও আফ্রিকার লিসুটু।

লোকসভা ২০১৪
ক’দিন আগে পর্যন্তও নাওয়া-খাওয়ার সময় পাননি মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেডের দুই শতাধিক কর্মচারি। ওভার টাইম করে সামলাতে হচ্ছিল চলতি লোকসভা ভোটের জন্য কালি তৈরির কাজ। এক দফায় এত কালি এর আগে কখনও লাগেনি। দেশে এবার মোট ভোটার একাশি কোটিরও বেশি। ওয়েস্টেজ ধরে অর্ডার ছিল প্রায় বাইশ লক্ষ কৌটো কালির। দশ মিলিলিটারের একটি পাত্রের দাম দেড়শো টাকার কাছাকাছি --- মানে, প্রায় একত্রিশ কোটি টাকার বিক্রি।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে লেগেছিল প্রায় বিশ লাখ কৌটো কালি। কৌটোগুলি ছিল এবারের মতোই দশ এমএল-এর। কিন্তু ২০০৪ সালে কালির বরাত ছিল অনেক কম। পাঁচ মিলিলিটারের ছোটো কৌটো সেবার গিয়েছিল ১৭ লাখ মাত্র। শুধু ক্রমবর্ধমান ভোটারের সংখ্যা নয়, এই হিসেব আসলে নির্ভর করে কালি লাগানোর পদ্ধতির উপর। ২০১৪-র এই লোকসভায় দশ এমএল-এর একটি কৌটো খুললে গড়ে পাঁচশো জনের হাতে কালির দাগ পড়বে বড়জোর। কিন্তু আট-ন বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না। মনে করে দেখুন, তখন ভোট দিলে তর্জনীর নখ আর ত্বকের সন্ধিস্থলে একটি আড়াআড়ি দাগ পড়ত। আর এখন পড়ে লম্বা একটি দাগ, তর্জনীর প্রথম গাঁটটির আগের চামড়া থেকে নখের উপরিভাগ পর্যন্ত। স্বভাবতই কালি লাগে বেশি। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন এই নতুন নিয়ম চালু করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯-এ কালির প্রয়োজনও তাই এক লাফে এতটা বেড়ে যায়। শুধু সময়ের সঙ্গেই নয়, রাষ্ট্রভেদেও এই হিসেব বদলায়। কারণ কালি লাগানোর পদ্ধতি একেক দেশে একেক রকম। যেমন, ভারতে কালি লাগানো হয় কাঠি জাতীয় কোনও বস্তুর সাহায্যে, আবার আফগানিস্তানেই ভোটের কালি লাগানো হয় মার্কার পেন দিয়ে। এতে কালি খরচ হয় কম। কম্বোডিয়া বা মালদ্বীপে গোটা তর্জনীর উপরিভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয় কালিতে। আফ্রিকার কোনও কোনও দেশ যেমন বুরকিনা বা বুরুন্ডিতে ভোটের কালি লাগাতে ব্যবহৃত হয় ব্রাশ। তুরস্কে নজ্‌ল থেকে কালির ফোঁটা ফেলা হয় আঙুলে।

কালির কেমিস্ট্রি
কী থাকে ভোটের কালিতে? কেন তা কিছুতেই মোছে না? গোটাটাই রসায়নের খেলা। কিন্তু ধাঁ করে পুরো ইকুয়েশনটা বলে ফেলা সম্ভব নয়! ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরি এই সিক্রেট ফরমুলা তুলে দেয় মাইসোরের ওই কালি নির্মাণকারী সংস্থার হাতে। আজও তা গোপনই রয়েছে। দু-একজন বাদে সংস্থার কর্মীরাও পুরোপুরি জানেন না, আসলে ঠিক কী করে তৈরি হয় এই কালি। তবে, সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই কালি আসলে রুপোর এক রাসায়নির পদার্থ (সিলভার নাইট্রেট বা AgNO3) আর পাতিত জলের মিক্সচার। সঙ্গে কিছুটা অ্যালকোহল, যাতে চট করে শুকিয়ে যায় কালিটি। আর থাকে বিশেষ কিছু রং। এখন এই সিলভার নাইট্রেটই হচ্ছে আসল মক্কেল! চামড়ার প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সে ফেলে বিশেষ এক প্রকার অধঃক্ষেপ, যা এক্কেবারে সেঁটে যায় চামড়ার সঙ্গে। সিলভার নাইট্রেটের আধিক্য যত বেশি থাকবে, তত টেঁকসই হবে কালি। আমাদের দেশে সচরাচর আঠেরো শতাংশের কাছাকাছি থাকে সিলভার নাইট্রেটের ঘনত্ব, তাতে হপ্তা তিনেকের জন্য নিশ্চিন্তি! আর, কালি লাগানোর পর এক ছটাক অতিবেগুনি রশ্মি যদি তার উপর পড়ে, তবে তো রুপোয় সোহাগা! বেগুনি কালি রং বদলে কালচে-বাদামি হয়ে আরও চিপকে বসে আঙুলে।
তবে ভোটের কালির রংবাজি যে শুধু বেগুনিতেই, তা নয়। রেয়ার হলেও, অন্য রঙের ভোটের কালিও দেখা যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার সুরিনেম দেশটিতে এই কালির রং কমলা। ভোটারদের আকর্ষণ করতে একদা ডাচ কলোনি সুরিনেমের জাতীয় রঙের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই এই রং বদল।

মোছে না সে মোছে না
ভোট দিয়ে বেরিয়েই আঙুল থেকে কালির দাগটি ভ্যানিশ করে দেওয়া যায় কিনা জাদুকর সরকার জানেন না, কিন্তু শরদ পাওয়ার জানেন। নইলে কেন আর খুলে আম সমর্থকদের কালি মুছে বারবার ভোট দিতে বলে কমিশনের শো-কজ খাবেন! আসলে স্যাট করে ভোটের কালি তুলে ফেলাটা একটা মিথের মতো। কোনও কেমিস্ট্রি বইতে লিখবে না, কোনও প্রাইভেট টিউটর বুঝিয়ে দেবে না, মায় ইন্টারনেটও উপরচালাকির ভ্যান্তাড়া কষবে --- শুধু মাতব্বরের মতো ঠোঁট বেঁকিয়ে হাফ-ক্যাডার বন্ধুরা চিরকাল বলে আসবে --- হয়, হয়, জানতি পারো না! ভাবখানা এমন --- জানি বিলক্ষণ, কিন্তু তোমায় বলা চলে না কাকা! কেবল নিষিদ্ধ মন্ত্রের মতো ভোটের বাতাসে ফিসফিস ঘুরে বেড়াবে কাল্পনিক সব টোটকা। কেউ বলবে, পাতি টুথপেস্ট লাগিয়ে পনেরো মিনিট রাখতে হয়, তারপর দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আলতো ঘষলেই রং হাওয়া। অথবা, খানিক দুব্বো ঘাস তুলে তার রসটুকু লাগাতে হবে, তাতেই নাকি কালির জারিজুরি শেষ! কেউ বা আরও ক্রিয়েটিভ, তাদের টোটকা কখনও পেঁপে গাছের দুধ-রস, কখনও ব্লিচিং পাওডার আর ফিনাইলের মিক্সচার! কেউ আবার ভেবেচিন্তে জানাবে, এ তো সিম্পল, এক টুকরো সিরিষ কাগজ নিয়ে বার কয়েক ঘষলেই হল! কেউ বাতলাবে প্রকৃতই সৃজনশীল উপায় --- দেশলাই কাঠি জলে ভিজিয়ে শুধু তার বারুদটুকু কালির উপর ঘষতে হবে একশো আটবার। সর্বজ্ঞের ভাবখানি দেখিয়ে কেউ বলবে, আরও আগে থেকে নাকি মাঠে নামতে হয়! মানে, ভোট দিতে যাওয়ার আগেই হাতে স্বচ্ছ নেলপালিশ বা গঁদের আঠা লাগিয়ে নিতে হবে। তাতে একটা আস্তরণ পড়ে যাবে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। তারপর ভোট দিয়ে বেরিয়ে নেলপালিশ রিমুভার দিয়ে বা এমনিই ঘষে-ঘষে তুলে ফেললেই হল। ব্যস, হাত ধুয়ে, আবার দাঁড়িয়ে যাও! তবে, রাসায়নিক ও রাজনৈতিক এসব আনফেয়ারি টেলের মোরালে ঘাপটি মেরে থাকে দু’টি জিনিস। এক : সাংবিধানিক অপরাধ। দুই : আঙুলের দফারফা।

হাতকাটা কার্তিক
ভাগ্যিস পেটো বাঁধতে গিয়ে ফুটো মস্তান কার্তিকের বাঁ হাতটি ওড়েনি, নইলে ভোট দেওয়ার আগে অহেতুক টেনশন পোহাতে হত হাতকাটা কার্তিককে। বাঁ হাতই যদি না থাকে, তাহলে কোথায় আর বাঁ হাতের তর্জনী, কোথায়ই বা ভোটের কালির দাগ! আজ্ঞে না, এসব ক্ষেত্রেও স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কারো বাঁ হাতে তর্জনী না থাকলে, কালি লাগাতে হবে বাঁ হাতেরই অন্য কোনও আঙুলে। বাঁ হাতে যদি কোনও আঙুলই না থাকে, তাহলে ডান হাতের তর্জনী। সেটিও যদি না থাকে, তবে বাছতে হবে ডান হাতের মধ্যমা থেকে শুরু করে অন্য কোনও আঙুল। সে গুড়েও বালি হলে, মানে, ভোটারের কোনও হাতেই যদি আঙুল না থাকে, তাহলে দু’টি হাতই যেভাবে আছে, সেখানেই ভালো করে মাখাতে হবে ভোটের কালি।

বিতর্কিত কালি
ভোটের কালি চট করেই উঠে যাচ্ছে --- এমন অভিযোগ মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান কি কম্বোডিয়ায় অনেকবার শোনা গিয়েছে। কখনও এর কারণ হয়েছে ভুলবশত কালি বদলে যাওয়া, কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে কালিতে ভেজাল দেওয়া। এসব চিরাচরিত বিতর্কের বাইরে ভোটের কালি নিয়ে আরও নানা বিচিত্র প্রশ্নও কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে। এবারই অন্ধ্রপ্রদেশে ৩০ মার্চ থেকে ৭ মের মধ্যে অনেকগুলি ভোট হচ্ছে। ৩০ মার্চ ১৫৬টি জায়গায় পুরভোট হয়েছে, মাঝে পঞ্চায়েত ভোট, আবার ৩০ এপ্রিল ও ৭ মে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর নির্বাচন পড়ায় অনেকেই ঘোর দুশ্চিন্তায় --- লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের আগে যদি পুর বা পঞ্চায়েত ভোটের কালি আঙুল থেকে না ওঠে, তাহলে কী হবে? আবার ২০০৮-এ মালয়েশিয়ায় ইলডেলিবল ইঙ্ক চালু করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেও, নির্বাচনের চারদিন আগে তা বাতিল করতে হয়। কারণ, শেষবেলায় চোখে পড়ে, তখনও সেদেশের সংবিধানে এই আইনটিই হয়নি যে, কারো হাতে ভোটের কালি থাকলে সে আর ভোট দিতে পারবে না! আবার জিম্বাবোয়েতে দেখা গিয়েছে, ভোটের পরে কারো হাতে কালির দাগ না থাকলে, মিলিটারিই অত্যাচার চালিয়েছে। ভোট দাওনি কি মরেছো, সিধে কথা! বাংলাদেশে দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর নাকি উলটো ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের হাতে কালির দাগ রয়েছে, তাঁদের উপরই চলেছে নির্যাতন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ছত্তীশগড়ের বহু মানুষই যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, ভোটের পর তাঁদের আঙুলে যাতে কালি না লাগানো হয়। কারণ মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে তাঁরা যে সাড়া দেননি, তা বোঝা গেলে তো কপালে ঢের দুঃখ!
হাতে রইল ভোটের কালি তার চেয়ে, সকাল সকাল ভোট দিন। আপনি পাতি ভোটার, প্রতিশ্রুতি মাফিক ভোটের পর আর কিছু পান না-পান, দু’তিন সপ্তাহের জন্য কালির গ্ল্যামারটুকু আপনার আঙুলে অ্যাসিওর্ড। ভবিষ্যতে বায়োমেট্রিকের থ্রেট আছে বটে, আধার কার্ড একদিন আঁধারে ঠেলে দিতেই পারে ভোটের কালিকে, কিন্তু সে ঢের দেরি। তার আগে আপনি দিনভর, সপ্তাহভর, ভেজাল না থাকলে মাসভর গণতন্ত্রের স্মৃতি রোমন্থন করুন। দেখুন, দেখান। আপনি কক্ষণও ভাববেন না যে গণতন্ত্র আপনাকে প্রতারক ভেবেছে, কক্ষণও ভাববেন না যে আপনি ফের এসে ভোট দিতে পারেন সন্দেহ করে আপনার আঙুলে গণতন্ত্র কালি মাখিয়েছে। সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের দোহাই দিয়ে আপনি ঘুণাক্ষরেও গুনগুন করবেন না শ্যামাসঙ্গীত --- ও মা কালী, চিরকালই সঙ সাজালি এ সংসারে! কালির দিব্যি খেয়ে আপনি কেবল ভাববেন সেই বছর চারেকের ডেঁপো ছোঁড়াটির গপ্পো। মায়ের কোল থেকেই যে হেবি রেলায় চেঁচাচ্ছিল, ‘এইযো... আমি ভোট দিয়েছি’! তার কচি হাতে তখন ইনডেলিবল ইঙ্ক। পিছনে পালস পোলিও-র ব্যানার।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে ২০১৪

15 April 2014

ছ’টা=সাড়ে ছ’টা=সাতটা

সুস্নাত চৌধুরী


কাকের ক্যাকোফোনি কানে তোলেনি বাঙালি। নইলে শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে তো কবেই সেই ভারী প্রশ্নটা করে ফেলেছিল— ‘তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?’ কিন্তু ‘কাকস্য’ পরিবেদনা! বঙ্গালি বং হল, ট্যাঁকঘড়ি থেকে মোবাইলে শিফ্ট করল, তবু তার জীবনদর্শন রয়ে গেল একই— লেট্স বি লেট! দেরি করতে সে কক্ষনও দেরি করেনি। প্রেমিকা থেকে পাওনাদার, যে কোনও কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখতে সে আর জায়গা পায়নি— রেলাভরে রেলস্টেশনের বড়ঘড়ির তলাকেই বেছে নিয়েছে। ঘাড় তুলে গোন পাগলা, কত ক্ষণ লেটে আসছি আমি! তাবৎ বাঙালির আইকনিক ওয়েটিং রুমটির মাথায় ছাদ দিয়েছে হাওড়ার বড়ঘড়ি।
ঘড়ি চিরকালই বাঙালির কবজিতে শ্রেষ্ঠ অর্নামেন্ট। দেওয়ালে সেরা শো-পিস। বাঙালির কাছে সে টোটাল হেরে গিয়েছে। নইলে কি প্রতুলচন্দ্র সরকারের সেই জাদুটির কথা বার বার বাঙালি সগর্বে স্মরণ করে! মঞ্চে পৌঁছতে সে দিন বেশ বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল পি সি সরকার সিনিয়রের। অতঃপর স্রেফ সম্মোহনের কৌশলে সময়কেও বশ করলেন তিনি। ঘড়ির কাঁটা যেন উলটো দিকে ছুটল। খানিক আগেও যারা পাংচুয়ালিটি নিয়ে সোচ্চার লেকচার ঝাড়ছিল, তাদেরও হতভম্ব হয়ে গুনগুন সলিলকি— না হে, সময় তো দেখছি এখন ঠিকই আছে! এই ম্যাজিক বাঙালি হেবি খেয়েছিল, আজও আপিসে-ইস্কুলে শুরুর ঘণ্টা বেজে গেলে নানা বাহানায় বদহজমের চোঁয়া ঢেকুর সে ভরপুর তোলে। লেট মার্ক খেয়েও বেহেলদোল স্মার্টনেসে ভাবখানা তার এমন— সে যখন মাঠে নামে, তখনই কিক-অফ! আসলে সময়কে মান্য করা নয়, মহৎ-পাতি নির্বিশেষে বাঙালি চির কাল সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। বেলা পড়ে এলেও বোকাসোকা গোপীনাথ ওস্তাদকে ভৈরবী রাগিণী গাওয়ানোর জন্য বাঙালি তার ‘স্বকাল’ নির্মাণ করে নিয়েছে। গাঁয়ের মাতব্বরদের সেই আড্ডা আসলে গড় বাঙালির মনের কথাই বলে— ‘আমার এই যষ্টির ছায়া... যত ক্ষণ না পর্যন্ত ওই প্রস্তরখণ্ড স্পর্শ করছে, তত ক্ষণ সকাল।’ আবার বেয়াড়া সুরের তাড়নায় সমবেত মশকরা পরক্ষণেই ঘোষণা করে দেয়— ‘সকাল ফুরিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল...’! ঠিক যেমন আজকের কবিয়াল গেয়ে ওঠেন— ‘ধরা যাক আজ রোববার কোনও কাজ নেই... ধরা যাক আজ রোববার কোনও তাড়া নেই...’। ক্যালেন্ডারকে তুড়ি মেরে, আপনার উইক-এন্ড বাঙালি আপনি রচনা করে। বাঙালি জাতির কাছে যদি ধরা হয় সরা, তবে রাত হবে দিন, এ আর কী কঠিন! এই ঘড়ি ধরে মারো টান ল্যাদ কি বাঙালির বাপের সম্পত্তি নয়?



ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
বাঙালি জানে, ‘পাংচুয়ালিটি’র বাংলা ‘সময়জ্ঞান’। ‘পাংচুয়ালিটি’ মানে যে আসলে ‘দায়িত্বজ্ঞান’, তা বাঙালিকে কে শেখাবে? ঔপনিবেশিক খোঁয়াড়ি তার শিরায়-স্নায়ুতে আজও নানা রূপে বহমান, কিন্তু এই জিনিসটি সে লালমুখোদের থেকে দুশো বছরেও শিখতে পারেনি। এক ‘ইউরোপীয় বাঙালি’র কাছে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন বিখ্যাত এক বাঙালি সাংবাদিক। পটভূমি বিলেত। হোটেল থেকে বেরিয়ে সেই বাঙালির বাড়িতে পৌঁছতে পাঁচ মিনিট মোটে লেট হয়েছিল সাংবাদিকের। নক করার পর, সে দিনের মতো নক আউট হয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল— দরজার ও-পারে যাওয়ার আর অধিকার মেলেনি। আবার পর দিন। এ বার আধ ঘণ্টা আগে পৌঁছে উনত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করে তবে কলিং বেলে হাত ছোঁয়ান ওই সাংবাদিক। প্রবেশাধিকার মেলে। সাক্ষাৎকার দিতে সে দিন নাকি আর কোনও বেগড়বাঁই করেননি নীরদ সি চৌধুরী!
জাপানে গিয়েও নাকি ভারী বিড়ম্বনায় পড়েছিল এক বাঙালি। অচেনা দেশে ঠিক জায়গায় নামতে যাতে সমস্যা না হয়, তাই ট্রেনে ওঠার আগেই সে জানতে চাইল, অমুক স্টেশনে তাকে নামতে হবে, তো তার আগের স্টেশনের নামটি কী? অবাক কণ্ঠে ছুটে এল স্পষ্ট জবাব, পাঁচটা তেইশে যেখানে ট্রেন দাঁড়াবে, সেখানে নামতে হবে। সে যতই জিজ্ঞেস করে, আগের স্টেশনের নাম কী, ততই উত্তর আসে, পাঁচটা তেইশ। পাঁচটা তেইশ অবধি অপেক্ষা করে বাঙালি বাবুটি ঠাওর করেছিল, পাংচুয়ালিটি কারে কয়! রোজকার মতোই ঠিক তখনই ওই স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল ট্রেন। অতঃপর বাঙালি নামে। জাপানিরা ওঠে।
অথচ বাঙালির শহুরে রূপকথা মেট্রো রেলও আজ পাঁচ-দশ মিনিট অন্তরই ডিজিটাল বোর্ডে তার নীল আর হলুদ সময়ের তুলনা দিয়ে জাহির করে, এই দু-এক দশকেই সে কত্তখানি বাঙালি হয়ে গিয়েছে! শিয়ালদা-ডানকুনি লাইনে ডেলি প্যাসেঞ্জারির সূত্রেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি এক বিচিত্র টাইমটেব্ল পকেটে রাখতেন। নিজেরই বানানো। তাতে প্রতিটি ট্রেনের নম্বরের পাশে লেখা থাকত, আসলে ওই ট্রেনটি গড়পড়তা য’টা নাগাদ আসে, সেই সময়টি! বলা ভাল, টাইমটেব্লের প্যারডি। এখন প্রশ্ন হল, কোনটি প্যারডি, আর কোনটি অরিজিনাল!
ট্রেনের স্টেশনে ঢুকতে, দিদিমণির ক্লাসে ঢুকতে, গবেষকের সেমিনারে ঢুকতে, কেরানির আপিসে ঢুকতে... সব রকমের ঢোকাঢুকির ক্ষেত্রেই এই যে বাড়তি সময়টুকু, বাঙালির কাছে টেক্ন ফর গ্র্যান্টেড। বছর পনেরো আগের কথা। সন্ধে ছ’টা থেকে কলকাতার এক মঞ্চে সে দিন একটি বাংলা ব্যান্ডের অনুষ্ঠান। কী করে কে জানে, একেবারে যথাসময়েই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সোয়া ছ’টা নাগাদ হঠাৎই গেটের মুখে জোর বাওয়াল! ব্যান্ডেরই এক সদস্যের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড় দশ-বারো জন দর্শকের। তাঁদের অভিযোগ, কেন শুরু হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠান? ব্যান্ড-সদস্য জানান, কার্ডেই তো সময় লেখা রয়েছে: ছ’টা। বিক্ষুব্ধ দর্শকদেরও তখন বক্তব্য সেটাই— ‘আরে দাদা, সেই তো বলছি! পরিষ্কার লেখা রয়েছে, সন্ধে ছ’টায় প্রোগ্রাম। আর এখন সবে সোয়া ছ’টা, শুরু হয়ে গেল?’
‘আই এস টি’ মানে আজ বাঙালির অভিধানে— ইন্ডিয়ান স্ট্রেচেব্ল টাইম! ‘ডেডলাইন’ মানে জাঙিয়ার ইলাস্টিক। বাঙালি-শ্রেষ্ঠ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কি ‘সময়জ্ঞান’ কনসেপ্টটিকে খোঁটা দেননি ‘অন্ত্যেষ্টি-সৎকার’ নাটিকায়? মৃত্যুশয্যায় বাবা। আশা-মাফিক যথাসময়ে তাঁর দেহান্ত হচ্ছে না দেখে, ছেলে গোটা বাঙালি জাতিকেই দুষছে— ‘মরবে তবু পাংচুয়াল হবে না।’ ‘লিপিকা’র ‘ভুল স্বর্গ’ রচনাটিতেও রবীন্দ্রনাথ কাক্কেশ্বরকে কাউন্টার করছেন। লিখছেন, ‘সবাই বলে, ‘সময়ের মূল্য আছে।’ কেউ বলে না, ‘সময় অমূল্য।’ আমবাঙালি অবশ্য সময় নিয়ে এই দর কষাকষিতে নেই। সময় তার কাছে সারা বছরের চৈত্র সেল। ফ্রি। মাগনা।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিল ২০১৪