09 August 2016

ফেসবুকভরা ভালবাসা

সুস্নাত চৌধুরী


আরেকটা পৃথিবী, এবং যে পৃথিবীতে আপনিও আছেন। ‘লেট দেয়ার বি কানেক্টিভিটি’ উচ্চারণে সেই অপর দুনিয়ার জন্ম কোনো ঈশ্বর দেননি; দিয়েছিলেন হার্ভার্ড-এর ছোকরা মার্ক জুকেরবার্গ। সেই ‘সৃষ্টির আদি’ মোটে দশ-বারো বছর আগের কথা। অথচ এটুকু সময়েই যেন আবিশ্ব বদলে গেল বিশ্ব। আকাশ ছেয়ে যাওয়া বিপুল তরঙ্গ হয়ে উঠল সম্পর্কের সুতো। ভার্চুয়াল ঈশ্বরের বানানো বস্তুময় পৃথিবীর জায়গা নিতে থাকল রক্ত-মাংসের মানুষের বানানো ভার্চুয়াল পৃথিবী। যত গড়াচ্ছে দিন সেই দুনিয়ায় বেঁচে থাকছে আরও বেশি মানুষ। বাড়ছে সেখানে মরা মানুষের সংখ্যাও।
ইয়াহু মেসেঞ্জার কিংবা অরকুট-এর মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম তখনও ছিল, কিন্তু ‘ফেসবুক’ নামক বদনবইটি যে এভাবে একদিন রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে সর্বব্যাপী হয়ে উঠবে, দেখা দেবে রূপ থেকে রূপান্তরে, শুরুতে তা সম্ভবত জুকেরবার্গ সাহেবও আন্দাজ করতে পারেননি। ক্রমে যত লম্বা হয়েছে টাইমলাইন, ততই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ফেসবুক। কখনও মনের আয়না, কখনও বন্ধুত্বের ব্যালকনি, কখনও আবার রাজনীতির রণাঙ্গন। ভিতর ও বাহির – দু’দিকের জানলা খুলেই সে ইউজারকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছে। ব্যক্তিক অনুভূতিকে যেমন স্পেস দিয়েছে, তেমনই অস্বীকার করেনি নেহাত কেজো প্রয়োজনগুলিকে। আবার শুধু ইউটিলিটির ক্লান্তিকর ফর্দও বানিয়ে তোলেনি, ইউটোপিয়ার হাতছানিও রেখেছে। চেপে-রাখা কথা, আটকে-থাকা কান্না, মনে-পড়া হাসি... অক্ষর হয়ে ছবি হয়ে তার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে। প্রযুক্তিগত জায়গা থেকে তো সামগ্রিক ভাবেই কৃতিত্বের বটে, কিন্তু কনসেপ্টের ক্ষেত্রে মনে হয় ফেসবুকের সাফল্য আরও বেশি, সম্ভবত যা লুকিয়ে আছে তার এই দ্বৈত অবস্থানের মধ্যেই। এমন বন্ধু আর কে আছে!‍
প্রাথমিক ভাবে তথ্য দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যম হলেও, মানুষ ফে বু-কে নিজের মতো করে কাস্টমাইজ করে নিয়েছে। হারিয়ে-যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া কিংবা দূর-দেশি সমমনস্কের সঙ্গে যোগাযোগ – এটুকুতেই সে থেমে থাকেনি। আসলে তার কাছে ফেসবুক হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সমার্থক। ফেসবুক নিজে একটি এস্টাব্লিশমেন্ট হয়েও মানুষের হাতে ধরা দিয়েছে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্টের হাতিয়ার হিসেবে। মানুষ এখানে নিজেই নিজের কথা বলতে পেরেছে। এলাকার খবরটা সক্কলকে জানাতে টিভি ক্যামেরার জন্য বসে থাকতে হয়নি। ব্যান্ডের শো-এর জন্য বিজ্ঞাপনে মোটা টাকা খসাতে হয়নি, কেবল একটা ইভেন্ট টাঙিয়ে দিয়েই বেমালুম হাউসফুল করা গিয়েছে। সেলেব না হয়েও নিজের পাতাটি পেজ ফোরের মতো সাজিয়ে নেওয়া গিয়েছে। অ্যালবাম বানিয়েছে সে দিনের পোশাকের, রাতের মেনুর। হোক না কাঁচা, অপাঠ্য, তবু অন্তর থেকে লেখা কবিতাটা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে কোনো পত্রিকার দফতরে হত্যে দিতে হয়নি, কোনো সম্পাদককে তেল দেওয়ারও দরকার পড়েনি। বরং পাঠকের মতামতও সহজেই জানতে পেরেছে। এই যে ‘সাধারণ’ থেকে ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠা, ‘জনৈক’ থেকে হয়ে ওঠা ‘স্বয়ং’ – এই পরিবর্তন প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষেরই শক্তি বাড়িয়েছে। সেই শক্তি কতটা, তার নিদর্শন দেখিয়েছে আরব স্প্রিং। রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানকেও সে ছেড়ে কথা বলেনি। বহুলাংশে ফেসবুক হাতিয়ার করেই মিশরে হোসনি মুবারককে গদিচ্যুত করেছে জনতা। ব্যাপারটা অনেকদিনই এই জায়গায় পৌঁছেছে যে প্রতিষ্ঠানকেও গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াতে হয়েছে ফেসবুকের মঞ্চে। দেশের সরকারও তাকে বাদ দিয়ে আর ভাবতে পারছে না। বলা যায়, এস্টাব্লিশমেন্টও আজ এক প্রকার বাধ্যই হয়েছে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্টের অংশ হয়ে উঠতে।
ফেসবুকের এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ইমেজ কাজ করেছে তাদের ‘ফ্রি বেসিক’ চালু করার উদ্যোগেও। কিন্তু বিনামূল্যে কিছু সাইট ব্যবহার করতে পারার প্রস্তাব নাকি নেট নিরপেক্ষতা বিরোধী, ভারতে তাদের প্রয়াসের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য ছিল বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশেরই। সে আশঙ্কা অমূলক নয় বটে। আর ফেসবুক যে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান, আমি-আপনি পোস্ট শেয়ার করলে ফেসবুকেরও শেয়ার মহার্ঘ হয়, তা তো জানা কথাই। আবার এ-ও ঠিক, ‘ফ্রি বেসিক’ নিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্তই ভবিষ্যত অনুমান করে এক সম্ভাব্যতার খাতিরে গ্রহণ করা। নেট নিউট্রালিটি আদৌ কতটা সফল হবে, তা যে একটি ডবকা অশ্বডিম্ব প্রসব করবে না, হলফ করে তা-ই বা কে বলতে পারে! কাজেই, ফেসবুক ‘ধান্দা’ করছে বলেই হুট করে কি তাকে ‘ধান্দাবাজ’ বলে দেগে দেওয়া যায়? যে অবদান সে মানব সমাজে রেখেছে, তাকে অস্বীকার করা তো সম্ভব নয়। এমনকী তার প্রভাব সর্বদা কল্যাণকর না হওয়া সত্ত্বেও। কখনও সে ত্বরাণ্বিত করেছে সম্পর্কের ভাঙন, কখনও জন্ম দিয়েছে মানসিক অতৃপ্তির – এমন উদাহরণ সারা পৃথিবীতেই আজ ঢের। এই ফেসবুকে তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা; একটি পাখির গান কী রকম ভালো।


পঁচিশ পুরাণ, সংবাদ প্রতিদিন, ৯ আগস্ট ২০১৬

No comments:

Post a Comment