30 December 2013

তুই তুমি আপনি

সুস্নাত চৌধুরী



ছবি: সুমন চৌধুরী

ভিখিরিকে আপনি কখনও আপনি বলে ডেকেছেন? রিকশাওলা, তা তিনি আপনার বাপের বয়সি হলেও আপনার রিফ্লেক্স আপনাকে আপনি বলা থেকে আটকেছে। আপনি তেমন মাতব্বর টাইপ্‌স হলে, তুইতোকারি করেছেন হেলায়, রেলায়। ‘ওয়, হট এখান থে...’ কিংবা ‘কীরে, কে যাবি রে’। খুব সমাজ-সচেতন সুনাগরিক হলেও বলেছেন --- ‘এ নাও গো, ছেলের চিকিচ্ছে করিও’ কিংবা ‘আচ্ছা বাবা, তোমায় পাঁচ টাকা বেশি ভাড়াই দেব, একটু জোরে টানো এবার’। আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি বাবা-বাছা করেছেন, ওই মানুষটির ভালোও চেয়েছেন হয়তো, কিন্তু কক্ষণও কোনওদিনও তুমি-র উপরে উঠতে পারেননি। অথচ ওই অশিক্ষিত ছোটলোক ভিখিরি কি রিকশাওলারা কিন্তু আগাগোড়া আপনাকে আপনি-ই বলে এসেছেন --- আপনি কেরানি না প্রোমোটার, অধ্যাপক না আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বিচার করেননি।
আপনার আদরের লাল টুকটুকে নতুন গাড়িটিকে যখন পনেরো দিনের মাথায় হালকা ঘষে দিয়েছে বেয়াক্কেলে রিকশা, আপনার অন্তর থেকে খুব থাপ্পড় পেলেও আপনি নিজেকে আটকেছেন। কিন্তু চিৎকার করতে দ্বিধা করেননি --- ‘অ্যাই, দেখে চালাতে পারিস না’! আবার মাস খানেকের মাথায় যখন ছোট্ট চুমু খেয়েছে রঙচটা হলুদ ট্যাক্সি, আপনি একই ভাবে চেঁচিয়ে উঠেছেন, একই অভিব্যক্তি ছিল আপনার, শুধু তুই-টা বদলে গিয়েছিল তুমি-তে --- ‘আরে ভাই, দেখে চালাও’! আর যখন টোকাটা মারল আপনার চেয়ে আরও লাখ দুয়েক বেশি দামের একটা সেদান, আপনি তখনও রাস্তা-টাস্তা আটকে সে-গাড়ির ড্রাইভার কাম মালিকের সঙ্গে জোর একচোট ক্যাচাল বাধিয়েছেন। কিন্তু, আপনি-র নীচে আপনি নামেননি --- ‘দ্যোর মশাই, দেখে চালাতে পারেন না’! বাইরে একই রকম চোখ রাঙাচ্ছেন, ভেতরেও একই খিস্তি দিচ্ছেন প্রত্যেককে, কিন্তু আপনা থেকেই আপনার মুখ দিয়ে কখনও বেরোচ্ছে তুই, কখনও তুমি, কখনও আপনি। ব্যক্তিভেদে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ফারাক যে এভাবে আমাদের থেকে স্রেফ সম্বোধনের তারতম্য আদায় করে নেয়, তাকে আমাদের ‘শিক্ষা’ বা ‘সংস্কৃতি’ না বলে ‘রিফ্লেক্স’ বলাই বোধহয় ঠিক হয়। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সমাজ যে রিফ্লেক্সকে একেবারে গভীরে পুঁতে দেয়। স্বতঃসিদ্ধের মতো যা চলে আসে, যাকে ঘিরে কোনও প্রশ্নই আর অ্যাফোর্ড করা যায় না। সন্ধের মহানগরে বেকার টাইম খেতে থাকা বাসটিতে সওয়ার হয়ে যখন বিরক্ত হয়ে ওঠেন অফিস-ফেরতা সুশিক্ষিত ভদ্র যুবকটি, তিনিও তো দুমদুম চাপড় মেরে চল্লিশোর্ধ ড্রাইভার আর কন্ডাকটারকে উদ্দেশ করে হেঁকে ওঠেন --- ‘আরে, টান না রে ভাই... আর কত প্যাসেঞ্জার তুলবি...’। এক বাস মানুষের কারো মনেই কি তখন প্রশ্ন জাগে, যে, ক্রিয়াপদগুলি ‘টানুন’ কিংবা ‘তুলবেন’ হলে বাসটা একটু জোরে চললেও চলতে পারত? এখানে অবশ্য ছোট্ট একটু ব্যতিক্রম আছে। আদেশ বা নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তুইতোকারি অনেক সময়ই অপরিহার্য। তা একেবারেই কাউকে খাটো করা নয়, বরং সেই নির্দেশকে জোরদার করা। চরম মোহনবাগান-সমর্থকটি যখন উত্তেজিত হয়ে কাৎসুমির উদ্দেশে বলেন, ‘চল... চল... বলটা বাড়া এবার...’ --- কিংবা, টেনশনে ভরা স্লগ ওভারে যখন ক্লাস সিক্সের ছোঁড়াটিও টিভির পর্দায় কোহলি কি ধোনির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘আরে এটা মারতে পারলি না...’ --- তখন সেখানে অপমানের ছিটেফোঁটাও থাকে না। যেমন থাকে না, ‘চল রে চল সবে ভারতসন্তান’ গাইবার সময়। ‘চলুন’ বা ‘চলো’ বললে, গানটি মাঠে মারা যায়। মঞ্চে তো মারা যায়ই!
কিন্তু, দিন বদলের স্বপ্ন দেখা তরুণ নেতাটি যখন ঢুকে যান গ্রাম বাংলার ধান খেত পেরিয়ে, চাষিভাইদের একজোট করে বপন করতে থাকেন তাঁর সৎ রাজনৈতিক বিশ্বাসের বীজ --- কেমন বক্তৃতা করেন তখন? ‘এই জমি তোমাদের, এক চিলতে মাটিও তোমরা ছাড়বে না...’। না হয় তাঁরা মার্ক্স-এঙ্গেলস-মাও পড়েননি, চাষভুসো খেটে-খাওয়া মানুষ --- তাই বলে ষাটোর্ধ্ব-সত্তরোর্ধ্ব মানুষগুলোর বরাতে কখনও আপনি জুটবে না? এককালে রক্তচোষা জমিদার তাঁদের তুই বলে এসেছেন, পরবর্তীতে সত্যি-সত্যিই পাশে দাঁড়ানো বাবুরাও তাঁদের গড়পড়তা তুমি-র উপরে জায়গা দিতে পারলেন না।
কাকে তুই বলতে হবে, কাকে তুমি বা আপনি --- তা নির্ধারণ করতে আরেকটা বড় ফ্যাক্টর বয়স। কলেজ লাইফে দেখেছি, দাড়ি-টাড়ি কেটে বেরোলে মেয়েরা একটু তাকাত বটে, কিন্তু অচেনা লোকে তুমি-তুমি বলত। তাতে আঁতে লাগলে --- কাল ছিল গাল খালি, আজ চুলে যায় ভরে! ছেলেদের দাড়ি, মেয়েদের শাড়ি --- আনজান পাবলিকের থেকে বহু আকাঙ্ক্ষিত আপনি, আপনিই আদায় করে নিত! নইলে মনে হত, আমি তো তাঁদের আপনি-আজ্ঞে করছি, কিন্তু জাস্ট কয়েক বছর আগে ঘটনাচক্রে জন্মে গিয়েছে বলে অচেনা-আধাচেনা কিছু মানুষ নির্দ্বিধায় তুইতোকারি করে যাবে? মাগনা! কখনও কি আমাদের সবারই এই রোখ চেপে যায় না --- রাস্তা-ঘাটে যে আমায় তুই বলবে, আমিও শালা তাকে তুই বলব!
সত্যজিৎ রায়ের অনুকূল তো ঠিক এমনটাই করত। নিকুঞ্জবাবুর রোবট-চাকর। নিকুঞ্জবাবুর বন্ধু বিনয় পাকড়াশি নিজের চাকরদের তুইতোকারি করেই অভ্যস্ত। আড্ডা মারতে এসে একদিন অনুকূলকেও তুই বলে ফেললেন। ‘তাতে অনুকূল গম্ভীর ভাবে বলে, আমাকে তুই বললে কিন্তু তোকেও আমি তুই বলব।’ কতকটা একই চাল ছিল তারিণীখুড়োরও। ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’-এ গেরুয়াধারী বাবাজি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী চাস তুই?’ এই প্রশ্নে খচে যাওয়ার কাহিনি বর্ণনা করছেন খুড়ো স্বয়ং --- ‘বাবাজিদের এই হোলসেল তুইতোকারির ব্যাপারটা আমি মোটে বরদাস্ত করতে পারি না। তাই এনার প্রশ্ন শুনে ধাঁ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। বললাম, “রাজার অনুরোধে তোর সঙ্গে দেখা করতে এলাম”।’ এরপর খুড়ো যা বলছেন, তা ভারী ইন্টারেস্টিং! বাবাজি নাকি এই জবাবে মোটেই বিরক্ত বা বিচলিত হননি, তুইতোকারিও চালিয়ে গিয়েছিলেন। বরং সঙ্গে যা-যা বলেছিলেন এবং করেছিলেন, তাতে স্বয়ং তারিণীখুড়োই ফিদা! ‘মনে-মনে বললাম, বাবাজির ক্ষমতা অসীম, কারণ আমার কাছ থেকে “তুই” থেকে “আপনি” সম্বোধন আদায় করে নিতে লেগেছে ঠিক দু মিনিট।’
ব্যাপারটা এমনই। প্রশ্নটা যদি সম্মান জানানোরই হয় --- তবে তা যথাযথ ক্ষেত্রে আপনা-আপনিই চলে আসা উচিৎ। তার জন্য সমাজের ঠিক করে দেওয়া কোনও প্যারামিটারের প্রয়োজন পড়ে না! তখন ক্লাস, হায়ারার্কি, সোশ্যাল স্টেটাস, সিটিসি --- এসব বিচার করে ব্যাকরণ বই দেখে মুখস্ত করতে হয় না, কাকে কী বলে ডাকব। উপেন্দ্রকিশোরের ‘উকুনে বুড়ির কথা’ সমাজ-নির্ধারিত এই সিস্টেমের চমৎকার এক উদাহারণ। সেখানে শুরু থেকেই সকলের সঙ্গে সকলের --- বুড়ি-বক, বক-নদী, নদী-হাতি, হাতি-গাছ, গাছ-ঘুঘু... সব সম্পর্কই তুইতোকারির। কিন্তু ঘুঘু যেই রাখালের সঙ্গে কথা বলছে, তাকে তুমি বলছে। উল্টোদিকে রাখাল কিন্তু বলছে তুই। আবার রাজার বাড়ির দাসী রাখালকে বলছে তুই, রাখাল তাকে বলছে তুমি। মজার কথা, তবে স্বাভাবিকই, গোটা গল্পে আপনি সম্বোধন জুটছে কেবল রানিমা আর রাজামশাই-এর!
এই ট্র্যাডিশন আজও। ফ্যালাসিটাও শুরু হয় এখান থেকেই। বাংলা খবরের কাগজে বা নিউজ চ্যানেলের ভয়েজ ওভারে দেখেছি, ছোটখাটো চোর-ছ্যাঁচোড়দের ক্ষেত্রে তুচ্ছার্থে ‘সে’, ‘তাকে’ এইসব শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অপরাধী যেই চার্লস শোভরাজ, বিন লাদেন বা দাউদ ইব্রাহিমের মতো রাঘব-বোয়াল, তখন বলা হয় ‘তিনি’, স-চন্দ্রবিন্দু ‘তাঁআঁকে’! মানে, একটি চুনোপুঁটির চেয়ে অনেক-অনেক বেশি ঘৃন্য ও মারাত্মক অপরাধে যিনি দোষী, তাঁর জন্য বরাদ্দ বেশ-খানিক সম্মান। আবার ধরা যাক, বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরেও নির্দেশ থাকে কতকটা এরকম --- ‘যা জান, লেখো’। সেই নির্দেশই বদলে যায় স্কুল সার্ভিসের মতো চাকরির পরীক্ষায় --- ‘যা জানেন, লিখুন’। এখন যে পড়ুয়াটি বিএ-তে অকথ্য ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতেই পারলেন না, পড়া-টড়া আর হবে না ভেবে এসএসসি দিয়ে চাকরির চেষ্টা করলেন --- আর যিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে ইস্কুলে ঢোকার চেষ্টা না-করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেন --- তাঁদের বৈপরীত্যটা ভাবুন। এই সিস্টেমে প্রথমজনের কপালে জুটল আপনি, আর ভাল রেজাল্ট করেও দ্বিতীয়জন পড়ে রইলেন তুমি-র ক্যাটাগরিতেই! আগে থেকেই ধরে নিয়ে সম্বোধনের ফ্যালাসি আরও আছে। ১৩৪০ সনের শ্রাবণ সংখ্যার ‘বিচিত্রা’-এ অবিকল এই বিষয়টি নিয়েই একটি বিতর্ক চলে। ব্যক্তির পোশাক-আশাকের উপর কীভাবে সম্বোধন নির্ভর করে, তা বোঝাতে শুরুতেই এক গভীর গোলমালের কথা ফাঁদেন সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বৈঠকখানার কাজ করতে করতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে --- পরিধানে পরিচ্ছন্ন ধুতি, দেহে সদ্য-ধৌত ছিটের শার্ট, পায়ে কালো রঙের বার্ণিশ করা পাম্‌প্‌ শু এবং মাথায় হাল ফ্যাশনে ছাঁটা বারো-আনা চার-আনা চুলের মধ্যে সযত্ন-রচিত টেরি। ব্যস্ত হয়ে বলি, “ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসুন?” অপরিচিত ব্যক্তির মুখে বিহ্বলতার গ্লানি ফুটে ওঠে, কুণ্ঠিত স্বরে সে বলে, “আজ্ঞে আপনাদের চাকর রাস্তা থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিলে। কে চুল ছাঁট্‌বেন।” ‘আপনি’ শব্দের অপ-প্রয়োগে বিরক্ত হয়ে উঠি। নাপিতের ক্ষৌর দ্রব্যের বাক্সটি দৃষ্টি-গোচর না হওয়াতেই এই দুর্ঘটনা!’ এমন দুর্ঘটনা আজও আমাদের জীবনে কম ঘটে না। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পরামানিককে আপনি বলাটা ‘অপপ্রয়োগ’ হতে যাবে কেন? বরং যথার্থ অপপ্রয়োগের একটি নিদর্শন তার আধঘণ্টা পরেই ঘটছে লেখকের জীবনে। ‘পদ শব্দে চেয়ে দেখি একটি লোক ঘরে ঢুকেছে, মলিন বসন, পায়ে অর্ধছিন্ন জুতা, মাথার চুল রুক্ষ। ভ্রুকুঞ্চিত ক’রে তাকিয়ে বলি, “কি চাও?” লোকটি একটু সঙ্কুচিত হয়ে বলে, “শ্যামবাজারের দিকে কাজ ছিল, এসেছিলাম, বঙ্কিম আপনাকে একখানা চিঠি দিতে দিয়েছে।” তেমনি ভুকুঞ্চিত ক’রে বলি, “কে বঙ্কিম?” লোকটি একটু বিস্মিত হয়ে বলে, “১৭ নং ঈশ্বর দত্ত লেনের বঙ্কিম সেন।” শুনে লাফিয়ে উঠি, “তাই বল! আমাদের বঙ্কিমবাবু?” লোকটি মৃদু হেসে বলে, “কিন্তু আমাদের বঙ্কিমবাবু ত নয়, আমাদের বঙ্কিমই।”’ মলিন পোশাকের এই মানুষটি যে স্বনামধন্য সাংবাদিক (‘দেশ’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক) বঙ্কিমচন্দ্র সেনের দাদা হতে পারেন, তা ভাবতেই পারেননি লেখক! তুমি-র এমন অপপ্রয়োগে তখন চূড়ান্ত ফল্‌স পজিশনে। ‘লজ্জায় কুণ্ঠায় বিমূঢ় হয়ে যাই এবং প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ‘আপনি’ সম্বোধনের ধারা বর্ষণ করতে থাকি। কিন্তু তখন তীর ছোঁড়া হয়ে গেছে, তখন আর ধনুক সাম্‌লে লাভ কি?’
সম্বোধনের এমন আরও ধাঁধা আছে অন্য জায়গাতেও। প্রশ্নটা যখন নৈকট্যের... আপনি, তুমি না তুই --- কোনটা কাছের, কোনটা দূরের? কী বলে ডাকব কাছের মানুষকে? প্রশ্নটাকে যদি আমাদের কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে ফেলি, তাহলে একটা ছবি উঠে আসে। যে সহকর্মীর সঙ্গে একেবারেই ফরম্যাল সম্পর্ক, তিনি আমার উপরে থাকুন বা নীচে, তাঁকে আমরা সচরাচর আপনি-ই বলি। একটু ঘনিষ্ঠ যাঁরা, তাঁরা তুমি। আর কলিগ হয়েও যাঁরা প্রায় জিগরি দোস্তে পর্যবসিত, ক্যান্টিন থেকে পানশালার সাথী, তাঁরা স্রেফ তুই। কিন্তু এমন সহজ একটা সমীকরণ দিয়ে কি সব অঙ্ক মেলে! আজ থেকে আধা শতক আগেও তো বাবাকে আপনি বলার রেওয়াজ ছিল। সেসব আপনি-বাবারা কি আজকের তুমি-বাবার চেয়ে খারাপ মানুষ ছিলেন, না কম শ্রদ্ধেয় বা কম ভালবাসার লোক ছিলেন? স্বামীকেও তো সেসময় আপনি বলাই ছিল স্ত্রীদের রীতি। তখনও সবচেয়ে কাছের মানুষটি কি তিনিই ছিলেন না? তুই-তুমি-আপনির চলতি কনভেনশন এসবের ব্যাখ্যা চট করে দিতে পারে না।
শুনেছি, স্লোভাক ভাষাতেও নাকি সম্বোধনের এই পার্থক্য আছে। তা অবশ্য আমাদের মতো ত্রিস্তরীয় নয়, দ্বিস্তরীয়। আপনি হল ‘ভি’ (ফরম্যাল ইউ), আর তুমি বা তুই হল ‘তি’ (ইনফরম্যাল ইউ)। সেসব দেশের অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হামেশাই দেখা যায়, পরিচয়ের দিনকয়েকের মধ্যেই পড়ুয়াদের সঙ্গে অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সম্বোধনের পরিবর্তন। শুরু হয় ‘ভি’ দিয়ে, তারপর যেসব ছাত্রছাত্রীরা অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন, তাঁদের অধিকার জন্মায় ‘তি’ ডাকের। আর আপনি নয়, সেই ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে ওই মাস্টারমশাই বা দিদিমণি তখন তুমি। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিটা অবশ্য এখনও এতটা ইনফরম্যাল নয়। তবে, নৈকট্য আর সম্বোধনের আরও আশ্চর্য এক খেলা দেখেছিলাম স্কুলজীবনে। আমাদের মফস্বলের ইস্‌কুলে গেম্‌স টিচার ছিলেন দেবজ্যোতি সাহা। ছাত্রদরদী মানুষ। প্রায়, প্রায় কেন, একেবারেই, বন্ধুর মতোই মিশতেন ছাত্রদের সঙ্গে। কোন লেফট ব্যাকের প্রেমঘটিত সমস্যা, কোন লেগ স্পিনারের পরীক্ষার হলে বসে কিচ্ছু মনে পড়ছে না, কিংবা এমনিই কোনও ল্যাদোস ছাত্র মাইনের টাকায় আলুকাবলি খেয়ে ফেলেছে --- রণে বনে জঙ্গলে এবং পরীক্ষার হলে সহায় একমাত্র তিনি! ছাত্রদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয় এই মানুষটিকে গোটা স্কুল আর ‘স্যার’ বলে ডাকত না। তাঁর ডাকনামেই হয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিচয় --- ‘বাবলুদা’। সঙ্গে, তুমি! তিনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষক, যাঁকে আপনি বলা হত না। মজাটা এখানেই। গোটা স্কুলে, ব্যাচের পর ব্যাচ এটাই রীতি থাকলেও, একটা ব্যতিক্রম ছিল। আমাদের স্কুল টিমে যারা খেলত, অর্থাৎ যারা তাঁর সবচেয়ে কাছের ছাত্র, তিনিও যাদের সবচেয়ে কাছের শিক্ষক --- তারা কিন্তু চিরকাল তাঁকে ‘স্যার’-ই বলে এল। এবং, আপনি!
আবার নৈকট্য কখনও আপনি-কে তুই-এও এনে ফেলে। শ্যামাসঙ্গীত। ‘তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি, তবে আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই’। ‘তুই নাকি মা দয়াময়ী, শুনেছি ওই লোকের মুখে’। কিন্তু, নৈকট্য গভীর গভীরতর হলে এই তুই-ই আবার বদলে যায় তুমি-তে। ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দিব্যি তুইতোকারি চলল, ওয়ান ফাইন মর্নিং হয়ে গেল তুমি! আরও কাছাকাছি আরও কাছে এসো। প্রোপোজ করার পরক্ষণ থেকেই তুমি-তুমি বললে নাকি শরীর জুড়ে শিহরণ! পুরোনো অভ্যেস বয়ে নিয়ে যাওয়াও অবশ্য বিরাট ঝক্কি; সে প্রায় সমাজবিপ্লব! মানে, প্রেমিক-প্রেমিকা যখন স্বামী-স্ত্রী, তখনও তুইতোকারি চলতে থাকলে আর রক্ষে নেই। ফুলশয্যের আগে থেকেই আত্মীয়-পড়শিদের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর শুরু! বিয়ের পর দু’জনে দু’জনকে তুমি বলতে হবে। বলতে হবে মানে, বলতেই হবে। নইলে নাকি পরস্পরকে ঠিক সম্মান দেখানো হয় না। সমাজের এসব ব্যাকরণ যে মানবে না --- সে হয় আঁতেল, নয় ঋতুপর্ণ!
অথচ জীবনের খেলা কেমন বিচিত্র --- যখন কোত্থাও আর কেউ নেই, শুধু আবেগ আর প্রবৃত্তি আছে, তখন বহু ক্ষেত্রেই বিবাহিত সম্পর্কের এসব সম্বোধন আপনা-আপনিই বদলে যায়। বন্ধুবান্ধবের ‘ওইসব’ গল্প থেকে বুঝেছি (এ তথ্যের কোনও গ্যারান্টি দিতে পারব না), এমনিতে যাঁদের তুমি-র সম্পর্ক, সেইসব ঘন সময়ে, ঘামঝরা মুহূর্তে অনেকেই পরস্পরকে তুই বলেন। তবে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমি অন্তত একটি দম্পতিকে চিনি, এমনিতে যারা তুইতোকারি চালায় কিন্তু সেইসব মাখন-সময়ে বলে ওঠে --- তুমি... তুমি...!
কাজেই, দুটো মানুষের নৈকট্য বা দুটো মানুষের দূরত্বের গায়ে প্রথামাফিক একটা করে সর্বনামের টিকিট আটকে আলাদা-আলাদা খাপে পুরে রাখা যায় না। তবু আমরা সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাই। নিয়ম আঁকড়ে থাকি। সে ডাকে কেউ অপমানিত হলেন কিনা, আমাদের ভাবতে বয়ে গেছে। সে সম্বোধন আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত কিনা, আদৌ আমরা কনসার্নড নই। বরং, ঋতুপর্ণ ঘোষ কেন সব্বাইকে তুই-তুই করতেন, কেন মুনমুন সেন-কে ‘মুনদি, তুই...’ বলতেন --- এ নিয়ে বাঙালির অনেক বেশি মাথাব্যথা। শোনা কথা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নাকি সক্কলকে আপনি বলতেন। তা নিয়েও কৌতুহল ছিল বিস্তর। অবশ্য সুনীতিবাবু নিজেই নাকি ভাষাতাত্ত্বিকের জবাব শুনিয়েছিলেন --- সম্বোধন বদলালে তো ক্রিয়াপদও বদলাতে হয়, সে বিস্তর বখেরা, তাই এক আপনি-তেই স্থির থাকা শ্রেয়! এক সময় এমনই একটা যুক্তি ছিল বটে --- ইংরেজির ইউ-এর মতোই কোনও একটি কমন সম্বোধন বাংলাতেও চালু করা। ব্যস, হলেই, তুই-তুমি-আপনি-র জটিলতা থেকে রেহাই! তখন অনেকেই সওয়াল করেছিলেন আপনি-র স্বপক্ষে। তবে, ‘বিচিত্রা’-র ওই পূর্বোক্ত বিতর্কে ভারী আশ্চর্য এক প্রস্তাব রেখেছিলেন এক লেখক। মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য ছিল, বাঙালির একমাত্র সম্বোধন-শব্দটি হোক --- ‘তাত’! তিনি লিখছেন, “‘তাত’ শব্দের অর্থ পিতা, পবিত্র ব্যক্তি ও স্নেহ পাত্র। সুতরাং সকলকে ‘তাত’ বলা চলতে পারে।”
একটিমাত্র সম্বোধন-শব্দ বাংলার ক্ষেত্রে ঘোর অবাস্তব বলেই মনে হয়। তবু যদি সত্যিই কখনও এমন হয়, এ ভাষায় সবাই সবাইকে আপনি বলছে! উকুনে বুড়ি বককে, বক নদীকে, নদী হাতিকে, হাতি গাছকে, গাছ ঘুঘুকে, ঘঘু রাখালকে...। কিন্তু সেদিনও, একজন ধর্ষকের রিফ্লেক্স কি পারবে একজন ধর্ষিতাকে আপনি বলতে? একজন ধর্ষিতাই বা অন্তর থেকে কী সম্বোধন করবেন একজন ধর্ষককে?


আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩

18 November 2013

‘সুলভ’

সুস্নাত চৌধুরী


ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ফ্রি কিংবা একটাকা
নিশিডাকেরও বাড়া হিসিডাক। ডাক এলে, জিপার-সর্বস্ব পুং, আপনি যেকোনও ওয়ালেই পোস্ট করতে পারেন। তবে, দেওয়ালে মা দুগ্গা আর বাবা লোকনাথের টাইল দেখলে ব্যক্তিগত পোস্টাপিস খুলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে ডাকঘরে। তোমার ডাকে সাড়া দিতেই, বহে গেছে...! আপনি কেগেল এক্সারসাইজের বিস্ময় বালক, উসেইনতর গতিতে পৌঁছে যাবেন ওই দূরে --- কংক্রিটের আধখাওয়া অকর্পোরেট কিউবিকলে। বলে লাভ নেই, ইটের ধাপে আপনি পা রাখতে পারবেন না; কেননা আপনার আগের জন রাখেননি। কারণ, তার আগের জনও রাখেননি। তার আগের জনও...। বিনে পয়সার পৌনপুনিকতা কাটাতে চাইলে আপনি খুঁজবেন এ এলাকায় দুর্লভ একটি সুলভ। কমপ্লেক্স তো বটেই ব্যাপারটা। তার ওপর গ্যাঁটগচ্চা আছে। খুচরোর আকালে পার্সে কয়েন না থাকলে রবিঠাকুর কয়েনই শেষ পারানির কড়ি। ‘দ্বারী মোদের চেনে না যে, বাধা দেয় পথের মাঝে, বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি, লও ভিতরে ডেকে ডেকে’। মুক্ত। ধারা।
আপনিও চেনেন না বিন্দেশ্বর পাঠককে। পদ্মভূষণ, ১৯৯১। একটাকায় মুক্তির কারিগর। আপনার ওয়াটার-লু যুদ্ধের বিরুদ্ধেই তাঁর ‘সুলভ আন্দোলন’। সেই ১৯৭০-এ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন সুলভ ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস অর্গানাইজেশন। আপনি জানেন না তিনি ডবল এমএ। পিএইচডি, ১৯৮৫, পটনা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বেচারার বিদ্যালয় হয়তো ছিল আপনারই মতো। ফার্স্ট আর ফিফ্‌থ পিরিয়ডে মিস বললে তবেই, গুটিগুটি বাথরুম যাওয়া। নইলে চেপে বসে থাকো। সেই আপনার পাবলিক টয়লেটে হাতেমাটির হাতেখড়ি। আপনার মতো এহেন চাপের ব্যাকগ্রাউন্ডই হয়তো বিন্দেশ্বরকে আন্দোলনের পথে ঠেলেছিল। কিন্তু, আপনি? বান্ধবীদের ড্রেস না তলপেটের যাতনা, কী থেকে জন্ম নিল আপনারও বিপ্লবী চেতনা? জন হেনরির হাতুড়ির মতো প্রতিবাদের ভাষায় হিজিবিজি আঁকলেন আর লিখলেন। গ্রাফিতি। ১৯৬৬-তে বার্কলের অ্যালান দুন্দে ‌যাকে ডাকলেন ‘ল্যাট্রিনালিয়া’ বলে। রেস্টরুমের আঁকিবুকি। দিন যত গড়াল, মাইনাস করার দেওয়ালে এঁকে চললেন একের পর এক ‘প্লাস’। নিজের নামের সঙ্গে জুড়তে থাকলেন সেই সব ডাকসাইটে সুন্দরীর নাম, যাঁদের বাসস্টপে তিনমিনিট, কিন্তু স্বপ্নে সারারাত দেখেছেন। আপনার যৌন একাকিত্ব ‘অমুক + তমুক’-এর নিরামিশ গ্রাফিতিতে মেশাল আমিশ মশলা। কথায়-ছবিতে সেই দেওয়াল পত্রিকায় উঠে এল স্মার্ট যৌনতার কথা। সুনির্বাচিত স্ল্যাং। কাঁচা হুমকি। আপনার চোখে তখন অবদমিত কামনার চশমা। ভেবে দেখার প্রশ্নই ওঠে না, কোন পাঠিকা বা পাঠকের জন্য এই অমর সৃষ্টি। শুধু নিজেকে একটু আড়ালে রেখে, আর-পাঁচজনের সামনে স্বরচিত রূপকথার মোরাল শোনাতে চাইছিলেন। মাঝখান থেকে সারা পৃথিবীর তাবৎ ইন্টেলেকচুয়াল সমাজবিজ্ঞানীরা হেদিয়ে পড়লেন দেওয়ালের কানে-কানে বলা সেইসব কথা আর ছবি নিয়ে। ব্যাপারটা এতদূরই এগোল আবিশ্ব, গাল পেড়ে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২০০৫-এ নাকি তাদের একটি ওপিনিয়ন কলামের নামই দিয়ে দিল How to Earn Your Pee h.D!
এত ফুটেজ খাওয়া সেই আপনিও মোক্ষম আনইজি ফিল করলেন যখন চরকসুশ্রুতধন্বন্তরীবিধানরায়তর প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হলেন স্বয়ং ডঃ ডি কে লোধ‍। টাইফয়েড-ভাইরাল-ম্যালেরিয়া-জন্ডিসে অভ্যস্ত, বড়জোর ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়ার নাম শুনেছেন। এডস-ও সই। তাবলে, বিচিত্র সব উপসর্গে অতিবিচিত্র আধা-তত্সম আধা-বিদেশি রোগের বিজ্ঞাপন! স্যরি, রোগ-উপশমেরই বিজ্ঞাপন। এসব আপনাকে তো লাজুক করে তুলবেই। তাই ইস্কুলের মতো কাটাকুটি কিংবা মেনপয়েন্ট-মেনপয়েন্ট খেলার প্রশ্নই ওঠে না। বরং আপনাকে না ‘প্যারুরেসিস’ রোগ খেয়ে ফেলে, সেদিকে লক্ষ রাখলেন আপনি। এ এক বিশেষ কিসিমের স্ফিংটেরিক ফোবিয়া। আর কেউ থাকলেই আটকে যাওয়া। হেব্বি পাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই বেরোচ্ছে না। ভাগ্যিস, এহেন প্রকাশ্য গোপনরোগের টোটকা আপনি জেনে গিয়েছিলেন! ওইখানে দাঁড়িয়ে কোনও কথা বা চোখাচোখি নয়; পারলে দু-পাশে ফাঁকা খোপ রেখে জায়গা নির্বাচন; অহেতুক দেরি নয়; কোনও ইমোশন-টিমোশন তো একেবারেই নয়। আর যদি স্মুথলি সব কিছু চলে, সেই ঝরনাতলার নির্জনে, সার্কাসের বেঁটে জোকারের মতো পিছু ফিরে নীচু হয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতেই পারেন --- একটি বুটের টোয়ের আগায় একটি শিশিরবিন্দু।


একটাকা + একটাকা = দু’টাকা
এখানে আর বসা-দাঁড়ানো লিঙ্গ বৈষম্য নেই। নারী-পুরুষ সমান-সমান। বিল গেটসও বসেই ডাউনলোড করেন। তবে, সারকথা বুঝিয়েছিলেন গোপাল ভাঁড়। ছোট কাজ না হলে বড় কাজ হয় না। তাই পার কাজ একটাকা করে মোট দু’টাকা, চলতি রেট। অবশ্য ‘ছোট বাইরে’-র নামে ঢুকে, আপনি চলে যেতেই পারেন ‘বড়’ ভেতরে! কেউ টের না পেলেই হল। খুচরো বাঁচানোর আরও পদ্ধতি আছে। ধরুন, আপনি ধর্মতলায়। ডাক এসেছে। সুলভের দিকে হাঁটবেন, নাকি স্মার্টলি সাহেব-সুবোর মতো গটগট বেগে এন্ট্রি নেবেন ওবেরয়দের গ্র্যান্ডাকঘরে? আকাচা শার্টেও আপনি এদিক-সেদিক তাকান, ঢুকে যান ওয়াশরুমে। দারোয়ান সেলাম ঠুকবে। কিংবা, বাংলায় ফিরে এসো, বাবা। আপনি নন্দন চত্বরে, খুচরো অটুট রেখে ঢুকে পড়ুন বাংলা আকাদেমির একতলায়। ঢুকে, এখনও, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও, একটু বামপন্থী হয়ে দু-পা এগোলেই, মুক্তির সন্ধান। আপনি পাঠক না-হন, ও-চত্বরে ঘোরাঘুরি যখন, লেখক-কবি-সম্পাদক কিছু তো একটা হবেনই। অতএব, বাংলা ভাষায় করা আপনার অধিকার।
যদি ভাবেন নগদে পে করে ঢুকলেও অধিকার জন্মায়, ভুল ভাবছেন। ছুটন্ত আপনি অগ্রিম দু’টাকা দিয়ে পড়িমড়ি ঢুকেছেন। গুডলাক, কোথাও কিছু ভাসছে না। নড়বড়ে ছিটকিনিটা যদিও টালিগঞ্জের সেটের মতো, ধাক্কা দিলেই যাতে খুলে যায়, সেভাবেই বানানো। তবু তাকে ম্যানেজ করে, ইজ্জত বাঁচিয়ে আপনি জাস্ট বসেছেন, একটা শান্তি আপনাকে ঘিরে ধরবে-ধরবে করছে... আআআ! সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া। ‘দাদা, আর কতক্ষণ?’ বাইরে গোটা কলকাতার একসঙ্গে পেয়েছে। দ্বার খোল, দ্বার খোল। অথবা, শৌচাগারের পাংচুয়াল কেয়ারটেকার আপনাকে জানান দিচ্ছেন, দু’টাকায় কেনা টাইম খতম। আপনি ইসবগুল নাকি সিঙ্গাপুরি, এই কোষ্ঠকঠিন পৃথিবীর তাতে থোড়াই কেয়ার। সে বিশ্বাসই করবে না, পাবলিক টয়লেট আসলে বিয়ের মতো। যারা এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে আছে, তারা চায় যেন-তেন ভেতরে ঢুকতে। সে বুঝবেই না, যারা ভেতরে আছে, তারাও মরিয়া বাইরে বেরোতে। যেন আপনি জয়রাম রমেশের দলে, শৌচাগারকেই মন্দির ভেবেছেন। উল্টে সে সতর্কীকরণ লিখে রাখবে দেওয়ালে --- নো লাউড ফিলোজফিকাল থিঙ্কিং।

তিনটাকা
চানঘর। বারাণসী-গঙ্গাসাগরের মতো স্নানের স্থানমাহাত্ম ও স্থানের স্নানমাহাত্ম এখানে নেই। এই বাথপার্টি প্রলেতারিয়েতদের। তুরস্কের কেতাদুরস্ত ‘হামাম’ বা রাশিয়ার গণস্নানঘর ‘বান্যা’-র মতো কিছু এক্সপেক্ট করা একেবারেই ভুল হবে। আপনার সুড়সুড়ি থাকলে, তা-ও এখানে মিটবে না। দিওনসুসের মন্দিরে নারী-পুরুষের নগ্নস্নান কিংবা ক্যালিগুলা-বাত্স্যায়নের দৃশ্যকল্পে গা-ভাসালেও, গা ভিজবে না। আপনার পিপিং টম দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ‘পানি মে খুদকো সমেটে হু’ গাইতে থাকা স্যাঁতস্যাতে মন্দাকিনিকে খুঁজে পাবে না। সত্যম শিবম সুন্দরম-এর ভেজা জিনাত আমান গ্রিলের ওপাশ থেকে হাস্কি গলায় বলবে না ‘মোরি চুনারিয়া লিপটি যায়ে’। কোনও হেমেন মজুমদারও তাঁর জল-রঙা ক্যানভাস এগিয়ে দেবেন না। তবু, শহরের ধুলো-ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত আপনি, শরীর আনচান করলে এখানে চান করতেই পারেন।

অনুভব করিনি, তবু বলছি
হি, শি --- ঈশ্বরের বানানো দুই রকমের জন্য দুই রকমেরই ব্যবস্থা। তবু প্রকৃতির ডাকঘরের ‘স্যানিটেশন’ পুরুষদের নয়, ছুটি না-পাওয়া মহিলাদের জন্য। একটাকা দু’টাকা তিনটাকায় সেই ডাকমাশুলের হিসেব হয় না। অনুভব করিনি, অনুমান করেছি, তাই বলছি। অনুরোধও করছি, আপনাকে কিন্তু কেউ বলেনি, ‘রক্ত দাও, স্বাধীনতা দেব’ --- তাই আপনি ফ্রি থাকতে চান থাকুন, ফ্রিডম উপভোগ করুন; কিন্তু যেখানে-সেখানে ফেলে-ছড়িয়ে আসবেন না, প্লিজ।

বেগতিক = বেগ + গতি
গতি যখন আছেই, তখন আর ‘বেগ’ মানে স্পিড নয়, ট্রাবল। হ্যাঁ, সেইসব পাবলিক টয়লেটের কথা বলছি, যখন আপনি গতিশীল, আর অনেকক্ষণ ধরে বেগ পেয়ে, এবার বেগতিক বুঝছেন। তারপর যেতে যেতে যেতে... এবং এতক্ষণ দূরপাল্লার বাসে খেতে খেতে খেতে... না, এমতাবস্থায় নদীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আপনার নেই, নদীর পাড়ে কাজ সারার প্রশ্নও নেই। বরং আপনার গন্তব্য বহরমপুর হলে কৃষ্ণনগর, দিঘা হলে মেচেদা --- এতটা পথ পেরোলে তবে হল্ট বলা যাবে। বাস থামলেই গুঁতিয়ে নামুন, পড়িমড়ি ছুটুন। কৃষ্ণনগরে সরপুরিয়া কিংবা মেচেদায় সিঙাড়ার অর্ডার দিন, সঙ্গে বিনি পয়সায় হালকা হয়ে আসুন। ব্যবস্থা এমনই, আপলোড করলে, ডাউনলোড ফ্রি।
ব্যাপারটা ট্রেনে হলে অবশ্য অন্যরকম। লোকাল ট্রেনে জার্নি যদি লম্বাতর হয়, আপনার হাতে জাস্ট কোনও অপশন নেই। সরপুরিয়াও নেই, সিঙাড়াও নেই। প্যাকেটে বাদাম বা খোসাছাড়ানো ডিমসেদ্ধর দিকেও আপনি আর লোলুপ নজরটি ফেলতে পারবেন না। কাপড়ে-চোপড়ে হওয়া থেকে বাঁচতে কোনও মতে চুপচাপ বসে, ঠায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাবতে-ভাবতে স্টেশন গুনতে লাগবেন ডিসেন্ডিং অর্ডারে। অডারে আপনার রুমাল-সর্বস্ব গোটা কম্পার্টমেন্টের কী হাল, সেদিকে না হয় ভুলেও তাকাবেন না। এ যেন জীবনের দীর্ঘতম ‌যাত্রা। গন্তব্য এলে, তারপর, সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি (কার্টসি : গোপাল ভাঁড়)! অবশ্য দূরপাল্লার ট্রেনে আপনার জন্য টোটাল অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে। ঝক্কাস! দরজায় ঘটাং-ঘট লক, চিকনাই স্টিলের কমোড (নীচে ফুটো), ঝরঝরে ফ্ল্যাশ, গুটখা-ওলা বেসিন। এখন প্রশ্ন হল একটাই, দুললে কি আপনার হয়?
কিংবা, মোশন বাড়লে কি আপনার মোশন লুজ হয়ে আসে? তাহলেও চিত্তির। বিমানে উঠলে করবেন কী! ঘনঘন যাওয়া তো বিসদৃশ ঠেকবে। আরে বাবা, মার্কিন মুলুকেই মাঝারি দরের বিমানে পঞ্চাশ জন প্রতি একটি করে ল্যাভাট্রি থাকে। লম্বা পথে অত ইয়ে ওরা ফেলবেই বা কোন চুলোয়? ট্রেনের মতো সে তো আর বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া চলে না! অবশ্য চলত এক কালে। তিরিশের দশকে বিলিতি সুপারমেরিন স্ট্র্যানরের বায়ুযানটিতে ছিল এমনই এক মুক্ত শৌচাগার। উড়তে-উড়তে তার ঢাকনাটি যখন খুলে দেওয়া হত, জন্মদিনের বেলুন ফেটে চকচকে কাগজের মতো নীচে সব ছড়িয়ে পড়ত, বাতাসের ধাক্কায় শোনা যেত একরকম শিসের আওয়াজ। সেই থেকে যানটির বদনামই হয়ে যায় --- ‘হুইসলিং শিটহাউস’। কিংবা জলপথও আপনার কিসমতে শুধু যাওয়া-আসা শুধু স্রোতে ভাসা হবে না। বাইচান্স আপনি যদি সাবমেরিনে সওয়ার হন, সে শৌচাগারটি ব্যবহার করতেই রীতিমতো একজন ইঞ্জিনায়ারকে ডাক পাঠাতে হবে! এতই নাকি জটিল তার অপারেশন। একটু ভুলচুক হলেই আপনার বাহ্যটি আর বাহ্য থাকবে না, সটান এসে মাখামাখি হবে সাবমেরিনের গায়েই। অতএব, আপনি হরাইজেন্টাল গতিতে থাকলে ভার্টিকাল বেগের কথাটা বিলক্ষণ মাথায় রাখুন।

আসুন, অন্যরকম করে করি
আসলে বলতে চাইছি, প্রকৃতির ডাক যখন, ব্যাপারটা কি মানুষের অধিকারের মধ্যেই পড়ে না? হালকা হওয়ার অধিকার। রাইট টু ফ্রি। ফ্রি-তেই তো হওয়া উচিত তবে। নিদেনপক্ষে রেটটা একটু কমুক। অন্যভাবে করুন না, মদনদা যেরকম করতে চেয়েছিলেন আরকি, বাসভাড়া না বাড়িয়ে বাসের গায়ে বিজ্ঞাপন সেঁটে দাও। অবশ্য বইমেলার মতো নয়। ‘বানান যখন ভাবায়’ শীর্ষক প্রদর্শনী। কোনওটার গায়ে লেখা --- GENTS TO LET! কোনওটার আবার --- LADIES TOY LET! এই না হলে মিলন মেলা! আমি বলছি, এসব নয়, এক্কেবারে অন্যরকম করে করুন। ধরুন, আসছে ১৯ নভেম্বর বিশ্ব শৌচাগার দিবসে টয়লেটে-টয়লেটে যদি উত্তর-আধুনিকদের ‘শক আর্ট’-এর প্রদর্শনী করা যায়। অনেকটা ২০০৮-এ নিউইয়র্কে যেমন করেছিলেন শিল্পী আন্দ্রে সেরানো। ‘শিট’ ফটোগ্রাফ এক্সিবিশন। কিংবা ১৯৬১-তে মিলানের পিয়েরো মানজোনি-র কৌটোভরা ‘আর্টিস্ট’স শিট’। ‘থার্টিগ্রাম নেট, ফ্রেশলি প্রিজার্ভড’। দেদার বিকিয়েছিল শিল্পীর সত্যি-সত্যি ক্রিয়েশন! আবার নিউজিল্যান্ডের জন কাজিনস। ১৯৮৪-তে সুরে মাতালেন এডিনবরা ফেস্টিভ্যাল। টানা সাত ঘণ্টা ধরে জল খেলেন আর লাইভ মূত্রত্যাগ করলেন সাতটি ড্রামের উপর। সা নি ধা পা মা গা রে। ভরা সন্ধ্যায় এই মূত্রশিল্পীর আশ্চর্য জলতরঙ্গ সেদিন প্রমাণ করেছিল, মানুষের ভেতরেই রয়েছে প্রকৃত হারমনি। যে শহরে জলই শোভন, জলসা এমন হতে পারে সেখানেও। এসব বাণিজ্য আরও স্ট্রেটকাট করা যায়। ১৮৭০ পর্যন্ত বিলেতে যা চলেছে। লন্ডনের স্ট্রিটকর্নার থেকে পিপে-পিপে মূত্র তোলা হত জাহাজে। তারপর জাহাজ যেত হুইটবি। ভেতরে টলটল করছে ফটকিরি তৈরির অপরিহার্য কাঁচামাল। এসব করে টু-পাইস এলে, পাবলিকের ব্লাডারে পাস্কালের সূত্রও একটু কম চাপ দিত।
আর শুধু অর্থকরী নয়, অর্থবোধকও। ১৯১৭-এ ফরাসি দাদাইস্ট মার্সেল দিউশাঁ-র আর্ট ওয়ার্ক ছিল ‘ফাউন্টেন’। স্রেফ একটা পোর্সেলেন ইউরিনালকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন স্টুডিওতে। এখন দেখার, কতটা উচ্চতায় রেখেছিলেন সেই মূত্রাধার। জলের সমোচ্চশীলতা মেনে, ঢ্যাঙা আর গেঁড়ের তো এক জায়গায় দেননি ঠাকুর! তাহলে কোন অ্যাপ্রক্সিমেশন তুলে ধরেছিল শিল্পীর চোখ? গার্নার আর গাওস্কর পাশাপাশি দাঁড়ালে কোথায় হবে গুড লেংথ? কোথাকার জল তখন কোথায় গড়াবে? এসব বিতর্কিত সময়ে, আপনি, এতক্ষণ চেপে রাখার পর, বড়জোর পুরন্দর ভাটের কবিতার ডাকে সাড়া দেবেন...

চারদিকে ছনছন
সারা গায়ে ঘিনঘিন
থই থই ছপছপ
ইউরিন! ইউরিন!

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ নভেম্বর ২০১৩