22 October 2012

ঠাকুরের পিছন দিক

সুস্নাত চৌধুরী


ছবি: সুমন চৌধুরী

আমাদের যত ভাবনা, শুধু দুর্গার সামনেটা নিয়েই। এক বারও ভেবে দেখি না, তাঁর পিছনের দিকটা কেমন হল। ওমা, কী অলুক্ষুনে কতা গো! মায়ের আবার ‘পেছন’ কী! আগুপিছু ভেবেই বলছি শুধু দুর্গা নন, লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ, কারও পশ্চাদ্দেশ নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা নেই। কী থাকে তাঁদের পিছনে? বাঁশ। কাঠের ঠেকনা। ইতস্তত বেরিয়ে আসা খড়। আর, খড়খড়ে লেপা মাটি। লজ্জা ঢাকতে কিছু না হোক, সস্তা এক টুকরো কাপড়ও তাঁদের ‘ও দিকে’ জোটে না।
চালার ঠাকুর হলে বাই ডিফল্ট বাঁচোয়া। তা না হলে, পিছনের নগ্নতা ঢাকার বাড়তি প্রয়াস আমাদের লিফলেটে নেই। রিয়েল লাইফ মূর্তি ক্রমশ লার্জার দ্যান লাইফ হবে, দিঘে ফুট থেকে ফুটান্তরে যাবে, আড়ে অতিক্রম করবে ওয়াইড লেন্সের সীমা। কিন্তু আমরা ততটাই সাজাব যতনে, যতটা দেখতে পাবে কুসুমে, রতনে। দর্শনার্থীদের ‘ঠাকুর দেখা’র স্বতঃস্ফূর্ততাকে দীর্ঘ দিন ধরেই একটা ‘প্র্যাক্টিস’-এ পরিণত করে ফেলতে চেয়েছি। লাইন দিয়ে ঢুকে সে ততটাই দেখছে, যতটা তাকে দেখানো হচ্ছে। তার দৃষ্টি-ধরনকে ‘প্রেডিক্ট’ করে নিয়ে, ‘গ্রান্টেড’ ধরে নিয়ে, আমরা স্বপ্নের রাজ্য গড়েছি। প্যান্ডেল বানিয়েছি। কিন্তু, পাবলিক কান্নিক মেরে চোখের আলোয় দেখেছে চোখের বাহিরে।
যে নৈপুণ্যে নির্মিত হয় প্রতিমার প্রচ্ছদ, সে ভাবেই তো নির্মাণ করা যায় তার ব্যাক কভারও। চন্দ্রের তেজে যদি দুর্গার স্তন হতে পারে, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, তা হলে পৃথিবীর তেজে নিতম্ব হতে ক্ষতি কী? দুর্গার ধ্যানেই তো বলছে, তিনি ‘সুচারুদশনাং তদ্বৎ পীনোন্নতপয়োধরাম্’। তাঁকে তো সম্পূর্ণ করেই গড়ে তোলা যায়। সব দিক থেকে। ত্রুটিহীন, নিখুঁত, সর্বাঙ্গসুন্দর।
দুর্গার হেয়ার স্টাইল ‘জটাজুটসমাযুক্তা’। আমাদের নির্মাণে সেই কেশবিন্যাসও আংশিক। সামনে দু’একটা লক্স। পাশে কার্লের ঢল নেমেছে। কিন্তু পিছনে একেবারে টাক। মাঝে আবার মুকুটের আড়ালে ছাঁচের ফুটো। কিন্তু আমরা যখন পার্লারে গিয়ে বসি, সামনে-পিছনে আয়না থাকা মাস্ট। আলোর সরলরেখা যাতে মুহূর্তে বানিয়ে ফেলতে পারে রেশমি চুলের পশ্চাৎভাগের অসংখ্য প্রতিবিম্ব।
ভাবের পুজো তো আমরা কবেই ছেড়েছি। আমাদের মূর্তিপুজোটুকুও ঠিকঠাক সৎ হবে না কেন? উমাকে বাপের বাড়ি এনে যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জগৎ আমরা তৈরি করি, বচ্ছরকার পাঁচ দিন তার ভেতর ডুবে থাকি, নিজস্ব সেই অনুভূতিকে আর একটু নিষ্ঠায় রুচিসম্মত করে তোলার প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা নেই। আমরা অকল্পনীয় সব থিম কল্পনা করব। সাবেক রীতিকে বয়ে নিয়ে যাব মুখস্থের মতো। চড়া লাইটিং-এ মুড়ে দেব পাড়ার পর পাড়া। টুনি কিংবা এলইডি-তে আনসিন গল্প বলব। ভুল বানানে ‘দূর্গাপূজো’ লিখব। জঘন্য অন্ত্যমিলে ছড়াব মিনিমাম বিশ-তিরিশটা হোর্ডিং। আর, যাবতীয় অন্ধকার উগরে দেব প্যান্ডেলের একদম ভেতরের দিকে। বাজেটের সব কাটছাঁট গুঁজে রাখব প্রতিমার ‘ওই পারে’। প্রথমে ব্লাউজের কাপড়, শাড়ির থান ফুরোবে। তার পর দু’এক এম এম বেরিয়ে থাকবে ফেড হতে থাকা গায়ের ‘অতসীপুষ্পবর্ণ’। এ বার হালকা সাদা রং দেখা যাবে। একদম শেষে, গ্রেনিচের ঠিক উল্টো দিকে ইন্টারন্যাশনাল ডেটলাইনের কাছে স্রেফ নগ্ন মাটি। ওখানটা তো কেউ দেখতেই পাবে না। যা এক্সপোজ্ড নয়, তা যেন উপেক্ষণীয়।
রাজা সুরথ আর সমাধি যখন নদীর ধারে দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন, তার আগে দেবীসূক্ত পাঠ করে, সে-সবের সারকথা ভাবতে ভাবতে তপস্যা করতে হয়েছিল। কারণ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল জগন্মাতার সম্যক দর্শনলাভ ‘সন্দর্শনার্থমম্বায়াঃ’। ‘সম্যক’ বিশেষণটি ভিড়ের একাকিত্বে আর আলোকসজ্জার অন্ধকারে আমরা বহু দিন হারিয়েছি। আজ আমরাও মা দুর্গার দর্শন চাই, সঙ্গে ইনক্রিমেন্ট চাই, গোয়িং অ্যাব্রড চাই, ধবধবে বউ চাই, ইন্টেলিজেন্ট বাচ্চা চাই, ম্যাথ্স-এ ফুল মার্কস চাই। কিন্তু কিছুই ‘সম্যক’ ভাবে চাই না। পুরোপুরি চাইলে, চিন্ময়ীর জন্য না হোক, অন্তত মৃন্ময়ীর জন্য আমাদের তপস্যা ত্রুটিহীন ও পরিপূর্ণ হত। আসলে, ষোলো আনার বায়না নিয়ে ঠাকুরকে আমরা মোটে আট আনা বানিয়েছি।

আমাদের বেলা ঠাকুর কিন্তু ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা দিয়েছেন। বাজেট বেড়ে যাওয়ার ভয় খেয়ে স্রেফ সামনেটা বানিয়ে ছেড়ে দেননি। খামখা আর একটু সময় যাবে বলে, পিছনে কঙ্কাল বের করে রাখেননি। পিছনেও মাংস লাগিয়েছেন, চামড়া চড়িয়েছেন। হয়তো সামনে চোখ মুখ নাক কান দিয়েছেন, যৌনাঙ্গ দিয়েছেন, কিন্তু পিছনে দিয়েছেন বাড়তি শক্তি। সহনশীলতা। ফ্রি-কিকের দেওয়ালে দাঁড়ালে বোঝা যায়, গোলার বেগে শট এলে কী ভাবে মুহূর্তে ঘুরে যেতে হয়। সিলি পয়েন্টে বসলে দেখা যায়, ঠাটানো স্কোয়ার কাট কী ভাবে আপনাআপনি ঘুরিয়ে দেয় রিফ্লেক্স অ্যাকশন। পিঠে খেলে, পেটে সয়। লক্ষ কোটি বছরের অভিযোজনে আমাদের সামনেকে সামনে পিছনকে পিছন করে তুলেছে প্রকৃতি। সেই পশ্চাদ্ভাগে আরও ভ্যালু অ্যাড করে নিয়েছি আমরা। যোগ করেছি গ্রীবার মাহাত্ম্য। খোঁপার মাহাত্ম্য। নিতম্বের মাহাত্ম্য। স্টাইল স্টেটমেন্টে ঝড় তুলেছে হিপ ক্লিভেজ। খোলা পিঠ আরও সুন্দর করেছে কারুকাজ। টিশার্টের পিছনে ক্যাপশন লিখে ঘুরেছে। কিন্তু যে দেবীকে নিয়ে তার এত উদ্যাপন, এত উৎসব, যাকে সে সবার উপরে বসিয়েছে, তার বাকি আট আনার ব্যাকগ্রাউন্ড করে রেখেছে কদর্য। সেখানে ঠাঁই হয়নি এতটুকু নান্দনিকতারও।
প্রাচীন গ্রিসের প্রবাদপ্রতিম ভাস্কর ফিডিয়াস। একের পর এক দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করে তিনি প্রায় গ্রিসের বিশ্বকর্মা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে নাকি প্রশ্ন করা হয়েছিল, এ সব দেবদেবীকে তো তিনি চাক্ষুষ করেননি, তা হলে কোন কল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলেন তাঁদের? ফিডিয়াস জানিয়েছিলেন, তিনি স্টুডিয়োতে জনা কুড়ি গ্রিক অ্যাথলিটকে নগ্ন করে বৃত্তাকারে ঘোরান। বৃত্তের কেন্দ্রে থাকেন তিনি। কর্মরত। তাঁদের দেহসৌষ্ঠব, অপূর্ব অ্যানাটমি তাঁকে ঈশ্বরের আন্দাজ দেয়। কেন বৃত্তাকারে ঘোরাতেন ফিডিয়াস? কেন এক জন ভাস্করের দরকার হয় রিভল্ভিং প্ল্যাটফর্ম? কারণ সে তিনশো ষাট ডিগ্রিই নির্মাণ করতে চায়। সামনে আর পিছনে সে তুলে ধরে সমান ডিটেল। মার্জার সরণি বেয়ে হেঁটে আসা রূপসীরাও তো প্রথমে ক্লকওয়াইজ অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ মোচড় দেন। তার পর, থামেন। আবার পিছু ফিরে দুলকি চালে হেঁটে যান। কেন না যিনি সুন্দর, তিনি তিনশো ষাট ডিগ্রিই সুন্দর। আমাদের পুজোর রীতিতেও কিন্তু এই ‘প্রদক্ষিণ’ অনিবার্য অঙ্গ। সেখানেও বামাবর্ত আর দক্ষিণাবর্তের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ কিনা দেবস্থানকে, স্বয়ং দেবতাকে ঘুরে ঘুরে উপাসনা করবে ভক্ত। আমাদের দুর্গাপ্রতিমায় সেই রাউন্ড-আপ থাকে না। সে শুধু সামনে থেকেই দেখার চিজ। ব্যাক টু ক্যাম ঈশ্বর, আমাদের দিগ্দর্শনে নেই। ব্যাপারটা আরও দৃষ্টিকটু হয় বিসর্জনের দিন। প্রদক্ষিণের রেফারেন্সটা উল্টে যায়। ‘আমাদের প্রতিমা ধীরে ধীরে নিরঞ্জনের পথে’ এগিয়ে চলে, আমরা পথের দু’পাশে স্থির থাকি। তখন সেই আপেক্ষিক গতিবেগ জাঁকজমকে আড়াল করে রাখা বাঁশ, কাঠামো, খড়, মাটিকে ল্যাংটো করে দেয়। হ্যালোজেনের ফোকাস মেরে সেই অন্ধকার কখনও গোপন করা যায় না।

মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবণতাতেই থ্রি-ডি দেখতে চায়। চোখে চশমা লাগিয়ে টু-ডি পর্দাতেও সে তিন মাত্রাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। এই বঙ্গেই ঘূর্ণির মিনিয়েচার পুতুলেও সেই ত্রিমাত্রিক পরিপূর্ণতার ছোঁয়া মেলে। কিন্তু দুর্গাকে আমরা ঠায় বসিয়ে রেখেছি মাপ করে কাটা একটা টু-ডি খোপের মধ্যে। যেন খাড়া করে রাখা দ্বিমাত্রিক শবদেহ।
দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখিনি, দেখেছি খোলা রাস্তায়। প্রতি বছর দেখি, পুজোর কিছুটা আগে। বাইরে শুকোতে দেওয়া আদুড় গায়ে দুর্গা। এমনই আমাদের সচেতনতা। এমনই আমাদের নান্দনিকতা। বসন পরো মা। এ ক’দিন অর্ধেক বেনারসিতেই চালিয়ে নাও। বাকি অর্ধেকে পট না-পাও, চটই টাঙিয়ে নিও।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ অক্টোবর ২০১২

15 September 2012

পক্ষীরাজ ঘোড়া তার পক্ষীরানি ঘুড়ি

সুস্নাত চৌধুরী


এ গল্পটা বরং সেই ছেলেটাকে নিয়ে, যে বয়স বারো কি তেরোর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ময়দানে। আর বিস্ময়ে তাকিয়েছিল আকাশের ক্যানভাসে। যেখানে তখন অসংখ্য রঙের ফোঁটা কেউ স্থির, কেউ সরে যাচ্ছে। না, তার হাতে সে দিন লাটাই ছিল না। ছিল সরু আর লম্বা একটা ডাল। ছোট্ট ছেলেটা তার হাতের অস্ত্র দিয়েই সে দিন নামিয়ে নিয়েছিল কে-জানে-কার কেটে যাওয়া একটা ঘুড়ি। লেগে থাকা সুতোটাকেই সম্বল করেই শুরু হয়েছিল তার আকাশে ওড়া। সারা আকাশকে চ্যালেঞ্জ জানানো। সেই তার বড় হয়ে ওঠার শুরু।
খুব তাড়াতাড়ি সে শিখে নিয়েছিল ঠিকঠাক কল খাটানোর কৌশল। জেনে গিয়েছিল কোনটা পেটকাটি, কাকে বলে মুখপোড়া, রসগোল্লা বা মোমবাতি আসলে কী রকম, ভড়-ই বা ঠিক কী! শুনে ফেলেছিল কত রকম সুতোর কথা। স্পেকট্রা, ডেক্রন, ডিকট। তবু, এত সবের মধ্যেও ওকে টানত যা-হোক কিছু নিয়ে বাতাসে ভেসে থাকার মজা। আর একটু... আর একটু উপরে যদি শুধু ওঠা যায়। ঘুড়ি নিয়ে লড়াই তখন ওর ভালই লাগত না। পাড়া-কাঁপানো ‘ভোকাট্টা’ চিৎকারে বাচ্চা ছেলেটা হকচকিয়েই যেত। অশালীন লাগত। খানিক আগেও যে ‘ভোম্মারা’ বলে লাফিয়ে উঠেছে, সেই দুষ্টু লোকটার ঘুড়ি কেটে গেলেও ওর মন খারাপ হয়ে যেত। আসলে, সুতো ছিঁড়ে ভেসে যাওয়া ঘুড়ি দেখলে ওর মরে-যাওয়া বাবার কথা মনে পড়ত। ও চিনতই না হারবার্ট সরকারকে, যে শিশুকালে মৃতা মার অনতিদূরে শুয়ে ঢিলি প্যাঁচ দেখেছিল। ‘মেঘলা আকাশে অনেক ওপর দিয়ে কেটে যাওয়া একটা কালো বুলুম দেখে হারবার্টের প্রায় ভয় করেছিল। এত গম্ভীর শেষযাত্রা হারবার্ট আগে বা পরে কখনও দেখেনি।’ তবে, ও খুব চেষ্টা করত অজানা পথে পাড়ি দেওয়া সেই সব ঘুড়িগুলোকে হারিয়ে যাওয়ার আগে নিজের কাছে টেনে নিতে; তার পর আবার সুতো বেঁধে আকাশে তোল্লাই দিতে। এতেই ওর মন উৎসব-উৎসব হয়ে যেত!
আসল উৎসব সতেরোই সেপ্টেম্বর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরেই নিয়েছিল, পাঁজিতে নির্ঘাত লেখা আছে, বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানোই বিহিত। ঠিক তখনই নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছিল শিল্পের শ্রেষ্ঠকর্তা বিশ্বকর্মার হাতে ঘুড়ি তুলে দেওয়ার থিয়োরি। বাবলুকাকুর গ্যারাজের হেল্পারদের কালিমাখা হাতে রেঞ্চ-প্লায়ার্স নয়, সতেরো তারিখ ববিন লাটাই তুলে নেওয়ার ব্যাখ্যা। আর একটু বড় হয়ে অবশ্য আরও অনেক কিছু ভেবে নিয়েছিল। সতেরোই সেপ্টেম্বর মানে সংক্রান্তি। যেমন মকর সংক্রান্তির দিন ঘুড়ির উৎসবে মাতেন গুজরাত বা বাংলাদেশের মানুষ। এ প্রশ্নও জেগেছিল মনে, এর মধ্যে কি কোথাও শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার ভাবনা কাজ করছে? ইন্দোনেশিয়ায় বিবিন ঘুড়ি, জানগান ঘুড়ি উড়িয়েই তো প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কৃষকরা। জাপানের হনসু-তে খরা কাটানোর জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ আছে। চিনের ড্রাগন ঘুড়িও প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজনে কামনায় ওড়ানো। মকর সংক্রান্তির ‘আউনি-বাউনি’ও তো ধান তোলারই অনুষ্ঠান। তা হলে ভাদ্র সংক্রান্তির মর্মই বা অন্য রকম হবে কেন? যে উৎসব জানান দিচ্ছে আশ্বিনের আগমনের, যে আশ্বিনে আসবেন মা দুর্গা স্বয়ং। অতএব? না, এ সব তত্ত্ব উড়িয়ে ও ফাইন্যালি ধরে ফেলেছিল খুব গরম নয়, খুব ঠান্ডা নয়, আকাশে মেঘ নেই, কড়া রোদও নেই স্রেফ সে কারণেই সতেরোই সেপ্টেম্বর ঘুড়ি ওড়ানোর উপযুক্ত তিথি!
বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে ঘুড়িকেই ওর প্রেমিকা মনে হয়েছিল। রূপসী, তন্বী, নিখুঁত ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স। কখনও তিরতির কাঁপছে, কখনও স্থির। তত দিনে ও শুনে ফেলেছে রফি আর লতার কণ্ঠে ‘চলি চলি রে পতং মেরি চলি রে... সারি দুনিয়া ইয়ে দেখ দেখ জলি রে... ’ স্বপ্ন দেখত, ও চেপেছে পক্ষীরাজ ঘোড়ায়, আর সঙ্গে পক্ষীরানি ঘুড়ি। ওর মনে তখন বাজত হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে...
ঘুড়ি নিয়ে যারা কালচার করে, তারা জানে মাথা তুলে বাঁচতে। উপরের দিকে তাকাতে। সাহস করে ও-ও এক দিন উঠে গিয়েছিল একতলা বাড়ির ছোট্ট ছাদে। বাড়তে গিয়ে বুঝেছিল, চার পাশে বড্ড দেওয়াল। ওর আকাশ আসলে অন্যের জানলা মাত্র। তিনতলা-চারতলা-সাততলা বাড়িরা যেন ওর প্রেমিকাকে গডজিলার মতো গিলে ফেলবে। সে দিনই ও সিদ্ধান্ত নেয়, আরও উপরে উঠতে গেলে আরও উপরে তাকাতে হবে। অগত্যা ওকে শিখতেই হল মাঞ্জা। মায়দানি, বেরিলি, ডাবল স্পেশাল, সারস। তত দিনে ও বুঝে গিয়েছিল, কাটাকুটি না করলে বেঁচে থাকা যাবে না। ওর ঘুড়িকে কেউ উপরে উঠতেই দেবে না। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। শুধু নন্দিনীর বাড়িতেই নয়, দুনিয়ার সর্বত্রই ‘ঢিল দে ঢিল দে দে রে ভাইয়া’ বলে উঠতে না পারলে সমীরদের ব্যর্থ হতেই হবে। হাম ঢিল দে চুকে সনম!
আজ নতুন ফ্ল্যাটের ছাদে উঠেই বুঝতে পারছে, এখানে পৌঁছতেই পারবে না কোনও কানকাটা, ময়ূরপঙ্খী। আসবে না সেই পক্ষীরাজও। এত দিন পর পিনুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। স্কুলের বন্ধু। বাবার টেলারিং-এর দোকান থেকে সুতো চুরি করে আনত। ঘুড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে। হলদে চাঁদিয়ালের হলুদ সুতো, লাল মুখপোড়ার জন্য লাল। কিন্তু, ও সুতোয় কি ঘুড়ি টেকে আকাশে! পারেনি পিনু। ওরও আজ নিজেকে বড্ড পারফেক্ট লাগছে। সব মিলে যাচ্ছে। লাটাই, সুতো, মাঞ্জা এ সব কি বড় বেখাপ্পা ওর কাফলিঙ্ক লাগানো হাতে? এ বার কি দিনভর www.gamesgames.com কিংবা www.thekidzpage.com-এ ঢুকে ফ্লাইং কাইটস খেলবে তবে!
না কি, এক বার নীচে নেমে দেখবে? সূর্য ডোবার আগে পক্ষীরানিও তো ফিরে এসেছিল। ও-ও ফিরে যাবে ময়দানে। মাঞ্জা নয়, একদম সাদা সুতোর মতো দিনটা কাটাবে। আকাশটা রঙে রঙে ছেয়ে দেবে।



আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২