03 August 2014

-498A

সুস্নাত চৌধুরী


এই কথা বললে, শুধু ফেমিনিস্টরাই নন, লোকাল ট্রেনের মেল শভিনিস্ট ডেলি প্যাসেঞ্জাররাও হাঁ হাঁ করে উঠবেন। কিন্তু তথ্য বলছে, বছরের পর বছর ধরে এ দেশে যতগুলি বধূ নির্যাতনের মামলা হয়, তার প্রায় চোদ্দো আনার ক্ষেত্রেই অভিযোগ কিচ্ছুটি প্রমাণ করা যায় না। বেশির ভাগটাই নাকি ভুয়ো! স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অপদস্থ করার কৌশল। অথচ ১৯৮৩ সালে এই আইনের জন্মই তো হয়েছিল বরপণের দাঁত-নখ থেকে গৃহবধূদের রক্ষা করতে। তা হলে ব্যাপারটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল কী করে? আইনি পরিভাষায় এ আইনটি ‘অ-জামিনযোগ্য’, মানে, আদালতে হাজিরা না দিলে জামিনের আবেদন করা যায় না। এবং ‘কগ্নিজেবল’, অর্থাৎ কিনা অভিযুক্তকে জেলে পুরতে হলে আদালতের নির্দেশ বা নিদেনপক্ষে কোনও প্রাথমিক তদন্ত কিংবা ওয়ারেন্টেরও ধার ধারতে হয় না পুলিশকে। স্রেফ তোলো, আর পোরো! এই ‘সোজা’ রাস্তাটিকেই কাজে লাগাতে থাকলেন বহু ভদ্দরমহিলা। চোখে তাঁদের গ্লিসারিন— ‘সাজা’ মানে তো আর শুধু ‘পানিশমেন্ট’ নয়, ‘মেক-আপ’ও বটে! ব্যাপারটা এতটাই ব্যাপক যে, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টকে রায় দিতে হয়েছে, ৪৯৮এ ধারায় বধূ নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া মাত্রই পুলিশ আর হুটহাট অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে না। আগে প্রাথমিক তদন্ত করে দেখতে হবে গ্রেফতার করা আদৌ জরুরি কি না। এক দিন যা ঢাল ছিল, আজ যে তা অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বীকার করছে খাস সুপ্রিম কোর্ট। বছর নয়েক আগেও দেশের শীর্ষ আদালত এই আইনকে ‘লিগাল টেররিজ্ম’ আখ্যা দিয়েছিল। দেশের বহু হাইকোর্টেও বার বার সমালোচিত ৪৯৮এ-র ক্রমবর্ধমান এই অপব্যবহার।

ছবি: সুমন চৌধুরী
দেশে বা এই রাজ্যে আজও বহু নারীই যে চার দেওয়ালের আড়ালে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির হাতে প্রবল লাঞ্ছিত অত্যাচারিত হন, তা চরম সত্য। কিন্তু তার মানেই তো এটা হতে পারে না যে, সব স্বামীই প্রেম চোপড়া আর সব স্ত্রীই নিরুপা রায়। ভারত সরকারের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত বছর এ দেশে গড়ে প্রতি ৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে এক জন করে স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৩ সালে ভারতে বিবাহিত পুরুষের আত্মহত্যার সংখ্যা আত্মঘাতী বিবাহিত মহিলার দ্বিগুণেরও বেশি। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার অনুপাতটাও প্রায় একই রকম। গত বছর ২১,০৯৬ জন পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন কেবল পারিবারিক ঝামেলা থেকে চিরমুক্তি পেতে। পাশাপাশি, একই কারণে আত্মঘাতী মহিলা ১১,২২৯ জন। সব ক’টি আত্মহত্যাই দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এই তথ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পুরুষও কোনও অংশে কম চাপে নেই। থাকার কথাও কি ছিল?
৪৯৮এ-র রাস্তায় হাঁটা কী হারে বাড়ছে, ২০১২ আর ২০১৩ সালের তুলনাই তা বলে দেয়। মাত্র এক বছরে বৃদ্ধির হার ১১.৫%-এরও বেশি। সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গেই। অথচ এ রাজ্যে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে মাত্র ২.৩% ক্ষেত্রে। গোটা দেশেই, বিগত বছরগুলির মতো ২০১৩ সালেও, এই ধারায় বেশির ভাগ মামলারই কোনও গতি হয়নি। দেশ জুড়ে দোষী সাব্যস্ত করা গিয়েছে মাত্র ১৬% ক্ষেত্রে।
এ কথা হয়তো সত্যি যে, আজও অনেক নির্যাতিতাই ৪৯৮এ-র নামটুকুও শোনেননি। অনেকে থানা-পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারেন না। কিংবা ৪৯৮এ দায়ের করলেও চার দেওয়ালের অন্ধকারে ঘটে চলা অত্যাচার প্রমাণ করাও সব সময় সহজ হয় না; মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে তো আরওই নয়। কিন্তু তাতে তো ভুয়ো মামলাকারী ধান্দাবাজ স্ত্রীদের অস্তিত্বটা মুছে যায় না। শাস্তি না চেয়ে সুরক্ষা চাইলে, অনেকে তো ৪৯৮এ-র বদলে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আইনেও মামলা করতে পারতেন। অনেকে তো ঝক্কি পুইয়ে মামলাটুকুও আর করেন না— এই ৪৯৮এ ঠুকলেন বলে— স্রেফ এমন থ্রেট-এর উপর শ্বশুরবাড়িকে রেখেই কাজ হাসিল করেন। ‘নন বেলেব্ল’ আর ‘কগ্নিজেবল’-এর সাঁড়াশি আক্রমণকে অস্ত্র বানিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে ‘দু’দিনের শ্বশুরবাড়ি’ থেকে মওকা বুঝে মোটা অঙ্ক হাতিয়ে নেওয়া, কোনও অবৈধ সম্পর্ক ফাঁস হয়ে গেলে পালটা চাপ সৃষ্টি, প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে ডিভোর্সের পথ সুগম করা, স্বামীকে তার বাপ-মা’কে ছেড়ে আলাদা সংসার পাততে বাধ্য করা, কিংবা বিবাহপূর্ব অসুস্থতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত কোনও গোপন সত্য প্রকাশ হয়ে গেলে তার পালটা— এমন হরেক কারণই নাকি ৪৯৮এ অপব্যবহারের নেপথ্যে থাকে, বলছে এ নিয়ে কাজ করা একাধিক এনজিও। এমনকী স্রেফ ৪৯৮এ কাজে লাগাবেন অদূর ভবিষ্যতে, এমন মতলবেও নাকি ইদানীং কোনও কোনও মহিলা বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন।
কলকাতার হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং ‘পীড়িত পুরুষ পতি পরিষদ’-এর কর্ণধার রাধিকানাথ মল্লিকের বক্তব্য এ বিষয়ে একই। তাঁদের সাফ কথা— আর পাঁচটা আইনের সঙ্গে ৪৯৮এ-কে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এই আইনের সঙ্গে সমাজ জড়িয়ে, পরিবার জড়িয়ে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বহু নির্দোষ স্বামী। মিথ্যে অভিযোগে তাঁর নিকটজনেরাও সমান ভাবে হেনস্থা হচ্ছেন। জেল খাটছেন, চাকরি খোয়াচ্ছেন, অপমানে ধ্বস্ত হচ্ছেন, কেউ বা এ জীবনটাই শেষ করে দিচ্ছেন। বৃদ্ধ, শিশু, এমনকী পরিবারের অন্য মহিলারাও পার পাচ্ছেন না। শুধু ২০১৩ সালেই ৪৭,৪৭১ জন মহিলা গ্রেফতার হয়েছেন এই আইনে। কারাবাসী সেই ননদটির কথা ভাবুন, এক দিন যে নতুন বউদির দিকে সৌজন্যের হাতই বাড়িয়ে দিয়েছিল। হয়তো সামনেই তার বিয়ে, কথা চলছে। কিংবা একটা চাকরির কল আসার প্রতীক্ষায় সে। এ বার সেই স্বপ্নমাখা ভবিষ্যতে বেশ খানিকটা অন্ধকারই গাঢ় হয়ে এল না? বহু ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি যে কষ্ট পাচ্ছে, সে একটি শিশু, নিজেরই সন্তান। শুধু তাই নয়, সামগ্রিক ভাবে কলুষিত হচ্ছে দেশের আইনব্যবস্থা। গুচ্ছের ভুয়ো কেসের ঠেলায় আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, অহেতুক দীর্ঘায়িত হচ্ছে অনেক ‘সত্যিকারের’ বধূ নির্যাতনের মামলা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ ঘোষণা করেছে, এ দেশে বয়স্কদের নিগ্রহের অন্যতম বড় কারণ ৪৯৮এ-র অপব্যবহার। মার্কিন প্রশাসন, কানাডা প্রশাসন আজ তাঁদের নাগরিকদের এই আইনের ‘ব্যথা’ মনে করিয়ে সতর্ক করছে, দু’বার ভেবে দেখতে বলছে, কোনও ভারতীয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার আগে!
এখন ‘সেভ বেঙ্গলি ফ্যামিলি’-র মতো সংস্থা বলছে পরিবার বাঁচিয়ে রাখার কথা। ভুয়ো ৪৯৮এ-র শিকার অসহায় স্বামীদের পাশে দাঁড়াতে মাস কয়েক আগেই মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে ‘সেভ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি’-র কলকাতা শাখা ‘হৃদয়— নেস্ট অব ফ্যামিলি হারমনি’। আইনি পরামর্শ পেতে দেশের ৫০টি শহরের ৫০টি এনজিও-র তথ্য সেখানে মিলবে। অনলাইন পরামর্শ, এ সংক্রান্ত যাবতীয় খবরাখবর কিংবা ভুয়ো ৪৯৮এ-র ভুক্তভোগীদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছে www.498a.org। হয়তো এই সব পুং-সংস্থার কিছু বক্তব্য যুক্তিরহিত ভাবেই তীব্র নারীবিদ্বেষী ঠেকবে, কিন্তু গোটাটাই যে লিঙ্গ-পক্ষপাতের অসারতায় পূর্ণ, এমনটাও নয়।
এত এত ভুয়ো ৪৯৮এ দায়ের হওয়ার নেপথ্যে দুষ্ট মহিলাদের হাত নেই— এমন একটা ‘প্রায়-স্বতঃসিদ্ধ’ ঝুড়ি-কোদাল সহযোগে প্রমাণে নারীবাদী সমাজকর্মী ও আইনজীবী ফ্লেভিয়া অ্যাগনেস-এর মন্তব্য প্রায়শই উদ্ধৃত হয়— নিম্ন আদালতের কিছু উকিল ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশই নাকি ৪৯৮এ ব্যবহারে মূল কালপ্রিট। আবার একই সঙ্গে যুক্তি দেওয়া হয়— ৪৯৮এ-র ক্ষেত্রে চার্জশিট দেওয়ার মাত্রা যথেষ্ট উচ্চ, মানে, পুলিশ তদন্ত চালিয়ে অভিযোগ যথাযথ মনে করেছে এবং চার্জশিট দিয়েছে। অর্থাৎ, একই পুলিশ যুগপৎ সৎ ও অসৎ! শ্রডিংগারের বেড়ালের মতো এখানে দুর্বোধ্য কোয়ান্টাম ফিজিক্স কাজ করতে পারে, ৪৯৮এ পারে কি!
অতঃ কিম? বিবাহের ঠিক পরেই যে স্বামীটি মনেপ্রাণে বাঁচতে চেয়েও ধনেপ্রাণে মরতে বসে, তাকে অক্সিজেন দেবার উপায়? তার সব বুকে-ব্যথা তো গ্যাস অম্বল থেকে হয়নি— কিছু বেদনার জন্ম প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকে আসা আকস্মিক আঘাতে, কিছু বা তজ্জনিত হার্ট অ্যাটাকে! কেউ বলছেন, ‘৪৯৮বি’ নামে পুরুষের অধিকার নিয়ে আইন প্রণয়ন হোক। বিচারপতি মলিমথ কমিটি পরামর্শ দিয়েছে, ৪৯৮এ-কে জামিনযোগ্য (বেলেব্ল) ও মীমাংসাযোগ্য (কম্পাউন্ডেব্ল) করার। আইনটিকে আগাগোড়া ঠান্ডাঘরে পাঠাতেও চাইছেন অনেকে। কেউ বলছেন, ৪৯৮এ থাকুক, কিন্তু বদলাক— এ ধারায় মামলা করার আগে বাধ্যতামূলক করা হোক কাউন্সেলিং। তাঁরা একমত, সময় বদলেছে, যুগের সঙ্গে আইনেরও বদল দরকার— পারস্পরিক কলহের কেন্দ্রে আজ আর শুধু পণের গয়না কি ক্যাশটুকুই নেই— চ্যাট আছে, ফেসবুকও আছে। আসলে, আমাদের বোঝার সময় এসেছে— আইপিসি ৪৯৮এ সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়।
আর, একটু মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে— গত শতকের শেষ দিকে মার্কিন সমাজকর্মী ওয়ারেন ফ্যারেল-এর ঠাট্টা-ছলে বলা খাঁটি কথাটির প্রতি: In the past quarter century, we exposed biases against other races and called it racism, and we exposed biases against women and called it sexism. Biases against men we call humor.

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ আগস্ট ২০১৪

04 May 2014

ভোটের কালি

সুস্নাত চৌধুরী


ভোটের দিন তর্জনী উঁচিয়ে কথা বলা মানেই যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কিচাইন, এমনটা মোটেই নয়। ঠিকঠাক আঙুল তুললে নির্বাচন কমিশন বরং আপনাকে সাধুবাদই জানাবে। আপনার আঙুল, স্বাধীন গণতান্ত্রিক আঙুল। ভোটাধিকার প্রয়োগের সে একমাত্র প্রমাণ। ডাবল এক্সএল গণতন্ত্রের তুখোড় বিজ্ঞাপন। কারণ ততক্ষণে সেই তুলে ধরা আঙুল গৌরবের কালিমালিপ্ত। ওই একদিন কালি মাখার ব্যাপারে ফ্রম অম্বানি টু কামদুনি একই সারিতে। ভোটের লাইন। আর বাঁ হাতের তর্জনীতে জ্বলজ্বল ভোটের কালির টিপ। 
এক চুটকি ‘কালি’ কি কিমত তুম কেয়া জানো রমেশ বাবু! সেদিনের নকশাল কিংবা আজকের মাওবাদীদের দিকে আঙুল তুলেই এমন প্রশ্ন আপনি করতে পারেন ভোটের দিন। নকশাল জমানার ইনারশিয়ায় দিনযাপন করা অনেকেই নাকি বলতেন --- ‘আমি কক্ষণও আঙুলে কালি মাখিনি’। যেসব বিপ্লব দাশগুপ্তদের নির্বাচনী রাজনীতিতে অবিশ্বাসের ভূতে পেয়েছে, ভবিষ্যত তাঁদের আর বুথে পায়নি। তাঁদের কাছে ভোটের কালি মানে কলঙ্ক। ওই অম্বানি থেকে কামদুনির আপামর ব্যান্ডের বাইরে এঁদের আদর্শগত অবস্থান। অবশ্য ভোটপুজোর এই পুণ্যতিথিতে কংরেজ-তিনোমূল-ছিপিএম ছেড়ে এমন অ-কালি দলের সমর্থক আর কতজনই বা! নইলে কি আর রাজধানী দিল্লির বুকে গত বছর এতটা সাড়া ফেলতে পারত ‘রক দ্য ভোট’ ক্যাম্পেন! জেন নেক্সটকে ভোট দেওয়ার জন্য চাগাতে এম টিভি’র পরিকল্পনা --- ভোটের পর ঝিনচ্যাক লাইভ কনসার্ট। সেই অনুষ্ঠানের গেটপাসটি ছিল খাসা --- কালিমাখা তর্জনী! নিজের নিজের আঙুল দেখিয়ে ভেতরে ঢোকা। আপনার আঙুলই আপনার পরিচয়। সেখানে এক চিলতে কালির দাগ মানেই... রকিং!
ভোটের কালি। পরিভাষায় ‘ইনডেলিবল ইঙ্ক’। অনপনেয় কালি। একটুকু ছোঁয়া লাগলেই হল, মুহূর্তে গেঁড়ে বসবে দাগ। তারপর বেশ ক’দিন নট নড়নচড়ন। ছাপ্পা ভোট রুখতে, একই ব্যক্তি যাতে একাধিকবার ভোট দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে মোক্ষম দাওয়াই। ফেয়ার ইলেকশনের জন্য ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনিবার্য পথ। চলতি লোকসভা ভোটেও তাই আমার-আপনার হাতে পড়ছে এই ফেয়ার অ্যান্ড আগলি অনপনেয় কালি।

কে বানায় ভোটের কালি
জেরক্স মেশিন থেকে ফাউন্টেন পেন, চাইনিজ ইঙ্ক থেকে ভুষি --- হরেক রকম কালি আপনি বাজারে পেতে পারেন, কিন্তু মাথা কুটে মরলেও ভোটের কালির দোয়াতটি জুটবে না। খোলা বাজারে এই কালি বিক্রিই হয় না। বরাত দিয়ে বানাতে হয়। বরাতজোর থাকলেও উপযুক্ত কার্যকারণ বা সরকারি শিলমোহর না দেখাতে পারলে সে কালি আদৌ আপনার হস্তগত হবে কিনা, বলা মুশকিল। এমনকী এই কালি বানানোর অথরিটিও রয়েছে গোটা দেশে মোটে দু’একটি সংস্থার হাতেই।
তার মধ্যে প্রধান মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড। সংক্ষেপে ‘এমপিভিএল’। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ভোটের কালি নির্মাতা। এবারের লোকসভা ভোটেও সারা দেশে কালি সাপ্লাই করেছে কর্নাটকের এই সংস্থাটিই। মাইসোরের এককোণে ষোলো একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই কারখানা। ১৯৩৭ সালে মাইসোরের রাজ পরিবারের আনুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংস্থা। তখন মাইসোরের মহারাজ চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওদইয়ার। শিল্পোদ্যোগী মানুষটি ঠিক করলেন, আশপাশের জঙ্গলকে কাজে লাগিয়ে বড়সড় আকারে মোম উৎপাদন করতে হবে। এককোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতার দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হল মাইসোর ল্যাক ফ্যাক্টরি। সেই মোম উৎপাদনের ট্র্যাডিশন আজও রয়েছে। ব্যালটে ভোট হলে, সেই ব্যালটবাক্স সিল করার সময়ও এই কারখানার মোমই ব্যবহার করা হত। আজও রোজ রাতে কারখানা বন্ধের সময় তালা দিয়ে সেই তালা নিজেদের বানানো মোমেই সিল করা হয়। ১৯৪৭ সালে কর্নাটক সরকার সংস্থাটিকে অধিগ্রহণ করে। পরিণত হয় পাবলিক সেক্টরে। শুরু হয় রং উৎপাদনও। সংস্থাটির নতুন নাম হয় মাইসোর ল্যাক অ্যান্ড পেন্টস লিমিটেড। ১৯৮৯ সালে আবার কিছু পরিবর্তন। তার পর থেকে মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড নামেই সংস্থাটি পরিচিত। বর্তমানে মোম ও নানা ধরনের রং ছাড়াও পালিশ, প্রাইমার, ডিস্টেম্পার, সিন্থটিক এনামেল ইত্যাদি তৈরি হয় এখানে। রীতিমতো লাভজনক একটি পাবলিক সেক্টর। নানাবিধ গবেষণা ও খাঁটি মালই এঁদের ইউএসপি। তবে আজও সংস্থাটি সবচেয়ে বেশি লাভ করে ভোটের কালি থেকেই।
১৯৬২ সালে দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রথম ব্যবহৃত হয় ভোটের কালি। সেই শুরু ইনডেলিবল ইঙ্ক প্রস্তুতি। তারপর দেশজুড়ে লোকসভা, বিধানসভা বা স্থানীয় নির্বাচনে নিরন্তর কালি জুগিয়ে আসা। দিন যত গড়িয়েছে, ভোটার তত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লাভও। গড়পড়তা একটা হিসেব বলছে, দেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ছশো কোটি ভোটারের হাতে দাগ ফেলেছে এই কালি। আর বিদেশেও এই সংস্থার কালি হাতে-মাখা ভোটারের সংখ্যাটা কম নয় --- চল্লিশ কোটি। হ্যাঁ, বহু দেশে ভোটের কালি রফতানি হয়েছে, হচ্ছেও, এই সংস্থা থেকে। নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, পাপুয়া নিউ গিনি, ফিজি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক, কানাডা, মায় বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় এই কালি। কখনও আবার অনুদান হিসেবেও একেবারে গণতান্ত্রিক সৌজন্যে বিনি পয়সায় এই কালি দিয়েছে ভারত। তার ঠিকানা কখনও কম্বোডিয়া, কখনও আফ্রিকার লিসুটু।

লোকসভা ২০১৪
ক’দিন আগে পর্যন্তও নাওয়া-খাওয়ার সময় পাননি মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেডের দুই শতাধিক কর্মচারি। ওভার টাইম করে সামলাতে হচ্ছিল চলতি লোকসভা ভোটের জন্য কালি তৈরির কাজ। এক দফায় এত কালি এর আগে কখনও লাগেনি। দেশে এবার মোট ভোটার একাশি কোটিরও বেশি। ওয়েস্টেজ ধরে অর্ডার ছিল প্রায় বাইশ লক্ষ কৌটো কালির। দশ মিলিলিটারের একটি পাত্রের দাম দেড়শো টাকার কাছাকাছি --- মানে, প্রায় একত্রিশ কোটি টাকার বিক্রি।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে লেগেছিল প্রায় বিশ লাখ কৌটো কালি। কৌটোগুলি ছিল এবারের মতোই দশ এমএল-এর। কিন্তু ২০০৪ সালে কালির বরাত ছিল অনেক কম। পাঁচ মিলিলিটারের ছোটো কৌটো সেবার গিয়েছিল ১৭ লাখ মাত্র। শুধু ক্রমবর্ধমান ভোটারের সংখ্যা নয়, এই হিসেব আসলে নির্ভর করে কালি লাগানোর পদ্ধতির উপর। ২০১৪-র এই লোকসভায় দশ এমএল-এর একটি কৌটো খুললে গড়ে পাঁচশো জনের হাতে কালির দাগ পড়বে বড়জোর। কিন্তু আট-ন বছর আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না। মনে করে দেখুন, তখন ভোট দিলে তর্জনীর নখ আর ত্বকের সন্ধিস্থলে একটি আড়াআড়ি দাগ পড়ত। আর এখন পড়ে লম্বা একটি দাগ, তর্জনীর প্রথম গাঁটটির আগের চামড়া থেকে নখের উপরিভাগ পর্যন্ত। স্বভাবতই কালি লাগে বেশি। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন এই নতুন নিয়ম চালু করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯-এ কালির প্রয়োজনও তাই এক লাফে এতটা বেড়ে যায়। শুধু সময়ের সঙ্গেই নয়, রাষ্ট্রভেদেও এই হিসেব বদলায়। কারণ কালি লাগানোর পদ্ধতি একেক দেশে একেক রকম। যেমন, ভারতে কালি লাগানো হয় কাঠি জাতীয় কোনও বস্তুর সাহায্যে, আবার আফগানিস্তানেই ভোটের কালি লাগানো হয় মার্কার পেন দিয়ে। এতে কালি খরচ হয় কম। কম্বোডিয়া বা মালদ্বীপে গোটা তর্জনীর উপরিভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয় কালিতে। আফ্রিকার কোনও কোনও দেশ যেমন বুরকিনা বা বুরুন্ডিতে ভোটের কালি লাগাতে ব্যবহৃত হয় ব্রাশ। তুরস্কে নজ্‌ল থেকে কালির ফোঁটা ফেলা হয় আঙুলে।

কালির কেমিস্ট্রি
কী থাকে ভোটের কালিতে? কেন তা কিছুতেই মোছে না? গোটাটাই রসায়নের খেলা। কিন্তু ধাঁ করে পুরো ইকুয়েশনটা বলে ফেলা সম্ভব নয়! ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরি এই সিক্রেট ফরমুলা তুলে দেয় মাইসোরের ওই কালি নির্মাণকারী সংস্থার হাতে। আজও তা গোপনই রয়েছে। দু-একজন বাদে সংস্থার কর্মীরাও পুরোপুরি জানেন না, আসলে ঠিক কী করে তৈরি হয় এই কালি। তবে, সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই কালি আসলে রুপোর এক রাসায়নির পদার্থ (সিলভার নাইট্রেট বা AgNO3) আর পাতিত জলের মিক্সচার। সঙ্গে কিছুটা অ্যালকোহল, যাতে চট করে শুকিয়ে যায় কালিটি। আর থাকে বিশেষ কিছু রং। এখন এই সিলভার নাইট্রেটই হচ্ছে আসল মক্কেল! চামড়ার প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সে ফেলে বিশেষ এক প্রকার অধঃক্ষেপ, যা এক্কেবারে সেঁটে যায় চামড়ার সঙ্গে। সিলভার নাইট্রেটের আধিক্য যত বেশি থাকবে, তত টেঁকসই হবে কালি। আমাদের দেশে সচরাচর আঠেরো শতাংশের কাছাকাছি থাকে সিলভার নাইট্রেটের ঘনত্ব, তাতে হপ্তা তিনেকের জন্য নিশ্চিন্তি! আর, কালি লাগানোর পর এক ছটাক অতিবেগুনি রশ্মি যদি তার উপর পড়ে, তবে তো রুপোয় সোহাগা! বেগুনি কালি রং বদলে কালচে-বাদামি হয়ে আরও চিপকে বসে আঙুলে।
তবে ভোটের কালির রংবাজি যে শুধু বেগুনিতেই, তা নয়। রেয়ার হলেও, অন্য রঙের ভোটের কালিও দেখা যায়। যেমন লাতিন আমেরিকার সুরিনেম দেশটিতে এই কালির রং কমলা। ভোটারদের আকর্ষণ করতে একদা ডাচ কলোনি সুরিনেমের জাতীয় রঙের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই এই রং বদল।

মোছে না সে মোছে না
ভোট দিয়ে বেরিয়েই আঙুল থেকে কালির দাগটি ভ্যানিশ করে দেওয়া যায় কিনা জাদুকর সরকার জানেন না, কিন্তু শরদ পাওয়ার জানেন। নইলে কেন আর খুলে আম সমর্থকদের কালি মুছে বারবার ভোট দিতে বলে কমিশনের শো-কজ খাবেন! আসলে স্যাট করে ভোটের কালি তুলে ফেলাটা একটা মিথের মতো। কোনও কেমিস্ট্রি বইতে লিখবে না, কোনও প্রাইভেট টিউটর বুঝিয়ে দেবে না, মায় ইন্টারনেটও উপরচালাকির ভ্যান্তাড়া কষবে --- শুধু মাতব্বরের মতো ঠোঁট বেঁকিয়ে হাফ-ক্যাডার বন্ধুরা চিরকাল বলে আসবে --- হয়, হয়, জানতি পারো না! ভাবখানা এমন --- জানি বিলক্ষণ, কিন্তু তোমায় বলা চলে না কাকা! কেবল নিষিদ্ধ মন্ত্রের মতো ভোটের বাতাসে ফিসফিস ঘুরে বেড়াবে কাল্পনিক সব টোটকা। কেউ বলবে, পাতি টুথপেস্ট লাগিয়ে পনেরো মিনিট রাখতে হয়, তারপর দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আলতো ঘষলেই রং হাওয়া। অথবা, খানিক দুব্বো ঘাস তুলে তার রসটুকু লাগাতে হবে, তাতেই নাকি কালির জারিজুরি শেষ! কেউ বা আরও ক্রিয়েটিভ, তাদের টোটকা কখনও পেঁপে গাছের দুধ-রস, কখনও ব্লিচিং পাওডার আর ফিনাইলের মিক্সচার! কেউ আবার ভেবেচিন্তে জানাবে, এ তো সিম্পল, এক টুকরো সিরিষ কাগজ নিয়ে বার কয়েক ঘষলেই হল! কেউ বাতলাবে প্রকৃতই সৃজনশীল উপায় --- দেশলাই কাঠি জলে ভিজিয়ে শুধু তার বারুদটুকু কালির উপর ঘষতে হবে একশো আটবার। সর্বজ্ঞের ভাবখানি দেখিয়ে কেউ বলবে, আরও আগে থেকে নাকি মাঠে নামতে হয়! মানে, ভোট দিতে যাওয়ার আগেই হাতে স্বচ্ছ নেলপালিশ বা গঁদের আঠা লাগিয়ে নিতে হবে। তাতে একটা আস্তরণ পড়ে যাবে, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। তারপর ভোট দিয়ে বেরিয়ে নেলপালিশ রিমুভার দিয়ে বা এমনিই ঘষে-ঘষে তুলে ফেললেই হল। ব্যস, হাত ধুয়ে, আবার দাঁড়িয়ে যাও! তবে, রাসায়নিক ও রাজনৈতিক এসব আনফেয়ারি টেলের মোরালে ঘাপটি মেরে থাকে দু’টি জিনিস। এক : সাংবিধানিক অপরাধ। দুই : আঙুলের দফারফা।

হাতকাটা কার্তিক
ভাগ্যিস পেটো বাঁধতে গিয়ে ফুটো মস্তান কার্তিকের বাঁ হাতটি ওড়েনি, নইলে ভোট দেওয়ার আগে অহেতুক টেনশন পোহাতে হত হাতকাটা কার্তিককে। বাঁ হাতই যদি না থাকে, তাহলে কোথায় আর বাঁ হাতের তর্জনী, কোথায়ই বা ভোটের কালির দাগ! আজ্ঞে না, এসব ক্ষেত্রেও স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কারো বাঁ হাতে তর্জনী না থাকলে, কালি লাগাতে হবে বাঁ হাতেরই অন্য কোনও আঙুলে। বাঁ হাতে যদি কোনও আঙুলই না থাকে, তাহলে ডান হাতের তর্জনী। সেটিও যদি না থাকে, তবে বাছতে হবে ডান হাতের মধ্যমা থেকে শুরু করে অন্য কোনও আঙুল। সে গুড়েও বালি হলে, মানে, ভোটারের কোনও হাতেই যদি আঙুল না থাকে, তাহলে দু’টি হাতই যেভাবে আছে, সেখানেই ভালো করে মাখাতে হবে ভোটের কালি।

বিতর্কিত কালি
ভোটের কালি চট করেই উঠে যাচ্ছে --- এমন অভিযোগ মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান কি কম্বোডিয়ায় অনেকবার শোনা গিয়েছে। কখনও এর কারণ হয়েছে ভুলবশত কালি বদলে যাওয়া, কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে কালিতে ভেজাল দেওয়া। এসব চিরাচরিত বিতর্কের বাইরে ভোটের কালি নিয়ে আরও নানা বিচিত্র প্রশ্নও কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে। এবারই অন্ধ্রপ্রদেশে ৩০ মার্চ থেকে ৭ মের মধ্যে অনেকগুলি ভোট হচ্ছে। ৩০ মার্চ ১৫৬টি জায়গায় পুরভোট হয়েছে, মাঝে পঞ্চায়েত ভোট, আবার ৩০ এপ্রিল ও ৭ মে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর নির্বাচন পড়ায় অনেকেই ঘোর দুশ্চিন্তায় --- লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের আগে যদি পুর বা পঞ্চায়েত ভোটের কালি আঙুল থেকে না ওঠে, তাহলে কী হবে? আবার ২০০৮-এ মালয়েশিয়ায় ইলডেলিবল ইঙ্ক চালু করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলেও, নির্বাচনের চারদিন আগে তা বাতিল করতে হয়। কারণ, শেষবেলায় চোখে পড়ে, তখনও সেদেশের সংবিধানে এই আইনটিই হয়নি যে, কারো হাতে ভোটের কালি থাকলে সে আর ভোট দিতে পারবে না! আবার জিম্বাবোয়েতে দেখা গিয়েছে, ভোটের পরে কারো হাতে কালির দাগ না থাকলে, মিলিটারিই অত্যাচার চালিয়েছে। ভোট দাওনি কি মরেছো, সিধে কথা! বাংলাদেশে দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর নাকি উলটো ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের হাতে কালির দাগ রয়েছে, তাঁদের উপরই চলেছে নির্যাতন। গত বিধানসভা নির্বাচনে ছত্তীশগড়ের বহু মানুষই যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, ভোটের পর তাঁদের আঙুলে যাতে কালি না লাগানো হয়। কারণ মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে তাঁরা যে সাড়া দেননি, তা বোঝা গেলে তো কপালে ঢের দুঃখ!
হাতে রইল ভোটের কালি তার চেয়ে, সকাল সকাল ভোট দিন। আপনি পাতি ভোটার, প্রতিশ্রুতি মাফিক ভোটের পর আর কিছু পান না-পান, দু’তিন সপ্তাহের জন্য কালির গ্ল্যামারটুকু আপনার আঙুলে অ্যাসিওর্ড। ভবিষ্যতে বায়োমেট্রিকের থ্রেট আছে বটে, আধার কার্ড একদিন আঁধারে ঠেলে দিতেই পারে ভোটের কালিকে, কিন্তু সে ঢের দেরি। তার আগে আপনি দিনভর, সপ্তাহভর, ভেজাল না থাকলে মাসভর গণতন্ত্রের স্মৃতি রোমন্থন করুন। দেখুন, দেখান। আপনি কক্ষণও ভাববেন না যে গণতন্ত্র আপনাকে প্রতারক ভেবেছে, কক্ষণও ভাববেন না যে আপনি ফের এসে ভোট দিতে পারেন সন্দেহ করে আপনার আঙুলে গণতন্ত্র কালি মাখিয়েছে। সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের দোহাই দিয়ে আপনি ঘুণাক্ষরেও গুনগুন করবেন না শ্যামাসঙ্গীত --- ও মা কালী, চিরকালই সঙ সাজালি এ সংসারে! কালির দিব্যি খেয়ে আপনি কেবল ভাববেন সেই বছর চারেকের ডেঁপো ছোঁড়াটির গপ্পো। মায়ের কোল থেকেই যে হেবি রেলায় চেঁচাচ্ছিল, ‘এইযো... আমি ভোট দিয়েছি’! তার কচি হাতে তখন ইনডেলিবল ইঙ্ক। পিছনে পালস পোলিও-র ব্যানার।


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে ২০১৪