17 May 2015

সলমন প্রসঙ্গে অভিজিৎ : ভুল? বিলকুল?

সুস্নাত চৌধুরী


সলমন খানকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা শুনিয়েছিল আদালত। তামাম বলিউড সেদিন কোথাও অশ্রু কোথাও গ্লিসারিনে স্যাঁতসেঁতে। আর ঠিক তখনই কহানি মে টুইট! হুড় হুড় দাবাং দাবাং ভঙ্গিতে মাঠে নামলেন গায়ক অভিজিৎ। তাঁর ছোট ছোট বাক্যগুলি গোটা দেশেরই বড্ড কানে লাগছিল। বড় আলটপকা যেন। অতঃপর সোশ্যাল নেটওয়ার্কও স্বাভাবিক কারণেই অভিজিৎ-কে ঝেড়ে কাপড় পরাতে দেরি করেনি। সোনাক্ষী সিংহ, বাবুল সুপ্রিয় কিংবা ঋষি কপূরের মতো অনেকেই তাঁর মন্তব্যের উপযুক্ত বিরোধিতায় সরব হন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩, ১৫৩-এ, ৫০৪ এবং ৫০৬ নম্বর ধারায় নাকি এফআইআরও দায়ের হয় বিহারের কোনও একটি জেলা আদালতে।
কী টুইট করেছিলেন সে দিন অভিজিৎ? ‘কুত্তা রাস্তায় শোবে, কুত্তার মতোই মরবে। রাস্তা গরিবদের বাপের সম্পত্তি নয়। এক বছর আমার কোনও বাড়িঘর ছিল না, কখনও রাস্তায় শুইনি।’ এ বক্তব্যের রেশ ধরেই তার পর এমন আরও কয়েকটি টুইট করেন। যে ভঙ্গিতে শিল্পী অভিজিৎ এই মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলেন, তা বেসুরোই ছিল। হয়তো এর নেপথ্যে গভীর কোনও স্বার্থ, হীন ধান্দাবাজির বীজও আছে; চট করে বলা মুশকিল। কিন্তু ব্যক্তি অভিজিৎ ভট্টাচার্যকে যদি সাময়িক সরিয়ে রাখি, তা হলে তাঁর এই মন্তব্যের কনটেন্টকে কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? বরং সলমনের সাজা প্রসঙ্গে টুইট থেকে বাইট আ-বলিউড যে যেখানে যা কপচেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সমর্থনযোগ্য মনে হয় অভিজিতের এই মন্তব্যকেই।



আদালত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, সেই রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সলমনই স্টিয়ারিং-এ ছিলেন। সুতরাং সলমন সম্ভবত তাঁর প্রাপ্য সাজাই পাচ্ছেন, পাওয়া উচিতও। কিন্তু কথা হচ্ছে, দুর্ঘটনাটি তো নেহাতই যান্ত্রিক কারণেও হতে পারত। ব্রেক ফেল হতে পারত, টায়ার বার্স্ট করে গাড়ি ফুটপাতে উঠে যেতে পারত। কিংবা নিছক ড্রাইভারের বোকামি কিংবা ভুলবশত, মানুষমাত্রেরই যেমন ভুল হয় আর কী, পুকুরপাড়ে পা পিছলে যায়, স্টেপ আউট করতে গিয়ে বলের ফ্লাইট মিস হয়, সেই রকমও কিছু ঘটতেই পারত! অর্থাৎ দুর্ঘটনা যদি একই ঘটত, অথচ সলমন মদ্যপ অবস্থায় না থাকতেন, সে ক্ষেত্রে? সলমনের সাজা হয়তো খানিক কম হত, কিন্তু নুরুল্লা মেহবুব শরিফের প্রাণ কি বাঁচত? আবদুল্লা রউফ শেখ কি জীবনে আর দু-পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারতেন? সেই ২০০২ সালে গোটা দেশে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৮৪,৬৭৪ জনের। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাটাও প্রতি বছরই বাড়ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সালে গড়ে প্রতি দিন ৩৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়। রোজ আহত হয়েছেন ১২৮৭ জন। এত এত দুর্ঘটনার, এত এত মৃত্যুর সবগুলি নিশ্চয়ই ড্রাইভারের দোষে নয়। কেবল মদ্যপান করে গাড়ি চালানোর কারণে তো নয়ই। এ কথা ঠিক, বেশির ভাগের জন্য ড্রাইভারই দায়ী, কিন্তু পথ দুর্ঘটনা মানেই ড্রাইভার ভিলেন, তা ঠিক নয়। সরকারি খতিয়ান বলছে, ২০১১ সালে ভারতে যে সংখ্যক পথ দুর্ঘটনা হয়, তার মধ্যে ২২.৫% ক্ষেত্রে ড্রাইভারের দোষ ছিল না। অর্থাৎ, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সেখানে কাজ করেছিল পথচারীর দোষ, যান্ত্রিক গোলযোগ, খারাপ রাস্তা, খারাপ আবহাওয়া ইত্যাদি অনেক কিছু। আর থাকে মদ্যপানের প্রসঙ্গ। কমিউনিটি এগেনস্ট ড্রাঙ্কেন ড্রাইভিং (ক্যাড)-এর মতো সংস্থার বক্তব্য যথার্থ। বহু দুর্ঘটনার নেপথ্যেই রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত নেশাগ্রস্ততা। সারা বিশ্বেই এটি এখন বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু পরিমিত মদ্যপান আর বেহেড মাতাল হয়ে যাওয়া তো এক জিনিস নয়। দুর্ঘটনা ঘটলেই মদের বোতলকে কাঠগড়ায় তোলার সুযোগ খোঁজা কি এক প্রকার বায়াস্‌ড অপচেষ্টা নয়? স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের সঙ্গে তুমুল মনোমালিন্য, অফিসে কোণঠাসা অবস্থান, সহকর্মীদের অবিরাম হ্যাটা— এক কথায়, জীবনযুদ্ধে বিচ্ছিরি ভাবে ক্রমশ হেরে যেতে থাকা— এ সবেও তো কত সময়ই মাথার ঠিক থাকে না। চালককে তো সে সবও কয়েক মুহূর্তের জন্য বেখেয়াল করে দিতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। ২০১৩ সালের নিরিখে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র আর একটি তথ্য বলছে, সন্ধে ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পথ দুর্ঘটনার খবর মিলেছে। ৭৪,৪১১টি। কাজেই নেশাতুর রাতের নিশিডাক শুনতে পাওয়ার ঢের আগেও যে সময় ঘনিয়ে আসে, সে সম্ভাবনাকেও কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
পথ দুর্ঘটনা ঘটলে, তা তো পথেই ঘটবে, ড্রয়িং রুমে বা খেলার মাঠে নয়। কাজেই পথে বা পথের পাশে যিনি রয়েছেন, সচেতন থাকাটা তাঁরও দায়িত্ব। আর সেখানে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে থাকাটা কি নিজের মৃত্যুকেই আমন্ত্রণ জানানো নয়? রাস্তা বা ফুটপাত যেমন কখনওই উচ্চবিত্তের 'বাপের সম্পত্তি' নয়, একই ভাবে সত্যিই তো নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত কোনও কাউকেই তাঁর পিতৃদেবও সেটি গত বারের জন্মদিনে গিফ্‌ট করেননি। রাস্তার ধারে ফুটপাত দখল করে এক জন শোবেন কেন? কলকাতার বহু ফুটপাত ধরে হাঁটার চেষ্টা করুন, করদাতা হয়েও কোনও মতে দু’পা এগিয়েই মনে হবে, এই ফুটপাতে হাঁটার কোনও অধিকার আপনার নেই। মনে রাখা উচিত, ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে না-পারাটাও কিন্তু দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ, ফুটপাতে ঘর-বাঁধা, পথকে আরও দুর্ঘটনাপ্রবণ করে তুলছে। এক, পথে-হাঁটা মানুষজনের ঝুঁকি ‌বাড়ছে। দুই, পথের পাশে বসবাসকারীদের জীবন তো সর্বদা বিপন্ন থাকছেই। এই দখলদারিও কি আগাগোড়া অনুচিত বেআইনি কাজ নয়? ফুটপাত জুড়ে, এমনকী ফুটপাত ছাপিয়ে রাস্তা ছুঁই-ছুঁই অজস্র ঝুপড়ির অবস্থানকে যদি সমর্থন করতে হয়, তা হলে তো ফুটপাতের বেআইনি হকারদেরও মেনে নেওয়া উচিত। এই হকাররাও তো পেটের টানে, বাধ্যতই সেখানে বসছেন। হাতিবাগান কি গড়িয়াহাটের বেদখল হওয়া ফুটপাত নিয়ে তবে আর হা-হুতাশ কেন!
শখ করে কেউ ফুটপাতে ঘর বাঁধেন না, ঠিক। বাধ্য হয়েই এক-ফালি জায়গা দখল করে ছিঁড়ে-আনা ফ্লেক্স টাঙিয়ে ঘর সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। দুর্ঘটনায় পা-হারানো আবদুল্লা রউফ শেখ তো কাজ করতেন আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারিতে। তাদের কর্মচারীকেই বা বেকারির সামনের ফুটপাতে নিশিযাপন করতে হত কেন? সে দায় তো তারাও এড়াতে পারে না। রাতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থেকে যাঁর প্রাণ গেল, তাঁর সুরক্ষার দায়িত্ব কি রাষ্ট্রেরও ছিল না? মাথার উপর ছাদও কিন্তু এক অর্থে আমাদের মৌলিক অধিকার। যে দেশ তার নাগরিকের মাথায় ছাদ দিতে পারে না, তার আইনই যদি সেই নাগরিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিচার চালায়, একটু তলিয়ে ভাবলে তাকে কত দূর নিরপেক্ষ বলা যায়? সলমন যেমন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তেমনই মুম্বই কর্পোরেশনেরও কি এই দুর্ঘটনার জন্য সমান দায় নেই? দায় নেই ৬৮ বছরের স্বাধীন ভারতের?
‘নবান্ন’ নাটকে বুভুক্ষু মানুষ আর কুকুরকে একই ডাস্টবিনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। দেখিয়েছিলেন ক্ষুধার যন্ত্রণা। এ দেশে আজও কুকুর-মানুষে ফারাকটা বাড়েনি। অথচ এ সত্যিটা আমরা মেনে নিতে পারি না। ‘পথের পাঁচালী’ হোক বা ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’— দারিদ্র নিয়ে ব্যবসার অভিযোগ তুলি। অথচ ‘কুত্তে কি মওত’-ও কুকুরের সব সময় হয় না। ‘কুত্তা’-র মতো মরণ যে আসলে আমাদেরই ভবিতব্য, আমরা যারা ঘুমিয়ে রয়েছি মহান ভারতের ফুটপাতে কিংবা বেডরুমে, তা আর এক বার বুঝিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক এই মন্তব্য।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ মে ২০১৫

05 April 2015

প্রক্সি কয়েদি

সুস্নাত চৌধুরী


মুরলীপ্রসাদ শর্মার হয়ে মেডিকালের এন্ট্রান্সে যিনি বসেছিলেন, তাঁর নাম আসলে ডক্টর রুস্তম পাভরি। হলে ঢোকার আগে সেই জালি ক্যান্ডিডেটকে মাত্র কয়েক মিনিটের মেক-ওভারে কলার-তোলা রংচঙে শার্টের বোতাম খোলা রেখে আর চুল ব্যাকব্রাশ করে স্রেফ একটু মুন্নাভাই-প্রতিম লুক দিতে হয়েছিল। পরীক্ষায় মুন্নাভাই প্রক্সি পেলেও, টাডা-র কেসে অবশ্য সে পথে হাঁটেননি সঞ্জয় দত্ত। কিন্তু তাঁর সাজন-তুতো ভাই-এর গাড়ি টায়ার ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারানোর মামলা পাক্কা এক যুগ পর আবার যে দিকে মোড় নিয়েছে, তাতে পাবলিক তুমুল বিস্ময়ে। অনেক নিন্দুক অনেক কিছু বলছে। আর সেই সূত্রে উঠে আসছে এমন গল্পগুজবের কথা, যেখানে এক জন লোক অপরাধ করার পর, সে অন্যকে গিয়ে বলছে, ভাই, তুই মিথ্যে বলে সব দোষ তোর কাঁধে নিয়ে নে, বদলে তোর ফ্যামিলিকে আমি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেব, তোর মেয়ের বিয়ের হিল্লে করে দেব।
১৯৯৯ সালে, বিজনেস স্কুলের পড়ুয়া বিত্তশালী পরিবারের ছেলে সঞ্জীব নন্দার বিএমডব্লিউ কেড়ে নেয় ছ’জনের জীবন। সে ঘটনার আদলেই বছর দুয়েক আগে নির্মিত হয়েছে ‘জলি এলএলবি’। সে ছবিতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো ও হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত রাহুল দেওয়ানের হয়ে কেস সাজাতে গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ যথারীতি বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘যত নষ্টের গোড়া’ ড্রাইভারকে। আদালতে সওয়াল করতে গিয়ে জাঁদরেল আইনজীবী সেই যুক্তিতেই যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন। শেষমেশ এই মিথ্যাচার ব্যর্থ হচ্ছে দূর গ্রামে পড়ে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। সেই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তিনিই একমাত্র জীবিত, অথচ পুলিশ রেকর্ড-মতে আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে!



দুর্ঘটনার পর মালিকের হয়ে প্রক্সি দিতে রাজি হয়েছেন এমন ‘সৎ’ ড্রাইভার চলচ্চিত্র আরও দেখেছে। তুরস্কের ছবি ‘থ্রি মাংকিজ’। থমথমে ছবিটি শুরুই হয় একটি গাড়ি দুর্ঘটনা দিয়ে। বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা সার্ভেট ফিরছিলেন নির্বাচনী প্রচার সেরে। ক্লান্ত শরীরে, বুজে আসা চোখে ড্রাইভ করছিলেন নিজেই। সহসা দুর্ঘটনা। এক পথচারীর মৃত্যু। ভয় পেয়ে পালালেন সার্ভেট। ভোটের মুখে এ খবর জানাজানি হলে তাঁর ভরাডুবি নিশ্চিত, অগত্যা মাঝ রাতে ঘুম-ভাঙানিয়া রিং-টোন বেজে উঠল ড্রাইভার এয়ুপ-এর ফোনে। মনিবের কথা মতো ছুটে গেলেন এয়ুপ। সার্ভেট বোঝালেন, মোটে তো মাস ছয়েক, বড়জোর এক বছরের মামলা; তার পর জেল থেকে বেরোলেই মোটা বকশিশ। এই ‘ডিল’ মেনে জেলে ঢুকলেন এয়ুপ। ন’মাসের কারাবাস। তারই মধ্যে সার্ভেটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন এয়ুপের স্ত্রী। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময়ও ঘরের পরিস্থিতিটা স্পষ্ট ছিল না এয়ুপের কাছে। হঠাৎই তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর ডাক পড়ল থানায়। পুলিশ জানাল, সার্ভেটকে হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর ছবির শেষাংশটি এক আশ্চর্য বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। ছেলে ইসমাইল মা’কে জানায়, খুনটি সে-ই করেছে। এয়ুপ তখন এক হতদরিদ্র ব্যক্তিকে বেছে নেন, তাঁকে সেই কথা বলেন, এক রাতে তাঁকে যা বলেছিলেন তাঁর মনিব। নিজের ছেলের অপরাধ অন্যের কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রস্তাব রাখেন হতভাগ্য এয়ুপ।
শুধুই টাকার লোভ নয়, কখনও আরও বড় কিছুও হয়তো থাকে অন্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অপরাধী সাজার এই খেলায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘আমি সে ও সখা’ সিনেমাটি হয়েছিল সত্তরের দশকে। সে ছবিতে দেখি, অর্থের মোহে ভুল করে ফেলা বন্ধু প্রশান্তকে (অনিল চট্টোপাধ্যায়) বাঁচাতে পুলিশের হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন নির্দোষ সুধীর (উত্তমকুমার)। সাত বছর সশ্রম কারদণ্ডের আদেশ হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন। এর মূলে কি সুধীরের বড় হয়ে ওঠায় প্রশান্তর পরিবারের যে ভূমিকা, সেই ঋণশোধ; না কি প্রকৃত বন্ধুত্বের চিরন্তন কোনও সংজ্ঞা! কোন পরিতৃপ্তির বশে পারে এক জন মানুষ, অন্যের কালির দাগ নিজের শার্টে লাগাতে? এ ছবিই যখন হিন্দিতে বানান হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, সেই ‘বেমিসাল’-এও এ সব প্রশ্নই জেগে ওঠে। অমিতাভ বচ্চনের লিপে যেখানে কিশোরকুমার গেয়ে ওঠেন— ‘মুঝে দোস্তোঁ সে শিকায়ত হ্যায় শায়দ, মুঝে দুশমনো সে মহব্বত হ্যায় শায়দ’। এমনকী খলনায়কের মতো কাজকর্মে, চোখমুখের তেমনই রিঅ্যাকশনে দর্শককে বোকা বানাতে চান, আর বন্ধুকে বাঁচাতে মিথ্যে কাগজপত্র বানিয়ে নিয়ে থানায় এসে সব দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নেন অমিতাভ। পুলিশ তাঁকে ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’ বললে, জবাব দেন ‘থ্যাংক ইউ’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সোনাই আর পরি-র ট্র্যাজিক প্রেমের ছবি ‘মনপুরা’-র কাহিনিও শুরু হয় এমনই এক অপরাধ ও তার দায়ভার গ্রহণে নিরপরাধ কাউকে রাজি করানোর মধ্যে দিয়ে। গাজি সাহেবের মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে গভীর রাতে একটি খুন করে বসে। ছেলেকে বাঁচাতে অপরাধী সাজিয়ে বাড়ির কাজের লোক সোনাই-কে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সুদূর দ্বীপেও তার সন্ধান পেয়ে যায় পুলিশ। সোনাইয়ের জেল হয়। মনিবের পরিবারকে রক্ষা করতে কয়েক মাসের এই অভিনয় সে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বদলে তার গোটা জীবনটাই ক্রমশ ছারখার হয়ে যায়। ‘অল্প বয়সে পিরিতি করিয়া, হয়ে গেল জীবনেরও শেষ।’ তার মনের মানুষ পরি-র সঙ্গেও ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন গাজি সাহেব। জামিনে ছাড়া পেয়ে সোনাই যে দিন ফেরে একটি বার পরিকে দেখার জন্য, জানতে পারে সে আত্মহত্যা করেছে। একই বিয়োগান্ত কাহিনি নিয়ে এই বাংলাতেও ছবি বানিয়েছেন অঞ্জন দাস। ‘অচিন পাখি’।
শুধুই জল-মাটি-বাতাসের নরম আবহে নয়, বিরল হলেও এমন সহজ মানবিক অবস্থানের দেখা মেলে অর্থ, ক্ষমতা আর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এ প্যাঁচানো ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট ড্রয়িংরুমেও। মধুর
ভান্ডারকর-এর ‘কর্পোরেট’-এ নিশিগন্ধা দাশগুপ্ত (বিপাশা বসু) বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেহগল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-কে। কোম্পানিকে ধসের হাত থেকে রক্ষা করতে গেলে সেহগল পরিবারের বাইরের কাউকে বিরাট কেলেঙ্কারির দায় নিতে হত। রাজি হয়ে যান সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিশি। টাকার লোভ নয়, সংস্থার স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর। এর পর এনকোয়ারি কমিশন তাঁকে হেফাজতে নেয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও, অন্য রকম বোঝাপড়া হয়ে যায় উপরমহলে। বলির পাঁঠা হন নিশি।
তবে, সবচেয়ে বিস্ময় জাগে যখন ব্যক্তিগত স্বাের্থর কথা না ভেবে দাগি ক্রিমিনালরাই এই মানবিকতার শরিক হন। জরাসন্ধর ‘লৌহকপাট’-এ এমনই এক চরিত্র বদরউদ্দীন মুন্সী। সে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত। সে দিন ছিল এক বিত্তশালী সীতানাথ দত্তের মেয়ের বিয়ে। রাতে আক্রমণ করল তার ডাকাত দল। টাকাপয়সা সোনাদানা নিয়ে ফেরার পথে বদরউদ্দীনের চোখে পড়ে গেল তেতলার বন্ধ ঘরে লুকিয়ে রাখা ফুটফুটে কনেটি। গায়ে অন্তত হাজার দশেক টাকার জড়োয়ার গয়না। বদরউদ্দীনের শরীর থেকে তখন লোভ নামক বস্তুটি ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। বদলে ভেসে উঠছে তার আদরের নূরজাহানের মুখ— আট বছর আগে যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল সে, তার পর আর যে-মেয়ে ফিরে আসেনি। সেই কনের দামি গয়নায় হাত ছোঁয়াতে না পেরে ছুটে বেরিয়ে আসে বদরউদ্দীন। খানিক পরে আবার ফিরে গিয়ে দেখে তারই দলের এক জন মেয়েটিকে ধর্যণ করেছে। তার সদ্যবিবাহিত স্বামীকে খুন করেছে। বদরউদ্দীনের সব কিছু গুলিয়ে যায়। সে দিনই দুর্বল কিছু বরযাত্রী তাকে ধরে ফেলে। তার পর অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতাল। সেখানেই হাকিম ডেকে স্ব-ইচ্ছায় সে জবানবন্দি দেয়। জানায়, সে-ই এই খুন ও ধর্ষণ করেছে। এর পর জরাসন্ধ বলছেন, ‘একটা কথা শুধু বুঝতে পারছিনে। অপরাধী তার কৃত-অপরাধ স্বীকার করেছে, এটা নতুন নয়, অদ্ভুত কিছুও নয়। কিন্তু যে-অপরাধ সে করেনি, তারই বোঝা স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে হাকিম ডেকে হলপ করে বলেছে, এটা আমি করেছি— এরকম তো কখনো শুনিনি। এর মধ্যে বাহাদুরি থাকতে পারে, কিন্তু একে সৎসাহস বলে না।’
আজকের দুনিয়াতেও এমন প্রক্সি হরবখত ঘটে চলেছে। তা সে কলেজের গার্জেন কলে ভাড়াটে বাপ-মা নিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালের ভর্ৎসনা খাওয়ানোই হোক, বা কলকাতার পাতাখোরদের ভাষায় ‘পাঁচাইন’ কেসে অন্যের হয়ে দু-তিন দিনের জন্য জেল খাটাই হোক। ডেলি তিন-চারশো টাকায় রোজগার তাতে মন্দ না! বিহারেও নাকি কেউকেটাদের হয়ে জেলে ‘দাখিল’ হতে নির্দিষ্ট লোক পাওয়া যায়। জেল খাটাই নাকি তাদের পেশা। শোনা যায়, বাংলাদেশেও নাকি চার-পাঁচ বছর, এমনকী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কেসেও নকল আসামির সন্ধান মিলেছে। এককালীন দু’লক্ষ ও মাসিক পাঁচ হাজার টাকা চুক্তিতে বছর কয়েক আগেই একটি ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবনের প্রক্সি দেওয়া শুরু করেন ঢাকার এক রিকশাওয়ালা। পরে ধরাও পড়ে যান। আবার দিনাজপুরের যে সব এলাকায় বেআইনি মাদকচক্রের রমরমা, সেখানেও নাকি এমন লোক আছে, কেউ মাদক সংক্রান্ত মামলায় ফাঁসলে, তাঁর হয়ে ‘প্রফেশনালি’ জেল খেটে দেন। বাস্তবের এই দুনিয়াকে বিলক্ষণ চিনত, কাজেই ‘হযবরল’-র ন্যাড়া কোনও দিনই বোকা ছিল না। আসামি নেই দেখে তাকে যখন ভুলিয়ে-ভালিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল, সে যথার্থই ভেবেছিল, ‘আসামীরাও বুঝি পয়সা পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না’!


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ এপ্রিল ২০১৫