04 May 2014

ভোটের কালি

সুস্নাত চৌধুরী


ভোটের দিন তর্জনী উঁচিয়ে কথা বলা মানেই যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কিচাইন, এমনটা মোটেই নয়। ঠিকঠাক আঙুল তুললে নির্বাচন কমিশন বরং আপনাকে সাধুবাদই জানাবে। আপনার আঙুল, স্বাধীন গণতান্ত্রিক আঙুল। ভোটাধিকার প্রয়োগের সে একমাত্র প্রমাণ। ডাবল এক্সএল গণতন্ত্রের তুখোড় বিজ্ঞাপন। কারণ ততক্ষণে সেই তুলে ধরা আঙুল গৌরবের কালিমালিপ্ত। ওই একদিন কালি মাখার ব্যাপারে ফ্রম অম্বানি টু কামদুনি একই সারিতে। ভোটের লাইন। আর বাঁ হাতের তর্জনীতে জ্বলজ্বল ভোটের কালির টিপ। 
এক চুটকি ‘কালি’ কি কিমত তুম কেয়া জানো রমেশ বাবু! সেদিনের নকশাল কিংবা আজকের মাওবাদীদের দিকে আঙুল তুলেই এমন প্রশ্ন আপনি করতে পারেন ভোটের দিন। নকশাল জমানার ইনারশিয়ায় দিনযাপন করা অনেকেই নাকি বলতেন --- ‘আমি কক্ষণও আঙুলে কালি মাখিনি’। যেসব বিপ্লব দাশগুপ্তদের নির্বাচনী রাজনীতিতে অবিশ্বাসের ভূতে পেয়েছে, ভবিষ্যত তাঁদের আর বুথে পায়নি। তাঁদের কাছে ভোটের কালি মানে কলঙ্ক। ওই অম্বানি থেকে কামদুনির আপামর ব্যান্ডের বাইরে এঁদের আদর্শগত অবস্থান। অবশ্য ভোটপুজোর এই পুণ্যতিথিতে কংরেজ-তিনোমূল-ছিপিএম ছেড়ে এমন অ-কালি দলের সমর্থক আর কতজনই বা! নইলে কি আর রাজধানী দিল্লির বুকে গত বছর এতটা সাড়া ফেলতে পারত ‘রক দ্য ভোট’ ক্যাম্পেন! জেন নেক্সটকে ভোট দেওয়ার জন্য চাগাতে এম টিভি’র পরিকল্পনা --- ভোটের পর ঝিনচ্যাক লাইভ কনসার্ট। সেই অনুষ্ঠানের গেটপাসটি ছিল খাসা --- কালিমাখা তর্জনী! নিজের নিজের আঙুল দেখিয়ে ভেতরে ঢোকা। আপনার আঙুলই আপনার পরিচয়। সেখানে এক চিলতে কালির দাগ মানেই... রকিং!
ভোটের কালি। পরিভাষায় ‘ইনডেলিবল ইঙ্ক’। অনপনেয় কালি। একটুকু ছোঁয়া লাগলেই হল, মুহূর্তে গেঁড়ে বসবে দাগ। তারপর বেশ ক’দিন নট নড়নচড়ন। ছাপ্পা ভোট রুখতে, একই ব্যক্তি যাতে একাধিকবার ভোট দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে মোক্ষম দাওয়াই। ফেয়ার ইলেকশনের জন্য ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনিবার্য পথ। চলতি লোকসভা ভোটেও তাই আমার-আপনার হাতে পড়ছে এই ফেয়ার অ্যান্ড আগলি অনপনেয় কালি।

কে বানায় ভোটের কালি
জেরক্স মেশিন থেকে ফাউন্টেন পেন, চাইনিজ ইঙ্ক থেকে ভুষি --- হরেক রকম কালি আপনি বাজারে পেতে পারেন, কিন্তু মাথা কুটে মরলেও ভোটের কালির দোয়াতটি জুটবে না। খোলা বাজারে এই কালি বিক্রিই হয় না। বরাত দিয়ে বানাতে হয়। বরাতজোর থাকলেও উপযুক্ত কার্যকারণ বা সরকারি শিলমোহর না দেখাতে পারলে সে কালি আদৌ আপনার হস্তগত হবে কিনা, বলা মুশকিল। এমনকী এই কালি বানানোর অথরিটিও রয়েছে গোটা দেশে মোটে দু’একটি সংস্থার হাতেই।
তার মধ্যে প্রধান মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড। সংক্ষেপে ‘এমপিভিএল’। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ভোটের কালি নির্মাতা। এবারের লোকসভা ভোটেও সারা দেশে কালি সাপ্লাই করেছে কর্নাটকের এই সংস্থাটিই। মাইসোরের এককোণে ষোলো একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই কারখানা। ১৯৩৭ সালে মাইসোরের রাজ পরিবারের আনুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংস্থা। তখন মাইসোরের মহারাজ চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওদইয়ার। শিল্পোদ্যোগী মানুষটি ঠিক করলেন, আশপাশের জঙ্গলকে কাজে লাগিয়ে বড়সড় আকারে মোম উৎপাদন করতে হবে। এককোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতার দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হল মাইসোর ল্যাক ফ্যাক্টরি। সেই মোম উৎপাদনের ট্র্যাডিশন আজও রয়েছে। ব্যালটে ভোট হলে, সেই ব্যালটবাক্স সিল করার সময়ও এই কারখানার মোমই ব্যবহার করা হত। আজও রোজ রাতে কারখানা বন্ধের সময় তালা দিয়ে সেই তালা নিজেদের বানানো মোমেই সিল করা হয়। ১৯৪৭ সালে কর্নাটক সরকার সংস্থাটিকে অধিগ্রহণ করে। পরিণত হয় পাবলিক সেক্টরে। শুরু হয় রং উৎপাদনও। সংস্থাটির নতুন নাম হয় মাইসোর ল্যাক অ্যান্ড পেন্টস লিমিটেড। ১৯৮৯ সালে আবার কিছু পরিবর্তন। তার পর থেকে মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড নামেই সংস্থাটি পরিচিত। বর্তমানে মোম ও নানা ধরনের রং ছাড়াও পালিশ, প্রাইমার, ডিস্টেম্পার, সিন্থটিক এনামেল ইত্যাদি তৈরি হয় এখানে। রীতিমতো লাভজনক একটি পাবলিক সেক্টর। নানাবিধ গবেষণা ও খাঁটি মালই এঁদের ইউএসপি। তবে আজও সংস্থাটি সবচেয়ে বেশি লাভ করে ভোটের কালি থেকেই।
১৯৬২ সালে দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রথম ব্যবহৃত হয় ভোটের কালি। সেই শুরু ইনডেলিবল ইঙ্ক প্রস্তুতি। তারপর দেশজুড়ে লোকসভা, বিধানসভা বা স্থানীয় নির্বাচনে নিরন্তর কালি জুগিয়ে আসা। দিন যত গড়িয়েছে, ভোটার তত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লাভও। গড়পড়তা একটা হিসেব বলছে, দেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ছশো কোটি ভোটারের হাতে দাগ ফেলেছে এই কালি। আর বিদেশেও এই সংস্থার কালি হাতে-মাখা ভোটারের সংখ্যাটা কম নয় --- চল্লিশ কোটি। হ্যাঁ, বহু দেশে ভোটের কালি রফতানি হয়েছে, হচ্ছেও, এই সংস্থা থেকে। নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক, কানাডা, মায় বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় এই কালি। কখনও আবার অনুদান হিসেবেও একেবারে গণতান্ত্রিক সৌজন্যে বিনি পয়সায় এই কালি দিয়েছে ভারত। তার ঠিকানা কখনও কম্বোডিয়া, কখনও আফ্রিকার লিসুটু।

লোকসভা ২০১৪
ক’দিন আগে পর্যন্তও নাওয়া-খাওয়ার সময় পাননি মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেডের দুই শতাধিক কর্মচারি। ওভার টাইম করে সামলাতে হচ্ছিল চলতি লোকসভা ভোটের জন্য কালি তৈরির কাজ। এক দফায় এত কালি এর আগে কখনও লাগেনি। দেশে এবার মোট ভোটার একাশি কোটিরও বেশি। ওয়েস্টেজ ধরে অর্ডার ছিল প্রায় বাইশ লক্ষ কৌটো কালির। দশ মিলিলিটারের একটি পাত্রের দাম দেড়শো টাকার কাছাকাছি --- মানে, প্রায় একত্রিশ কোটি টাকার বিক্রি।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে লেগেছিল প্রায় বিশ লাখ কৌটো কালি। কৌটোগুলি ছিল এবারের মতোই দশ এমএল-এর। কিন্তু ২০০৪ সালে কালির বরাত ছিল অনেক কম। পাঁচ মিলিলিটারের ছোটো কৌটো সেবার গিয়েছিল ১৭ লাখ মাত্র। শুধু ক্রমবর্ধমান ভোটারের সংখ্যা নয়, এই হিসেব আসলে নির্ভর করে কালি লাগানোর পদ্ধতির উপর। ২০১৪-র এই লোকসভায় দশ এমএল-এর একটি কৌটো খুললে গড়ে পাঁচশো জনের হাতে কালির দাগ পড়বে বড়জোর। কিন্তু আট-ন বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না। মনে করে দেখুন, তখন ভোট দিলে তর্জনীর নখ আর ত্বকের সন্ধিস্থলে একটি আড়াআড়ি দাগ পড়ত। আর এখন পড়ে লম্বা একটি দাগ, তর্জনীর প্রথম গাঁটটির আগের চামড়া থেকে নখের উপরিভাগ পর্যন্ত। স্বভাবতই কালি লাগে বেশি। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন এই নতুন নিয়ম চালু করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯-এ কালির প্রয়োজনও তাই এক লাফে এতটা বেড়ে যায়। শুধু সময়ের সঙ্গেই নয়, রাষ্ট্রভেদেও এই হিসেব বদলায়। কারণ কালি লাগানোর পদ্ধতি একেক দেশে একেক রকম। যেমন, ভারতে কালি লাগানো হয় কাঠি জাতীয় কোনও বস্তুর সাহায্যে, আবার আফগানিস্তানেই ভোটের কালি লাগানো হয় মার্কার পেন দিয়ে। এতে কালি খরচ হয় কম। কম্বোডিয়া বা মালদ্বীপে গোটা তর্জনীর উপরিভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয় কালিতে। আফ্রিকার কোনও কোনও দেশ যেমন বুরকিনা বা বুরুন্ডিতে ভোটের কালি লাগাতে ব্যবহৃত হয় ব্রাশ। তুরস্কে নজ্‌ল থেকে কালির ফোঁটা ফেলা হয় আঙুলে।

কালির কেমিস্ট্রি
কী থাকে ভোটের কালিতে? কেন তা কিছুতেই মোছে না? গোটাটাই রসায়নের খেলা। কিন্তু ধাঁ করে পুরো ইকুয়েশনটা বলে ফেলা সম্ভব নয়! ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরি এই সিক্রেট ফরমুলা তুলে দেয় মাইসোরের ওই কালি নির্মাণকারী সংস্থার হাতে। আজও তা গোপনই রয়েছে। দু-একজন বাদে সংস্থার কর্মীরাও পুরোপুরি জানেন না, আসলে ঠিক কী করে তৈরি হয় এই কালি। তবে, সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই কালি আসলে রুপোর এক রাসায়নির পদার্থ (সিলভার নাইট্রেট বা AgNO3) আর পাতিত জলের মিক্সচার। সঙ্গে কিছুটা অ্যালকোহল, যাতে চট করে শুকিয়ে যায় কালিটি। আর থাকে বিশেষ কিছু রং। এখন এই সিলভার নাইট্রেটই হচ্ছে আসল মক্কেল! চামড়ার প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সে ফেলে বিশেষ এক প্রকার অধঃক্ষেপ, যা এক্কেবারে সেঁটে যায় চামড়ার সঙ্গে। সিলভার নাইট্রেটের আধিক্য যত বেশি থাকবে, তত টেঁকসই হবে কালি। আমাদের দেশে সচরাচর আঠেরো শতাংশের কাছাকাছি থাকে সিলভার নাইট্রেটের ঘনত্ব, তাতে হপ্তা তিনেকের জন্য নিশ্চিন্তি! আর, কালি লাগানোর পর এক ছটাক অতিবেগুনি রশ্মি যদি তার উপর পড়ে, তবে তো রুপোয় সোহাগা! বেগুনি কালি রং বদলে কালচে-বাদামি হয়ে আরও চিপকে বসে আঙুলে।
তবে ভোটের কালির রংবাজি যে শুধু বেগুনিতেই, তা নয়। রেয়ার হলেও, অন্য রঙের ভোটের কালিও দেখা যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার সুরিনেম দেশটিতে এই কালির রং কমলা। ভোটারদের আকর্ষণ করতে একদা ডাচ কলোনি সুরিনেমের জাতীয় রঙের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই এই রং বদল।

মোছে না সে মোছে না
ভোট দিয়ে বেরিয়েই আঙুল থেকে কালির দাগটি ভ্যানিশ করে দেওয়া যায় কিনা জাদুকর সরকার জানেন না, কিন্তু শরদ পাওয়ার জানেন। নইলে কেন আর খুলে আম সমর্থকদের কালি মুছে বারবার ভোট দিতে বলে কমিশনের শো-কজ খাবেন! আসলে স্যাট করে ভোটের কালি তুলে ফেলাটা একটা মিথের মতো। কোনও কেমিস্ট্রি বইতে লিখবে না, কোনও প্রাইভেট টিউটর বুঝিয়ে দেবে না, মায় ইন্টারনেটও উপরচালাকির ভ্যান্তাড়া কষবে --- শুধু মাতব্বরের মতো ঠোঁট বেঁকিয়ে হাফ-ক্যাডার বন্ধুরা চিরকাল বলে আসবে --- হয়, হয়, জানতি পারো না! ভাবখানা এমন --- জানি বিলক্ষণ, কিন্তু তোমায় বলা চলে না কাকা! কেবল নিষিদ্ধ মন্ত্রের মতো ভোটের বাতাসে ফিসফিস ঘুরে বেড়াবে কাল্পনিক সব টোটকা। কেউ বলবে, পাতি টুথপেস্ট লাগিয়ে পনেরো মিনিট রাখতে হয়, তারপর দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আলতো ঘষলেই রং হাওয়া। অথবা, খানিক দুব্বো ঘাস তুলে তার রসটুকু লাগাতে হবে, তাতেই নাকি কালির জারিজুরি শেষ! কেউ বা আরও ক্রিয়েটিভ, তাদের টোটকা কখনও পেঁপে গাছের দুধ-রস, কখনও ব্লিচিং পাওডার আর ফিনাইলের মিক্সচার! কেউ আবার ভেবেচিন্তে জানাবে, এ তো সিম্পল, এক টুকরো সিরিষ কাগজ নিয়ে বার কয়েক ঘষলেই হল! কেউ বাতলাবে প্রকৃতই সৃজনশীল উপায় --- দেশলাই কাঠি জলে ভিজিয়ে শুধু তার বারুদটুকু কালির উপর ঘষতে হবে একশো আটবার। সর্বজ্ঞের ভাবখানি দেখিয়ে কেউ বলবে, আরও আগে থেকে নাকি মাঠে নামতে হয়! মানে, ভোট দিতে যাওয়ার আগেই হাতে স্বচ্ছ নেলপালিশ বা গঁদের আঠা লাগিয়ে নিতে হবে। তাতে একটা আস্তরণ পড়ে যাবে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। তারপর ভোট দিয়ে বেরিয়ে নেলপালিশ রিমুভার দিয়ে বা এমনিই ঘষে-ঘষে তুলে ফেললেই হল। ব্যস, হাত ধুয়ে, আবার দাঁড়িয়ে যাও! তবে, রাসায়নিক ও রাজনৈতিক এসব আনফেয়ারি টেলের মোরালে ঘাপটি মেরে থাকে দু’টি জিনিস। এক : সাংবিধানিক অপরাধ। দুই : আঙুলের দফারফা।

হাতকাটা কার্তিক
ভাগ্যিস পেটো বাঁধতে গিয়ে ফুটো মস্তান কার্তিকের বাঁ হাতটি ওড়েনি, নইলে ভোট দেওয়ার আগে অহেতুক টেনশন পোহাতে হত হাতকাটা কার্তিককে। বাঁ হাতই যদি না থাকে, তাহলে কোথায় আর বাঁ হাতের তর্জনী, কোথায়ই বা ভোটের কালির দাগ! আজ্ঞে না, এসব ক্ষেত্রেও স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কারো বাঁ হাতে তর্জনী না থাকলে, কালি লাগাতে হবে বাঁ হাতেরই অন্য কোনও আঙুলে। বাঁ হাতে যদি কোনও আঙুলই না থাকে, তাহলে ডান হাতের তর্জনী। সেটিও যদি না থাকে, তবে বাছতে হবে ডান হাতের মধ্যমা থেকে শুরু করে অন্য কোনও আঙুল। সে গুড়েও বালি হলে, মানে, ভোটারের কোনও হাতেই যদি আঙুল না থাকে, তাহলে দু’টি হাতই যেভাবে আছে, সেখানেই ভালো করে মাখাতে হবে ভোটের কালি।

বিতর্কিত কালি
ভোটের কালি চট করেই উঠে যাচ্ছে --- এমন অভিযোগ মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান কি কম্বোডিয়ায় অনেকবার শোনা গিয়েছে। কখনও এর কারণ হয়েছে ভুলবশত কালি বদলে যাওয়া, কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে কালিতে ভেজাল দেওয়া। এসব চিরাচরিত বিতর্কের বাইরে ভোটের কালি নিয়ে আরও নানা বিচিত্র প্রশ্নও কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে। এবারই অন্ধ্রপ্রদেশে ৩০ মার্চ থেকে ৭ মের মধ্যে অনেকগুলি ভোট হচ্ছে। ৩০ মার্চ ১৫৬টি জায়গায় পুরভোট হয়েছে, মাঝে পঞ্চায়েত ভোট, আবার ৩০ এপ্রিল ও ৭ মে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর নির্বাচন পড়ায় অনেকেই ঘোর দুশ্চিন্তায় --- লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের আগে যদি পুর বা পঞ্চায়েত ভোটের কালি আঙুল থেকে না ওঠে, তাহলে কী হবে? আবার ২০০৮-এ মালয়েশিয়ায় ইলডেলিবল ইঙ্ক চালু করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেও, নির্বাচনের চারদিন আগে তা বাতিল করতে হয়। কারণ, শেষবেলায় চোখে পড়ে, তখনও সেদেশের সংবিধানে এই আইনটিই হয়নি যে, কারো হাতে ভোটের কালি থাকলে সে আর ভোট দিতে পারবে না! আবার জিম্বাবোয়েতে দেখা গিয়েছে, ভোটের পরে কারো হাতে কালির দাগ না থাকলে, মিলিটারিই অত্যাচার চালিয়েছে। ভোট দাওনি কি মরেছো, সিধে কথা! বাংলাদেশে দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর নাকি উলটো ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের হাতে কালির দাগ রয়েছে, তাঁদের উপরই চলেছে নির্যাতন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ছত্তীশগড়ের বহু মানুষই যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, ভোটের পর তাঁদের আঙুলে যাতে কালি না লাগানো হয়। কারণ মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে তাঁরা যে সাড়া দেননি, তা বোঝা গেলে তো কপালে ঢের দুঃখ!
হাতে রইল ভোটের কালি তার চেয়ে, সকাল সকাল ভোট দিন। আপনি পাতি ভোটার, প্রতিশ্রুতি মাফিক ভোটের পর আর কিছু পান না-পান, দু’তিন সপ্তাহের জন্য কালির গ্ল্যামারটুকু আপনার আঙুলে অ্যাসিওর্ড। ভবিষ্যতে বায়োমেট্রিকের থ্রেট আছে বটে, আধার কার্ড একদিন আঁধারে ঠেলে দিতেই পারে ভোটের কালিকে, কিন্তু সে ঢের দেরি। তার আগে আপনি দিনভর, সপ্তাহভর, ভেজাল না থাকলে মাসভর গণতন্ত্রের স্মৃতি রোমন্থন করুন। দেখুন, দেখান। আপনি কক্ষণও ভাববেন না যে গণতন্ত্র আপনাকে প্রতারক ভেবেছে, কক্ষণও ভাববেন না যে আপনি ফের এসে ভোট দিতে পারেন সন্দেহ করে আপনার আঙুলে গণতন্ত্র কালি মাখিয়েছে। সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের দোহাই দিয়ে আপনি ঘুণাক্ষরেও গুনগুন করবেন না শ্যামাসঙ্গীত --- ও মা কালী, চিরকালই সঙ সাজালি এ সংসারে! কালির দিব্যি খেয়ে আপনি কেবল ভাববেন সেই বছর চারেকের ডেঁপো ছোঁড়াটির গপ্পো। মায়ের কোল থেকেই যে হেবি রেলায় চেঁচাচ্ছিল, ‘এইযো... আমি ভোট দিয়েছি’! তার কচি হাতে তখন ইনডেলিবল ইঙ্ক। পিছনে পালস পোলিও-র ব্যানার।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে ২০১৪

15 April 2014

ছ’টা=সাড়ে ছ’টা=সাতটা

সুস্নাত চৌধুরী


কাকের ক্যাকোফোনি কানে তোলেনি বাঙালি। নইলে শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে তো কবেই সেই ভারী প্রশ্নটা করে ফেলেছিল— ‘তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?’ কিন্তু ‘কাকস্য’ পরিবেদনা! বঙ্গালি বং হল, ট্যাঁকঘড়ি থেকে মোবাইলে শিফ্ট করল, তবু তার জীবনদর্শন রয়ে গেল একই— লেট্স বি লেট! দেরি করতে সে কক্ষনও দেরি করেনি। প্রেমিকা থেকে পাওনাদার, যে কোনও কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখতে সে আর জায়গা পায়নি— রেলাভরে রেলস্টেশনের বড়ঘড়ির তলাকেই বেছে নিয়েছে। ঘাড় তুলে গোন পাগলা, কত ক্ষণ লেটে আসছি আমি! তাবৎ বাঙালির আইকনিক ওয়েটিং রুমটির মাথায় ছাদ দিয়েছে হাওড়ার বড়ঘড়ি।
ঘড়ি চিরকালই বাঙালির কবজিতে শ্রেষ্ঠ অর্নামেন্ট। দেওয়ালে সেরা শো-পিস। বাঙালির কাছে সে টোটাল হেরে গিয়েছে। নইলে কি প্রতুলচন্দ্র সরকারের সেই জাদুটির কথা বার বার বাঙালি সগর্বে স্মরণ করে! মঞ্চে পৌঁছতে সে দিন বেশ বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল পি সি সরকার সিনিয়রের। অতঃপর স্রেফ সম্মোহনের কৌশলে সময়কেও বশ করলেন তিনি। ঘড়ির কাঁটা যেন উলটো দিকে ছুটল। খানিক আগেও যারা পাংচুয়ালিটি নিয়ে সোচ্চার লেকচার ঝাড়ছিল, তাদেরও হতভম্ব হয়ে গুনগুন সলিলকি— না হে, সময় তো দেখছি এখন ঠিকই আছে! এই ম্যাজিক বাঙালি হেবি খেয়েছিল, আজও আপিসে-ইস্কুলে শুরুর ঘণ্টা বেজে গেলে নানা বাহানায় বদহজমের চোঁয়া ঢেকুর সে ভরপুর তোলে। লেট মার্ক খেয়েও বেহেলদোল স্মার্টনেসে ভাবখানা তার এমন— সে যখন মাঠে নামে, তখনই কিক-অফ! আসলে সময়কে মান্য করা নয়, মহৎ-পাতি নির্বিশেষে বাঙালি চির কাল সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। বেলা পড়ে এলেও বোকাসোকা গোপীনাথ ওস্তাদকে ভৈরবী রাগিণী গাওয়ানোর জন্য বাঙালি তার ‘স্বকাল’ নির্মাণ করে নিয়েছে। গাঁয়ের মাতব্বরদের সেই আড্ডা আসলে গড় বাঙালির মনের কথাই বলে— ‘আমার এই যষ্টির ছায়া... যত ক্ষণ না পর্যন্ত ওই প্রস্তরখণ্ড স্পর্শ করছে, তত ক্ষণ সকাল।’ আবার বেয়াড়া সুরের তাড়নায় সমবেত মশকরা পরক্ষণেই ঘোষণা করে দেয়— ‘সকাল ফুরিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল...’! ঠিক যেমন আজকের কবিয়াল গেয়ে ওঠেন— ‘ধরা যাক আজ রোববার কোনও কাজ নেই... ধরা যাক আজ রোববার কোনও তাড়া নেই...’। ক্যালেন্ডারকে তুড়ি মেরে, আপনার উইক-এন্ড বাঙালি আপনি রচনা করে। বাঙালি জাতির কাছে যদি ধরা হয় সরা, তবে রাত হবে দিন, এ আর কী কঠিন! এই ঘড়ি ধরে মারো টান ল্যাদ কি বাঙালির বাপের সম্পত্তি নয়?



ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
বাঙালি জানে, ‘পাংচুয়ালিটি’র বাংলা ‘সময়জ্ঞান’। ‘পাংচুয়ালিটি’ মানে যে আসলে ‘দায়িত্বজ্ঞান’, তা বাঙালিকে কে শেখাবে? ঔপনিবেশিক খোঁয়াড়ি তার শিরায়-স্নায়ুতে আজও নানা রূপে বহমান, কিন্তু এই জিনিসটি সে লালমুখোদের থেকে দুশো বছরেও শিখতে পারেনি। এক ‘ইউরোপীয় বাঙালি’র কাছে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন বিখ্যাত এক বাঙালি সাংবাদিক। পটভূমি বিলেত। হোটেল থেকে বেরিয়ে সেই বাঙালির বাড়িতে পৌঁছতে পাঁচ মিনিট মোটে লেট হয়েছিল সাংবাদিকের। নক করার পর, সে দিনের মতো নক আউট হয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল— দরজার ও-পারে যাওয়ার আর অধিকার মেলেনি। আবার পর দিন। এ বার আধ ঘণ্টা আগে পৌঁছে উনত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করে তবে কলিং বেলে হাত ছোঁয়ান ওই সাংবাদিক। প্রবেশাধিকার মেলে। সাক্ষাৎকার দিতে সে দিন নাকি আর কোনও বেগড়বাঁই করেননি নীরদ সি চৌধুরী!
জাপানে গিয়েও নাকি ভারী বিড়ম্বনায় পড়েছিল এক বাঙালি। অচেনা দেশে ঠিক জায়গায় নামতে যাতে সমস্যা না হয়, তাই ট্রেনে ওঠার আগেই সে জানতে চাইল, অমুক স্টেশনে তাকে নামতে হবে, তো তার আগের স্টেশনের নামটি কী? অবাক কণ্ঠে ছুটে এল স্পষ্ট জবাব, পাঁচটা তেইশে যেখানে ট্রেন দাঁড়াবে, সেখানে নামতে হবে। সে যতই জিজ্ঞেস করে, আগের স্টেশনের নাম কী, ততই উত্তর আসে, পাঁচটা তেইশ। পাঁচটা তেইশ অবধি অপেক্ষা করে বাঙালি বাবুটি ঠাওর করেছিল, পাংচুয়ালিটি কারে কয়! রোজকার মতোই ঠিক তখনই ওই স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল ট্রেন। অতঃপর বাঙালি নামে। জাপানিরা ওঠে।
অথচ বাঙালির শহুরে রূপকথা মেট্রো রেলও আজ পাঁচ-দশ মিনিট অন্তরই ডিজিটাল বোর্ডে তার নীল আর হলুদ সময়ের তুলনা দিয়ে জাহির করে, এই দু-এক দশকেই সে কত্তখানি বাঙালি হয়ে গিয়েছে! শিয়ালদা-ডানকুনি লাইনে ডেলি প্যাসেঞ্জারির সূত্রেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি এক বিচিত্র টাইমটেব্ল পকেটে রাখতেন। নিজেরই বানানো। তাতে প্রতিটি ট্রেনের নম্বরের পাশে লেখা থাকত, আসলে ওই ট্রেনটি গড়পড়তা য’টা নাগাদ আসে, সেই সময়টি! বলা ভাল, টাইমটেব্লের প্যারডি। এখন প্রশ্ন হল, কোনটি প্যারডি, আর কোনটি অরিজিনাল!
ট্রেনের স্টেশনে ঢুকতে, দিদিমণির ক্লাসে ঢুকতে, গবেষকের সেমিনারে ঢুকতে, কেরানির আপিসে ঢুকতে... সব রকমের ঢোকাঢুকির ক্ষেত্রেই এই যে বাড়তি সময়টুকু, বাঙালির কাছে টেক্ন ফর গ্র্যান্টেড। বছর পনেরো আগের কথা। সন্ধে ছ’টা থেকে কলকাতার এক মঞ্চে সে দিন একটি বাংলা ব্যান্ডের অনুষ্ঠান। কী করে কে জানে, একেবারে যথাসময়েই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সোয়া ছ’টা নাগাদ হঠাৎই গেটের মুখে জোর বাওয়াল! ব্যান্ডেরই এক সদস্যের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড় দশ-বারো জন দর্শকের। তাঁদের অভিযোগ, কেন শুরু হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠান? ব্যান্ড-সদস্য জানান, কার্ডেই তো সময় লেখা রয়েছে: ছ’টা। বিক্ষুব্ধ দর্শকদেরও তখন বক্তব্য সেটাই— ‘আরে দাদা, সেই তো বলছি! পরিষ্কার লেখা রয়েছে, সন্ধে ছ’টায় প্রোগ্রাম। আর এখন সবে সোয়া ছ’টা, শুরু হয়ে গেল?’
‘আই এস টি’ মানে আজ বাঙালির অভিধানে— ইন্ডিয়ান স্ট্রেচেব্ল টাইম! ‘ডেডলাইন’ মানে জাঙিয়ার ইলাস্টিক। বাঙালি-শ্রেষ্ঠ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কি ‘সময়জ্ঞান’ কনসেপ্টটিকে খোঁটা দেননি ‘অন্ত্যেষ্টি-সৎকার’ নাটিকায়? মৃত্যুশয্যায় বাবা। আশা-মাফিক যথাসময়ে তাঁর দেহান্ত হচ্ছে না দেখে, ছেলে গোটা বাঙালি জাতিকেই দুষছে— ‘মরবে তবু পাংচুয়াল হবে না।’ ‘লিপিকা’র ‘ভুল স্বর্গ’ রচনাটিতেও রবীন্দ্রনাথ কাক্কেশ্বরকে কাউন্টার করছেন। লিখছেন, ‘সবাই বলে, ‘সময়ের মূল্য আছে।’ কেউ বলে না, ‘সময় অমূল্য।’ আমবাঙালি অবশ্য সময় নিয়ে এই দর কষাকষিতে নেই। সময় তার কাছে সারা বছরের চৈত্র সেল। ফ্রি। মাগনা।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিল ২০১৪