19 August 2013

কে সি পাল

সুস্নাত চৌধুরী


সূর্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে, পৃথিবী মোটেই তার চার দিকে ঘুরছে নাওয়ান ফাইন মর্নিং এই সহজ কথাটা সত্যি হয়ে দেখা দিলে আমার-আপনার কৌন সা মহাভারত অশুদ্ধ হবে? দিনের বেলা ট্রেনে সেই একই রকম ভিড় থাকবে... রাতের বেলা মিনিমাম তিন পেগ না হলে ঘুম আসবে না... মাস ফুরোলে মাইনে চার আনা বাড়বে না... বছর ঘুরলে অন্যের ইনক্রিমেন্ট দেখে আগের মতোই জ্বলুনি ধরবে...যেমন খাচ্ছেন, বাথরুম যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে শুচ্ছেন, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছেন কিংবা পিরিয়ড এলে কষ্ট পাচ্ছেন, শীতকালে পিকনিক করছেন, গ্রীষ্মকালে ঘামছেন অবিকল তেমনটাই চলতে থাকবে। আপনি ইশকুলের ভূগোল টিচার না হলে, জাস্ট কিচ্ছু যাবে-আসবে না। অথচ সেই মানুষটাকে আমি দেখেছি, আপনারাও অনেকে দেখেছেন, স্রেফ এই একটা কারণে নিজের জীবনটা যিনি খরচ করে দিয়েছেন। আপাতত ঘর-বাড়ি-পেনশন হারিয়ে গত দু’বছর ধরে কলকাতার ফুটপাতে দিন কাটাচ্ছেন। রাত কাটাচ্ছেন।
‘পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে, কিন্তু বার্ষিক গতি নেই। আহ্নিক গতি আছে বলেই দিন-রাত্রি হয়। আর ঋতু পরিবর্তন হয় সূর্যের বার্ষিক গতির জন্য।’ রাসবিহারী মোড়ে ফুটপাতের ওপর বসে বলছিলেন কার্তিকবাবু। কার্তিকচন্দ্র পাল। কে সি পাল। হাওড়া স্টেশন চত্বর কিংবা কলকাতার বহু দেওয়ালে, ব্রিজে, ল্যাম্পপোস্টে, দেওয়ালে যাঁর গ্রাফিত্তি আপনারা দেখেছেন। নিজের হাতের লেখায় তাঁর তত্ত্বের ওয়ান-লাইনার, বা ছবি-টবি দিয়ে ভাল করে এঁকে তত্ত্বটার বিশদ ব্যাখ্যা। কৌতূহলবশে বইমেলা থেকে নগদ দশ টাকা বা খুচরো এক টাকায় হয়তো বা তাঁর থিসিসও সংগ্রহ করেছেন। ই-নাগরিকরা হয়তো গুগ্‌ল-বুকস-এ তাঁর বইটির নাম দেখে থাকবেন। এর পর বাকিটা আপনার মনে হতেই পারে...
‘বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।
...ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট
সংক্ষেপে বলিতে গেলে, হিং টিং ছট্।’
কথা হচ্ছিল সেই কে সি পাল-এর সঙ্গে। পাশেই তাঁর থাকার জায়গা। থাকার জায়গা মানে, নিদেন পক্ষে নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির যে দশ ফুট বাই দশ ফুট জোটে, তা-ও নয়। ফুটপাতের রেলিঙের সঙ্গে বাঁধা, মাথা আর কুঁকড়েমুকড়ে দেহ গোঁজার একটা ঠাঁই। চওড়া বড়জোর দু-আড়াই ফুট, লম্বাতেও ছ-সাত ফুটের বেশি হবে না। শুয়ে পড়লে, পাশ ফেরার জায়গাটুকুও মেলা দায়। এর ভেতরেই সব কিছু। রান্নাবান্না, পড়াশোনা। এখানেই কে সি পালের রোজকার দিনরাত্রি, সারা বছরের ঋতু পরিবর্তন।


ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ফুটপাতের একটি ছাউনি মাত্র, কিন্তু নিজের আইডিয়ায় তাকে গড়ে তুলেছেন কার্তিকবাবু। চার দিকে কোনও প্লাস্টিক শিট কিংবা তেরপল দিয়ে বানানো দেওয়ালের আপাত সুরক্ষা নেই। বরং ছোট ছোট পিচবোর্ড বা প্লাস্টিকের টুকরো জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে পরদা। কোনওটায় লেখা তাঁর থিয়োরি, কোনওটায় তাঁর সৌরমণ্ডলের মডেল, কোনওটায় আমজনতার উদ্দেশে বক্তব্য, আবার কোনওটায় বিজ্ঞানীদের প্রতি তির্যক মন্তব্য। নিজের তত্ত্ব দিয়েই নিজের ঘর গড়েছেন তিনি। আক্ষরিক ভাবেই নিজের আইডিয়ার ভেতর বেঁচে রয়েছেন। যেন সেই বিদেশি ছবিতে দেখা পাদরির ঘর, যে ঘরের দেওয়াল জুড়ে সাঁটা বাইবেলের পাতা। যেন এক বর্ম, এক রক্ষাকবচ যেন এ ঘরে কোনও ক্রমেই না ঢুকে পড়তে পারে শয়তান! এ পৃথিবীতে অন্তত একটি ঘর আছে, যে ঘরে পৃথিবী স্থির, তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে সূর্য!
সাংবাদিকতার সূত্রেই বছর পাঁচেক আগেও এক বার গিয়েছিলাম ওঁর বাড়ি। হাওড়া শহরে। মনে আছে, পাকা বাড়ি। সামনে কিছুটা জমি। সে সব ছেড়ে এই ফুটপাত কেন? উত্তরে বুঝলাম, নেপথ্যে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক সমস্যা। হয়তো রয়েছে তাঁর এই একান্ত ব্যক্তিগত ‘সত্য’-র পিছনে সব কিছু ভুলে ছুটে চলাও। এই ‘পাগলামি’ আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! প্রতি মাসে পেনশনের কয়েক হাজার টাকাও নাকি তিনি আর হাতে পান না। জোটে মোটে পাঁচশো টাকা। ‘ইচ্ছে করলে কোর্টে যেতে পারতাম, কিন্তু সে আমি পছন্দ করি না।’ তা হলে চলে কী করে? হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দিলেন কার্তিকবাবু ‘মাসে পাঁচশো মানে, দিনে সতেরো টাকার মতো করে দাঁড়াচ্ছে। মোটামুটি খরচ ওতেই চলে যায়। দু’টাকা লাগে সকালে চা খেতে, দু’টাকা লাগে পায়খানা করতে। নস্যির জন্য সামান্য খরচ। বাকি টাকায় রান্নাবান্না। এ ছাড়াও তো বই বিক্রির টাকা থেকে লাভ থাকে।’ আমার বেসিক-পিএফ-ইএমআই-মুদিখানার জটিল সুদকষায় অভ্যস্ত মস্তিষ্কে এত সরল পাটিগণিত ঢুকছিল না। তিনি বলতে থাকেন ‘মা মারা যাওয়ার পরে গ্রামের বাড়িটাও বিক্রি করে দিই এক আত্মীয়কে। সেখানেও আশি হাজার পাঁচশো টাকা পাওনা। আড়াই বছর হয়ে গেল, কিন্তু আমি চুপ করে আছি, দেখি কবে দেয়। এখন যদি আমি ঝগড়ার মধ্যে যাই, আমার প্রচারের কাজটায় ভাটা পড়ে যাবে।’
আমি একটু কেয়ারিং হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু ফুটপাতে এ ভাবে থাকাটা কতটা সেফ?’ কার্তিকবাবু বলেন, ‘আমি তো এ সব খুলে রেখেই চলে যাই। তবে হ্যাঁ, আমার মোবাইলটা এখান থেকেই চুরি হয়ে গিয়েছে। তার পর দুজন আমাকে ফ্রি-তে ফোন দিতে চেয়েছে, বইমেলায়। আমি নিইনি। কেননা, যার ইন্টারেস্ট থাকবে, সে আমার কাছে আসবে। আমি যদি এত পরিশ্রম করে থাকি, এত পয়সা খরচ করে থাকি, সে দুটো মিনিট আর দশ-বিশ টাকা খরচ করে আসতে পারবে না? আমি রাস্তায় থাকি, এখানে অনেক পাতাখোর গাঁজাখোর ঘুরে বেড়ায়। তাদের এক দিন কম পড়লে, হয়তো আমাকে মেরে দিয়ে ফোনটা নিয়ে চলে যাবে। তখন, আমার এই আবিষ্কারের কী হবে? ফোন-টোন আমার চাই না। তবু, রাতে শোওয়ার সময় আমি মাথার কাছে একটা ছুরি নিয়ে শুই...’
‘আমার জীবনের কথা লিখে কী হবে, আমার তত্ত্বটা নিয়ে লিখুন।’ জানতে চেয়েছিলাম ওঁর পড়াশোনা কাজকর্ম সম্পর্কে। দ্বিতীয় বার অনুরোধে বলতে শুরু করলেন। জন্ম হাওড়ার আমতার আনুলিয়া গ্রামে। ১৯৪২ সালে। পড়াশোনা গ্রামেই। একটু বেশি বয়সেই ভরতি হন এআরবি হাইস্কুলে। ক্লাস থ্রি-তে। পয়সার দরকার, অতএব ক্লাস এইট-এই প্রথাগত শিক্ষায় ইতি। এলেন কলকাতা। কখনও মোটর-মেকানিকের কাজ, কখনও গড়িয়াহাটে আলু-পেঁয়াজ বিক্রি। এ সময়ই ডাক এল মিলিটারি থেকে। সেটা ১৯৬২। ভারত-চিন যুদ্ধ। প্রথমে উত্তরপ্রদেশের ফতেহ্‌গড়। রাজপুত রেজিমেন্টে কাটল দু’বছর। তার পর প্যারাশুট রেজিমেন্টের হাবিলদার। টানা পনেরো বছর। এই ’৬২ সালেই সন্ধে বা রাতে ডিউটির সময় সন্ধ্যাতারার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হঠাত্‌ই মনে প্রশ্ন দানা বাঁধে। চার মাস পর্যবেক্ষণের পর জোরদার হয় সন্দেহ। স্রেফ এক হাত লম্বা একটি পাইপ জানালার সঙ্গে বেঁধে চলে নজরদারি। কখনও তা ধ্রুবতারার দিকে তাক করা, কখনও সপ্তর্ষিমণ্ডলের কোনও তারার দিকে, কখনও আবার দিনের বেলায় পাইপের ফুটোয় সূর্য! প্রাপ্ত ফলের ওপর নির্ভর করে চলতে থাকে বিশ্লেষণ। দেখতে দেখতে কেটে যায় বারো বছর। ১৯৭৪ সালে তিনি নিশ্চিত হন পৃথিবী স্থির, সূর্যই ঘুরছে তাকে কেন্দ্র করে।
হাত-টাত নেড়ে, প্রায় ডেমনস্ট্রেট করার ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন কার্তিকবাবু। দেখছিলাম, এক জন সত্তরোর্ধ্ব মানুষেরও কী ভয়ংকর প্রাণশক্তি থাকতে পারে। সব সময় যেন ফুটছেন। ‘এই ছবিটায় আসতে আমার বারো বছর লেগে গেল। তার পর এই তত্ত্বকে যখন ভূগোল বইয়ের যে-কোনও প্রশ্ন করেছি, সব উত্তর পেয়ে গিয়েছি। এ বার আমি দেখলাম, আমার থিয়োরিটাকে দাঁড় করাতে গেলে আমাকে তো ইতিহাস জানতে হবে। আপনি যদি আমাকে টলেমির থিয়োরি জিজ্ঞেস করেন, আর আমি বলতে না পারি, তা হলে তো আমি বেওকুফ বনে যাব! সে সময় আগ্রা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি আমাকে ফ্রি-তে নানা বইপত্র পড়ার সুযোগ দিল।’ চলল ক্লাস এইট ড্রপ-আউট ছাত্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ। গ্যালিলিয়ো, অ্যারিস্টট্ল, কোপার্নিকাস, টলেমি, আর্যভট্ট...। একই সঙ্গে তিনি শুরু করে দিলেন প্রচার।
দু’মাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন। হাজার কপি করে ছাপিয়ে নিতেন তাঁর তত্ত্ব। বিলোতেন স্কুলে স্কুলে। এ সময়ই উত্তরপ্রদেশের ‘অমর উজালা’ সংবাদপত্রে সবিস্তার ছাপা হল তাঁর গবেষণার কথা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে তা আসতেই শুরু হল সমস্যা। বিনা অনুমতিতে সাক্ষাত্‌কার দেওয়ায় সার্ভিস রেকর্ডে পড়ল লাল কালির দাগ। আরও দু’বার রেড এন্ট্রির পর শো-কজ করা হল কার্তিকবাবুকে। ‘আমি বলে দিলাম, চাকরি করব না, আমি কোনও জবাব দিতে চাই না। আমার প্রচারেরও অসুবিধে হচ্ছিল। নিয়ম আছে, শো-কজের এক মাসের মধ্যে জবাব না দিলে অটোমেটিক আউট করে দেওয়ার। আমাকেও আউট করে দিল। আমি খুশিই হলাম। সেটা ১৯৭৯। ফিরে এলাম। এসে, এক বছর আমি আমার বই বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি... চার ছেলেমেয়ে... সকাল সাতটায় বেরোতাম, বারোটায় বাড়ি ফিরতাম... খেয়েদেয়ে আবার বেরোতাম, রাত দশটায় ফিরতাম! তার পর, ১৯৮০ সালে আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি পাই। রিটায়ার করি ২০০৫-এ। তখন পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম। আমার বউ...’ সেই সম্বলটুকুও হারানোর কথা বলতে থাকেন আবার। কিন্তু সেখানে কোনও আক্ষেপ বাসা বাঁধার সময় পায় না। কেন না, তত ক্ষণে আবার তিনি ঘুরে গিয়েছেন তাঁর তত্ত্বের দিকে। সেই তত্ত্ব প্রচারের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন।
‘এখন তো শুধু দু’ঘণ্টা লেকচার করি। বাসে বাসে। সকাল ন’টা থেকে এগারোটা। দু’ঘণ্টায় আমি পঞ্চাশ টাকার বিক্রি করে দেব। তাও তো এখন দাম কমিয়ে দিয়েছি। এক টাকা আর পাঁচ টাকা। আগে দশ টাকা ছিল, এখন পাতা কমিয়েছি। পুরো ইতিহাস দিলে আমার খরচ বেড়ে যাচ্ছিল। মানুষ তো মোদ্দা জিনিসটা জানতে চায়। ইতিহাস তারা জানতে চায়, যারা আমার সঙ্গে তর্ক করবে। তারা তো ইতিহাস পড়লেই জানতে পারবে, আমার বই পড়ার দরকার নেই। তা ছাড়া কিছু কিছু বিশেষ জায়গায় আমি এমনিতেই বিলি করি, পয়সা নিই না। ইংলিশ বইটা ফরেনারদের জন্য ফ্রি। তবে ফরেনাররা সবাই তো আর পণ্ডিত নয়, তাদের মধ্যেও আমাদের মতো গাধা আছে! কেউ হয়তো পড়তে চাইল না। নিল না-নিল, বয়ে গেল! যে নিল নিউ থিয়োরি: দ্য সান গোজ অ্যারাউন্ড দি আর্থ ওয়ান্স ইন আ ইয়ার, চ্যালেঞ্জ ফর অল সায়েন্টিস্ট অল ওভার দি ওয়ার্ল্ড ইংলিশে বলে দিলাম।’ এক লাখ টাকার চ্যালেঞ্জ। এক জন ফুটপাতবাসীর। তাঁর ফুটপাতের বাসার গায়েই একটা বোর্ডে বড় বড় করে লেখা!
পালটা বিরোধিতার মুখেও অনেক বার পড়তে হয়েছে। কখনও ফোনে হুমকি এসেছে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব! কখনও চিঠি। সে সব চিঠি নিজের বইতেও ছেপেছেন কার্তিকবাবু। তাঁর পাওয়া প্রথম চিঠিটি ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ লেখা। শুরুর দু’কথার পর প্রেরক লিখছেন ‘...আমার মনে হচ্ছে আপনি একটি দু’পেয়ে গরু। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আপনার গাঁজা খাওয়া কি অভ্যাস আছে? আপনার যদি নেশায় গাঁজা কম পড়ে, তা হলে দয়া করে জানাবেন। আমরা আপনার মাথার ছিট ছাড়াবার জন্য সযত্নে গাঁজা পাঠিয়ে দেব।’ আবার, ৩/৪/৮১ তারিখে আর এক জন তাঁকে লিখছেন ‘...একটি কথা বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয় যে আপনি কি রাঁচীর পাগলখানার একজন প্রাচীন সভ্য ছিলেন? তাহা না হইলে এই ধরণের মস্তিষ্কের উর্ব্বরতা কোথা হইতে আসিল? অতএব আমরা ইহাই সাব্যস্ত করিলাম যে, আপনি গাঁজা খাইয়া থিয়োরীটি উদ্ভাবন করিয়াছেন, অতএব আপনার প্রাপ্য পুরস্কার হলো একটি সুদীর্ঘ ঘুঁটের মালা।’ আবার প্রচারের সময় সরাসরি প্রতিবাদের সামনেও পড়তে হয়েছে। কেউ সরব হয়েছে বইমেলায় তাঁর ক্যানভাসিং-এর সময়, কেউ চলতি বাস থেকে তাঁকে নামিয়ে দিতে চেয়েছে। কখনও আবার প্রতিবাদ আরও দু-এক ডিগ্রি কড়া। ‘এক বার দু’জন আমাকে বলল, প্রোফেসরের কাছে নিয়ে যাব। বলে, লালবাজারে ধরে নিয়ে গেল। লালবাজার বলল এটা আমাদের আন্ডারে নয়। তার পর নিয়ে গেল হেয়ার স্ট্রিট থানায়। সেখানে ডায়েরি লিখল। অফিসার বলল ‘আরে, এনার একটা বক্তব্য আছে, বলছেন। আপনাদের ভাল লাগে শুনুন, না হলে শুনবেন না। আপনাদের তো জোর করে কেউ দিচ্ছে না বইটা।’ আমায় ছেড়ে দিল। আর এক বার হয়েছিল শিয়ালদার কাছে। এক জন প্রোফেসর জনা দশেক ছাত্র এনেছে। আমি তখন আমেরিকা থেকে আসা চিঠিগুলো ঝুলিয়ে রাখতাম। ওরা চেষ্টা করছিল কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলার। আমি ছিঁড়তে দিইনি, আমাকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে গেল শিয়ালদার কাছে একটা পুলিশ ফাঁড়িতে। অফিসারকে বললাম আমি একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছি, সেটাই প্রচার করছি, এরা আমায় ফালতু ধাক্কা মেরে এখানে নিয়ে এল। অফিসার বললেন দেখুন, আপনি একা, এরা দশ জন। আপনি আর আসবেন না এখানে। আমি বললাম ঠিক আছে। বলে, কেটে পড়লাম। আর যেতাম না ওখানে। এক বছর অন্তর এক দিন করে যেতাম, পর দিন দল বেঁধে এলেও আমাকে আর দেখতে পেত না!’
কে সি পাল-কে আমার তখন ফ্যাতাড়ু মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে একটা চোরা থ্রেট। পাগল-ছাগল ইমেজের একটা মানুষ রাসবিহারীর ফুটপাত থেকে গোটা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তাবত্‌ বিজ্ঞান যখন ‘ঘোরো ঘোরো ঘোরো’ বলে পৃথিবীর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, তিনি উলটো দিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক কথায় ‘স্টপ’ বলে সব থামিয়ে দিচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে আঙুল তুলে বলছেন, ‘একটা ছবি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি আমার থিয়োরির ভুল ধরার, পারিনি। কারও ক্ষমতা নেই এর ভুল ধরার।’ তাঁর কথায় কথায় রাম-শ্যাম-যদুর মতো উঠে আসছেন টলেমি, কোপার্নিকাস, পিথাগোরাস, অ্যারিস্টট্ল, কেপ্‌লার। অনায়াসে কাউকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউ কিঞ্চিত্‌ নম্বরও পাচ্ছেন। ‘কোপার্নিকাস, গ্যালিলিয়ো ভুল করেছিলেন, সেই ভুলটাই এখন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ পড়ছে। আমার থিয়োরিটা যে দিন স্বীকৃতি পাবে, সে দিন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ আমার কথাটাই মানবে।’
ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, একটা প্রশ্ন ওঁকে করা হল না দেওয়ালে, পোস্টারে উনি শুধু সাদা আর কালো রং-ই কেন ব্যবহার করেন? খরচের কারণে? না কি সাদা-কালোর বৈপরীত্যটা আসলে সত্য আর মিথ্যার মতোই বলে। একটা লড়াই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের। হ্যাঁ বনাম না। চল্লিশ বছর হতে চলল, যে লড়াইয়ে তিনি একাই একটা পক্ষ। উলটো দিকে আমি, আপনি, মনমোহন সিংহ, বারাক ওবামা, বিড়লা তারামণ্ডল, কেনেডি স্পেস সেন্টার... সব্বাই। গোটা দুনিয়া। তবু এক দিন এক মুহূর্তের জন্যও এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েননি ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই প্রাক্তন সদস্যটি। তিনি জানেন, তাঁকে নিয়ে সর্বত্র ব্যঙ্গ করা হয়। আড়ালে নয়, সামনেই লোকে হাসে, বইমেলায় ঘিরে ধরে হ্যারাস করে, কখনও তাঁর প্রচার শুনে খিস্তি মেরে চলে যায়, তবু সমান তেজ নিয়ে লড়ে গিয়েছেন তিনি। সামান্য ট্যারা কথা, তা সে শাশুড়ির মুখ থেকেই হোক বা বসের মুখ থেকে বঙ্গললনা আর বাঙালি বীরপুঙ্গবদের আধরাতের ঘুম কেড়ে নেয়। সেই জাতে এমন এক মানুষ সত্যিই বিরলতম, যিনি হাজারও অপমান, যাবতীয় বাধা সত্ত্বেও নিজের প্রতিপাদ্যে অবিচল থাকতে পারেন বছরের পর বছর।
তত্ত্বটা ঠিক না ভুল, সত্যিই ‘নাসা’ এক দিন তাঁর কথা মেনে নেবে কি না, ছেড়ে দিন। সেই লোকটার কথা ভাবুন, যাঁর ছেলেমেয়েরা অবধি স্কুলে গিয়ে যা পড়ে আসছে, তা তাদের বাবার কথাকে সরাসরি প্রলাপ বলে প্রমাণ করে। তবু সেই লোকটা তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়ছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, সেই বিশ্বাসটা শুধু তক্তপোশে শুয়ে শুয়ে লালন করলে চলে না। সেটা প্রচারের জন্য গোটা শহর জুড়ে নিজের হাতে লেখাগুলো লিখতে হয়, পাতাগুলো নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়ে ছাপতে হয়, বাস্তব পৃথিবীতে সরাসরি গলার শির ফাটিয়ে তা জোরে জোরে বলতে হয়। জীবনের প্রতিটি দিন মাস বছর মুহূর্ত, শরীর মন শক্তি আশা, সব এই একটা প্রোজেক্টে নিংড়ে নিংড়ে খরচা করে ফেলতে হয়। এবং এই সমস্তটাই করতে হয় পুরোপুরি জেনে, যে, পৃথিবীতে এক জনও তাঁর পক্ষে নেই, এক জনও না, এবং গলা দিয়ে রক্ত উঠে এলেও এক জনও তাঁর পক্ষে চলে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এই রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে একটা লোক একাত্তর বছর বয়সে এতটুকু অপ্রসন্ন নন। একটা কথাতেও কোনও হতাশা ধরা পড়ে না। ক্রোধ, ক্ষোভ, বিলাপ, আর্তনাদ যা প্রায় সব বাঙালি নিত্য ভাতে মেখে খায়, তা তাঁর মধ্যে প্রবেশাধিকারই পায়নি। তিনি জান লড়িয়ে দিচ্ছেন শুধু তাঁর তত্ত্বটা আঁকড়ে। অন্তত এই জায়গায়, ডেডিকেশন আর টেনাসিটির প্রশ্নে, তিনি আমাদের ইতিহাসের অতিমানবিক চরিত্রগুলির সঙ্গে তুলনীয় নন কি? তিনি লড়াইটা কি গ্যালিলিয়োর চেয়ে কম লড়ছেন? তিনি আরও অপেক্ষা করতে রাজি। তাঁর স্থির বিশ্বাস, এক দিন না এক দিন তিনি জিতবেনই। না, কথাটা ঠিক হল না তিনি জানেন, এই লড়াইয়ে সৃষ্টির আদি থেকেই তিনি জিতে রয়েছেন। তাঁর তত্ত্বই ষোলো আনা অভ্রান্ত, নির্ভুল। এই বিশ্বাসই তাঁর পুঁজি। এই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁর এই বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু নেই। আসলে কে কার চার দিকে ঘুরল, তাতে শেষ অবধি কিস্যু যায়-আসে না।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট ২০১৩

15 July 2013

কে সি নাগ

সুস্নাত চৌধুরী


ইস্কুল যেতে পেটব্যথা হবে। পরীক্ষার হলে ঘাম দিতে থাকবে। তেল মাখা বাঁশে উল্লাসে উঠেছে মাংকি! প্রোপোজ-টোপোজ ঘুচিয়ে ম্যাথস-এর কোচিং-এ প্রেস্টিজ ফুটো হবে। কেননা চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে তত ক্ষণে সব জল বেরিয়ে যাচ্ছে, আর উপরের কোন ব্যাটাচ্ছেলে খুলে দিয়েছে কল! এমতাবস্থায় কোনটে চাই, ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, সেটুকু ধরতেই মাথা গুলিয়ে গ। এই কিংকতর্ব্যবিমূঢ়তারই আদি পিতা কে সি নাগ।
আবার, কে সি নাগ একটা চ্যালেঞ্জের নাম। তেমন জুতসই একটা অঙ্কের সমাধান কারও কনফিডেন্সের ফুসফুসটা আরও ফুলিয়ে দেয়। এক-একটা অনুশীলনী যত গড়িয়ে আসতে থাকে, খেলা তত জমে। উনতিরিশ, তিরিশ, একত্রিশের দাগের অঙ্কগুলো যেন এক একটা হার্ডল, টপকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে সাঁইসাঁই রেস জেতার উল্লাস।



ছবি: সুমন চৌধুরী

ছাত্রজীবন, শিক্ষকজীবন
১৮৯৩ খ্রি.। ১৩০০ বঙ্গাব্দ। রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশবচন্দ্র নাগ। বাবা রঘুনাথ, মা ক্ষীরোদাসুন্দরী। শৈশবেই পিতৃহারা হন কেশব। সন্তানদের মানুষ করতে শুরু হল ক্ষীরোদাসুন্দরীর লড়াই। কেশবচন্দ্রের পড়াশোনার শুরু স্থানীয় বাংলা স্কুলে। গুড়াপে তখন ওই একটিই স্কুল। তার পর ক্লাস সেভেন থেকে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়। রাত থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়া, তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে প্রতি দিন স্কুল যাওয়া। হেঁটেই ফেরা। ক্লাস নাইনে ভরতি হলেন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। ১৯১২ সালে সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া। এ বার রিপন কলেজ। বিষয় বিজ্ঞান। এই সময় থেকেই প্রাইভেট টিউশনি শুরু করে দেন কেশবচন্দ্র। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগেই পাশ করলেন আইএসসি।



কেশবচন্দ্র নাগ
যে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক দিন ছাত্র ছিলেন, সেখানেই শুরু করলেন শিক্ষকতা। যোগ দিলেন থার্ড মাস্টার হিসেবে। সংসারের ভার তখন কাঁধে, চাকরি ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার চেষ্টা চলল। বিজ্ঞান নয়, যদি কলা বিভাগেও স্নাতক হওয়া যায়! অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করলেন কেশবচন্দ্র। এ বার ডাক এল অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার, সেই ছাত্রবেলার কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে। সেখানেও কিছু দিন শিক্ষকতা করলেন তিনি। তার পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল। এ সময়ই অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে কেশবচন্দ্রের সুখ্যাতির কথা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছয়। মানুষ চিনতে তিনি ভুল করেননি। মিত্র ইনস্টিটিউশন ভবানীপুরে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসা হয় কেশবচন্দ্রকে। রসা রোডে মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। তত দিনে তাঁর জীবনের কেন্দ্রে কেবল একটিই শব্দ গণিত। এই মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নেন কেশবচন্দ্র। মেসবাড়ি ছেড়ে ১৯৬৪ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনের নতুন বাড়িতে। আজও যে বাড়িতে ‘কেশবচন্দ্র নাগ’ লেখা নেমপ্লেটটি উজ্জ্বল! তাঁর শিক্ষকজীবনের শেষার্ধ কেটেছে কলকাতায়। তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু, অন্তরের টানে বারে বারে ফিরে গিয়েছেন হুগলির গুড়াপে, তাঁর মাটির কাছে।

বই লেখা
বই লেখার কথা দূর কল্পনাতেও ছিল না। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। সেখানে তাঁর অগ্রজ সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায়। তাঁর বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’। আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকরা। কেশবচন্দ্রও হয়ে ওঠেন সেই আড্ডার অন্যতম। শরৎচন্দ্রই নাকি তাঁকে প্রথম বলেন গণিতের বই লেখার কথা। তখন কেশবচন্দ্র বিষয়টাকে বড় একটা পাত্তা দেননি। তার পর এক দিন তাঁকে প্রায় চেপেই ধরেন কবিশেখর। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের জন্য বই লেখার কথা বলেন। ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ প্রবন্ধে সে কথোপকথনের একটা ইঙ্গিত রেখেছেন লেখক চিত্তরঞ্জন ঘোষাল। কালিদাসবাবু বলেন ‘ক্লাসে যেভাবে অঙ্ক শেখাও, আর ছেলেরা যেভাবে চুপ করে ওই শুকনো খড়কুটো গোগ্রাসে গেলে, দেখে তো মনে হয় ভাই যে তুমি গল্প লেখা শেখাচ্ছো। তাহলে নিজে লিখতে পারবে না কেন?’ শুরু হল পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। তখন তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। প্রকাশিত হল ‘নব পাটীগণিত’। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। কেশবচন্দ্র নাগের সেই ‘কে সি নাগ’ হয়ে ওঠার শুরু। বছর কয়েকের মধ্যেই তামাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও অনুমোদিত হল।
আক্ষরিকই, অপাঠ্য বই লিখেও অনেকের কপালে সাহিত্যিক-সুলেখকের তকমা জোটে। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের রচয়িতাকে ‘লেখক’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্র্যাকটিসে নেই। ল্যাডলিমোহনের কেমিস্ট্রি বা সিআরডিজি-র ফিজিক্স অনেক বাজারি গপ্পো-কবিতার চেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে, বেশি মানুষের ‘কাজে’ লেগেছে। তবু তাঁদের আমরা লেখক বলি না। কে সি নাগের ক্ষেত্রেও ‘পাঠক’-এর অবস্থানটা সেরকমই। ভুললে চলবে না, কে সি নাগকে অঙ্কের বই লিখতে বলছেন কবি আর কথাশিল্পী। শরৎচন্দ্র মজা করেই তাঁকে ডাকছেন ‘গণিত-শিল্পী’ বলে! কে সি নাগের সেই সব অঙ্কবইয়ে কি তবে কোনও মৌলিকত্ব নেই? তাঁকে পুরোদস্তুর ‘লেখক’-এর তকমা দেওয়া কি উচিত নয়?
ঘটনাচক্রে কেশবচন্দ্রের মেসে এক দিন এসে পড়েন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল। টেবিলের উপরেই ছিল কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা। দেখামাত্রই চমকে ওঠেন পরেশবাবু। কোন অঙ্ক কোন উপায়ে করলে সহজেই বোধগম্য হবে ছাত্রদের, তার হরেক রকম টেকনিক লিখে রাখা পাতার পর পাতায়। সেই খাতাটি বইয়ের আকারে ছাপার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে একেবারেই রাজি হননি কেশবচন্দ্র। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, অঙ্কের কি হেল্প-বুক হয়, না শিক্ষকদের জন্য গাইডবুক হবে এটি? শেষমেশ কেশবচন্দ্রকে রাজি করাতে সফল হন প্রকাশক। ১৯৪২। প্রকাশিত হল অঙ্কের সহায়িকা ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। বেরনো মাত্রই বইটির চাহিদা হয়েছিল আকাশছোঁয়া।
একে একে তাঁর আরও বই প্রকাশিত হতে থাকে। ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। পাকিস্তান বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী লিখেছিলেন ‘পাক ম্যাথমেটিক্স’। দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ব্রেল সংস্করণও। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মার্টিন বার্ড স্নাইডার কে সি নাগের বইগুলির বিষয়ে বলেছিলেন, ‘দ্য থিয়োরিটিকাল ট্রিটমেন্ট অব দ্য সাবজেক্ট ইন দিজ বুকস ওয়্যার সুপিরিয়র টু দ্যাট ফাউন্ড ইন সিমিলার বুকস ইন দ্য ইউএসএ’।

অ-গণিত প্রতিভা
গণিতের বাইরেও অগণিত ক্ষেত্রে অবিচল যাতায়াত ছিল কেশবচন্দ্রের। ছেলেবেলাতেই তাঁর ভেতর জনসেবার বীজ রোপণ করেছিলেন প্রতিবেশী জিতুদা জিতেন্দ্রনাথ রায়। পরে যিনি হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ মহারাজ। এক কথায় তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্রের মেন্টর। তাঁর প্রতিটি কথা জীবনভর মন্ত্রের মতো পালন করতেন কেশবচন্দ্র। তাঁর আয়োজনেই উপনিষদ, বেদ-বেদান্তের চর্চা। শ্রীশ্রীসারদামায়ের প্রত্যক্ষ শিষ্যত্বও নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। সমাজসেবা আর অধ্যাত্মচিন্তা একযোগে চলেছে, শিক্ষকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
ব্যক্তিগত ডায়েরি ‘রত্ন-বেদী’-তে লিখে গিয়েছেন বহু কবিতা, ভক্তিমূলক গান। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসিকতার কথাও। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য যেখানে যে মন্তব্যটি মনে ধরেছে, টুকে রেখেছেন এই খাতায়। আর খাতার উপরে লিখে রেখেছেন ‘বিনা অনুমতিতে পাঠ নিষেধ’! ১৯২৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত টানা এই অভ্যাস চালিয়েছেন। এ ছাড়াও কেশবচন্দ্র বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বামী অভেদানন্দের বহু ইংরেজি বক্তৃতা। অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার লেখাও।
গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও শামিল হয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। তাঁর বই তত দিনে বাজারে ঝড় তুলে দিয়েছে। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন গ্রামে। ধনেখালি থানা কংগ্রেসের তখন তিনি সভাপতি। চলল মিছিল, আন্দোলন। পুলিশ গ্রেপ্তার করল কেশবচন্দ্রকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দিন কাটতে লাগল জেলখানায়। গুজব রটল ইংরেজরা চাইছে কেশবচন্দ্রকে গুম করে দিতে! অবশেষে তিনি ছাড়া পেলেন বেশ কয়েক মাস পর। ফিরে এসে ফের যোগ দিলেন গাঁধীজির অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আন্দোলনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান। ভোটে দাঁড়াতে বলেন। সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কেশবচন্দ্র।
কেশবচন্দ্রের আরও এক আগ্রহের জায়গা ছিল খেলার মাঠ। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস সবেতেই সমান আগ্রহ। ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য। বয়সকালে মাঠে যেতে পারতেন না, রেডিয়োয় সম্প্রচার শুনতেন। আর পাটিগণিত থেকে শিফ্ট করে যেতেন জ্যামিতিতে! রিলে শুনতে শুনতেই কাগজে আঁক কেটে বুঝতেন ও বুঝিয়ে দিতেন মাঠের এক একটা মুভমেন্ট।
১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫। রেডিয়োয় চলছে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী। কানপুরে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট। কেরিয়ারের শুরুতেই তিন নম্বর সেঞ্চুরিটি হাঁকাচ্ছেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। টানটান রোমাঞ্চ। উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেশবচন্দ্র। সেরিব্রাল। আরও দু’বছর পর থেমে গেল সব অঙ্ক। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭।

স্যরের ছাত্ররা
তালিকাটা স্বভাবতই বেশ লম্বা। তারকাখচিতও বটে। চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বিকাশ রায়। রঞ্জিত মল্লিক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ গ্রন্থে (চিত্তরঞ্জন ঘোষাল সম্পাদিত ও ‘গ্রন্থ সম্পুট’ প্রকাশিত) কলম ধরেছিলেন তাঁর এই সব কৃতী ছাত্ররা। নিজেদের মাঠে যাঁরা সব হিসেব এক্কেবারে মিলিয়ে দিয়েছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গণিতবিদ হয়েও বেদ-উপনিষদে কেশববাবুর যে টান, তাতেও এ দুইয়ের নিকটাত্মীয়তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।’ সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলছেন, ‘ছাত্রদের সাহায্য করতে (শুধু অঙ্কে নয়, যে কোনও ব্যাপারে) তাঁর দিনে রাত্রে কোনো সময়েই কিছুমাত্র অনাগ্রহ বা উদ্যমের অভাব ছিল না। এবং সে সাহায্যের মধ্যে কোনো দেনাপাওনার সম্পর্কের লেশমাত্র ছিল না।’ সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘অবাক হয়েছিলাম, যাঁকে দেখে ভয় হোত, কড়া ধাতের মানুষ বলে মনে হোত সেই কেশববাবু স্যারই যখন গান করার উৎসাহ দিতেন আমাকে।’ তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিতে দেখেছেন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। তিনি লিখছেন, ‘তাঁরই প্রেরণায় উপলব্ধি করলাম অঙ্ক কত সহজ অঙ্ক একটা ম্যাজিক অঙ্কের মধ্যেও সাহিত্য-শিল্প আছে।’ আবার গুড়াপ সুরেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের স্মারকগ্রন্থে লিখছেন অভিনেতা বিকাশ রায় ‘মোটা চশমার আড়ালে গম্ভীর মুখের ছায়ায় একজোড়া সহানুভূতি-ভরা চোখ আমরা দেখেছিলাম, আমরা ভাল কিছু করতে পারলে সেই চোখে উৎসাহ জ্বলে উঠতো, আমাদের দুষ্টুমি দেখে সেই চোখে মৃদু ভর্ৎসনার সঙ্গে সামান্য indulgence ফুটে উঠতো।’

অঙ্ক মেলে না
আমি-আপনিও কি কে সি নাগের ছাত্র নই? কে সি নাগ বহু মানুষের কৈশোরের এক অনিবার্য স্মৃতি। এক আইকন। তিনিই আমাদের পাঠ্যক্রমের একমাত্র অরণ্যদেব। অথচ বইয়ের টাইটেল পেজে নামের পাশে ডিগ্রি লিখতেন না তিনি। আজও তাঁর বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত রয়্যালটির টাকার একটা বড় অংশ চলে যায় দুটি চ্যারিটি ফান্ডে। একটি তাঁর নিজের নামে, অন্যটি তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীমণির নামে। এখনও প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হয় গুড়াপে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের উদ্যোগে। আয়োজিত হয় কেশবচন্দ্র নাগ স্মারক বক্তৃতা। এ বারও হয়েছে। কিন্তু সে খবর আমরা ক’জন রাখি? ক’টা টিভি ক্যামেরা যায় সেখানে? হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে জাস্ট দু’পা হাঁটলেই কে সি নাগের কলকাতার বাড়ি। পাড়ার মেয়েটিও আগে জন্মদিনে প্রণাম করে যেতেন বৃদ্ধ কে সি নাগ’কে বলছিলেন তাঁর বড় ছেলে দেবীপ্রসাদ নাগ। এখন মেয়েটি ইচ্ছে করলেই হয়তো মানুষটির স্মৃতি উদযাপনে অনেক কিছু করতে পারেন।
আমাদের অবশ্য প্রণাম-ট্রনাম খুব ভাল আসে না। পাটিগণিতের মতোই, বেশ গুলিয়ে গেছে। এই নল দিয়ে ঢুকছিল শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধ আর ওই নল দিয়ে খরচ করে ফেলছিলাম ফুর্তিময় বিন্দাস মুহূর্ত, হাতে রইল যেন কী?





আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ জুলাই ২০১৩