04 December 2012

স্বপ্ন বনাম মতলব বনাম জিজ্ঞাসাচিহ্ন

সুস্নাত চৌধুরী


জর্জ বার্নাড শ-কে নাকি একবার এক রূপসী ফরাসি অভিনেত্রী অচানক যেচেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একটু হতচকিত শ এমন আবেদনের কারণ জানতে চাইলে আবেদনময়ী বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হলে যেটা হবে, তা হল একটি ফাটাফাটি বাচ্চা! আমার রূপ ও আপনার প্রজ্ঞা নিয়ে সে জন্মাবে।’ ভুরু তুলে শ-এর জবাব, যেন রিফ্লেক্সে --- ‘আমি ভাবছিলাম, উলটোটা হওয়ার চান্সও তো আটআনা থেকে যাচ্ছে। মানে, যদি, আপনার প্রজ্ঞা ও আমার রূপ...!’
আমিও একাই এক শ। আ স্যুটেবল বয়। তর্জমায় ‘সৎ পাত্র’-ও বলতে পারেন। সু ও কুমার গঙ্গারামের আর্কেটাইপ। তাই, শ-সুলভ সমস্যা আমাদের নেই। রূপ ও প্রজ্ঞা, বাই দ্বি-ফল্ট, দুয়েরই তথৈবচ হাল আমার। শূন্যকে থ্রি-এক্স দিয়ে গুণ করলেও তো শূন্যই হয়, তা সে প্রবল গুণই হোক আর প্রচ্ছন্ন গুণ। আমার ‘তিনি’ শত জিনোটাইপ-ফিনোটাইপ কষে, মেন্ডেলের মটরশুঁটি থেকে ইঁদুরছানার পিছে ছুটে, বায়োলজি থেকে জাভা সিপ্লাসপ্লাস হয়ে, ফের জাভা সুমাত্রা বালি পেরিয়ে উত্তরপাড়াতেই এসে থেমেছেন। এবং অবশেষে বুঝেছেন (বিয়ের মাত্র তিন বছরে হাড়ে-হাড়ে বোঝা সম্ভব নয়, বিশেষত স্ত্রীদের পক্ষে), আমাকে দিয়ে বাথরুম পরিষ্কারও করানো যায় না। নিছক আত্মোপলব্ধি নয়, এ ফ্যাক্ট। তবু নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস রাখেন বলেই, লার্নিং ইংলিশের ফ্যামিলি ট্রি কি অবনেদি বাড়ির বংশলতিকা নির্মাণের আশায় এই নেভার এন্ডিং লুপ-এ পা বাড়িয়েছেন ভদ্রমহিলা। আমি স্রেফ ডিকটেশন শুনে-শুনে ডিটেকশন করেছি। ওয়ান প্লাস ওয়ান ইজ ইকুয়াল টু থ্রি। সংসারের যোগে ক্যালকুলেটর ছেড়ে ইউএসজি-র উপর ভরসা রাখতে হয়েছে আমায়।
ব্যয় আছে, তবু একথা সত্য, সংসার নামক চড়ুইভাতিতে আমি আসলে অব্যয়। ‘তিনি’ একাই কর্তৃকারক ও কর্মকারক। অতএব জিনের দায়িত্বও আমার নয় --- তা সে আলাদিনেরই হোক, বা নিজের সন্তানের। এমতাবস্থায়, যখন তিনি ও তাঁর সন্তানের মোট ওজন কিলোয় মাপা হবে না কুইন্টালে, এই নিয়ে রিপোর্ট-লিখিয়েদের মধ্যে জোর বাদানুবাদ --- আমি কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে হোটেলের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে চলেছি। কেননা, সত্যি কথা বলতে কী, নিজের সন্তানকে নিয়ে আমার ওসব স্বপ্ন-টপ্ন কিস্যু নেই। আমার আসলে অন্য কিছু মতলব আছে!
আপাতত, একটা মতলবের কথাই খুলে বললে, টের পাবেন বাকিগুলো কেমন হতে পারে। আমার ওই বনের মোষগুলির একটি, বছরে একবারই বনে বেরোয়, জানুয়ারি নাগাদ। লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। তারপর শিং উঁচিয়ে বইমেলার ধুলো-কাদা মেখে তার ও আমার ফেরা। তো ব্যাপার হচ্ছে, গায়ে-গতরে এখন সে ব্যাটা বেশ পুরুষ্টু। তার ভবিষ্যতের ফর্মার কথা ভেবে আমি আরও শঙ্কিত। দূরদর্শীর মতো এলআইসি না করে, বরং ভদ্রমহিলার দিকে ইদানীং এগিয়ে দিচ্ছি দু-পাতা চারপাতা প্রুফ। মানে, প্রুফ দেখার ব্যাপারটা যদি ইনফিলট্রেট করা যায়। বাবা হিসেবে আমার শুধু এটুকুই আগাম চাহিদা! আর মেলার মাঠে টেবিল সামলানো? উলটোদিকে তন্বী পাঠিকা কিংবা মাচো কবি থাকলে, বাঙালি রক্ত এমনিই পৌঁছে যাবে ‘মিলনমেলা’-এ।

***
এই অবধি লিখে, দেখছি, আমার ধুনকি কেটে গিয়েছে। ব্যাপারটা অত ফচকে নয়। এটা কি একটা ফরমায়েসি হাজার শব্দের গদ্য, নাকি অন্য কিছু হয়ে যাচ্ছে? আমি কি সময়ের চেয়ে দু-এক পা এগিয়ে গিয়ে কিছু ডকুমেন্টেড করে যেতে চাইছি? কাকে লিখছি আমি, পাঠককে? নাকি ‘ভণ্ড পাঠক’-এর তোয়াক্কা না-করে --- ২০২৩, ২০৩১, আমার মতো ২০৪৫, কিংবা জানি না কবে কখন এ-লেখার উলটো দিকে সে বসে আছে বলেই ভাবছি আমি। হয়তো খিস্তিই করছে সে, অস্ফূটে।
এই যে ভবিষ্যতকে দেখতে পাওয়া, আগামীর সঙ্গে কথোপকথন, এও তো একরকম স্বপ্নই! হিন্দোল ব্লগ লিখে রাখছে কেলো-র জন্য। বড়ো হলে হাওয়ায়-হাওয়ায় পড়বে সে। মুজতবা আলি ভবিষ্যতের অ্যাড্রেসে চিঠি লিখছেন সৈয়দ মুশাররফ আলি আর সৈয়দ জগলুল আলি-কে। সম্বোধন করছেন ‘বাবা ফিরোজ’, ‘বাবা ভজু’। চিঠির শেষে --- ‘তোমার আব্বু’। পাতার পর পাতা জুড়ে ‘প্রবাসী পিতার বুভুক্ষু বাৎসল্য’। আমি কি টস হওয়ার আগেই নেমে পড়েছি ব্যাট করতে? সিজার না নর্মাল, তা বুঝতেও তো এখনও কয়েক মাস।

                                                                                                                  ১২ই জুন ১৯৫৫
বাবা ফিরোজ,
তুমি নাকি একদিন আদর করে ভজুকে জিজ্ঞেস করলে, ‘ভজু, তোর আব্বু কোথায়?’
আমি তখন ঢাকাতে তোমাদের দেখতে গিয়েছিলুম। তুমি ‘তোমার আব্বু’কে পেয়ে ভারী খুশী।
কিন্তু ভজুকে ভালোবাসো বলে দুশ্চিন্তা হল --- আমার তো তাই মনে হয় --- এর আব্বু একবারও আসেনি কেন?
                                                                                                                                     আব্বু

বড়ো ছেলেকে মুজতবা আলির এই চিঠি যেটুকু বাস্তবের ইঙ্গিত, আমি কি উপস্থিত সেটুকুও স্বপ্নের মতো কামনা করছি? অমন ‘ভারী খুশী’-র অনুভূতি যদি তার কোনওদিন না জাগে, আমি কি ভেঙে পড়ব? হয়তো পড়ব, হয়তো পড়ব না-ও। কিন্তু গর্ভে তো ধারণ করিনি, স্রেফ পার্শিয়ালি ক্রোমোজোম দিয়েছি বলেই, আমি এভাবে কতদূর বুনে যেতে পারি স্বপ্নের জাল? যদি বা গর্ভবানও হতাম, তা-ও কি সঙ্গত ছিল এইসব ড্রিম সিকুয়েন্স? ও যদি পাজ্‌ল-এর সাইট থেকে ধাঁধা সল্‌ভ করে একের পর এক, কিন্তু ফরমুলা মনে রাখতে না-পেরে ত্রিকোণমিতিতে গোল্লা পায় --- আমি কি রাগ করব? যদি সিলেবাসের নির্বাচিত অংশের বদলে গোগ্রাসে গিলে ফেলে গোটা উপন্যাসের পিডিএফ, কিন্তু নোট মুখস্থ করতে না-পেরে বাংলায় থার্টি পার্সেন্ট তোলে --- বকব, ভীষণ বকব গোপনে? কিংবা যদি সবকিছুই উলটো খাতে বয় --- অঙ্কে নিরানব্বই, পাজ্‌ল নিয়ে সময় নষ্ট না করে --- বাংলায় হায়েস্ট, ‘মানে বই’-কেই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ঠাওরায় --- আমি কি খুশিই হব, নাকি ভাসমান থাকব হতাশায়? কিংবা দু-টি অপশনেরই মাঝামাঝি, একদম মিডিওকার --- ধাঁধায় বাহান্ন, অঙ্কে তিপ্পান্ন --- টেক্সটবই কি কবিতা সমগ্র, দু-থেকেই শতহাত দূরে --- তখন?
লেটার প্রেস হলে, এতক্ষণে ‘জিজ্ঞাসা চিহ্ন’ ফুরিয়ে যেত! এই ডিজিটাল উত্তর-আধুনিক যুগ প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিতে পারে। আমি তারই ফায়দা লুটছি বেদম। হয়তো উত্তরসূরির কাছে প্রশ্নসূচি সাজিয়ে নিজেকে একটা নিরপেক্ষ উচ্চতায় তুলে নেওয়ার রাজনীতিই করছি। হয়তো, আড়ালে-আড়ালে এটাও বুঝে নিতে চাইছি, আমি কি আরেকজন ‘দ্বিতীয় আমি’-রই মুখোমুখি হতে চাই...
একজন পুরুষ কি বলতে পারে না, ‘কার ছায়া তোর মুখে মনে পড়ে না’?

***
আশা ছিলো সন্তানের উৎপন্ন চুলের পরে হাত
রাখা যাবে, আশা ছিলো --- এরকমতর ছিলো আশা
সংসারে ও চৌরাস্তায় ন্যাংটার মুখশ্রীখানি দেখে
একদিন অন্ধকারে নিজহাত রেখেছি মাথায়।
এখন আমার মনে হচ্ছে, ব্যক্তি মানুষের সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা হল, তার জন্মের সিদ্ধান্ত সে নিজে নিতে পারে না। তার বেড়ে ওঠাও অনেকাংশেই নিজের ইচ্ছাধীন থাকে না। বড়োজোর সে পরে একদিন মনে-মনে চিৎকার করে উঠতে পারে, ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’। কিন্তু হাসপাতালইস্কুলঅফিসফার্নেসের এই পৃথিবীতে ততক্ষণে যা হওয়ার, হয়ে গিয়েছে। তাই, ছেলে না মেয়ে, সাদা না কালো, বাপের মতো না মায়ের মতো --- এসব ছাপাখানার ব্যাপার-স্যাপার থেকে শুরু করে --- বিকেলে ড্রইং না সুইমিং, রাতে ভাত না রুটি, জয়েন্ট না অনার্স, অঙ্ক না ইতিহাস, লভ না অ্যারেঞ্জড --- এ-সবকিছু নিয়েই ক্রমাগত এত আশা আর এতধিক আশাভঙ্গের কাহিনি। এসব বড়োরাস্তা এড়িয়ে আমি কি পারব অন্য কোনও একটা গলি খুঁজে নিতে? না হয়, একটু ঘুরপথই হল। যেখানে স্বপ্ন-দেখা নেই, স্বপ্ন-দেখানো আছে।
কিন্তু আমিও তো অদ্যাবধি কোনও পারমিশন নিতে পারিনি। অদক্ষ অভিনেতার মতো নিজের হাত দুটো কোথায় রাখব, এখন ডিসাইড করতে পারছি না। হয়তো সত্যিই কোনও স্বপ্ন আমার ন্যাপস্যাকে নেই। আমি হয়তো কতকগুলো গোপন জিজ্ঞাসাচিহ্ন মনে-মনে বহন করছি মাত্র। তবু কে জানে কেন, মাঝে-মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। আর, ঝাপসা দেখছি। লেন্সে ফাংগাস, নাকি মেঘ করেছে আকাশে? নাকি প্রকৃত প্রস্তাবে, দৃশ্য এমনই? নচেৎ... প্রম্পটার, তুমি ভবিষ্যৎ থেকে প্রম্প্‌ট করো। যেন শুনতে পাই, শোনো, এ-নাটক মাইরি পড়া নেই --- কী ভয় করছে রে শালা, বাকি সব কাস্টিং কোথায়?



আত্মজ, ২০১২

22 October 2012

ঠাকুরের পিছন দিক

সুস্নাত চৌধুরী


ছবি: সুমন চৌধুরী

আমাদের যত ভাবনা, শুধু দুর্গার সামনেটা নিয়েই। এক বারও ভেবে দেখি না, তাঁর পিছনের দিকটা কেমন হল। ওমা, কী অলুক্ষুনে কতা গো! মায়ের আবার ‘পেছন’ কী! আগুপিছু ভেবেই বলছি শুধু দুর্গা নন, লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ, কারও পশ্চাদ্দেশ নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা নেই। কী থাকে তাঁদের পিছনে? বাঁশ। কাঠের ঠেকনা। ইতস্তত বেরিয়ে আসা খড়। আর, খড়খড়ে লেপা মাটি। লজ্জা ঢাকতে কিছু না হোক, সস্তা এক টুকরো কাপড়ও তাঁদের ‘ও দিকে’ জোটে না।
চালার ঠাকুর হলে বাই ডিফল্ট বাঁচোয়া। তা না হলে, পিছনের নগ্নতা ঢাকার বাড়তি প্রয়াস আমাদের লিফলেটে নেই। রিয়েল লাইফ মূর্তি ক্রমশ লার্জার দ্যান লাইফ হবে, দিঘে ফুট থেকে ফুটান্তরে যাবে, আড়ে অতিক্রম করবে ওয়াইড লেন্সের সীমা। কিন্তু আমরা ততটাই সাজাব যতনে, যতটা দেখতে পাবে কুসুমে, রতনে। দর্শনার্থীদের ‘ঠাকুর দেখা’র স্বতঃস্ফূর্ততাকে দীর্ঘ দিন ধরেই একটা ‘প্র্যাক্টিস’-এ পরিণত করে ফেলতে চেয়েছি। লাইন দিয়ে ঢুকে সে ততটাই দেখছে, যতটা তাকে দেখানো হচ্ছে। তার দৃষ্টি-ধরনকে ‘প্রেডিক্ট’ করে নিয়ে, ‘গ্রান্টেড’ ধরে নিয়ে, আমরা স্বপ্নের রাজ্য গড়েছি। প্যান্ডেল বানিয়েছি। কিন্তু, পাবলিক কান্নিক মেরে চোখের আলোয় দেখেছে চোখের বাহিরে।
যে নৈপুণ্যে নির্মিত হয় প্রতিমার প্রচ্ছদ, সে ভাবেই তো নির্মাণ করা যায় তার ব্যাক কভারও। চন্দ্রের তেজে যদি দুর্গার স্তন হতে পারে, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, তা হলে পৃথিবীর তেজে নিতম্ব হতে ক্ষতি কী? দুর্গার ধ্যানেই তো বলছে, তিনি ‘সুচারুদশনাং তদ্বৎ পীনোন্নতপয়োধরাম্’। তাঁকে তো সম্পূর্ণ করেই গড়ে তোলা যায়। সব দিক থেকে। ত্রুটিহীন, নিখুঁত, সর্বাঙ্গসুন্দর।
দুর্গার হেয়ার স্টাইল ‘জটাজুটসমাযুক্তা’। আমাদের নির্মাণে সেই কেশবিন্যাসও আংশিক। সামনে দু’একটা লক্স। পাশে কার্লের ঢল নেমেছে। কিন্তু পিছনে একেবারে টাক। মাঝে আবার মুকুটের আড়ালে ছাঁচের ফুটো। কিন্তু আমরা যখন পার্লারে গিয়ে বসি, সামনে-পিছনে আয়না থাকা মাস্ট। আলোর সরলরেখা যাতে মুহূর্তে বানিয়ে ফেলতে পারে রেশমি চুলের পশ্চাৎভাগের অসংখ্য প্রতিবিম্ব।
ভাবের পুজো তো আমরা কবেই ছেড়েছি। আমাদের মূর্তিপুজোটুকুও ঠিকঠাক সৎ হবে না কেন? উমাকে বাপের বাড়ি এনে যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জগৎ আমরা তৈরি করি, বচ্ছরকার পাঁচ দিন তার ভেতর ডুবে থাকি, নিজস্ব সেই অনুভূতিকে আর একটু নিষ্ঠায় রুচিসম্মত করে তোলার প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা নেই। আমরা অকল্পনীয় সব থিম কল্পনা করব। সাবেক রীতিকে বয়ে নিয়ে যাব মুখস্থের মতো। চড়া লাইটিং-এ মুড়ে দেব পাড়ার পর পাড়া। টুনি কিংবা এলইডি-তে আনসিন গল্প বলব। ভুল বানানে ‘দূর্গাপূজো’ লিখব। জঘন্য অন্ত্যমিলে ছড়াব মিনিমাম বিশ-তিরিশটা হোর্ডিং। আর, যাবতীয় অন্ধকার উগরে দেব প্যান্ডেলের একদম ভেতরের দিকে। বাজেটের সব কাটছাঁট গুঁজে রাখব প্রতিমার ‘ওই পারে’। প্রথমে ব্লাউজের কাপড়, শাড়ির থান ফুরোবে। তার পর দু’এক এম এম বেরিয়ে থাকবে ফেড হতে থাকা গায়ের ‘অতসীপুষ্পবর্ণ’। এ বার হালকা সাদা রং দেখা যাবে। একদম শেষে, গ্রেনিচের ঠিক উল্টো দিকে ইন্টারন্যাশনাল ডেটলাইনের কাছে স্রেফ নগ্ন মাটি। ওখানটা তো কেউ দেখতেই পাবে না। যা এক্সপোজ্ড নয়, তা যেন উপেক্ষণীয়।
রাজা সুরথ আর সমাধি যখন নদীর ধারে দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন, তার আগে দেবীসূক্ত পাঠ করে, সে-সবের সারকথা ভাবতে ভাবতে তপস্যা করতে হয়েছিল। কারণ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল জগন্মাতার সম্যক দর্শনলাভ ‘সন্দর্শনার্থমম্বায়াঃ’। ‘সম্যক’ বিশেষণটি ভিড়ের একাকিত্বে আর আলোকসজ্জার অন্ধকারে আমরা বহু দিন হারিয়েছি। আজ আমরাও মা দুর্গার দর্শন চাই, সঙ্গে ইনক্রিমেন্ট চাই, গোয়িং অ্যাব্রড চাই, ধবধবে বউ চাই, ইন্টেলিজেন্ট বাচ্চা চাই, ম্যাথ্স-এ ফুল মার্কস চাই। কিন্তু কিছুই ‘সম্যক’ ভাবে চাই না। পুরোপুরি চাইলে, চিন্ময়ীর জন্য না হোক, অন্তত মৃন্ময়ীর জন্য আমাদের তপস্যা ত্রুটিহীন ও পরিপূর্ণ হত। আসলে, ষোলো আনার বায়না নিয়ে ঠাকুরকে আমরা মোটে আট আনা বানিয়েছি।

আমাদের বেলা ঠাকুর কিন্তু ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা দিয়েছেন। বাজেট বেড়ে যাওয়ার ভয় খেয়ে স্রেফ সামনেটা বানিয়ে ছেড়ে দেননি। খামখা আর একটু সময় যাবে বলে, পিছনে কঙ্কাল বের করে রাখেননি। পিছনেও মাংস লাগিয়েছেন, চামড়া চড়িয়েছেন। হয়তো সামনে চোখ মুখ নাক কান দিয়েছেন, যৌনাঙ্গ দিয়েছেন, কিন্তু পিছনে দিয়েছেন বাড়তি শক্তি। সহনশীলতা। ফ্রি-কিকের দেওয়ালে দাঁড়ালে বোঝা যায়, গোলার বেগে শট এলে কী ভাবে মুহূর্তে ঘুরে যেতে হয়। সিলি পয়েন্টে বসলে দেখা যায়, ঠাটানো স্কোয়ার কাট কী ভাবে আপনাআপনি ঘুরিয়ে দেয় রিফ্লেক্স অ্যাকশন। পিঠে খেলে, পেটে সয়। লক্ষ কোটি বছরের অভিযোজনে আমাদের সামনেকে সামনে পিছনকে পিছন করে তুলেছে প্রকৃতি। সেই পশ্চাদ্ভাগে আরও ভ্যালু অ্যাড করে নিয়েছি আমরা। যোগ করেছি গ্রীবার মাহাত্ম্য। খোঁপার মাহাত্ম্য। নিতম্বের মাহাত্ম্য। স্টাইল স্টেটমেন্টে ঝড় তুলেছে হিপ ক্লিভেজ। খোলা পিঠ আরও সুন্দর করেছে কারুকাজ। টিশার্টের পিছনে ক্যাপশন লিখে ঘুরেছে। কিন্তু যে দেবীকে নিয়ে তার এত উদ্যাপন, এত উৎসব, যাকে সে সবার উপরে বসিয়েছে, তার বাকি আট আনার ব্যাকগ্রাউন্ড করে রেখেছে কদর্য। সেখানে ঠাঁই হয়নি এতটুকু নান্দনিকতারও।
প্রাচীন গ্রিসের প্রবাদপ্রতিম ভাস্কর ফিডিয়াস। একের পর এক দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করে তিনি প্রায় গ্রিসের বিশ্বকর্মা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে নাকি প্রশ্ন করা হয়েছিল, এ সব দেবদেবীকে তো তিনি চাক্ষুষ করেননি, তা হলে কোন কল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলেন তাঁদের? ফিডিয়াস জানিয়েছিলেন, তিনি স্টুডিয়োতে জনা কুড়ি গ্রিক অ্যাথলিটকে নগ্ন করে বৃত্তাকারে ঘোরান। বৃত্তের কেন্দ্রে থাকেন তিনি। কর্মরত। তাঁদের দেহসৌষ্ঠব, অপূর্ব অ্যানাটমি তাঁকে ঈশ্বরের আন্দাজ দেয়। কেন বৃত্তাকারে ঘোরাতেন ফিডিয়াস? কেন এক জন ভাস্করের দরকার হয় রিভল্ভিং প্ল্যাটফর্ম? কারণ সে তিনশো ষাট ডিগ্রিই নির্মাণ করতে চায়। সামনে আর পিছনে সে তুলে ধরে সমান ডিটেল। মার্জার সরণি বেয়ে হেঁটে আসা রূপসীরাও তো প্রথমে ক্লকওয়াইজ অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ মোচড় দেন। তার পর, থামেন। আবার পিছু ফিরে দুলকি চালে হেঁটে যান। কেন না যিনি সুন্দর, তিনি তিনশো ষাট ডিগ্রিই সুন্দর। আমাদের পুজোর রীতিতেও কিন্তু এই ‘প্রদক্ষিণ’ অনিবার্য অঙ্গ। সেখানেও বামাবর্ত আর দক্ষিণাবর্তের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ কিনা দেবস্থানকে, স্বয়ং দেবতাকে ঘুরে ঘুরে উপাসনা করবে ভক্ত। আমাদের দুর্গাপ্রতিমায় সেই রাউন্ড-আপ থাকে না। সে শুধু সামনে থেকেই দেখার চিজ। ব্যাক টু ক্যাম ঈশ্বর, আমাদের দিগ্দর্শনে নেই। ব্যাপারটা আরও দৃষ্টিকটু হয় বিসর্জনের দিন। প্রদক্ষিণের রেফারেন্সটা উল্টে যায়। ‘আমাদের প্রতিমা ধীরে ধীরে নিরঞ্জনের পথে’ এগিয়ে চলে, আমরা পথের দু’পাশে স্থির থাকি। তখন সেই আপেক্ষিক গতিবেগ জাঁকজমকে আড়াল করে রাখা বাঁশ, কাঠামো, খড়, মাটিকে ল্যাংটো করে দেয়। হ্যালোজেনের ফোকাস মেরে সেই অন্ধকার কখনও গোপন করা যায় না।

মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবণতাতেই থ্রি-ডি দেখতে চায়। চোখে চশমা লাগিয়ে টু-ডি পর্দাতেও সে তিন মাত্রাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। এই বঙ্গেই ঘূর্ণির মিনিয়েচার পুতুলেও সেই ত্রিমাত্রিক পরিপূর্ণতার ছোঁয়া মেলে। কিন্তু দুর্গাকে আমরা ঠায় বসিয়ে রেখেছি মাপ করে কাটা একটা টু-ডি খোপের মধ্যে। যেন খাড়া করে রাখা দ্বিমাত্রিক শবদেহ।
দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখিনি, দেখেছি খোলা রাস্তায়। প্রতি বছর দেখি, পুজোর কিছুটা আগে। বাইরে শুকোতে দেওয়া আদুড় গায়ে দুর্গা। এমনই আমাদের সচেতনতা। এমনই আমাদের নান্দনিকতা। বসন পরো মা। এ ক’দিন অর্ধেক বেনারসিতেই চালিয়ে নাও। বাকি অর্ধেকে পট না-পাও, চটই টাঙিয়ে নিও।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ অক্টোবর ২০১২