সুস্নাত চৌধুরী
আজ সেই গুগলই পূর্ণ করল আঠেরো বছর বয়স। এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়। সেই সংশয়হীনতার আশ্রয় এমনই ছায়াঘেরা, সেই নিশ্চয়তার বন্ধুহাত এত দূর সমর্থ যে বিশেষ্য থেকে ক্রমে ক্রিয়াপদ হয়ে উঠেছে গুগল। ‘ঘর পে যাকে তুম গুগল করলো’। যখন-তখন যে কোনও প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমরা আজ খাওয়া-বসা-শোওয়ার মতোই নির্দ্বিধায় গুগল ‘করছি’। পরিসংখ্যান বলছে, ওয়েব-দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ গুগলের মাধ্যমেই সার্চ করে থাকেন। দিনে নিদেনপক্ষে কুড়ি কোটি মানুষ গুগলের দরজায় এসে কড়া নেড়ে যান। এ পোড়া বাংলাতেও ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে গুগল। পারলে সাইবার ক্যাফেতে ফেলে-আসা পেন-ড্রাইভ কি খাইবার ক্যাফেতে ফেলে-আসা ভিজে বাঙালির ছাতাটিও যেন খুঁজে দেবে সে! বউ গেলে বউ, মায়, মা গেলে মা-ও!
ঈশ্বরই বটে! আগে লোকে বলত, ‘সব ব্যাদে আছে’। গুগলের কৃপায় আজ বলছে ‘সব ন্যাটে আছে’। কেষ্ট, খ্রিস্ট, আল্লাহ – সকলেই মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ। আজ গুগলের অবস্থানও কি সেরকমই হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? তা নইলে ফেসবুকে বা ব্লগে ‘জ্ঞানতীর্থ জ্ঞানরত্ন জ্ঞানাম্ভুধি জ্ঞানচূড়ামণি’ জাঁদরেল কুইজ মাস্টারটিকেও ডিসক্লেমার দিতে হয়, ‘গুগল না করিলে বাধিত হইব’! তা নইলে কি প্রতিষ্ঠা পায় ‘সিওজি’, মানে, ‘চার্চ অব গুগল’! যেখানে লোকে ঈশ্বর ঠাওরে উপাসনা করে গুগলের। কানাডার ম্যাট ম্যাকফারসনের এই বিচিত্র কীর্তির পর পেরিয়ে গিয়েছে দশ বছর। সেই চার্চে গুগল-উপাসকদের জন্য রয়েছে টেন কম্যান্ডমেন্টস, রয়েছে প্রার্থনা সংগীত! জিংগল বেল-এর সুরে তা শেষ হচ্ছে এই ভাবে – ‘Oh, Google's god, Google's god, I'm praying to her now. This prayer is just about over, so it's time to take my bow!’ কেবল সুরের সুতোয় শব্দ জুড়ে বানানো অ্যানালগ বাক্যবন্ধ নয়, চালু রয়েছে এই প্রার্থনা সংগীতের শূন্য-এক দিয়ে গাঁথা মালার বাইনারি গাথাও!
এখন কথা হল, আদৌ কি কারো পক্ষে ‘সবজান্তা’ বলে কিছু হওয়া সম্ভব? পরিভাষায় যাকে বলে ‘অমনিসিয়েন্ট’ কিংবা ‘প্যান্টোম্যাথ’। মাইক্রোসফ্ট নয়, মাইক্রফ্ট-এর প্রসঙ্গে কোনান ডয়েল লিখছেন, ‘অল আদার মেন আর স্পেশালিস্টস, বাট হিজ স্পেশালিজম ইজ অমনিসিয়েন্স’। কিন্তু এই ‘চূড়ান্ত’ হয়ে ওঠা তো একটা ধারণা মাত্র। আপেক্ষিকতার জালে-জড়ানো এক বিষম ধাঁধা। জটায়ু > ফেলুদা > সিধুজ্যাঠা – এই সম্পর্ক যে আপেক্ষিকতার নিদর্শন। পণ্ডিত হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গার্গীর র্যাপিড ফায়ারের শেষ দিকে যাজ্ঞবল্ক্যকেও প্রায় হুমকির সুরে কথা বলতে হচ্ছে। কতকটা ধম্কেই তিনি থামিয়ে দিচ্ছেন গার্গীকে। তা কি শেষ সত্য জানা নেই বলে, না কি সেই চূড়ান্ত সত্যটি প্রকাশিত হয়ে পড়লে ইহ জগতেরই আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না, সেই ভয়ে। ঠিক যেমন সর্বজ্ঞ ‘কম্পু’ প্রোফেসর শঙ্কুকে বলেছিল – ‘...আর সাড়ে তিন মিনিটে ভূমিকম্প হবে। মৃদু কম্পন। টের পাবে, তাতে কারুর ক্ষতি হবে না। আর তখনই আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর আমি পাব। সে উত্তর কোনও মানুষে পাবে না কোনওদিন।’ তারপর, শঙ্কু তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন – ‘ঠিক ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় পায়ের তলার মেঝেটা কেঁপে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে এক অপার্থিব বর্ণচ্ছটা বিকীর্ণ করে কম্পুর দেহ সশব্দে খণ্ড খণ্ড হয়ে স্ফটিকস্তম্ভের উপর থেকে শ্বেতপাথরের মেঝেতে পড়ল, তার ভিতরের কলকবজা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ধুলোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই ভগ্নস্তূপ থেকে একটা রক্ত হিম করা অশরীরী কণ্ঠস্বর বলে উঠল – ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি!’’ সবজান্তার এই ধাঁধাটি আরেক ভাবে খুব সহজ কথায় তুলে এনেছেন দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী। লন্ডনের গ্রেশ্যাম কলেজে এক বক্তৃতায় তিনি বলছেন – বুদ্ধ যদি সর্বজ্ঞ হন, আবার মহাবীরও যদি সর্বজ্ঞ হন; মানে, দু’জনেই যদি সবই জানেন, তাহলে তাঁদের মধ্যে মতানৈক্য হল কেন!
তবু যখন আশৈশব বলি, ‘আমার মা সব জানে’ – তখন সেই সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না। জীবনের সব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে আজও যখন নির্দ্বিধায় বনস্পতির ছায়ায় এসে দাঁড়াই, তখন আমার বাবা আমার ঈশ্বর। আমার শেষ সর্বজ্ঞ। কিংবা যখন ভাবি, ‘এই বেলা প্রশ্নটা লিখে রাখি গুছিয়ে / জবাবটা জেনে নেব মেজদাকে খুঁচিয়ে’ – তখন সবজান্তা মেজদা আমার একান্ত গুগল। আমার ভরসা। ভরসা যেন পড়ায় এবং ভরসা যেন পড়তে আসে। কিন্তু, এই ভরসারই দেখনদারিত্ব, এই প্রবল সবজান্তাপনাই আমাদের বেপথু করে যখন অপরের প্রতি এক সহজাত হ্যাটা-প্রবণতা দুন্দুভি-নিনাদে উচ্চারিত হয় – ‘বল্বে কি, তোমরাও নোট্বই পড়নি!’ তবু সংসারের গোলকধাঁধায় বারে বারে সবজান্তার ভূমিকায় অভিনয় করতে নেমেই পড়ি আমরা। সহকর্মীটির বস হতে হলে কি সহধর্মিনীটিকে বশ করতে হলে, জীবনের গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ সবজান্তা ছাড়া যে আমার-আপনার সাজার আর কিচ্ছুটি নেই। জিডিপি থেকে জিলিপি, রেশন থেকে রিসেশন – জগৎ-সংসারের সমস্ত কিছুর গুঢ় রহস্যই আপনার নখের ডগায় থাকুক না-থাকুক, জিভের ডগায় বিলক্ষণ থাকবে! পেটে না আসুক, মুখে আসা চাই। তখন সক্রেটিসের নাম আপনার ঘুণাক্ষরেও মনে আসবে না। আপনি জানেন না যে আপনি জানেন না।
আসলে দুলিরাম আর শ্যামচাঁদই আমাদের আর্কেটাইপ। দুলিরাম প্রসঙ্গে সুকুমার লিখছেন – ‘দু-চারিটি বড় বড় শোনা কথা আর খবরের কাগজ পড়িয়া দু-দশটা খবর এইমাত্র তাহার পুঁজি, তারই উপর রঙচঙ দিয়া নানারকম বাজে গল্প জুড়িয়া সে তাহার বিদ্যা জাহির করিত।’ আর দ্বিতীয়জনকে নিয়ে বলছেন – ‘বয়সের হিসাবে শ্যামচাঁদ একটু বেঁটে ছিল। পাছে কেহ তাকে ছেলেমানুষ ভাবে, এবং যথোপযুক্ত খাতির না করে, এই জন্য সর্বদাই সে অত্যন্ত বেশি রকম গম্ভীর হইয়া থাকিত এবং কথাবার্তায় নানা রকম বোলচাল দিয়া এমন বিজ্ঞের মতো ভাব প্রকাশ করিত যে স্কুলের দারোয়ান হইতে নিচের ক্লাশের ছাত্র পর্যন্ত সকলেই ভাবিত, ‘নাঃ, লোকটা কিছু জানে!’’ বলা বাহুল্য, পাঠকও জানেন, প্রথম গল্পটির নাম ‘সবজান্তা’, আর দ্বিতীয়টির ‘চালিয়াৎ’! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইশকুল-জীবনে শেখা অসংখ্য আমিষ ভোকাবুলারির মধ্যে এই নিরামিষটিও ছিল – ‘সবজান্তা গেঞ্জিওয়ালা’! সবজান্তা হওয়ার সঙ্গে হোসিয়ারি শিল্পের কী সম্পর্ক বলা মুশকিল। তবে মনে আছে, বছর বিশেক আগে সেই সব চলতা-ফিরতা সাইক্লোপিডিক দেখনদারি মানুষজনের উদ্দেশে এই বাক্যবাণ ছুড়ে দেওয়াই ছিল রেওয়াজ। আজ কাচের ঘরে বসে থাকি, তাই ঢিল ছুড়তে ভয় লাগে। বরং দরকার হলেই টুক করে গুগল করে নিই। আর গুগলেও সুবিধে না করতে পারলে, তারিণী কবিরাজের মতো বলে উঠি – ‘হয়, Zানতি পার না’।
ছুটি, সংবাদ প্রতিদিন, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬
I have also design some font for ABP and Pritidin befor a ling time
ReplyDelete