সুস্নাত চৌধুরী
জর্জ বার্নাড শ-কে নাকি একবার এক রূপসী ফরাসি অভিনেত্রী অচানক যেচেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একটু হতচকিত শ এমন আবেদনের কারণ জানতে চাইলে আবেদনময়ী বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হলে যেটা হবে, তা হল একটি ফাটাফাটি বাচ্চা! আমার রূপ ও আপনার প্রজ্ঞা নিয়ে সে জন্মাবে।’ ভুরু তুলে শ-এর জবাব, যেন রিফ্লেক্সে --- ‘আমি ভাবছিলাম, উলটোটা হওয়ার চান্সও তো আটআনা থেকে যাচ্ছে। মানে, যদি, আপনার প্রজ্ঞা ও আমার রূপ...!’
আমিও একাই এক শ। আ স্যুটেবল বয়। তর্জমায় ‘সৎ পাত্র’-ও বলতে পারেন। সু ও কুমার গঙ্গারামের আর্কেটাইপ। তাই, শ-সুলভ সমস্যা আমাদের নেই। রূপ ও প্রজ্ঞা, বাই দ্বি-ফল্ট, দুয়েরই তথৈবচ হাল আমার। শূন্যকে থ্রি-এক্স দিয়ে গুণ করলেও তো শূন্যই হয়, তা সে প্রবল গুণই হোক আর প্রচ্ছন্ন গুণ। আমার ‘তিনি’ শত জিনোটাইপ-ফিনোটাইপ কষে, মেন্ডেলের মটরশুঁটি থেকে ইঁদুরছানার পিছে ছুটে, বায়োলজি থেকে জাভা সিপ্লাসপ্লাস হয়ে, ফের জাভা সুমাত্রা বালি পেরিয়ে উত্তরপাড়াতেই এসে থেমেছেন। এবং অবশেষে বুঝেছেন (বিয়ের মাত্র তিন বছরে হাড়ে-হাড়ে বোঝা সম্ভব নয়, বিশেষত স্ত্রীদের পক্ষে), আমাকে দিয়ে বাথরুম পরিষ্কারও করানো যায় না। নিছক আত্মোপলব্ধি নয়, এ ফ্যাক্ট। তবু নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস রাখেন বলেই, লার্নিং ইংলিশের ফ্যামিলি ট্রি কি অবনেদি বাড়ির বংশলতিকা নির্মাণের আশায় এই নেভার এন্ডিং লুপ-এ পা বাড়িয়েছেন ভদ্রমহিলা। আমি স্রেফ ডিকটেশন শুনে-শুনে ডিটেকশন করেছি। ওয়ান প্লাস ওয়ান ইজ ইকুয়াল টু থ্রি। সংসারের যোগে ক্যালকুলেটর ছেড়ে ইউএসজি-র উপর ভরসা রাখতে হয়েছে আমায়।
ব্যয় আছে, তবু একথা সত্য, সংসার নামক চড়ুইভাতিতে আমি আসলে অব্যয়। ‘তিনি’ একাই কর্তৃকারক ও কর্মকারক। অতএব জিনের দায়িত্বও আমার নয় --- তা সে আলাদিনেরই হোক, বা নিজের সন্তানের। এমতাবস্থায়, যখন তিনি ও তাঁর সন্তানের মোট ওজন কিলোয় মাপা হবে না কুইন্টালে, এই নিয়ে রিপোর্ট-লিখিয়েদের মধ্যে জোর বাদানুবাদ --- আমি কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে হোটেলের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে চলেছি। কেননা, সত্যি কথা বলতে কী, নিজের সন্তানকে নিয়ে আমার ওসব স্বপ্ন-টপ্ন কিস্যু নেই। আমার আসলে অন্য কিছু মতলব আছে!
আপাতত, একটা মতলবের কথাই খুলে বললে, টের পাবেন বাকিগুলো কেমন হতে পারে। আমার ওই বনের মোষগুলির একটি, বছরে একবারই বনে বেরোয়, জানুয়ারি নাগাদ। লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। তারপর শিং উঁচিয়ে বইমেলার ধুলো-কাদা মেখে তার ও আমার ফেরা। তো ব্যাপার হচ্ছে, গায়ে-গতরে এখন সে ব্যাটা বেশ পুরুষ্টু। তার ভবিষ্যতের ফর্মার কথা ভেবে আমি আরও শঙ্কিত। দূরদর্শীর মতো এলআইসি না করে, বরং ভদ্রমহিলার দিকে ইদানীং এগিয়ে দিচ্ছি দু-পাতা চারপাতা প্রুফ। মানে, প্রুফ দেখার ব্যাপারটা যদি ইনফিলট্রেট করা যায়। বাবা হিসেবে আমার শুধু এটুকুই আগাম চাহিদা! আর মেলার মাঠে টেবিল সামলানো? উলটোদিকে তন্বী পাঠিকা কিংবা মাচো কবি থাকলে, বাঙালি রক্ত এমনিই পৌঁছে যাবে ‘মিলনমেলা’-এ।
ব্যয় আছে, তবু একথা সত্য, সংসার নামক চড়ুইভাতিতে আমি আসলে অব্যয়। ‘তিনি’ একাই কর্তৃকারক ও কর্মকারক। অতএব জিনের দায়িত্বও আমার নয় --- তা সে আলাদিনেরই হোক, বা নিজের সন্তানের। এমতাবস্থায়, যখন তিনি ও তাঁর সন্তানের মোট ওজন কিলোয় মাপা হবে না কুইন্টালে, এই নিয়ে রিপোর্ট-লিখিয়েদের মধ্যে জোর বাদানুবাদ --- আমি কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে হোটেলের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে চলেছি। কেননা, সত্যি কথা বলতে কী, নিজের সন্তানকে নিয়ে আমার ওসব স্বপ্ন-টপ্ন কিস্যু নেই। আমার আসলে অন্য কিছু মতলব আছে!
আপাতত, একটা মতলবের কথাই খুলে বললে, টের পাবেন বাকিগুলো কেমন হতে পারে। আমার ওই বনের মোষগুলির একটি, বছরে একবারই বনে বেরোয়, জানুয়ারি নাগাদ। লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। তারপর শিং উঁচিয়ে বইমেলার ধুলো-কাদা মেখে তার ও আমার ফেরা। তো ব্যাপার হচ্ছে, গায়ে-গতরে এখন সে ব্যাটা বেশ পুরুষ্টু। তার ভবিষ্যতের ফর্মার কথা ভেবে আমি আরও শঙ্কিত। দূরদর্শীর মতো এলআইসি না করে, বরং ভদ্রমহিলার দিকে ইদানীং এগিয়ে দিচ্ছি দু-পাতা চারপাতা প্রুফ। মানে, প্রুফ দেখার ব্যাপারটা যদি ইনফিলট্রেট করা যায়। বাবা হিসেবে আমার শুধু এটুকুই আগাম চাহিদা! আর মেলার মাঠে টেবিল সামলানো? উলটোদিকে তন্বী পাঠিকা কিংবা মাচো কবি থাকলে, বাঙালি রক্ত এমনিই পৌঁছে যাবে ‘মিলনমেলা’-এ।
***
এই অবধি লিখে, দেখছি, আমার ধুনকি কেটে গিয়েছে। ব্যাপারটা অত ফচকে নয়। এটা কি একটা ফরমায়েসি হাজার শব্দের গদ্য, নাকি অন্য কিছু হয়ে যাচ্ছে? আমি কি সময়ের চেয়ে দু-এক পা এগিয়ে গিয়ে কিছু ডকুমেন্টেড করে যেতে চাইছি? কাকে লিখছি আমি, পাঠককে? নাকি ‘ভণ্ড পাঠক’-এর তোয়াক্কা না-করে --- ২০২৩, ২০৩১, আমার মতো ২০৪৫, কিংবা জানি না কবে কখন এ-লেখার উলটো দিকে সে বসে আছে বলেই ভাবছি আমি। হয়তো খিস্তিই করছে সে, অস্ফূটে।
এই যে ভবিষ্যতকে দেখতে পাওয়া, আগামীর সঙ্গে কথোপকথন, এও তো একরকম স্বপ্নই! হিন্দোল ব্লগ লিখে রাখছে কেলো-র জন্য। বড়ো হলে হাওয়ায়-হাওয়ায় পড়বে সে। মুজতবা আলি ভবিষ্যতের অ্যাড্রেসে চিঠি লিখছেন সৈয়দ মুশাররফ আলি আর সৈয়দ জগলুল আলি-কে। সম্বোধন করছেন ‘বাবা ফিরোজ’, ‘বাবা ভজু’। চিঠির শেষে --- ‘তোমার আব্বু’। পাতার পর পাতা জুড়ে ‘প্রবাসী পিতার বুভুক্ষু বাৎসল্য’। আমি কি টস হওয়ার আগেই নেমে পড়েছি ব্যাট করতে? সিজার না নর্মাল, তা বুঝতেও তো এখনও কয়েক মাস।
১২ই জুন ১৯৫৫
বাবা ফিরোজ,
তুমি নাকি একদিন আদর করে ভজুকে জিজ্ঞেস করলে, ‘ভজু, তোর আব্বু কোথায়?’
আমি তখন ঢাকাতে তোমাদের দেখতে গিয়েছিলুম। তুমি ‘তোমার আব্বু’কে পেয়ে ভারী খুশী।
কিন্তু ভজুকে ভালোবাসো বলে দুশ্চিন্তা হল --- আমার তো তাই মনে হয় --- এর আব্বু একবারও আসেনি কেন?
আব্বু
১২ই জুন ১৯৫৫
বাবা ফিরোজ,
তুমি নাকি একদিন আদর করে ভজুকে জিজ্ঞেস করলে, ‘ভজু, তোর আব্বু কোথায়?’
আমি তখন ঢাকাতে তোমাদের দেখতে গিয়েছিলুম। তুমি ‘তোমার আব্বু’কে পেয়ে ভারী খুশী।
কিন্তু ভজুকে ভালোবাসো বলে দুশ্চিন্তা হল --- আমার তো তাই মনে হয় --- এর আব্বু একবারও আসেনি কেন?
আব্বু
বড়ো ছেলেকে মুজতবা আলির এই চিঠি যেটুকু বাস্তবের ইঙ্গিত, আমি কি উপস্থিত সেটুকুও স্বপ্নের মতো কামনা করছি? অমন ‘ভারী খুশী’-র অনুভূতি যদি তার কোনওদিন না জাগে, আমি কি ভেঙে পড়ব? হয়তো পড়ব, হয়তো পড়ব না-ও। কিন্তু গর্ভে তো ধারণ করিনি, স্রেফ পার্শিয়ালি ক্রোমোজোম দিয়েছি বলেই, আমি এভাবে কতদূর বুনে যেতে পারি স্বপ্নের জাল? যদি বা গর্ভবানও হতাম, তা-ও কি সঙ্গত ছিল এইসব ড্রিম সিকুয়েন্স? ও যদি পাজ্ল-এর সাইট থেকে ধাঁধা সল্ভ করে একের পর এক, কিন্তু ফরমুলা মনে রাখতে না-পেরে ত্রিকোণমিতিতে গোল্লা পায় --- আমি কি রাগ করব? যদি সিলেবাসের নির্বাচিত অংশের বদলে গোগ্রাসে গিলে ফেলে গোটা উপন্যাসের পিডিএফ, কিন্তু নোট মুখস্থ করতে না-পেরে বাংলায় থার্টি পার্সেন্ট তোলে --- বকব, ভীষণ বকব গোপনে? কিংবা যদি সবকিছুই উলটো খাতে বয় --- অঙ্কে নিরানব্বই, পাজ্ল নিয়ে সময় নষ্ট না করে --- বাংলায় হায়েস্ট, ‘মানে বই’-কেই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ঠাওরায় --- আমি কি খুশিই হব, নাকি ভাসমান থাকব হতাশায়? কিংবা দু-টি অপশনেরই মাঝামাঝি, একদম মিডিওকার --- ধাঁধায় বাহান্ন, অঙ্কে তিপ্পান্ন --- টেক্সটবই কি কবিতা সমগ্র, দু-থেকেই শতহাত দূরে --- তখন?
লেটার প্রেস হলে, এতক্ষণে ‘জিজ্ঞাসা চিহ্ন’ ফুরিয়ে যেত! এই ডিজিটাল উত্তর-আধুনিক যুগ প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিতে পারে। আমি তারই ফায়দা লুটছি বেদম। হয়তো উত্তরসূরির কাছে প্রশ্নসূচি সাজিয়ে নিজেকে একটা নিরপেক্ষ উচ্চতায় তুলে নেওয়ার রাজনীতিই করছি। হয়তো, আড়ালে-আড়ালে এটাও বুঝে নিতে চাইছি, আমি কি আরেকজন ‘দ্বিতীয় আমি’-রই মুখোমুখি হতে চাই...
একজন পুরুষ কি বলতে পারে না, ‘কার ছায়া তোর মুখে মনে পড়ে না’?লেটার প্রেস হলে, এতক্ষণে ‘জিজ্ঞাসা চিহ্ন’ ফুরিয়ে যেত! এই ডিজিটাল উত্তর-আধুনিক যুগ প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিতে পারে। আমি তারই ফায়দা লুটছি বেদম। হয়তো উত্তরসূরির কাছে প্রশ্নসূচি সাজিয়ে নিজেকে একটা নিরপেক্ষ উচ্চতায় তুলে নেওয়ার রাজনীতিই করছি। হয়তো, আড়ালে-আড়ালে এটাও বুঝে নিতে চাইছি, আমি কি আরেকজন ‘দ্বিতীয় আমি’-রই মুখোমুখি হতে চাই...
***
আশা ছিলো সন্তানের উৎপন্ন চুলের পরে হাতরাখা যাবে, আশা ছিলো --- এরকমতর ছিলো আশা
সংসারে ও চৌরাস্তায় ন্যাংটার মুখশ্রীখানি দেখে
একদিন অন্ধকারে নিজহাত রেখেছি মাথায়।
কিন্তু আমিও তো অদ্যাবধি কোনও পারমিশন নিতে পারিনি। অদক্ষ অভিনেতার মতো নিজের হাত দুটো কোথায় রাখব, এখন ডিসাইড করতে পারছি না। হয়তো সত্যিই কোনও স্বপ্ন আমার ন্যাপস্যাকে নেই। আমি হয়তো কতকগুলো গোপন জিজ্ঞাসাচিহ্ন মনে-মনে বহন করছি মাত্র। তবু কে জানে কেন, মাঝে-মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। আর, ঝাপসা দেখছি। লেন্সে ফাংগাস, নাকি মেঘ করেছে আকাশে? নাকি প্রকৃত প্রস্তাবে, দৃশ্য এমনই? নচেৎ... প্রম্পটার, তুমি ভবিষ্যৎ থেকে প্রম্প্ট করো। যেন শুনতে পাই, শোনো, এ-নাটক মাইরি পড়া নেই --- কী ভয় করছে রে শালা, বাকি সব কাস্টিং কোথায়?
আত্মজ, ২০১২