08 November 2014

Lovelect : উলু উলু, ইলু ইলু

সুস্নাত চৌধুরী




তখন টেক্সটিজ নেই। আমি ও আমার বাবা ইমোটিকনের নাম শুনিনি। কিন্তু ক্লাস ফাইভ, এ সেকশন, সব্বাই জেনে গেল ইলু কা মতলব আই লভ ইউ। কেমিস্ট্রি চালু হতে তখনও তিন বচ্ছর... তবু সংকেত, চিহ্ন। পুরোপুরি অ্যাব্রিভিয়েটেভ মুণ্ডমাল নয়, আইএলওয়াই নয়... তবু সবাই জানে। কেননা ক-দিন আগেই আমাদের মজা-পুকুরে ঘাই মেরেছেন সুভাষ! সওদাগর। ততদিনে কার্বাইড-ত্বরান্বিত কিশোর, শ্রেণি পঞ্চম। তবু, সেবার লক্ষ্মী। কান্ত। পেয়ারে ঈষৎ লাল। ১৯৯১, সেবার, ইলু কা মতলব আইএলইউ।
ইলু বোঝার আগেই বটে বাঙালি উলু জেনে যায়। আমরাও। বুঝিনি সেদিন। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, সশব্দে, খোলাখুলি অথচ সংকেতে সেক্সের ডাক। রিচুয়াল, পবিত্র। মা-জেঠিমা। সঙ্গে আমিও। যে জিভ সিটি-তে মুখড়া লেখে পাড়ায়, উলু তার ক্লাইম্যাক্স ছাতনাতলায়। পৃথক শুধু মেকানিজমটুকু। যে মেয়ে-ব্যাং শোবে এবার, সে নিজেই ডাকে। মানুষ গণতান্ত্রিক, পরোপকারী। অ্যাডাল্ট দু-জন আইনানুগ লাগাবে, সে-ফূর্তিতে বাকিরা। উলু। এই উলুধ্বনি নাকি থ্রি পয়েন্ট ফাইভ হার্ৎজ ব্রেন ওয়েভ জেনারেট করে। মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাল জাইরাস, ওই মেমারি সেন্টার টাইপের, সেখানে তা নাকি হেভি ধাক্কা মারে! স্মৃতি-ফৃতি ঘেঁটে দেওয়া ক্যাচড়া। সে-শব্দের জানান দেওয়া এমন! তাবলে ভাববেন না ফাইনম্যান-টাইনম্যান হায়ার ফিজিক্স কি সাঁতরার বায়োলজি প্লাস-টু থেকে ঝাড়ছি। এ আমার টরেন্টীয় টলিগাঁ। ডক্টর হাজরা টু কুশল হাজরা। মাইনর একচিলতে দৃশ্যে যেখানে চিনা না জাপানি সহপাঠিনীটি বিদায়ের শেষবেলায় তাঁর স্বভাষায় প্রেমপত্র তুলে দিয়ে যায় গুজরাতি হিন্দি ইংরেজি আর আধ-বাংলা জানা ভালোবাসার সুদূর ভারতীয়টির হাতে, সে-ভাষা যে কিছুমাত্র বুঝবে না, জেনেই। প্রেরকের অর্থবহ বাক্য যেখানে প্রাপকের কাছে অ্যাবস্ট্রাক্ট কয়েকটা ছবি। এই ব্যর্থ প্রেমের ভাষা সংকেতে সফল। এবং কোনওদিনও তা ডিকোড করা হল কি না, সেটাও আর বিচার্যই নয়।
ব্যাপার হল, প্রেম হোক বা কাম, তার আহ্বানে সাংকেতিকতার পথে হাঁটতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সেফ লাগে। তাতে বেশ একটা কবিতা-কবিতা ফিলও হয়, গানের মতো মনে হয়। সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না আমাদের। সহজ কথা সহজ করে বলতে বাধে। নইলে যেন কাজ হয়ই না, কামও নাকি হয় না। কিন্তু রুবি রায়ের অ্যাঙ্গেল থেকে যদি দ্যাখা যায়, তিনি তো বলতেই পারেন অসময়ে --- 'এঃ হেঃ, আমি তো ধরতেই পারিনি! তুমি খামোখা কবিতায় ডাকতে গেলে কেন সেদিন... স্ট্রেটকার্ট বলতে পারলে না ভাই একটিবারের জন্য! খামোখা কবিতায় কেন ডাকলে...'। এই রিস্ক আছেই। তাই, কে কার উপর কত্‌তোটা ডাইং সেটা আদৌ ডিপেন্ড করে না সাগরে কতটা জল লাইং, আকাশে কোন পাখি ফ্লাইং কিংবা বাগানে মৌমাছি কেমন গায়িং --- তার উপর। ডিপেন্ড করে, আদৌ বলে উঠতে পারা গেল কিনা আলটিমেটলি --- 'তানে প্রেম কারু ছু... ছু... ছু...'! তারপরও অবশ্য বংললনা পটাতে গুজ্জুকেও বিদ্যেসাগর-তক্কোলঙ্কার আওড়াতে হতে পারে। সেসব ব্যতিক্রম। কবেকার পুঁথির শোলোক তোমার মতোই অশ্রুমতী... সাধু সাধু! চলিত চলিত!
আর, ভ্যানতাড়া না কষে সোজাসুজি প্রোপোজ করলে কেমন হয়? উল্টোদিক থেকে ঠাটিয়ে থাপ্পড়ের চান্স ফ্যাক্টরটা কাটিয়ে দিতে পারলে, ব্যাপারটা জমে যেতেই পারে। ঘটকের ঘটকালিতে যেমন প্রেমের দৃশ্য তৈরি হয় আরকি --- 'একটা গোটা জলজ্যান্ত মেয়ে, সে কিনা এসে বলছে, বিয়ে করব..., ভালোবাসি...!' কিংবা সত্যব্রতকে দেওয়া বুঁচকীর জবাবের মতোও হতে পারে --- 'যাঃ'। 'যাঃ মানেই হ্যাঁ:'! আসলে, ছবির শেষে আর খেলার শুরুতে, ওই 'লভ-অল' সিচুয়েশনে কেবল শ্যামই বলতে পারে তার রাধাকে --- 'আমি জানতাম তুমি আসবে, তাই অপেক্ষা করছিলাম।' সিম্পল। কিন্তু সাইড ক্যারেকটারদের ক্ষেত্রে গপ্পোটা অন্য। সিধু তো আর এই গোদা বাক্যে ভরসা রাখতে পারবে না! তাকে পচা পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বলতেই হবে, 'তুমি আমাকে বলো, উত্তমকুমার...'। বেসুরে গাইতে হবে, 'আলো আমার আলো ওগো...'। কিংবা লালুকে ভুলভাল আওড়াতে হবে আগে থেকে মুখস্থ করা --- 'চুল তার কবেকার ('অন্ধকার' মিসিং!) বিদিশার নিশা... গন্ধ তার...'। এই বিলাপ শুধু বসন্তের নয়, প্রেমগলির ঘুপচিতে ষড়ঋতুরই কলার টিউন। অতএব, এইচএস লেটার রাইটিং-এর নোটবইটির পাশেই ফুটপাতে বিকোবে প্রেমপত্রের চটিবুক। রোমান্টিক এসএমএসের কালেকশন। শায়েরি সংগ্রহ। চিঠিটি লিখতে পাড়ার সেসব অল্প সিনিয়র কি ক্লাসের ঈষৎ বেঁড়ে-পাকাটির হেল্প-টেল্পও কি একই গোত্রে ফেলা যায় না! যে সাপ্লাই করতে পারবে একটা প্রামাণ্য প্রেমের ভাষা। বানান ভুল কম, ইনক্লুডিং কয়েকটি জব্বর কোটেশন। এবং জনশ্রুতি থাকবে, ইহা পরীক্ষিত, প্রমাণিতও!
তাহলে এখানে সত্যি কথাটা কি আদৌ থাকে? থাকে হয়তো ঠিকই, কিন্তু মনের কথা চাপা পড়ে যায় মন-মন বাজে শব্দের তলায়। মজা হল, প্রেমের প্রস্তাবনায় সবচেয়ে কেঠো আর সার কথাটা বলতেই আমাদের সবচেয়ে অস্বস্তি হয়, ন্যাকান্যাকা লাগে। অথচ ভেবে দেখতে গেলে, এই বাক্যবন্ধটিই সর্বাপেক্ষা সাহসী। 'আমি তোমাকে ভালোবাসি' --- সত্যিই তো, এই ওয়ান-লাইনারটা বাঙালি আর বলে কই! বড়ো জোর বলে, বলে মানে লেখে, টেক্সট করে বা মেল, ওই... 'আই লভ ইউ'। এই যে মলাট চাপানো, তা মোটেই কেবল বিষয়ে আটকে থাকে না, তার প্রকাশভঙ্গিতেও প্রভাব ফেলে। শুরুতে বাইকে স্টার্ট দেওয়ার মতো হয়তো একটা গলা খাঁকরি, তারপর শুরু হবে এই পথ যদি না...! শুধুই প্রোপোজ-পর্বে নয়, এমনকী প্রেমের মাঝরাস্তাতেও এসব প্রবণতার বাম্পার থাকে। কথা বলার সময় ভাষা বদলে যায়, স্বর বদলে যায়। শব্দ নির্বাচন প্রভাবিত হয়। যে ভাষায় যে ভঙ্গিতে আর পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে দেদার আড্ডা চলে, বিশেষ কারো সঙ্গে নিভৃত আলাপে একটু হলেও বদল আসবেই। একটা অন্য ভাষা, প্রায় একটা ইডিওলেক্ট তৈরি হয়ে যায় যেন। যে স্বভাবতই একটু প্রগল্‌ভ, অজান্তেই নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা চালায়। যে মুখচোরা, দু-কথা বেশি বলে হয়তো নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে। কথায়-কথায় যার 'দুঃ বাঁআঃ', সে নিজেকে সোবার দেখাবেই। অন্তত প্রথম-প্রথম... তারপর মাঠ বুঝে খেলা! আপাতভাবে মনে হতে পারে, এই সব যুক্তি মান্ধাতার বাবা ও মায়ের প্রণয়কালের, আজ আর খাটে না। জানি না, ক্ষেত্র সমীক্ষার বক্স-বক্স তো খেলিনি, তাই গা-ছুঁয়ে বলতে পারব না। তবে অন্য একটা ব্যাখ্যা কপি-পেস্ট করতে পারি। বছর খানেক আগে এক বাংলা দৈনিকে 'তুই তুমি আপনি' শিরোনামে লিখেছিলাম ---
নৈকট্য গভীর গভীরতর হলে এই তুই-ই আবার বদলে যায় তুমি-তে! ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দিব্যি তুইতোকারি চলল, ওয়ান ফাইন মর্নিং হয়ে গেল তুমি! বোঝো, প্রোপোজ করার পর ক্ষণ থেকেই তুমি-তুমি বললে নাকি শরীর জুড়ে অলৌকিক শিহরন! আসলে ওই মুহূর্ত থেকে তো আর বন্ধু নয়, তারা চলে গেছে ‘স্বামী-স্ত্রী’ মোড-এ! আর বিয়ের পরেও তুইতোকারি চললে তো আর রক্ষে নেই। আত্মীয়-পড়শিদের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরে টেকা দায়!
অথচ জীবনের খেলা এমন বিচিত্র --- যখন কোথাও আর কেউ নেই, শুধু আবেগ আর প্রবৃত্তি আছে, তখন বহু ক্ষেত্রেই দাম্পত্য সম্পর্কের এ সব সম্বোধন আপনা-আপনিই বদলে যায়। বন্ধুবান্ধবের ‘ওই সব’ গল্প থেকে বুঝেছি, এমনিতে যাদের তুমি-র সম্পর্ক, সেই সব ঘন সময়ে, ঘামঝরা মুহূর্তে অনেকেই পরস্পরকে ‘তুই’ বলে। এতে হরমোন তীব্রতর হয়!
(আবাপ, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩)

যদিও বন্ধুদের মুখে শোনা এসব রেফারেন্স যে ধ্রুব সত্য, তা-ও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারব না। তবে এ-কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমি অন্তত একটি দম্পতিকে চিনি, এমনিতে যারা তুইতোকারি চালায় বিলকুল, কিন্তু সেইসব মাখন-সময়ে বলে ওঠে --- 'তুমি... তুমি...'! এ অবশ্য বিবাহ-উত্তর কালের ছোট্ট কেস স্টাডি। বিবাহ-পূর্ববর্তী প্রেমও এসব অদল-বদল সয়ে নিলে আর কবিতা থাকে না, ঢাউস কাব্যোপন্যাস হয়ে ওঠে! সে প্রেমের পথ মোড়া থাকে দৌপদীর শাড়ির মতো অনন্ত সব সংলাপে। শব্দে শব্দে শব্দে। কথার পিঠে কথায়। গানের ধুয়ার মতো ঘুরে ফিরে আসে হয়তো একই প্রসঙ্গ। অকিঞ্চিৎকর বিষয়ই বিস্ময়ে মুগ্ধ করে সেসব কথোপকথনে। ঘোর ব্যক্তিগত হয়েও যে-কথা আদতে নৈর্ব্যক্তিক। স্বকীয়, কিন্তু সর্বজনীন। কিছুই যেখানে কথার কথা নয়, তাই কোনও কথাই আর ফুরোতে চায় না। 'A Lover's Discourse - Fragments' গ্রন্থে সংলাপের যে প্রবহমানতাকে ধরেছেন রলাঁ বার্ত, এক প্রেমিকের ভাষ্যে। কোথাও লিখছেন, 'I cannot keep from thinking, from speaking; no director is there to interrupt the interior movie I keep making of myself, someone to shout, Cut! ' (অনুবাদ : রিচার্ড হাওয়ার্ড), কোনও জায়গায় তুলে আনছেন ফরাসি কবি ফ্রাঁসিস পোঁশ-এর পঙ্‌ক্তি --- 'I speak and you hear me, hence we exist'। ওই... 'আমি যেন বলি, আর তুমি যেন শোনো / জনমে জনমে তার শেষ নেই কোনো। / দিনের কাহিনী কত, রাত চন্দ্রাবলী / মেঘ হয়, আলো হয়, কথা যাই বলি।' কিংবা 'আমি শুনবো শুনবো, তুমি বলবে। সন্ধ্যাবেলায়...'।
এত কথা, তবু নৃতত্ত্বের অনেক গবেষকই আজ বলছেন, মুখের কথায় চিঁড়ে ভেজে না। প্রেমের প্রশ্নে শরীরী ইঙ্গিতই নাকি ঢের বেশি কার্যকরী। ননভার্বালেই মানুষ বেশি আস্থা রাখে। তাহলে কি ঘুরে-ফিরে সেই সংকেত! অচানক চোখ মারা? শ্বদম্তে ঠোঁট কামড়ানো? সংকেত হলেও, এসব বড্ড অতুল বেদাদে স্টাইল। তার চেয়ে স্রেফ চোখে চোখ ভালো। আমার চোখে রাখো চোখ, কথার অবসান হোক। কাব্যে কৌশল থাকতে পারে, কথায় মারপ্যাঁচ। নীরবতা নিরপেক্ষ। নিখাদ। সে সংকেত হতে পারে, কিন্তু সাংকেতিক নয়। প্রতারক নয়। বরং সবচেয়ে সত্য। দুটো মানুষের মাঝখানে এই স্তব্ধতাই হয়তো বিশুদ্ধ প্রেমের ভাষা। না-বলেও যে অনেক কিছু বলে দিয়ে যায়, আজও। তুই না বুঝিস বয়েই গেল, আমার চোখে সকাল হয়।


দেশের আগামীকাল, নভেম্বর ২০১৪

28 September 2014

বসন পরো মা

সুস্নাত চৌধুরী


প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন কয়েকজন উলঙ্গ মেয়েমানুষ। শরীরে তখন সুতোটি পর্যন্ত নেই। না, মনোরমা দেবীর ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল মণিপুরের কথা বলছি না। এ আমাদের শহর কলকাতা আর তার আশপাশের ছবি। কোনও মারাত্মক ইস্যুতে প্রতিবাদ-টতিবাদও নয়। যাঁরা দাঁড়িয়ে, তাঁরা ভিখিরি-পাগলি জাতীয় রুগ্ন, খেতে-পরতে না পাওয়া কোনও সাপলুডো খেলোয়াড়ও নন। বরং ভরাযৌবনা। মাপা ফিগার।
এ দৃশ্য প্রতিবছর আমরা দেখি। দেখে, আরও দেখতে দেখতে রাস্তা দিয়ে হাঁটি। আমাদেরই ঘরের উমা, সম্পূর্ণ নগ্ন, তার উপর এসে পড়ছে সূর্যের আলো। সঙ্গে শত-শত পুরুষ মানুষের দৃষ্টি। মহিলারাও কি তাকান না, কেউ হয়তো আড়চোখে, একটু অস্বস্তি নিয়েই? দুর্গাপুজোর মাসখানেক আগে থেকেই এ আমাদের রোজকার অভিজ্ঞতা। পটুয়ার ঘরের আশপাশে ফুটপাত জুড়ে সারিবদ্ধ মাতৃমূর্তি। কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দেওয়া সারা। দেহের প্রতিটা ডিটেলিং নিখুঁত। নিটোল স্তন। সুস্পষ্ট স্তনবৃন্ত। গভীর নাভি। অমলিন ত্রিবলী। সুঠাম উরু। সব মিলে তাক লাগিয়ে দেওয়া শিল্পকর্ম! তবু, দেবী দুর্গার এই নগ্নমূর্তি কোথাও কি আমাদের অতিভক্তি আর আচারের দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন জাগায় না?
আমরা দেখেছি, বোধনের আগে পর্যন্ত মায়ের শ্রীমুখখানি ঢাকা থাকতে। হয় আনখশির টানা পর্দা, নয়তো নিদেনপক্ষে মুখটুকু কাপড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া। নইলে হয়তো ঘামতেলে নোংরা টেনে নেবে। কিংবা এ হয়তো প্রকাশিত হওয়ার আনুষ্ঠানিক আচার। অথবা নিছক একটা চমকের অপেক্ষাকে শেষপর্যন্ত জিইয়ে রাখা। কেমন হয়েছে এবারে মায়ের মুখটা? প্রশ্নটা গুনগুন করে দানা বেঁধে ওঠে, ঠেকে-ঠেকে নানা গুজব রটতে থাকে। উত্তরটা মহারানি ভিক্টোরিয়াও হতে পারে কিংবা শ্রীদেবী! অথবা গতবারের মতোই, চিরাচরিত। কিন্তু ষষ্ঠীর আগে এটুকু চর্মচক্ষে মিলিয়ে নিতে গেলেই পাপ! ঠিক যেন ছাঁতনাতলায় নববধূ, শুভদৃষ্টির লগ্নে মুখের সামনে পানপাতার আবরণ। এ সময় পাড়ার রক থেকে যদি রোমিওকণ্ঠে বাঁকা আওয়াজ ভেসে আসে --- ‘বাওয়া, এদের তো তিন বছরের সম্পক্কো, পাক্কা দু’বছরের অ্যাফেয়ার, আর শেষ ছ’মাসের অত্ত ফস্টিনষ্টি --- বডি-ফডি চিনে গেলে, একন লোকদ্যাকানো মুক ঢাকার আদিখ্যেতা কেন বাপু!’ তখন?
এভাবে ভাবলে কি ঠাকুর পাপ দেয়? দেয় নিশ্চয়ই, নইলে সমাজের জ্যাঠামশয়রা এসব শুনলেই রে-রে করে উঠবেন কেন! ‘ছিঃ ছিঃ, কী অলুক্ষুণে কথা! কী নোংরা মেন্টালিটি! স্বয়ং মা দুগ্গাকে নিয়েও এমন অশ্লীল শরীরী ইঙ্গিত! যত্তসব পারভার্ট…’। আবার নাস্তিক হাফ-আঁতেল হলে গম্ভীর হেসে বলবেন --- ‘নাবালক! একটা মাটির পুতুল নিয়ে এত কথা জাস্ট ননসেন্স!’ মোদ্দা ব্যাপার হল, এই ল্যাংটো নারীমূর্তি, তা তিনি মৃন্ময়ীই হোন বা চিন্ময়ী --- ভদ্রমহিলা এই এখন, পুজোর মুখে, আমাদের রাজপথে অলিতে গলিতে যেভাবে আছেন, যেখানে আছেন, তাতে আমাদের বড় একটা হেলদোল নেই। তাঁর জন্য হাতে গোনা পাঁচদিনের লাখ টাকা বাজেটে প্যান্ডেল আছে, ঝক্কাস লাইটিং আছে, বক্স-ফাটা ঝিনচ্যাক গান আছে --- শুধু তাঁর প্রাক-পুজো শালীনতা রক্ষার কনসেপ্টটুকু নেই।
ঠিক এগারো বছর আগে, ২০০৩ সালে, দুর্গাপুজোর মুখে কানাডার শতাব্দীপ্রাচীন দৈনিক ‘টরোন্টো স্টার’-এ ছাপা হয়েছিল ভারতীয় এই দেবীর উপর একটি প্রতিবেদন। সঙ্গে ছবি --- দশভুজার প্রতিমা নির্মাণ করছেন এক মৃৎশিল্পী। একেবারেই আমাদের চেনা দৃশ্য। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজ প্রায় শেষের পথে। কিন্তু, এ ছবি ছাপা হওয়া মাত্র বিশ্বের বহু জায়গায় কট্টর হিন্দুরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। তাঁদের বক্তব্য, দুর্গার নগ্ন ছবি ছেপে ঘোর অপমান করা হয়েছে। ওই সংবাদপত্রের অফিসেও কানাডাবাসী হিন্দুরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। দফতরের ইনবক্সে জমা হতে থাকে হাজার-হাজার ই-মেল। হিউম্যান রাইটস কমিশনে দায়ের হয় অভিযোগ। শেষমেশ নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পরিস্থি্তি সামাল দেয় সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ। আবার এই ঘটনাটিই যখন রিপোর্ট হিসেবে হিন্দুগন্ধী ওয়েবসাইটে উঠে আসে, তখনও সঙ্গে দুর্গার সেই নির্মীয়মান মূর্তির ছবি আপলোড করা থাকে। শুধু ছবির দু’জায়গায় সাঁটা হয়ে যায় দু’টি কালো স্টিকার --- ফটোশপ যতটুকু আব্রু জোগাতে সক্ষম আরকি! যদিও তাতে আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আন্ডারলাইনের মতোই লাগে।
এখন ব্যাপার হল, প্রবাসী ভারতীয় হিন্দুদের এই বিক্ষোভ ঠিক না ভুল, নৈতিক না অনৈতিক, সে বিতর্কে না ঢুকেও একথা বলা যায়, যদি কানাডার সংবাদপত্রটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হয়, তাহলে তার ঢের আগে শতগুণ বেশি প্রতিবাদ করা উচিত ছিল নিজের দেশে নিজেদের প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধেই। যে প্র্যাকটিস এক-দু’দিনের নয়, বহু বহু বছরের। কিন্তু আয়না নয়, আমাদের প্রিয় খেলনা তো চিরকালই আতস কাচ। অপরের ছোট খুঁতকেও যেখানে বড় করে দেখা যায়।
সেই অভ্যেসের বশেই বারবার আমরা হস্তক্ষেপ করেছি শিল্পীর স্বাধীনতায়। শিল্পীর কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ফতোয়া দিতে চেয়েছি। দিনের পর দিন রাস্তার উপর যে দেবীকে সকলের সামনে বেআব্রু করে রেখেছি, শিল্পীর ভাবনায় যখন তিনি কল্পনাতীত ভাবে বিবসনা হয়েও পরিপূর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ --- আমরা মেনে নিতে পারিনি। দুর্গার মতোই, সরস্বতী পুজোর মুখেও পূর্ণাবয়ব বাগদেবীর প্রতিমা খুলে আম নগ্ন থাকে থাকুক --- কিন্তু হুসেনের সরস্বতী নগ্ন হলে, দেশজুড়ে বিক্ষোভে সামিল হয়েছি --- তা যতই কমপ্লিট আর্টওয়ার্ক হোক না কেন! মার্কিন শিল্পী রবিন ফোলে যেমন বানিয়েছিলেন অর্ধনগ্ন দুর্গার একটি পুতুল। টপলেস। বিক্রি করার জন্য নিজের সাইটে পুতুলটির ছবিও আপলোড করেন তিনি। দিন কয়েকের মধ্যেই বন্যা বয়ে গেল প্রতিবাদী ইমেলের। কিছুদিন তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে নিজের অবস্থানেই অনড় ছিলেন ফোলে। পরে হাওয়া গড়বড় বুঝে, ফোলে ঘোষণা করেন, পুতুলটি তিনি বেচবেন না। ওয়েবসাইট থেকে মূল ছবিটিও সরিয়ে নেন। কিন্তু তার থাম্বনেল আজও ওয়েবে জ্বলজ্বল করছে! কোনও কোনও সংগঠন ফোলের বিরুদ্ধে স্বভাবতই তুমুল খাপ্পা। ফোলের অ্যাপ্রোচ অসংস্কৃত হতেই পারে, কিন্তু আমাদের ঘরের চারপাশেই এত এত উদোম দুর্গামূর্তি কেন, এতে সে প্রশ্নের জবাব মেলে না।
আবার কেউ বলতেই পারেন, নগ্নতায় কী যায় আসে? তুখোড় সব গ্রিক ভাস্কর্যে তো নগ্নতার ছড়াছড়ি। মনে রাখতে হবে, ভেনাস কি অ্যাফ্রোদিতের সঙ্গে কনসেপচুয়ালি দুর্গার অনেক ফারাক। যে দুর্গাকে ঘিরে আমরা উৎসবে মেতে উঠি, তিনি গৌরী, উমা। দেবী হয়েও, এই স্টোরি লাইনে তিনি ঘরের মেয়ে। বাপের বাড়ি এসেছেন। শুনতে যতই পাড়াগেঁয়ে লাগুক, বাপের বাড়ি সাউথ সিটির তিরিশ তলাতে হলেও, তা বাপের বাড়ি। তার একটা অন্যরকম ‘ইয়ে’ আছে! এতদিনের এই ফ্যামিলি ড্রামায় খামোখা কয়েকটা ‘এ’ মার্কা সিন ঢুকিয়ে দেওয়া কি উচিৎ কাজ? আর সবচেয়ে বড় কথা, আলটিমেটলি কিন্তু তাঁকে শাড়িটিই পরাবেন শিল্পী। অর্থাৎ যতক্ষণ না সেই বস্ত্রটুকু জুটছে, ততক্ষণ আক্ষরিক অর্থেই তিনি বিবস্ত্র। এটা প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব নয় --- কিন্তু তাদের পাপের ধারণাকে যেমন এক করা যায় না, তেমনই পবিত্রতার ধারণাও আলাদা। আমাদের মা কালীও তো নগ্ন। কিন্তু ভারী মজার ধাঁধা রয়েছে তাঁর রূপের বর্ণনায়! দক্ষিণাকালীর ধ্যানমন্ত্রে বলছে, তিনি ‘মুণ্ডমালাবিভূষিতাং’। অর্থাৎ তাঁর গলায় নরমুণ্ডের মালা। দৃশ্যত সে মালা তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গকে বহুলাংশে ঢেকে রাখে। ধ্যানমন্ত্রে আরও বলছে --- ‘শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীং’। সোজাকথায়, তিনি শবদেহের কাটা হাত দিয়ে নিজের কটিভূষণ রচনা করেছেন --- অনেকটা ওই মিনিস্কার্টের মতো। তাহলে? দিগ্বসনা কালীও কি আদৌ ততটা দিগ্বসনা?
কিন্তু পুজোর দিন কতক আগেও দেবী দুর্গা বিলক্ষণ দিগ্বসনা। প্রশ্ন হল, তখন আমাদের ভক্তিভাব আর শিল্প-সৌন্দর্য চেতনার মাঝখানে কোথাও কি জন্ম নেয় যৌনতার বোধ? ওই নিখুঁত গড়ন, ভোলাপচুয়াস ফিগার কি কোনও উত্তেজনার সৃষ্টি করে? এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে আমাদের পাপবোধের ধারণা। যাঁরা দেব-দেবী, তাঁদের নিয়ে ‘খারাপ কথা’ ভাবতে নেই! কামভাব জাগেই না, নাকি কামভাব জাগলেও তাকে গিলে নিতে হয়? ‘প্রথম শৈশবে সরস্বতী-মূর্তিকে আলিঙ্গন করা কি পাপ?’ এ প্রশ্নও তো ওঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এসব রিস্কি লাইনের সঙ্গে বাঙালি তো অপরিচিত নয়। আরেক ব্যতিক্রমী বাঙালি লেখক, যাঁর লেখা সেভাবে আম বাঙালির কাছে পৌঁছয়নি --- কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। এ বিষয়টিকেই আরও তীক্ষ্ণ করে তোলেন তিনি। নয়ের দশকের শুরুতে ‘আমার প্রেমিকারা’ উপন্যাসে যিনি ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে সরস্বতী প্রসঙ্গেই লেখেন --- ‘পান দু’খানা দু’গালে ছোঁয়াবার সময় ইচ্ছে করেই আমি পান ফেলে দিয়ে শুধু দুই হাত দু’গালে বুলিয়ে দিলুম একবার।… সেই থেকে আজও একইরকম চলছে।’ কৃষ্ণগোপালের লেখনিতে শ্যামার প্রসঙ্গ আরও মারাত্মক! ‘জোড়া ঢাক জোড়া কাঁসির উল্লাস গর্জনের মধ্যে দিয়ে, ধুনুচি নৃত্যের তাণ্ডবের পাশ দিয়ে, পঞ্চপ্রদীপের শিখার ওপর দিয়ে আমি এগিয়ে যাই ওর কাছে। এক পা শিবের পেটে আরেক পা শিয়ালের পিঠে দিয়ে আমি মুণ্ডমালায় চড়ে দাঁড়াই শ্যামার মুখোমুখি। বাঁ পায়ে জড়িয়ে ধরি ওর কোমর। কাঁধ ধরে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর আলতো করে দু’গাল দু’হাতে ধরি। নাকে নাক ঠেকাই, জিভের ডগায় জিভ। তিন চোখের পাতায় তিনটে চুমু খাই, চুমু খাই গলার ত্রিবলীরেখায়। ক্রমশ মিশে যাই শ্যামার ঘামতেল মাখা বুকের খাঁজে। বিপুল দুই স্তন আমাকে গায়েব করে নেয়। আমি চার বগলের গন্ধ শুঁকে শুঁকে ওর জিভটা মুখের মধ্যে নিয়ে আকণ্ঠ চুষতে থাকি। আমার দুই হাত লণ্ডভণ্ড করে ওর পাগলাঝোরা চুল। মড়মড় করে ওঠে পিষ্ট শিরদাঁড়া। অতএব শ্যামার নাভিমূলে একসময় আমার স্খলন হয়। ফ্যাটিগ্ড্ আমি লেপ্টে থাকি ওই বিশাল শরীরের মাঝখানে এই এতটুকু হয়ে।’ কিংবা সেই কবে, উনিশ শতকের ব্যঙ্গ-বিশারদ ঠাকুরদাস মুখুজ্জের ‘শারদীয় সাহিত্য’-তেও তো দেবী দুর্গার অর্ঘ্য হয়ে উঠেছিল প্রোভোকেটিভ পোশাক ---
'লও এই লিবারেল-লক্কাপেড়ে-সাড়ী, সূক্ষ্ম
সেমিজের সম্মোহন, রেডিকেল রস-ধাক্কা, ---'

আছে আরও পপুলার রেফারেন্স। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। শিবলিঙ্গের পাশে ঘুরে ঘুরে টাইটেল সং-এ লিপ মেলাচ্ছেন ব্লাউজ-বিহীন জিনাত আমন। লিঙ্গমুণ্ডে হাত বোলাচ্ছেন, নাক ঘষছেন...। এসব কি ইঙ্গিতবাহী নয়!
ঠাকুর-দেব্‌তার ব্যাপার মানেই আমিষের ছোঁয়া থাকবে না, এমন মিডিওকার যুক্তি তাই ধোপে টিঁকবে না। একতাল মাটি থেকে যখন গোটা দেহের আদল গড়ে তোলেন মৃৎশিল্পী, তখনও তাঁর শরীরে-মনে কি বিদ্যুৎ খেলে যায় না? তারাশঙ্করের কাহিনি অবলম্বনে ঋতুপর্ণের ‘অন্তরমহল’ ছবিতে যে প্রসঙ্গ উঠে আসে। দেবী প্রতিমার শরীর নির্মাণের সময় গেঁয়ো পটুয়ার মনে পড়তে থাকে দূর দেশে থাকা তাঁর স্ত্রীর কথা --- দুর্গার নির্মীয়মান মূর্তির সঙ্গে ইন্টারকাটে আসতে থাকে তাঁদের সদ্য অতীতের কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ঝলক। আর শেষমেশ নারী-পুরুষ সম্পর্কের চিররহস্যই আবার উঠে আসে একমাত্র সত্য হিসেবে। কে জানে, কোন অমোঘ আকর্ষণে সকলের অজান্তেই পটুয়ার হাতে দুর্গার মুখ হয়ে ওঠে হুবহু জমিদার বাড়ির ছোট বউ-এর আদলে। খোট্টা পোটো ব্রজভূষণ, যিনি ছবির শুরুতেই নিজ হাতে তৈরি গন্ধবিহীন মাটির চিংড়ি, ঝনঝন না-করা মাটির মোহর জমিদারমশাই-এর হাতে তুলে দিয়ে সার কথাটা বলেছিলেন --- ‘আগর আপ সোচ সাকতে হ্যায় তো সব মিলতা হ্যায়... বাস, আওয়াজ!’
সাংবাদিকতার সূত্রে বছর তিনেক আগে আলাপ হয়েছিল মালদহের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কাজের ফাঁকে মানবপুতুলের দলে পারফর্ম করতেন তিনি। মানুষই যেখানে পুতুলের মতো নাচে, পুতুলের মতোই যেন ডিজিটালি নড়াচড়া করে, যান্ত্রিক স্বরে কথা বলে। নারী চরিত্রটির পার্ট করতেন ওই ভদ্রলোক। শুনেছিলাম ছেলেবেলা থেকেই তাঁর হাবভাব, কথাবার্তা নাকি এইরকম মেয়েলি। বউ-বাচ্চা হওয়ার পরেও সেসব বদলায়নি। তিনিও লোকের ঠাট্টা-বিদ্রুপকে কোনওদিন পাত্তা দেননি। নিজের সত্ত্বাকেই সবচেয়ে আগে রেখেছেন। শুনে চমকে গিয়েছিলাম তাঁর পেশার বৃত্তান্ত। তিনি মৃৎশিল্পী। ঠাকুরের মূর্তি গড়েন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সেসব মূর্তি শুধুই দেবীর --- দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী! গণেশ, কার্তিক, বিশ্বকর্মার সেখানে কোনও ঠাঁই নেই! নিজের হাতে গড়া একের পর এক দেবী প্রতিমার শরীরে এ তো নিজের সুপ্ত নারীত্বকেই বারবার খুঁজে চলা। এখানে কি কোথাও যৌন চেতনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে না?
তাই পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা উদোম দুর্গার দিকে আমরা কামার্ত চোখ নিয়ে ফিরেই তাকাব না --- তা কি আর হয়! এখনও কেউ বলবেন, হয়। কারণ এই মূর্তি তো মায়ের। মা, দুর্গার। দেবীর দিকে হয়তো ও’চোখে তাকানো যায়, মায়ের দিকে কদাচ নয়। কিন্তু অদৃষ্টতাড়িত অয়দিপাউসের মায়ের সঙ্গে শোয়ার কাহিনি তো আমরা জানি। কিংবা শিবরাম চক্রবর্তীর ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’-র সেই অংশটি, যেখানে এক আকস্মিক বিকেলে কিশোর শিবরামকে সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়ে দিতে হচ্ছে তাঁর মাতৃস্থানীয়া --- ছেলেবেলার বান্ধবী রিনির মা-কে।
'আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি বুকের দিকে তোয়ালেটা সরিয়ে দিলেন 'এবার।'
তবু আমি হাত বাড়াই না দেখে তিনি একটু হেসে বললেন --- 'তোমার মনে পাপ ঢুকেছে দেখছি।'‌
পাপের কথায় রাগ হয়ে গেল আমার। আমি চোখ কান বুজে জোরে জোরে সাবান ঘষতে লাগলাম।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর। 'পায়ে মাখাও এবার।'
মাখাতে লাগলাম। কী সুন্দর সুগঠিত পা! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতই। বাবা বলতেন, দেবীর স্তবে পা থেকে বন্দনা শুরু করতে হয়। সরস্বতীর বেলায় কে যেন তা করেনি, তাই তাঁর কোপে সে নাকি গাধা বনে গেছল। আমি তার মর্মটা তখন বুঝতে পারি।'

তাহলে কি আমরা বড্ড ‘নিষ্পাপ’ বলেই দেবীকে শুধু স্নানের ঘরেই নগ্ন দেখি না, ফুটপাতেও দেখি! মূর্তি নির্মাণের টেকনিক্যাল দিকটিতেই কেবল নজর দিই --- রোদে-বাতাসে মাটিটা শুকিয়ে নিই। দেবী দুর্গা কি তবে শুধুই একটি পুতুল? মাটির খেলনা? এ প্রবাদ তো বহুদিনের --- ‘হিদুঁদের দুগ্গোপুজো, উপরে চিকন-চাকন, ভেতরে খড়ের বুজো’। সত্যিই আমাদের মাইন্ডসেট কি তবে এ কথাই বলে? তাঁকে যদি পূর্ণাঙ্গ নারী হিসেবেই না কল্পনা করতে পারলাম, সেই সম্মানই না দিতে পারলাম --- তাহলে কীসের প্রাণ প্রতিষ্ঠা! তাঁকে ‘মা’ ভাবা, ‘দেবী’ ভাবা --- এসব স্রেফ বাৎসরিক অভিনয়ের জন্য শত শত বছর আগে লিখে রাখা চিত্রনাট্যের অংশ বলেই মনে হয়।


সংবাদ প্রতিদিন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪