26 January 2015

হাজারটা শার্লি এবদো

সুস্নাত চৌধুরী



কার্টুন ১


কোনো কিছুর প্রতিবাদ করতে হলে তাকে হাস্যাস্পদ করে তোলার চেয়ে মাখন রাস্তা আর হয় না। গালাগালি বা গোলাগুলির চেয়ে ঢের বেশি কাজ হয় কাউকে লজিকালি খোরাক করে তুলতে পারলে। ক্ষমতার দম্ভ বা শক্তির ন্যায়হীনতা তখন বাধ্যত ধুলোতে হামাগুড়ি দেয় কলমের খোঁচায়, তুলির আঁচড়ে। পাল্টা ঘুরে দাঁড়ানো অন্তত তখনকার মতো তার পক্ষে আর সম্ভবই হয় না --- কারণ চোখা বুদ্ধির সূক্ষ্মরস তার ধূসর কোষে তো নেই-ই, সোনালি কোষাগারেও নেই। অগত্যা, ক্ষমতার চিরাচরিত প্র্যাকটিসে সেই গালাগালি বা গোলাগুলিকেই আঁকড়ে ধরে সে। বোকার মতো, বুদ্ধিকে কাউন্টার করতে যায় শক্তি দিয়ে। রাজা ও রানি তাই বরাবর হেরে এসেছে জোকারের কাছে। ভয় বা ভীতি আর যাকেই বাগে আনুক না কেন, হাস্যরসকে কখনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সেই হাস্যরস, যা শুধু হাসায় না, ভাবায়ও। কারণ তার উৎসবিন্দুতেই রয়েছে গভীর কোনও ভাবনা। সেই ভারী ভাবনাই যখন হালকা ঢঙে ভেসে ওঠে মজা-পুকুরে; বেশিটা ছবিতে, বাকিটা কথায় --- কার্টুনের জন্ম হয়। নিছক ঠেস দেওয়া বা হ্যাটা করা নয়, সার্থক কার্টুনের উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক। আলোর আড়ালে থাকা অন্ধকারকে সে আন্ডারলাইন করতে চায়। সোজা কথায়, কিন্তু বাঁকা ভঙ্গিতে। এই প্রতিবাদধর্মিতাই কার্টুনের মেরুদণ্ড। দণ্ডপ্রাপ্তির তোয়াক্কা সে করে না।

কার্টুন ২
চণ্ডীবাবু যেমন বলেছিলেন তাঁর 'কার্টুনের ইতিবৃত্ত' বইয়ের ভূমিকায় --- 'যুগোত্তীর্ণ সব কার্টুনেই আছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ভোরের পূরবী নয়, মেঘ গর্জনের সমতালে দীপক রাগিণী।' এ প্রতিবাদ নানা কিসিমের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় ক্ষমতার আস্ফালনকে পাবলিকলি নগ্ন করে দেওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা রাষ্ট্র বা শাসক বিরোধী। প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ওয়ালপোলের দানছত্রের প্রবণতাকে বিদ্ধ করে ছাপা হয়েছিল শিল্পীর নামহীন একটি কার্টুন। অষ্টাদশ শতকের সেই ছবিটি উল্লেখ্য এ কারণেই যে, সেখানে ওয়ালপোলের মুখ দেখানো হয়নি, আক্ষরিকভাবেই নগ্ন করে দেখানো হয়েছিল উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ! (কার্টুন ১) তবে, এ বিষয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন কার্টুনিস্ট ডেভিড লো। ইংল্যান্ডের কাগজে কাজ করেও, নাইটহুড পেয়েও, তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও বর্ণবিদ্বেষের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে কার্টুন এঁকেছেন। কখনওই চার্চিলের চামচাগিরি করেননি। উল্টে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল, রুজভেল্ট, এমনকী স্তালিনও নাকি প্রমাদ গুনতেন ওয়ান ফাইন মর্নিং তাঁদের নিয়ে ফের কী নতুন খোরাকই না রচনা করবেন লো! (কার্টুন ২)

কার্টুন ৩
সমালোচনা সইতে না-পারা রাষ্ট্রশক্তির খাঁড়াও বহুবার নেমে এসেছে, কিন্তু কার্টুনিস্টের হাতে শেকল পরানো যায়নি। ফরাসি বিপ্লবের পর নাগাড়ে রাজা লুই ফিলিপের প্রতিবাদ করছিল প্যারিসের 'লা কারিকাতুর' পত্রিকা। রাজাকে অবমাননার অভিযোগে সম্পাদক শার্লে ফিলিপঁ-র বিচার চলল। আত্মপক্ষ সমর্থনে ফিলিপঁ বললেন, যেকোনও কিছুর সঙ্গেই যেকোনও কিছুর মিল দেখানো সম্ভব! উদাহরণস্বরূপ কার্টুনের ঢঙে এঁকে দেখালেন একটি নাশপাতির সঙ্গে রাজার মুখের সাদৃশ্য। (কার্টুন ৩) ব্যাপার হল, ফরাসি স্ল্যাং-এ নাশপাতি বা 'la poire' বলতে বোঝানো হয় : মাথামোটা। কাজেই, ফিলিপঁ-র কারাবাস সেদিন আর ঠেকায় কে! একই সঙ্গে, এরপর তামাম ফ্রান্সে মহামান্য লুই ফিলিপের কথা এলেই 'মাথামোটা' নাশপাতির অনুষঙ্গ উঠে আসাকেও আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না রাজশক্তি। এদেশেও যেমন জরুরি অবস্থার সময়ে কার্টুনে শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর মুখাবয়ব হয়ে উঠেছিল রাক্ষুসির মতো। (কার্টুন ৪) তখনই শুরু হয় রাষ্ট্রের খবরদারি। সেন্সরের ছাড়পত্র পায় না আর কে লক্ষ্মণ কিংবা আবু আব্রাহামের তুখোড় সব কার্টুন। (কার্টুন ৫) কার্টুনে কার্টুনে রাজীব গাঁধীকেও তাড়া করে ফিরেছিল বোফর্স কামানের ছায়া। (কার্টুন ৬)

কার্টুন ৪

কার্টুন ৫

কার্টুন ৬

আজও অসীম ত্রিবেদীর মতো কার্টুনিস্টের লাগাতার ব্যঙ্গ বেশিক্ষণ নিতে পারে না রাষ্ট্র। কিন্তু কোণঠাসা করে তাঁদের প্রতিবাদী স্বরও চাপা দেওয়া যায় না। চারু রায় থেকে কুট্টি, পিসিয়েল থেকে সুফি --- পেটে খিল ধরিয়েছেন, মগজের খিল খুলে দিয়েছেন। আজও রসবোধের অভাব আর বোকামির হাতে হেনস্থা হতে হয় অম্বিকেশদের। কিন্তু তারপর আর কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় না মুকুলেই ঝরে না-পড়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়া তুমুল খিল্লিসমূহের। কেননা, রেলমন্ত্রক থেকে সারদা --- টাইমলাইন রিপিট্‌স ইটসেল্ফ। (কার্টুন ৭) 

কার্টুন ৭

শুধু ক্ষমতার আধিপত্যই নয়, সমাজকাঠামো ও সমাজের ভেতরে ঘটে চলা নানা কিছুও ধিকৃত হয়েছে কার্টুনে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিঁধেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আঁকলেন 'বিদ্যার কারখানা'। দেখালেন ভারী বইয়ের চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গ্র্যাজুয়েটদের। (কার্টুন ৮) বছর ষাটেক পরও সমান প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া এ ছবিই যেন অবিকল দৃশ্যায়িত হল পিংক ফ্লয়েড-এর গানে --- All in all it's just another brick in the wall! শিক্ষাযন্ত্র যেখানে খুদে পড়ুয়াদের পিষে তৈরি করল সুস্বাদু সসেজ। অসহযোগ আন্দোলনের সময় চিত্তরঞ্জন দাশের বিদেশি শিক্ষা বর্জনের ডাকে স্কুল-কলেজ খাঁ খাঁ করতে লাগল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিরোধিতা করলেন। এবার আশুতোষকে ব্যঙ্গ করে জোড়া-কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ। 'বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিযোগ --- Man proposes fire' ও 'বিশ্ববিদ্যালয়ে জলযোগ, God Disposes --- Sweets'। (কার্টুন ৯, কার্টুন ১০) এ ধরনের সামাজিক প্রেক্ষিত নিয়ে সব শিল্পীই কম-বেশি কাজ করলেও, বিশেষভাবে উল্লেখ্য গোয়ার কার্টুনিস্ট মারিও মিরান্ডা-র নাম। তাঁর কার্টুন প্রতিবাদী, কিন্তু মোলায়েম। গরম, কিন্তু নরম।

কার্টুন ৮
কার্টুন ৯
কার্টুন ১০













ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতাও উঠে এসেছে কার্টুনে। ষোড়শো শতকের প্রথমার্ধে পোপের বিলাসবহুল জীবনযাপনকে বিদ্ধ করেন শিল্পী লুকাস ক্রানাক। বন্ধু মার্টিন লুথারও রুখে দাঁড়ান ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। প্রচারপত্রে ছাপেন পোপ-বিরোধী দু'টি কার্টুন --- The Pope-Donkey of Rome (কার্টুন ১১) ও The Monk-Calf of Freiberg। অষ্টাদশ-উনিশ শতকে ধর্মান্ধতার প্রতিবাদ করেন স্পেনীয় শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়া। কাজেই, 'শার্লি এবদো' আজ নয়, আগেও ছিল। গুলি চালালে তাদেরও ঠান্ডা করা যেত না।

কার্টুন ১১

এমন উদাহরণ খুব বিরল নয়, যেখানে এক কার্টুনিস্ট তাঁর প্রিয়জনকেও রেয়াত করছেন না। সৎ কার্টুনিস্টের প্রতিবাদী সত্ত্বা এতটাই প্রবল। বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও স্যারেন্ডার নট ব্যানার্জি-কে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। বিলেতেও দেখি, কার্টুনিস্ট ভিকি লেবার পার্টির সমর্থক ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর্নেস্ট বেভান যখন লেবার পার্টির সরকারেরই প্রধানমন্ত্রী হলেন, ভিকি তাঁকে ছেড়ে কথা বলেননি। চণ্ডী লাহিড়ীর এক আবাল্য বন্ধু মন্ত্রী হওয়ার পর, তাঁকে নিয়ে কার্টুন আঁকেন চণ্ডী। তাতে সেই বন্ধু বিস্তর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব খোয়া গেলে রাতারাতি সেই তিনিই চণ্ডীর গুণগ্রাহী হয়ে পড়েন। সব দেশে, সব কালেই রাজনীতিকের অবস্থান বদলায়। প্রকৃত কার্টুনিস্টের বদলায় না। তুলি-কলম হাতে সে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে সম্ভাবনাময় সাদা পাতার সামনে। আইডিয়া ছাড়া তার কোনও বন্ধু নেই।


সহায়ক
কার্টুনের ইতিবৃত্ত, চণ্ডী লাহিড়ী
কার্টুন সংখ্যা, কিঞ্জল পত্রিকা, ১৯৮৫
দি গেমস অব এমারজেন্সি, আবু আব্রাহাম
কার্টুন পত্তর, www.cartoonpattor.in

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

08 November 2014

Lovelect : উলু উলু, ইলু ইলু

সুস্নাত চৌধুরী




তখন টেক্সটিজ নেই। আমি ও আমার বাবা ইমোটিকনের নাম শুনিনি। কিন্তু ক্লাস ফাইভ, এ সেকশন, সব্বাই জেনে গেল ইলু কা মতলব আই লভ ইউ। কেমিস্ট্রি চালু হতে তখনও তিন বচ্ছর... তবু সংকেত, চিহ্ন। পুরোপুরি অ্যাব্রিভিয়েটেভ মুণ্ডমাল নয়, আইএলওয়াই নয়... তবু সবাই জানে। কেননা ক-দিন আগেই আমাদের মজা-পুকুরে ঘাই মেরেছেন সুভাষ! সওদাগর। ততদিনে কার্বাইড-ত্বরান্বিত কিশোর, শ্রেণি পঞ্চম। তবু, সেবার লক্ষ্মী। কান্ত। পেয়ারে ঈষৎ লাল। ১৯৯১, সেবার, ইলু কা মতলব আইএলইউ।
ইলু বোঝার আগেই বটে বাঙালি উলু জেনে যায়। আমরাও। বুঝিনি সেদিন। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, সশব্দে, খোলাখুলি অথচ সংকেতে সেক্সের ডাক। রিচুয়াল, পবিত্র। মা-জেঠিমা। সঙ্গে আমিও। যে জিভ সিটি-তে মুখড়া লেখে পাড়ায়, উলু তার ক্লাইম্যাক্স ছাতনাতলায়। পৃথক শুধু মেকানিজমটুকু। যে মেয়ে-ব্যাং শোবে এবার, সে নিজেই ডাকে। মানুষ গণতান্ত্রিক, পরোপকারী। অ্যাডাল্ট দু-জন আইনানুগ লাগাবে, সে-ফূর্তিতে বাকিরা। উলু। এই উলুধ্বনি নাকি থ্রি পয়েন্ট ফাইভ হার্ৎজ ব্রেন ওয়েভ জেনারেট করে। মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাল জাইরাস, ওই মেমারি সেন্টার টাইপের, সেখানে তা নাকি হেভি ধাক্কা মারে! স্মৃতি-ফৃতি ঘেঁটে দেওয়া ক্যাচড়া। সে-শব্দের জানান দেওয়া এমন! তাবলে ভাববেন না ফাইনম্যান-টাইনম্যান হায়ার ফিজিক্স কি সাঁতরার বায়োলজি প্লাস-টু থেকে ঝাড়ছি। এ আমার টরেন্টীয় টলিগাঁ। ডক্টর হাজরা টু কুশল হাজরা। মাইনর একচিলতে দৃশ্যে যেখানে চিনা না জাপানি সহপাঠিনীটি বিদায়ের শেষবেলায় তাঁর স্বভাষায় প্রেমপত্র তুলে দিয়ে যায় গুজরাতি হিন্দি ইংরেজি আর আধ-বাংলা জানা ভালোবাসার সুদূর ভারতীয়টির হাতে, সে-ভাষা যে কিছুমাত্র বুঝবে না, জেনেই। প্রেরকের অর্থবহ বাক্য যেখানে প্রাপকের কাছে অ্যাবস্ট্রাক্ট কয়েকটা ছবি। এই ব্যর্থ প্রেমের ভাষা সংকেতে সফল। এবং কোনওদিনও তা ডিকোড করা হল কি না, সেটাও আর বিচার্যই নয়।
ব্যাপার হল, প্রেম হোক বা কাম, তার আহ্বানে সাংকেতিকতার পথে হাঁটতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সেফ লাগে। তাতে বেশ একটা কবিতা-কবিতা ফিলও হয়, গানের মতো মনে হয়। সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না আমাদের। সহজ কথা সহজ করে বলতে বাধে। নইলে যেন কাজ হয়ই না, কামও নাকি হয় না। কিন্তু রুবি রায়ের অ্যাঙ্গেল থেকে যদি দ্যাখা যায়, তিনি তো বলতেই পারেন অসময়ে --- 'এঃ হেঃ, আমি তো ধরতেই পারিনি! তুমি খামোখা কবিতায় ডাকতে গেলে কেন সেদিন... স্ট্রেটকার্ট বলতে পারলে না ভাই একটিবারের জন্য! খামোখা কবিতায় কেন ডাকলে...'। এই রিস্ক আছেই। তাই, কে কার উপর কত্‌তোটা ডাইং সেটা আদৌ ডিপেন্ড করে না সাগরে কতটা জল লাইং, আকাশে কোন পাখি ফ্লাইং কিংবা বাগানে মৌমাছি কেমন গায়িং --- তার উপর। ডিপেন্ড করে, আদৌ বলে উঠতে পারা গেল কিনা আলটিমেটলি --- 'তানে প্রেম কারু ছু... ছু... ছু...'! তারপরও অবশ্য বংললনা পটাতে গুজ্জুকেও বিদ্যেসাগর-তক্কোলঙ্কার আওড়াতে হতে পারে। সেসব ব্যতিক্রম। কবেকার পুঁথির শোলোক তোমার মতোই অশ্রুমতী... সাধু সাধু! চলিত চলিত!
আর, ভ্যানতাড়া না কষে সোজাসুজি প্রোপোজ করলে কেমন হয়? উল্টোদিক থেকে ঠাটিয়ে থাপ্পড়ের চান্স ফ্যাক্টরটা কাটিয়ে দিতে পারলে, ব্যাপারটা জমে যেতেই পারে। ঘটকের ঘটকালিতে যেমন প্রেমের দৃশ্য তৈরি হয় আরকি --- 'একটা গোটা জলজ্যান্ত মেয়ে, সে কিনা এসে বলছে, বিয়ে করব..., ভালোবাসি...!' কিংবা সত্যব্রতকে দেওয়া বুঁচকীর জবাবের মতোও হতে পারে --- 'যাঃ'। 'যাঃ মানেই হ্যাঁ:'! আসলে, ছবির শেষে আর খেলার শুরুতে, ওই 'লভ-অল' সিচুয়েশনে কেবল শ্যামই বলতে পারে তার রাধাকে --- 'আমি জানতাম তুমি আসবে, তাই অপেক্ষা করছিলাম।' সিম্পল। কিন্তু সাইড ক্যারেকটারদের ক্ষেত্রে গপ্পোটা অন্য। সিধু তো আর এই গোদা বাক্যে ভরসা রাখতে পারবে না! তাকে পচা পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বলতেই হবে, 'তুমি আমাকে বলো, উত্তমকুমার...'। বেসুরে গাইতে হবে, 'আলো আমার আলো ওগো...'। কিংবা লালুকে ভুলভাল আওড়াতে হবে আগে থেকে মুখস্থ করা --- 'চুল তার কবেকার ('অন্ধকার' মিসিং!) বিদিশার নিশা... গন্ধ তার...'। এই বিলাপ শুধু বসন্তের নয়, প্রেমগলির ঘুপচিতে ষড়ঋতুরই কলার টিউন। অতএব, এইচএস লেটার রাইটিং-এর নোটবইটির পাশেই ফুটপাতে বিকোবে প্রেমপত্রের চটিবুক। রোমান্টিক এসএমএসের কালেকশন। শায়েরি সংগ্রহ। চিঠিটি লিখতে পাড়ার সেসব অল্প সিনিয়র কি ক্লাসের ঈষৎ বেঁড়ে-পাকাটির হেল্প-টেল্পও কি একই গোত্রে ফেলা যায় না! যে সাপ্লাই করতে পারবে একটা প্রামাণ্য প্রেমের ভাষা। বানান ভুল কম, ইনক্লুডিং কয়েকটি জব্বর কোটেশন। এবং জনশ্রুতি থাকবে, ইহা পরীক্ষিত, প্রমাণিতও!
তাহলে এখানে সত্যি কথাটা কি আদৌ থাকে? থাকে হয়তো ঠিকই, কিন্তু মনের কথা চাপা পড়ে যায় মন-মন বাজে শব্দের তলায়। মজা হল, প্রেমের প্রস্তাবনায় সবচেয়ে কেঠো আর সার কথাটা বলতেই আমাদের সবচেয়ে অস্বস্তি হয়, ন্যাকান্যাকা লাগে। অথচ ভেবে দেখতে গেলে, এই বাক্যবন্ধটিই সর্বাপেক্ষা সাহসী। 'আমি তোমাকে ভালোবাসি' --- সত্যিই তো, এই ওয়ান-লাইনারটা বাঙালি আর বলে কই! বড়ো জোর বলে, বলে মানে লেখে, টেক্সট করে বা মেল, ওই... 'আই লভ ইউ'। এই যে মলাট চাপানো, তা মোটেই কেবল বিষয়ে আটকে থাকে না, তার প্রকাশভঙ্গিতেও প্রভাব ফেলে। শুরুতে বাইকে স্টার্ট দেওয়ার মতো হয়তো একটা গলা খাঁকরি, তারপর শুরু হবে এই পথ যদি না...! শুধুই প্রোপোজ-পর্বে নয়, এমনকী প্রেমের মাঝরাস্তাতেও এসব প্রবণতার বাম্পার থাকে। কথা বলার সময় ভাষা বদলে যায়, স্বর বদলে যায়। শব্দ নির্বাচন প্রভাবিত হয়। যে ভাষায় যে ভঙ্গিতে আর পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে দেদার আড্ডা চলে, বিশেষ কারো সঙ্গে নিভৃত আলাপে একটু হলেও বদল আসবেই। একটা অন্য ভাষা, প্রায় একটা ইডিওলেক্ট তৈরি হয়ে যায় যেন। যে স্বভাবতই একটু প্রগল্‌ভ, অজান্তেই নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা চালায়। যে মুখচোরা, দু-কথা বেশি বলে হয়তো নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে। কথায়-কথায় যার 'দুঃ বাঁআঃ', সে নিজেকে সোবার দেখাবেই। অন্তত প্রথম-প্রথম... তারপর মাঠ বুঝে খেলা! আপাতভাবে মনে হতে পারে, এই সব যুক্তি মান্ধাতার বাবা ও মায়ের প্রণয়কালের, আজ আর খাটে না। জানি না, ক্ষেত্র সমীক্ষার বক্স-বক্স তো খেলিনি, তাই গা-ছুঁয়ে বলতে পারব না। তবে অন্য একটা ব্যাখ্যা কপি-পেস্ট করতে পারি। বছর খানেক আগে এক বাংলা দৈনিকে 'তুই তুমি আপনি' শিরোনামে লিখেছিলাম ---
নৈকট্য গভীর গভীরতর হলে এই তুই-ই আবার বদলে যায় তুমি-তে! ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দিব্যি তুইতোকারি চলল, ওয়ান ফাইন মর্নিং হয়ে গেল তুমি! বোঝো, প্রোপোজ করার পর ক্ষণ থেকেই তুমি-তুমি বললে নাকি শরীর জুড়ে অলৌকিক শিহরন! আসলে ওই মুহূর্ত থেকে তো আর বন্ধু নয়, তারা চলে গেছে ‘স্বামী-স্ত্রী’ মোড-এ! আর বিয়ের পরেও তুইতোকারি চললে তো আর রক্ষে নেই। আত্মীয়-পড়শিদের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরে টেকা দায়!
অথচ জীবনের খেলা এমন বিচিত্র --- যখন কোথাও আর কেউ নেই, শুধু আবেগ আর প্রবৃত্তি আছে, তখন বহু ক্ষেত্রেই দাম্পত্য সম্পর্কের এ সব সম্বোধন আপনা-আপনিই বদলে যায়। বন্ধুবান্ধবের ‘ওই সব’ গল্প থেকে বুঝেছি, এমনিতে যাদের তুমি-র সম্পর্ক, সেই সব ঘন সময়ে, ঘামঝরা মুহূর্তে অনেকেই পরস্পরকে ‘তুই’ বলে। এতে হরমোন তীব্রতর হয়!
(আবাপ, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩)

যদিও বন্ধুদের মুখে শোনা এসব রেফারেন্স যে ধ্রুব সত্য, তা-ও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারব না। তবে এ-কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আমি অন্তত একটি দম্পতিকে চিনি, এমনিতে যারা তুইতোকারি চালায় বিলকুল, কিন্তু সেইসব মাখন-সময়ে বলে ওঠে --- 'তুমি... তুমি...'! এ অবশ্য বিবাহ-উত্তর কালের ছোট্ট কেস স্টাডি। বিবাহ-পূর্ববর্তী প্রেমও এসব অদল-বদল সয়ে নিলে আর কবিতা থাকে না, ঢাউস কাব্যোপন্যাস হয়ে ওঠে! সে প্রেমের পথ মোড়া থাকে দৌপদীর শাড়ির মতো অনন্ত সব সংলাপে। শব্দে শব্দে শব্দে। কথার পিঠে কথায়। গানের ধুয়ার মতো ঘুরে ফিরে আসে হয়তো একই প্রসঙ্গ। অকিঞ্চিৎকর বিষয়ই বিস্ময়ে মুগ্ধ করে সেসব কথোপকথনে। ঘোর ব্যক্তিগত হয়েও যে-কথা আদতে নৈর্ব্যক্তিক। স্বকীয়, কিন্তু সর্বজনীন। কিছুই যেখানে কথার কথা নয়, তাই কোনও কথাই আর ফুরোতে চায় না। 'A Lover's Discourse - Fragments' গ্রন্থে সংলাপের যে প্রবহমানতাকে ধরেছেন রলাঁ বার্ত, এক প্রেমিকের ভাষ্যে। কোথাও লিখছেন, 'I cannot keep from thinking, from speaking; no director is there to interrupt the interior movie I keep making of myself, someone to shout, Cut! ' (অনুবাদ : রিচার্ড হাওয়ার্ড), কোনও জায়গায় তুলে আনছেন ফরাসি কবি ফ্রাঁসিস পোঁশ-এর পঙ্‌ক্তি --- 'I speak and you hear me, hence we exist'। ওই... 'আমি যেন বলি, আর তুমি যেন শোনো / জনমে জনমে তার শেষ নেই কোনো। / দিনের কাহিনী কত, রাত চন্দ্রাবলী / মেঘ হয়, আলো হয়, কথা যাই বলি।' কিংবা 'আমি শুনবো শুনবো, তুমি বলবে। সন্ধ্যাবেলায়...'।
এত কথা, তবু নৃতত্ত্বের অনেক গবেষকই আজ বলছেন, মুখের কথায় চিঁড়ে ভেজে না। প্রেমের প্রশ্নে শরীরী ইঙ্গিতই নাকি ঢের বেশি কার্যকরী। ননভার্বালেই মানুষ বেশি আস্থা রাখে। তাহলে কি ঘুরে-ফিরে সেই সংকেত! অচানক চোখ মারা? শ্বদম্তে ঠোঁট কামড়ানো? সংকেত হলেও, এসব বড্ড অতুল বেদাদে স্টাইল। তার চেয়ে স্রেফ চোখে চোখ ভালো। আমার চোখে রাখো চোখ, কথার অবসান হোক। কাব্যে কৌশল থাকতে পারে, কথায় মারপ্যাঁচ। নীরবতা নিরপেক্ষ। নিখাদ। সে সংকেত হতে পারে, কিন্তু সাংকেতিক নয়। প্রতারক নয়। বরং সবচেয়ে সত্য। দুটো মানুষের মাঝখানে এই স্তব্ধতাই হয়তো বিশুদ্ধ প্রেমের ভাষা। না-বলেও যে অনেক কিছু বলে দিয়ে যায়, আজও। তুই না বুঝিস বয়েই গেল, আমার চোখে সকাল হয়।


দেশের আগামীকাল, নভেম্বর ২০১৪