15 April 2014

ছ’টা=সাড়ে ছ’টা=সাতটা

সুস্নাত চৌধুরী


কাকের ক্যাকোফোনি কানে তোলেনি বাঙালি। নইলে শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে তো কবেই সেই ভারী প্রশ্নটা করে ফেলেছিল— ‘তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?’ কিন্তু ‘কাকস্য’ পরিবেদনা! বঙ্গালি বং হল, ট্যাঁকঘড়ি থেকে মোবাইলে শিফ্ট করল, তবু তার জীবনদর্শন রয়ে গেল একই— লেট্স বি লেট! দেরি করতে সে কক্ষনও দেরি করেনি। প্রেমিকা থেকে পাওনাদার, যে কোনও কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখতে সে আর জায়গা পায়নি— রেলাভরে রেলস্টেশনের বড়ঘড়ির তলাকেই বেছে নিয়েছে। ঘাড় তুলে গোন পাগলা, কত ক্ষণ লেটে আসছি আমি! তাবৎ বাঙালির আইকনিক ওয়েটিং রুমটির মাথায় ছাদ দিয়েছে হাওড়ার বড়ঘড়ি।
ঘড়ি চিরকালই বাঙালির কবজিতে শ্রেষ্ঠ অর্নামেন্ট। দেওয়ালে সেরা শো-পিস। বাঙালির কাছে সে টোটাল হেরে গিয়েছে। নইলে কি প্রতুলচন্দ্র সরকারের সেই জাদুটির কথা বার বার বাঙালি সগর্বে স্মরণ করে! মঞ্চে পৌঁছতে সে দিন বেশ বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল পি সি সরকার সিনিয়রের। অতঃপর স্রেফ সম্মোহনের কৌশলে সময়কেও বশ করলেন তিনি। ঘড়ির কাঁটা যেন উলটো দিকে ছুটল। খানিক আগেও যারা পাংচুয়ালিটি নিয়ে সোচ্চার লেকচার ঝাড়ছিল, তাদেরও হতভম্ব হয়ে গুনগুন সলিলকি— না হে, সময় তো দেখছি এখন ঠিকই আছে! এই ম্যাজিক বাঙালি হেবি খেয়েছিল, আজও আপিসে-ইস্কুলে শুরুর ঘণ্টা বেজে গেলে নানা বাহানায় বদহজমের চোঁয়া ঢেকুর সে ভরপুর তোলে। লেট মার্ক খেয়েও বেহেলদোল স্মার্টনেসে ভাবখানা তার এমন— সে যখন মাঠে নামে, তখনই কিক-অফ! আসলে সময়কে মান্য করা নয়, মহৎ-পাতি নির্বিশেষে বাঙালি চির কাল সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। বেলা পড়ে এলেও বোকাসোকা গোপীনাথ ওস্তাদকে ভৈরবী রাগিণী গাওয়ানোর জন্য বাঙালি তার ‘স্বকাল’ নির্মাণ করে নিয়েছে। গাঁয়ের মাতব্বরদের সেই আড্ডা আসলে গড় বাঙালির মনের কথাই বলে— ‘আমার এই যষ্টির ছায়া... যত ক্ষণ না পর্যন্ত ওই প্রস্তরখণ্ড স্পর্শ করছে, তত ক্ষণ সকাল।’ আবার বেয়াড়া সুরের তাড়নায় সমবেত মশকরা পরক্ষণেই ঘোষণা করে দেয়— ‘সকাল ফুরিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল...’! ঠিক যেমন আজকের কবিয়াল গেয়ে ওঠেন— ‘ধরা যাক আজ রোববার কোনও কাজ নেই... ধরা যাক আজ রোববার কোনও তাড়া নেই...’। ক্যালেন্ডারকে তুড়ি মেরে, আপনার উইক-এন্ড বাঙালি আপনি রচনা করে। বাঙালি জাতির কাছে যদি ধরা হয় সরা, তবে রাত হবে দিন, এ আর কী কঠিন! এই ঘড়ি ধরে মারো টান ল্যাদ কি বাঙালির বাপের সম্পত্তি নয়?



ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
বাঙালি জানে, ‘পাংচুয়ালিটি’র বাংলা ‘সময়জ্ঞান’। ‘পাংচুয়ালিটি’ মানে যে আসলে ‘দায়িত্বজ্ঞান’, তা বাঙালিকে কে শেখাবে? ঔপনিবেশিক খোঁয়াড়ি তার শিরায়-স্নায়ুতে আজও নানা রূপে বহমান, কিন্তু এই জিনিসটি সে লালমুখোদের থেকে দুশো বছরেও শিখতে পারেনি। এক ‘ইউরোপীয় বাঙালি’র কাছে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন বিখ্যাত এক বাঙালি সাংবাদিক। পটভূমি বিলেত। হোটেল থেকে বেরিয়ে সেই বাঙালির বাড়িতে পৌঁছতে পাঁচ মিনিট মোটে লেট হয়েছিল সাংবাদিকের। নক করার পর, সে দিনের মতো নক আউট হয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল— দরজার ও-পারে যাওয়ার আর অধিকার মেলেনি। আবার পর দিন। এ বার আধ ঘণ্টা আগে পৌঁছে উনত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করে তবে কলিং বেলে হাত ছোঁয়ান ওই সাংবাদিক। প্রবেশাধিকার মেলে। সাক্ষাৎকার দিতে সে দিন নাকি আর কোনও বেগড়বাঁই করেননি নীরদ সি চৌধুরী!
জাপানে গিয়েও নাকি ভারী বিড়ম্বনায় পড়েছিল এক বাঙালি। অচেনা দেশে ঠিক জায়গায় নামতে যাতে সমস্যা না হয়, তাই ট্রেনে ওঠার আগেই সে জানতে চাইল, অমুক স্টেশনে তাকে নামতে হবে, তো তার আগের স্টেশনের নামটি কী? অবাক কণ্ঠে ছুটে এল স্পষ্ট জবাব, পাঁচটা তেইশে যেখানে ট্রেন দাঁড়াবে, সেখানে নামতে হবে। সে যতই জিজ্ঞেস করে, আগের স্টেশনের নাম কী, ততই উত্তর আসে, পাঁচটা তেইশ। পাঁচটা তেইশ অবধি অপেক্ষা করে বাঙালি বাবুটি ঠাওর করেছিল, পাংচুয়ালিটি কারে কয়! রোজকার মতোই ঠিক তখনই ওই স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল ট্রেন। অতঃপর বাঙালি নামে। জাপানিরা ওঠে।
অথচ বাঙালির শহুরে রূপকথা মেট্রো রেলও আজ পাঁচ-দশ মিনিট অন্তরই ডিজিটাল বোর্ডে তার নীল আর হলুদ সময়ের তুলনা দিয়ে জাহির করে, এই দু-এক দশকেই সে কত্তখানি বাঙালি হয়ে গিয়েছে! শিয়ালদা-ডানকুনি লাইনে ডেলি প্যাসেঞ্জারির সূত্রেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি এক বিচিত্র টাইমটেব্ল পকেটে রাখতেন। নিজেরই বানানো। তাতে প্রতিটি ট্রেনের নম্বরের পাশে লেখা থাকত, আসলে ওই ট্রেনটি গড়পড়তা য’টা নাগাদ আসে, সেই সময়টি! বলা ভাল, টাইমটেব্লের প্যারডি। এখন প্রশ্ন হল, কোনটি প্যারডি, আর কোনটি অরিজিনাল!
ট্রেনের স্টেশনে ঢুকতে, দিদিমণির ক্লাসে ঢুকতে, গবেষকের সেমিনারে ঢুকতে, কেরানির আপিসে ঢুকতে... সব রকমের ঢোকাঢুকির ক্ষেত্রেই এই যে বাড়তি সময়টুকু, বাঙালির কাছে টেক্ন ফর গ্র্যান্টেড। বছর পনেরো আগের কথা। সন্ধে ছ’টা থেকে কলকাতার এক মঞ্চে সে দিন একটি বাংলা ব্যান্ডের অনুষ্ঠান। কী করে কে জানে, একেবারে যথাসময়েই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সোয়া ছ’টা নাগাদ হঠাৎই গেটের মুখে জোর বাওয়াল! ব্যান্ডেরই এক সদস্যের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড় দশ-বারো জন দর্শকের। তাঁদের অভিযোগ, কেন শুরু হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠান? ব্যান্ড-সদস্য জানান, কার্ডেই তো সময় লেখা রয়েছে: ছ’টা। বিক্ষুব্ধ দর্শকদেরও তখন বক্তব্য সেটাই— ‘আরে দাদা, সেই তো বলছি! পরিষ্কার লেখা রয়েছে, সন্ধে ছ’টায় প্রোগ্রাম। আর এখন সবে সোয়া ছ’টা, শুরু হয়ে গেল?’
‘আই এস টি’ মানে আজ বাঙালির অভিধানে— ইন্ডিয়ান স্ট্রেচেব্ল টাইম! ‘ডেডলাইন’ মানে জাঙিয়ার ইলাস্টিক। বাঙালি-শ্রেষ্ঠ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কি ‘সময়জ্ঞান’ কনসেপ্টটিকে খোঁটা দেননি ‘অন্ত্যেষ্টি-সৎকার’ নাটিকায়? মৃত্যুশয্যায় বাবা। আশা-মাফিক যথাসময়ে তাঁর দেহান্ত হচ্ছে না দেখে, ছেলে গোটা বাঙালি জাতিকেই দুষছে— ‘মরবে তবু পাংচুয়াল হবে না।’ ‘লিপিকা’র ‘ভুল স্বর্গ’ রচনাটিতেও রবীন্দ্রনাথ কাক্কেশ্বরকে কাউন্টার করছেন। লিখছেন, ‘সবাই বলে, ‘সময়ের মূল্য আছে।’ কেউ বলে না, ‘সময় অমূল্য।’ আমবাঙালি অবশ্য সময় নিয়ে এই দর কষাকষিতে নেই। সময় তার কাছে সারা বছরের চৈত্র সেল। ফ্রি। মাগনা।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিল ২০১৪

30 December 2013

তুই তুমি আপনি

সুস্নাত চৌধুরী



ছবি: সুমন চৌধুরী

ভিখিরিকে আপনি কখনও আপনি বলে ডেকেছেন? রিকশাওলা, তা তিনি আপনার বাপের বয়সি হলেও আপনার রিফ্লেক্স আপনাকে আপনি বলা থেকে আটকেছে। আপনি তেমন মাতব্বর টাইপ্‌স হলে, তুইতোকারি করেছেন হেলায়, রেলায়। ‘ওয়, হট এখান থে...’ কিংবা ‘কীরে, কে যাবি রে’। খুব সমাজ-সচেতন সুনাগরিক হলেও বলেছেন --- ‘এ নাও গো, ছেলের চিকিচ্ছে করিও’ কিংবা ‘আচ্ছা বাবা, তোমায় পাঁচ টাকা বেশি ভাড়াই দেব, একটু জোরে টানো এবার’। আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি বাবা-বাছা করেছেন, ওই মানুষটির ভালোও চেয়েছেন হয়তো, কিন্তু কক্ষণও কোনওদিনও তুমি-র উপরে উঠতে পারেননি। অথচ ওই অশিক্ষিত ছোটলোক ভিখিরি কি রিকশাওলারা কিন্তু আগাগোড়া আপনাকে আপনি-ই বলে এসেছেন --- আপনি কেরানি না প্রোমোটার, অধ্যাপক না আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বিচার করেননি।
আপনার আদরের লাল টুকটুকে নতুন গাড়িটিকে যখন পনেরো দিনের মাথায় হালকা ঘষে দিয়েছে বেয়াক্কেলে রিকশা, আপনার অন্তর থেকে খুব থাপ্পড় পেলেও আপনি নিজেকে আটকেছেন। কিন্তু চিৎকার করতে দ্বিধা করেননি --- ‘অ্যাই, দেখে চালাতে পারিস না’! আবার মাস খানেকের মাথায় যখন ছোট্ট চুমু খেয়েছে রঙচটা হলুদ ট্যাক্সি, আপনি একই ভাবে চেঁচিয়ে উঠেছেন, একই অভিব্যক্তি ছিল আপনার, শুধু তুই-টা বদলে গিয়েছিল তুমি-তে --- ‘আরে ভাই, দেখে চালাও’! আর যখন টোকাটা মারল আপনার চেয়ে আরও লাখ দুয়েক বেশি দামের একটা সেদান, আপনি তখনও রাস্তা-টাস্তা আটকে সে-গাড়ির ড্রাইভার কাম মালিকের সঙ্গে জোর একচোট ক্যাচাল বাধিয়েছেন। কিন্তু, আপনি-র নীচে আপনি নামেননি --- ‘দ্যোর মশাই, দেখে চালাতে পারেন না’! বাইরে একই রকম চোখ রাঙাচ্ছেন, ভেতরেও একই খিস্তি দিচ্ছেন প্রত্যেককে, কিন্তু আপনা থেকেই আপনার মুখ দিয়ে কখনও বেরোচ্ছে তুই, কখনও তুমি, কখনও আপনি। ব্যক্তিভেদে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ফারাক যে এভাবে আমাদের থেকে স্রেফ সম্বোধনের তারতম্য আদায় করে নেয়, তাকে আমাদের ‘শিক্ষা’ বা ‘সংস্কৃতি’ না বলে ‘রিফ্লেক্স’ বলাই বোধহয় ঠিক হয়। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সমাজ যে রিফ্লেক্সকে একেবারে গভীরে পুঁতে দেয়। স্বতঃসিদ্ধের মতো যা চলে আসে, যাকে ঘিরে কোনও প্রশ্নই আর অ্যাফোর্ড করা যায় না। সন্ধের মহানগরে বেকার টাইম খেতে থাকা বাসটিতে সওয়ার হয়ে যখন বিরক্ত হয়ে ওঠেন অফিস-ফেরতা সুশিক্ষিত ভদ্র যুবকটি, তিনিও তো দুমদুম চাপড় মেরে চল্লিশোর্ধ ড্রাইভার আর কন্ডাকটারকে উদ্দেশ করে হেঁকে ওঠেন --- ‘আরে, টান না রে ভাই... আর কত প্যাসেঞ্জার তুলবি...’। এক বাস মানুষের কারো মনেই কি তখন প্রশ্ন জাগে, যে, ক্রিয়াপদগুলি ‘টানুন’ কিংবা ‘তুলবেন’ হলে বাসটা একটু জোরে চললেও চলতে পারত? এখানে অবশ্য ছোট্ট একটু ব্যতিক্রম আছে। আদেশ বা নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তুইতোকারি অনেক সময়ই অপরিহার্য। তা একেবারেই কাউকে খাটো করা নয়, বরং সেই নির্দেশকে জোরদার করা। চরম মোহনবাগান-সমর্থকটি যখন উত্তেজিত হয়ে কাৎসুমির উদ্দেশে বলেন, ‘চল... চল... বলটা বাড়া এবার...’ --- কিংবা, টেনশনে ভরা স্লগ ওভারে যখন ক্লাস সিক্সের ছোঁড়াটিও টিভির পর্দায় কোহলি কি ধোনির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘আরে এটা মারতে পারলি না...’ --- তখন সেখানে অপমানের ছিটেফোঁটাও থাকে না। যেমন থাকে না, ‘চল রে চল সবে ভারতসন্তান’ গাইবার সময়। ‘চলুন’ বা ‘চলো’ বললে, গানটি মাঠে মারা যায়। মঞ্চে তো মারা যায়ই!
কিন্তু, দিন বদলের স্বপ্ন দেখা তরুণ নেতাটি যখন ঢুকে যান গ্রাম বাংলার ধান খেত পেরিয়ে, চাষিভাইদের একজোট করে বপন করতে থাকেন তাঁর সৎ রাজনৈতিক বিশ্বাসের বীজ --- কেমন বক্তৃতা করেন তখন? ‘এই জমি তোমাদের, এক চিলতে মাটিও তোমরা ছাড়বে না...’। না হয় তাঁরা মার্ক্স-এঙ্গেলস-মাও পড়েননি, চাষভুসো খেটে-খাওয়া মানুষ --- তাই বলে ষাটোর্ধ্ব-সত্তরোর্ধ্ব মানুষগুলোর বরাতে কখনও আপনি জুটবে না? এককালে রক্তচোষা জমিদার তাঁদের তুই বলে এসেছেন, পরবর্তীতে সত্যি-সত্যিই পাশে দাঁড়ানো বাবুরাও তাঁদের গড়পড়তা তুমি-র উপরে জায়গা দিতে পারলেন না।
কাকে তুই বলতে হবে, কাকে তুমি বা আপনি --- তা নির্ধারণ করতে আরেকটা বড় ফ্যাক্টর বয়স। কলেজ লাইফে দেখেছি, দাড়ি-টাড়ি কেটে বেরোলে মেয়েরা একটু তাকাত বটে, কিন্তু অচেনা লোকে তুমি-তুমি বলত। তাতে আঁতে লাগলে --- কাল ছিল গাল খালি, আজ চুলে যায় ভরে! ছেলেদের দাড়ি, মেয়েদের শাড়ি --- আনজান পাবলিকের থেকে বহু আকাঙ্ক্ষিত আপনি, আপনিই আদায় করে নিত! নইলে মনে হত, আমি তো তাঁদের আপনি-আজ্ঞে করছি, কিন্তু জাস্ট কয়েক বছর আগে ঘটনাচক্রে জন্মে গিয়েছে বলে অচেনা-আধাচেনা কিছু মানুষ নির্দ্বিধায় তুইতোকারি করে যাবে? মাগনা! কখনও কি আমাদের সবারই এই রোখ চেপে যায় না --- রাস্তা-ঘাটে যে আমায় তুই বলবে, আমিও শালা তাকে তুই বলব!
সত্যজিৎ রায়ের অনুকূল তো ঠিক এমনটাই করত। নিকুঞ্জবাবুর রোবট-চাকর। নিকুঞ্জবাবুর বন্ধু বিনয় পাকড়াশি নিজের চাকরদের তুইতোকারি করেই অভ্যস্ত। আড্ডা মারতে এসে একদিন অনুকূলকেও তুই বলে ফেললেন। ‘তাতে অনুকূল গম্ভীর ভাবে বলে, আমাকে তুই বললে কিন্তু তোকেও আমি তুই বলব।’ কতকটা একই চাল ছিল তারিণীখুড়োরও। ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’-এ গেরুয়াধারী বাবাজি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী চাস তুই?’ এই প্রশ্নে খচে যাওয়ার কাহিনি বর্ণনা করছেন খুড়ো স্বয়ং --- ‘বাবাজিদের এই হোলসেল তুইতোকারির ব্যাপারটা আমি মোটে বরদাস্ত করতে পারি না। তাই এনার প্রশ্ন শুনে ধাঁ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। বললাম, “রাজার অনুরোধে তোর সঙ্গে দেখা করতে এলাম”।’ এরপর খুড়ো যা বলছেন, তা ভারী ইন্টারেস্টিং! বাবাজি নাকি এই জবাবে মোটেই বিরক্ত বা বিচলিত হননি, তুইতোকারিও চালিয়ে গিয়েছিলেন। বরং সঙ্গে যা-যা বলেছিলেন এবং করেছিলেন, তাতে স্বয়ং তারিণীখুড়োই ফিদা! ‘মনে-মনে বললাম, বাবাজির ক্ষমতা অসীম, কারণ আমার কাছ থেকে “তুই” থেকে “আপনি” সম্বোধন আদায় করে নিতে লেগেছে ঠিক দু মিনিট।’
ব্যাপারটা এমনই। প্রশ্নটা যদি সম্মান জানানোরই হয় --- তবে তা যথাযথ ক্ষেত্রে আপনা-আপনিই চলে আসা উচিৎ। তার জন্য সমাজের ঠিক করে দেওয়া কোনও প্যারামিটারের প্রয়োজন পড়ে না! তখন ক্লাস, হায়ারার্কি, সোশ্যাল স্টেটাস, সিটিসি --- এসব বিচার করে ব্যাকরণ বই দেখে মুখস্ত করতে হয় না, কাকে কী বলে ডাকব। উপেন্দ্রকিশোরের ‘উকুনে বুড়ির কথা’ সমাজ-নির্ধারিত এই সিস্টেমের চমৎকার এক উদাহারণ। সেখানে শুরু থেকেই সকলের সঙ্গে সকলের --- বুড়ি-বক, বক-নদী, নদী-হাতি, হাতি-গাছ, গাছ-ঘুঘু... সব সম্পর্কই তুইতোকারির। কিন্তু ঘুঘু যেই রাখালের সঙ্গে কথা বলছে, তাকে তুমি বলছে। উল্টোদিকে রাখাল কিন্তু বলছে তুই। আবার রাজার বাড়ির দাসী রাখালকে বলছে তুই, রাখাল তাকে বলছে তুমি। মজার কথা, তবে স্বাভাবিকই, গোটা গল্পে আপনি সম্বোধন জুটছে কেবল রানিমা আর রাজামশাই-এর!
এই ট্র্যাডিশন আজও। ফ্যালাসিটাও শুরু হয় এখান থেকেই। বাংলা খবরের কাগজে বা নিউজ চ্যানেলের ভয়েজ ওভারে দেখেছি, ছোটখাটো চোর-ছ্যাঁচোড়দের ক্ষেত্রে তুচ্ছার্থে ‘সে’, ‘তাকে’ এইসব শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অপরাধী যেই চার্লস শোভরাজ, বিন লাদেন বা দাউদ ইব্রাহিমের মতো রাঘব-বোয়াল, তখন বলা হয় ‘তিনি’, স-চন্দ্রবিন্দু ‘তাঁআঁকে’! মানে, একটি চুনোপুঁটির চেয়ে অনেক-অনেক বেশি ঘৃন্য ও মারাত্মক অপরাধে যিনি দোষী, তাঁর জন্য বরাদ্দ বেশ-খানিক সম্মান। আবার ধরা যাক, বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরেও নির্দেশ থাকে কতকটা এরকম --- ‘যা জান, লেখো’। সেই নির্দেশই বদলে যায় স্কুল সার্ভিসের মতো চাকরির পরীক্ষায় --- ‘যা জানেন, লিখুন’। এখন যে পড়ুয়াটি বিএ-তে অকথ্য ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতেই পারলেন না, পড়া-টড়া আর হবে না ভেবে এসএসসি দিয়ে চাকরির চেষ্টা করলেন --- আর যিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে ইস্কুলে ঢোকার চেষ্টা না-করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেন --- তাঁদের বৈপরীত্যটা ভাবুন। এই সিস্টেমে প্রথমজনের কপালে জুটল আপনি, আর ভাল রেজাল্ট করেও দ্বিতীয়জন পড়ে রইলেন তুমি-র ক্যাটাগরিতেই! আগে থেকেই ধরে নিয়ে সম্বোধনের ফ্যালাসি আরও আছে। ১৩৪০ সনের শ্রাবণ সংখ্যার ‘বিচিত্রা’-এ অবিকল এই বিষয়টি নিয়েই একটি বিতর্ক চলে। ব্যক্তির পোশাক-আশাকের উপর কীভাবে সম্বোধন নির্ভর করে, তা বোঝাতে শুরুতেই এক গভীর গোলমালের কথা ফাঁদেন সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বৈঠকখানার কাজ করতে করতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে --- পরিধানে পরিচ্ছন্ন ধুতি, দেহে সদ্য-ধৌত ছিটের শার্ট, পায়ে কালো রঙের বার্ণিশ করা পাম্‌প্‌ শু এবং মাথায় হাল ফ্যাশনে ছাঁটা বারো-আনা চার-আনা চুলের মধ্যে সযত্ন-রচিত টেরি। ব্যস্ত হয়ে বলি, “ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসুন?” অপরিচিত ব্যক্তির মুখে বিহ্বলতার গ্লানি ফুটে ওঠে, কুণ্ঠিত স্বরে সে বলে, “আজ্ঞে আপনাদের চাকর রাস্তা থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিলে। কে চুল ছাঁট্‌বেন।” ‘আপনি’ শব্দের অপ-প্রয়োগে বিরক্ত হয়ে উঠি। নাপিতের ক্ষৌর দ্রব্যের বাক্সটি দৃষ্টি-গোচর না হওয়াতেই এই দুর্ঘটনা!’ এমন দুর্ঘটনা আজও আমাদের জীবনে কম ঘটে না। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পরামানিককে আপনি বলাটা ‘অপপ্রয়োগ’ হতে যাবে কেন? বরং যথার্থ অপপ্রয়োগের একটি নিদর্শন তার আধঘণ্টা পরেই ঘটছে লেখকের জীবনে। ‘পদ শব্দে চেয়ে দেখি একটি লোক ঘরে ঢুকেছে, মলিন বসন, পায়ে অর্ধছিন্ন জুতা, মাথার চুল রুক্ষ। ভ্রুকুঞ্চিত ক’রে তাকিয়ে বলি, “কি চাও?” লোকটি একটু সঙ্কুচিত হয়ে বলে, “শ্যামবাজারের দিকে কাজ ছিল, এসেছিলাম, বঙ্কিম আপনাকে একখানা চিঠি দিতে দিয়েছে।” তেমনি ভুকুঞ্চিত ক’রে বলি, “কে বঙ্কিম?” লোকটি একটু বিস্মিত হয়ে বলে, “১৭ নং ঈশ্বর দত্ত লেনের বঙ্কিম সেন।” শুনে লাফিয়ে উঠি, “তাই বল! আমাদের বঙ্কিমবাবু?” লোকটি মৃদু হেসে বলে, “কিন্তু আমাদের বঙ্কিমবাবু ত নয়, আমাদের বঙ্কিমই।”’ মলিন পোশাকের এই মানুষটি যে স্বনামধন্য সাংবাদিক (‘দেশ’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক) বঙ্কিমচন্দ্র সেনের দাদা হতে পারেন, তা ভাবতেই পারেননি লেখক! তুমি-র এমন অপপ্রয়োগে তখন চূড়ান্ত ফল্‌স পজিশনে। ‘লজ্জায় কুণ্ঠায় বিমূঢ় হয়ে যাই এবং প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ‘আপনি’ সম্বোধনের ধারা বর্ষণ করতে থাকি। কিন্তু তখন তীর ছোঁড়া হয়ে গেছে, তখন আর ধনুক সাম্‌লে লাভ কি?’
সম্বোধনের এমন আরও ধাঁধা আছে অন্য জায়গাতেও। প্রশ্নটা যখন নৈকট্যের... আপনি, তুমি না তুই --- কোনটা কাছের, কোনটা দূরের? কী বলে ডাকব কাছের মানুষকে? প্রশ্নটাকে যদি আমাদের কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে ফেলি, তাহলে একটা ছবি উঠে আসে। যে সহকর্মীর সঙ্গে একেবারেই ফরম্যাল সম্পর্ক, তিনি আমার উপরে থাকুন বা নীচে, তাঁকে আমরা সচরাচর আপনি-ই বলি। একটু ঘনিষ্ঠ যাঁরা, তাঁরা তুমি। আর কলিগ হয়েও যাঁরা প্রায় জিগরি দোস্তে পর্যবসিত, ক্যান্টিন থেকে পানশালার সাথী, তাঁরা স্রেফ তুই। কিন্তু এমন সহজ একটা সমীকরণ দিয়ে কি সব অঙ্ক মেলে! আজ থেকে আধা শতক আগেও তো বাবাকে আপনি বলার রেওয়াজ ছিল। সেসব আপনি-বাবারা কি আজকের তুমি-বাবার চেয়ে খারাপ মানুষ ছিলেন, না কম শ্রদ্ধেয় বা কম ভালবাসার লোক ছিলেন? স্বামীকেও তো সেসময় আপনি বলাই ছিল স্ত্রীদের রীতি। তখনও সবচেয়ে কাছের মানুষটি কি তিনিই ছিলেন না? তুই-তুমি-আপনির চলতি কনভেনশন এসবের ব্যাখ্যা চট করে দিতে পারে না।
শুনেছি, স্লোভাক ভাষাতেও নাকি সম্বোধনের এই পার্থক্য আছে। তা অবশ্য আমাদের মতো ত্রিস্তরীয় নয়, দ্বিস্তরীয়। আপনি হল ‘ভি’ (ফরম্যাল ইউ), আর তুমি বা তুই হল ‘তি’ (ইনফরম্যাল ইউ)। সেসব দেশের অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হামেশাই দেখা যায়, পরিচয়ের দিনকয়েকের মধ্যেই পড়ুয়াদের সঙ্গে অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সম্বোধনের পরিবর্তন। শুরু হয় ‘ভি’ দিয়ে, তারপর যেসব ছাত্রছাত্রীরা অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন, তাঁদের অধিকার জন্মায় ‘তি’ ডাকের। আর আপনি নয়, সেই ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে ওই মাস্টারমশাই বা দিদিমণি তখন তুমি। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিটা অবশ্য এখনও এতটা ইনফরম্যাল নয়। তবে, নৈকট্য আর সম্বোধনের আরও আশ্চর্য এক খেলা দেখেছিলাম স্কুলজীবনে। আমাদের মফস্বলের ইস্‌কুলে গেম্‌স টিচার ছিলেন দেবজ্যোতি সাহা। ছাত্রদরদী মানুষ। প্রায়, প্রায় কেন, একেবারেই, বন্ধুর মতোই মিশতেন ছাত্রদের সঙ্গে। কোন লেফট ব্যাকের প্রেমঘটিত সমস্যা, কোন লেগ স্পিনারের পরীক্ষার হলে বসে কিচ্ছু মনে পড়ছে না, কিংবা এমনিই কোনও ল্যাদোস ছাত্র মাইনের টাকায় আলুকাবলি খেয়ে ফেলেছে --- রণে বনে জঙ্গলে এবং পরীক্ষার হলে সহায় একমাত্র তিনি! ছাত্রদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয় এই মানুষটিকে গোটা স্কুল আর ‘স্যার’ বলে ডাকত না। তাঁর ডাকনামেই হয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিচয় --- ‘বাবলুদা’। সঙ্গে, তুমি! তিনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষক, যাঁকে আপনি বলা হত না। মজাটা এখানেই। গোটা স্কুলে, ব্যাচের পর ব্যাচ এটাই রীতি থাকলেও, একটা ব্যতিক্রম ছিল। আমাদের স্কুল টিমে যারা খেলত, অর্থাৎ যারা তাঁর সবচেয়ে কাছের ছাত্র, তিনিও যাদের সবচেয়ে কাছের শিক্ষক --- তারা কিন্তু চিরকাল তাঁকে ‘স্যার’-ই বলে এল। এবং, আপনি!
আবার নৈকট্য কখনও আপনি-কে তুই-এও এনে ফেলে। শ্যামাসঙ্গীত। ‘তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি, তবে আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই’। ‘তুই নাকি মা দয়াময়ী, শুনেছি ওই লোকের মুখে’। কিন্তু, নৈকট্য গভীর গভীরতর হলে এই তুই-ই আবার বদলে যায় তুমি-তে। ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দিব্যি তুইতোকারি চলল, ওয়ান ফাইন মর্নিং হয়ে গেল তুমি! আরও কাছাকাছি আরও কাছে এসো। প্রোপোজ করার পরক্ষণ থেকেই তুমি-তুমি বললে নাকি শরীর জুড়ে শিহরণ! পুরোনো অভ্যেস বয়ে নিয়ে যাওয়াও অবশ্য বিরাট ঝক্কি; সে প্রায় সমাজবিপ্লব! মানে, প্রেমিক-প্রেমিকা যখন স্বামী-স্ত্রী, তখনও তুইতোকারি চলতে থাকলে আর রক্ষে নেই। ফুলশয্যের আগে থেকেই আত্মীয়-পড়শিদের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর শুরু! বিয়ের পর দু’জনে দু’জনকে তুমি বলতে হবে। বলতে হবে মানে, বলতেই হবে। নইলে নাকি পরস্পরকে ঠিক সম্মান দেখানো হয় না। সমাজের এসব ব্যাকরণ যে মানবে না --- সে হয় আঁতেল, নয় ঋতুপর্ণ!
অথচ জীবনের খেলা কেমন বিচিত্র --- যখন কোত্থাও আর কেউ নেই, শুধু আবেগ আর প্রবৃত্তি আছে, তখন বহু ক্ষেত্রেই বিবাহিত সম্পর্কের এসব সম্বোধন আপনা-আপনিই বদলে যায়। বন্ধুবান্ধবের ‘ওইসব’ গল্প থেকে বুঝেছি (এ তথ্যের কোনও গ্যারান্টি দিতে পারব না), এমনিতে যাঁদের তুমি-র সম্পর্ক, সেইসব ঘন সময়ে, ঘামঝরা মুহূর্তে অনেকেই পরস্পরকে তুই বলেন। তবে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমি অন্তত একটি দম্পতিকে চিনি, এমনিতে যারা তুইতোকারি চালায় কিন্তু সেইসব মাখন-সময়ে বলে ওঠে --- তুমি... তুমি...!
কাজেই, দুটো মানুষের নৈকট্য বা দুটো মানুষের দূরত্বের গায়ে প্রথামাফিক একটা করে সর্বনামের টিকিট আটকে আলাদা-আলাদা খাপে পুরে রাখা যায় না। তবু আমরা সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাই। নিয়ম আঁকড়ে থাকি। সে ডাকে কেউ অপমানিত হলেন কিনা, আমাদের ভাবতে বয়ে গেছে। সে সম্বোধন আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত কিনা, আদৌ আমরা কনসার্নড নই। বরং, ঋতুপর্ণ ঘোষ কেন সব্বাইকে তুই-তুই করতেন, কেন মুনমুন সেন-কে ‘মুনদি, তুই...’ বলতেন --- এ নিয়ে বাঙালির অনেক বেশি মাথাব্যথা। শোনা কথা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নাকি সক্কলকে আপনি বলতেন। তা নিয়েও কৌতুহল ছিল বিস্তর। অবশ্য সুনীতিবাবু নিজেই নাকি ভাষাতাত্ত্বিকের জবাব শুনিয়েছিলেন --- সম্বোধন বদলালে তো ক্রিয়াপদও বদলাতে হয়, সে বিস্তর বখেরা, তাই এক আপনি-তেই স্থির থাকা শ্রেয়! এক সময় এমনই একটা যুক্তি ছিল বটে --- ইংরেজির ইউ-এর মতোই কোনও একটি কমন সম্বোধন বাংলাতেও চালু করা। ব্যস, হলেই, তুই-তুমি-আপনি-র জটিলতা থেকে রেহাই! তখন অনেকেই সওয়াল করেছিলেন আপনি-র স্বপক্ষে। তবে, ‘বিচিত্রা’-র ওই পূর্বোক্ত বিতর্কে ভারী আশ্চর্য এক প্রস্তাব রেখেছিলেন এক লেখক। মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য ছিল, বাঙালির একমাত্র সম্বোধন-শব্দটি হোক --- ‘তাত’! তিনি লিখছেন, “‘তাত’ শব্দের অর্থ পিতা, পবিত্র ব্যক্তি ও স্নেহ পাত্র। সুতরাং সকলকে ‘তাত’ বলা চলতে পারে।”
একটিমাত্র সম্বোধন-শব্দ বাংলার ক্ষেত্রে ঘোর অবাস্তব বলেই মনে হয়। তবু যদি সত্যিই কখনও এমন হয়, এ ভাষায় সবাই সবাইকে আপনি বলছে! উকুনে বুড়ি বককে, বক নদীকে, নদী হাতিকে, হাতি গাছকে, গাছ ঘুঘুকে, ঘঘু রাখালকে...। কিন্তু সেদিনও, একজন ধর্ষকের রিফ্লেক্স কি পারবে একজন ধর্ষিতাকে আপনি বলতে? একজন ধর্ষিতাই বা অন্তর থেকে কী সম্বোধন করবেন একজন ধর্ষককে?


আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩