25 September 2016

শ্রেণিসংগ্রাম

সুস্নাত চৌধুরী


অরওয়েল সাহেবের কথাটি অন্তত এই ক্ষেত্রে খাপে-খাপ বটে! হ্যাঁ, সেই ‘হিট ডায়লগ’-টিই বলছি – ‘অল এনিমেলস আর ইকুয়াল, বাট সাম এনিমেলস আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদার্স’। তিন বছরের মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে দেখলাম আজও তা কী প্রবল প্রাসঙ্গিক! পিছু ফিরে মনে হল, বিশ-পঁচিশ বছর আগেও হয়তো কতকটা এমনই ছিল। তবে নিজের ছেলেবেলায় সেসব টের পাইনি। আজ চোখের ‘পাওয়ার’ বেড়েছে বলেই এসব দেখতে পাচ্ছি হয়তো!
বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাক। মানে, ‘ইউনিফর্ম’। শব্দটির মধ্যেই সকলকে সমান করে দেখার ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। কে ডাক্তারের ছেলে আর কে রিকশাচালকের, কার মা অধ্যাপিকা আর কার মা ছাপোষা গৃহবধূ, তা যেন ছা-এর বহিরঙ্গে প্রকাশ না পায়। যে কেউকেটাই হও না কেন বাপু, পারিবারিক পরিচয় গেটের বাইরে রেখে তুমি এই প্রতিষ্ঠানে পা রাখবে – ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে এনে দাঁড় করানোর এই প্রয়াসই এ পোশাকের প্রধান উদ্দেশ্য। ইউনিফর্ম এই ইউনিফর্মিটির কথাই বলতে চায়। সাধু ভাবনা, সন্দেহ নেই। কিন্তু শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিবিভাজন কি তাতে ঘোচে আদৌ? সেই ছেলেটির কথাই ভাবুন না, যে বলছে –
‘নাম বলেছি ধাম বলেছি এবং বয়েস কতো
সেই সঙ্গে এও বলেছি মা হয়েছেন গত।
দশখানা আঁক কষতে দিলে একটা হবে ভুল
আমাকে তাও নিতে নারাজ – এই তোমাদের স্কুল!’


কেন তাকে অ্যাডমিশন দিচ্ছে না স্কুল? ‘লিখছি আমি’ ছড়াটিতে তার কথাই লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত –
‘কারণ আমার প্যান্টে ফুটো, জামার কলার ফাঁসা
উড়াল সেতুর নিচে আমার পাখপাখালির বাসা।’

স্কুলের পোশাক পরার অধিকার লাভের আগেই যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পোশাকই, সেই ইউনিফর্মের ইউনিফর্মিটি নিয়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। যে আপাত সমতা আসলে এক বৈষম্যকেই চিহ্নিত করে। স্কুল পড়ুয়া ও স্কুলে ঢুকতে না-পারা দুটি বালক বা বালিকার মধ্যেও প্রকাশ্যেই সেই ফারাককে জিইয়ে রাখে এই ইউনিফর্ম। জিজ্ঞেস করতে হয় না, পোশাকই বলে দেয় কে স্কুলে যাচ্ছে আর কে চা দোকানে কাজ করতে। আবার যারা সুযোগ পেলও ইউনিফর্মটি গায়ে গলানোর, তারাও কি শেষমেশ একই ছাদের তলায় এসে দাঁড়াতে পারল? একসময় যদি দেখা যায় – কার তিন বছরের পুরোনো জামাটা বগল-ফাটা, আর কারটা উজালা-সফেদ, বদলে যাচ্ছে বছরে বেশ কয়েকবার – কার কোঁচকানো প্যান্টের ঝুল ক্রমেই খাটো হচ্ছে, কারটা নিপাট নিখুঁত নিভাঁজ – কার মোজার ইলাস্টিক শেষ পিরিয়েডেও টানটান, কার ফ্যাকাসে মোজা ম্যানেজ করতে হচ্ছে কালো গার্টারে – একই ইউনিফর্মের মধ্যেও এইসব বিভাজন কি থাকে না! বরং তথাকথিত ইউনিফর্মিটির সামতলিক একটা প্রেক্ষিত থাকে বলেই এই বিভাজনগুলি আরও বেশি চোখে পড়ার মতো হয়ে ওঠে। তখন ওই ‘অ্যানিমাল ফার্ম’-এর ‘সাম এনিমেলস আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদার্স’ হয়ে যায়। ক্লাসের গণ্ডি দিয়ে ক্লাস ডিফারেন্সকে আর চেপে রাখা যায় না। ‘সন্ধি’ আর ‘বিচ্ছেদ’ পাশাপাশি অবস্থান করে।
স্কুলজীবনে অবশ্য ‘পোশাকি’ থিয়োরির এইসব সন্ধিবিচ্ছেদ কি দ্বন্দ্বসমাস বড়-একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। সে ছিল সদলবলে পোশাক-জনিত প্র্যাকটিকাল সমস্যায় জর্জরিত হওয়ার দিন। স্কুলের শেষ ক’বছরের বেশিটাই কেটেছিল গৌরী, জয়ন্তী, নারায়ণী, অনন্যা আর সোনালী-র আশ্রয়ে। না, বান্ধবী নয়, সিনেমা হল। ম্যাটিনিতে যদি বা সেঁধিয়ে যাওয়া যেত স্কুল-ড্রেসেই, ছাল-ছাড়ানো নুন-মাখানো দুপুরের শো-এ ঢুকতে পারা ছিল ঘোর মুশকিলের। দু-চার বার সিভিল ড্রেসে গিয়ে টিকিট-কাকুর সঙ্গে বাড়তি খাতির জমাতে না পারলে, সাদা জামা আর নীল প্যান্টে গেট টপকানোর উপায় ছিল না। আর বুকের ব্যাজটা তখনও লাগানো থাকলে তো বিপত্তির একশেষ! কী ভাগ্যি, আমাদের বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলে গলায় গিট্টি-মারা টাইয়ের ঝকমারি ছিল না! নইলে তা আনটাই করতে ভুলে গেলে জানটাই বুঝি কোন দিন বেরিয়ে যেত!
ব্যক্তিগত ভাবে আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল। একটু-আধটু খেলাধুলো করতাম বলে ব্যাগে পাঠ্যপুস্তক থাকুক না-থাকুক, এক সেট খেলার পোশাক আর একটা গামছা বেশিরভাগ দিনই থাকত। বাড়িতেও এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। ভাবত, ছেলে শচীন হবে। কিন্তু সে যে স্পোর্টসম্যানের সমার্থক ঠাওরে প্লেবয়-এর সমর্থক হয়ে গিয়েছে, সে খবর আর পৌঁছোয়নি। কেবল তড়িঘড়িতে পোশাক বদলাতে গিয়ে দু-এক বার স্কুলের শার্টটি ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গিয়েছি, আর তার জন্য যেটুকু বকুনি দু-কান খোলা রেখে শুনে যেতে হয়েছে। কিন্তু স্কুল ছাত্র হিসেবে শণাক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো গিয়েছিল বিলকুল। ইউনিফর্মের এটা আরেক সমস্যা। স্কুলের ভেতর সে যতই চেষ্টা করুক না একটা হোমোজিনিয়াস পরিবেশ বজায় রাখার, বাইরে বেরোলে সেই পোশাকটাই গায়ে সেঁটে যাওয়া লেবেলের কাজ করবে। বাকি সমাজের থেকে আলাদা করে তোমাকে চিনিয়ে দিতে চাইবে। যেন তুমি হংস মধ্যে বকযথা। তুমি দুধভাত! আর সেই বেড়া ভাঙতে গেলেই দাবি করবে কৈফিয়ত। কিংবা তোমায় দেখেই বুঝে যাবে তুমি এলিট স্কুলের পড়ুয়া নাকি পাতি স্কুলের। দশ-বারো ক্লাসে পড়া প্রাপ্তমনস্ক একটি ছেলে বা মেয়ের কাছে এসব অস্বস্তিকর নয় কি!
কাজেই, সুবোধ বালক না হলেও বিদ্যাসাগরের ‘ব্যাড বয়’ যাদবকে দেখে ঈর্ষান্বিত হতেই হয়। মোটে আট বছর বয়সেই স্কুল কেটে সে খেলে বেড়ায়! বাপ-মা কি পাড়ার লোক টেরটিও পায় না। ‘যাদবের পিতা, প্রতিদিন, তাহাকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিতেন। লেখা পড়ায় যাদবের যত্ন ছিল না। সে, এক দিনও, বিদ্যালয়ে যাইত না; পথে পথে খেলা করিয়া বেড়াইত।
বিদ্যালয়ের ছুটী হইলে, সকল বালক যখন বাড়ী যায়, যাদবও সেই সময়ে বাড়ী যাইত। তাহার পিতা মাতা মনে করিতেন, যাদব বিদ্যালয়ে লেখা পড়া শিখিয়া আসিল।’ সহজেই অনুমেয়, ইউনিফর্মের ব্যাপার-স্যাপার যাদবের বিদ্যালয়ে ছিল না। থাকলে, স্কুলের পোশাক পরে প্রত্যহ পথে পথে খেলে বেড়ানো সেকালেও অত সহজ হত না। উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালাতেও যেমন – সুগত, ভানু, আলম, সৌদাস... একেক জনের পোশাক একেক রকম। সে পোশাকে বৈচিত্র আছে, বৈষম্য নেই। শুধু তাই নয়, নামের মধ্য দিয়ে তাদের ধর্মের বৈচিত্র দেখানোর ফলেও সামগ্রিক ভাবে এক সাম্যের ছবি ফুটে উঠেছে। পাঠশালা খোলা থাকলেও, রাজার মূর্তি তাক করে ঢিল মারার মতো দুঃসাহসিক কাজের জন্য তাদের পোশাক বদলে নেওয়ার সতর্কতা অবলম্বন করতে হত না।
বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন নিয়ে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষাবিধায়ক প্রস্তাব’ কিংবা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষাপ্রণালী’ গ্রন্থের ঐতিহ্য মাথায় রেখেই ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হচ্ছে অঘোরনাথ অধিকারীর ‘বিদ্যালয়-বিধায়ক বিবিধ বিধান’। তা থেকে উদ্ধার করা যেতে পারে – ‘কারসিয়ং ভিক্‌টোরিয়া স্কুলে সাহেবের ছেলেরা পড়ে। স্কুলের সঙ্গে ছাত্রনিবাস আছে, বালকেরা সেইখানে থাকে। তাহাদের মাথার চুল খুব ছোট করিয়া কাটা; পোষাক পরিচ্ছদ এক রকমের সামান্য খাকী কাপড়ের; ইহাই ব্রহ্মচর্য্য, আমাদিগেরও সেকালে ইহাই ছিল। আর এখন আমাদিগের কি হইয়াছে? আমাদের স্কুলের ছাত্রগণ সিঁথির উপর এলবার্ট কাটিয়া, ডবল প্লেট সার্টের উপর হাই কলার আটিয়া, চাদরখানি নানা রকমের চুনট করিয়া, বাঁশবেড়ের কার্ত্তিক সাজিয়া বিদ্যালয়ে উপস্থিত। আবার কেহ হয়ত দুই পায়ে দুই রকমের জুতা পরিয়া, লজ্জা নিবারণ হওয়া সুকঠিন – এরূপ ছিন্ন বস্ত্র পরিধান করিয়া, ধোয়া জামার উপর ময়লা চাদর গায় দিয়া, বড় বড় চুল গুলি পাগলের মতো এলো মেলো করিয়া বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। দুইই দোষের, কিন্তু বিলাসিতায় বালকগণ যত অধঃপাতে যায়, নোংরামীতে তত নয়। বিলাসিতার অন্তরালে কত যে কুৎসিত ভাব লুক্কায়িত থাকে, তাহা বলা বাহুল্য। অতএব সর্ব্বপ্রযত্নে এই বিলাসিতার ভাব বিনাশ করিতে চেষ্টা করিতে চেষ্টা করিবে। ছাত্রগণের জন্য একটা বিশেষ পোষাকের ব্যবস্থা করিলে কেমন হয়?’

 

অঘোরনাথ অধিকারীর ‘বিদ্যালয়-বিধায়ক বিবিধ বিধান’ (১৯০৯) গ্রন্থে ইউনিফর্ম-পরা ছাত্রদের ছবি

একশো বছরেরও বেশি আগে লেখা সে বই-এ তিনি শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের দু’টি ছবি ছাপছেন। সে ছবিতেও ছাত্রদের দেখাচ্ছেন স্কুল ইউনিফর্মে। মজার কথা, এই বছর কুড়ি আগে অঘোরনাথ অধিকারীর মতো প্রায় একই স্বর শোনা গেল বিল ক্লিন্টনের মুখে – ‘If it means that teenagers will stop killing each other over designer jackets, then our public schools should be able to require their students to wear uniforms’। ভারতের ঢের পরেই তবে বিদ্যালয়ে ইউনিফর্ম চালু করার ঝড়টা উঠল মার্কিন মুলুকে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, বাঁশবেড়ের কার্তিকই হোক বা আমেরিকার ডিজাইনার জ্যাকেট, তার প্রতি আদিখ্যেতা রুখতে গিয়ে কি একটি শিশুর কল্পনাশক্তিকেও রুখে দেওয়া হল না? মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার একটি চিরন্তন মাধ্যমই হল রং। কিশোর মনের আকর্ষণ সেই রঙের প্রতি আরও বেশি। কিন্তু তাকে প্রতিনিয়ত একই রঙের পোশাকে অভ্যস্ত করে দেওয়া মানে তো তার মানসিক বিকাশেও বাধা দান করা। এক অর্থে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপও বটে। ঘন বর্ষায় যে রঙের পোশাক পরে সে স্কুল যায়, কনকনে শীতে সেই একই রঙের পোশাক তার পরতে ইচ্ছে না-ও করতে পারে। দিনের পর দিন একঘেঁয়ে এই ঘেরাটোপে বাঁধা থাকার পর একদিন নিজেকে সে স্রেফ একটা রোবট বলে ধরে নিতেই পারে। ইউনিফর্মের জন্য তার ধারণাটা হয়ে উঠতেই পারে – ‘অল ইন অল ইট’স জাস্ট অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল’! নিছক সম্ভাবনা নয়, এমনটা যে হয়ও, তা কি আমরা নিজেদের স্কুলজীবনে দেখিনি? নইলে কেন বারবার মনে হবে, কবে যে দাদা বা দিদির মতো কলেজে উঠব! কারণ, বড় হওয়ার সমার্থক তখন কলেজে পড়া। আর কলেজে পড়লে স্কুল-ড্রেস পরতে হয় না!
এতই যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আমাদের শিক্ষায় স্কুল-ইউনিফর্মের ভূমিকাটা কী? কেনই বা ‘কচি ছেলেদের চোখ হল ট্যারা, বান্ধবীদের ড্রেস দেখে’? ব্রহ্মচর্যের ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষা না কি ঔপোনিবেশিক খোঁয়াড়ি! ছোট্ট একটা ঘটনাতেই বোধহয় বুঝিয়ে দিয়েছিল আমাদের সেরা বাঙালি ছাত্রটি – ‘একবার সে হঠাৎ পেন্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢল্‌ঢলে পায়জামার মতো পেন্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং সেটা তাহার কাছে ভারি একটা আমোদের ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘‘পেন্টেলুন পরেছিস্ কেন?’’ দাশু এক গাল হাসিয়া বলিল, ‘‘ভালো করে ইংরিজি শিখব ব’লে।’’’

রোববার, সংবাদ প্রতিদিন, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

No comments:

Post a Comment