05 April 2015

প্রক্সি কয়েদি

সুস্নাত চৌধুরী


মুরলীপ্রসাদ শর্মার হয়ে মেডিকালের এন্ট্রান্সে যিনি বসেছিলেন, তাঁর নাম আসলে ডক্টর রুস্তম পাভরি। হলে ঢোকার আগে সেই জালি ক্যান্ডিডেটকে মাত্র কয়েক মিনিটের মেক-ওভারে কলার-তোলা রংচঙে শার্টের বোতাম খোলা রেখে আর চুল ব্যাকব্রাশ করে স্রেফ একটু মুন্নাভাই-প্রতিম লুক দিতে হয়েছিল। পরীক্ষায় মুন্নাভাই প্রক্সি পেলেও, টাডা-র কেসে অবশ্য সে পথে হাঁটেননি সঞ্জয় দত্ত। কিন্তু তাঁর সাজন-তুতো ভাই-এর গাড়ি টায়ার ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারানোর মামলা পাক্কা এক যুগ পর আবার যে দিকে মোড় নিয়েছে, তাতে পাবলিক তুমুল বিস্ময়ে। অনেক নিন্দুক অনেক কিছু বলছে। আর সেই সূত্রে উঠে আসছে এমন গল্পগুজবের কথা, যেখানে এক জন লোক অপরাধ করার পর, সে অন্যকে গিয়ে বলছে, ভাই, তুই মিথ্যে বলে সব দোষ তোর কাঁধে নিয়ে নে, বদলে তোর ফ্যামিলিকে আমি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেব, তোর মেয়ের বিয়ের হিল্লে করে দেব।
১৯৯৯ সালে, বিজনেস স্কুলের পড়ুয়া বিত্তশালী পরিবারের ছেলে সঞ্জীব নন্দার বিএমডব্লিউ কেড়ে নেয় ছ’জনের জীবন। সে ঘটনার আদলেই বছর দুয়েক আগে নির্মিত হয়েছে ‘জলি এলএলবি’। সে ছবিতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো ও হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত রাহুল দেওয়ানের হয়ে কেস সাজাতে গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ যথারীতি বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘যত নষ্টের গোড়া’ ড্রাইভারকে। আদালতে সওয়াল করতে গিয়ে জাঁদরেল আইনজীবী সেই যুক্তিতেই যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন। শেষমেশ এই মিথ্যাচার ব্যর্থ হচ্ছে দূর গ্রামে পড়ে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। সেই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তিনিই একমাত্র জীবিত, অথচ পুলিশ রেকর্ড-মতে আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে!



দুর্ঘটনার পর মালিকের হয়ে প্রক্সি দিতে রাজি হয়েছেন এমন ‘সৎ’ ড্রাইভার চলচ্চিত্র আরও দেখেছে। তুরস্কের ছবি ‘থ্রি মাংকিজ’। থমথমে ছবিটি শুরুই হয় একটি গাড়ি দুর্ঘটনা দিয়ে। বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা সার্ভেট ফিরছিলেন নির্বাচনী প্রচার সেরে। ক্লান্ত শরীরে, বুজে আসা চোখে ড্রাইভ করছিলেন নিজেই। সহসা দুর্ঘটনা। এক পথচারীর মৃত্যু। ভয় পেয়ে পালালেন সার্ভেট। ভোটের মুখে এ খবর জানাজানি হলে তাঁর ভরাডুবি নিশ্চিত, অগত্যা মাঝ রাতে ঘুম-ভাঙানিয়া রিং-টোন বেজে উঠল ড্রাইভার এয়ুপ-এর ফোনে। মনিবের কথা মতো ছুটে গেলেন এয়ুপ। সার্ভেট বোঝালেন, মোটে তো মাস ছয়েক, বড়জোর এক বছরের মামলা; তার পর জেল থেকে বেরোলেই মোটা বকশিশ। এই ‘ডিল’ মেনে জেলে ঢুকলেন এয়ুপ। ন’মাসের কারাবাস। তারই মধ্যে সার্ভেটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন এয়ুপের স্ত্রী। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময়ও ঘরের পরিস্থিতিটা স্পষ্ট ছিল না এয়ুপের কাছে। হঠাৎই তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর ডাক পড়ল থানায়। পুলিশ জানাল, সার্ভেটকে হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর ছবির শেষাংশটি এক আশ্চর্য বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। ছেলে ইসমাইল মা’কে জানায়, খুনটি সে-ই করেছে। এয়ুপ তখন এক হতদরিদ্র ব্যক্তিকে বেছে নেন, তাঁকে সেই কথা বলেন, এক রাতে তাঁকে যা বলেছিলেন তাঁর মনিব। নিজের ছেলের অপরাধ অন্যের কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রস্তাব রাখেন হতভাগ্য এয়ুপ।
শুধুই টাকার লোভ নয়, কখনও আরও বড় কিছুও হয়তো থাকে অন্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অপরাধী সাজার এই খেলায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘আমি সে ও সখা’ সিনেমাটি হয়েছিল সত্তরের দশকে। সে ছবিতে দেখি, অর্থের মোহে ভুল করে ফেলা বন্ধু প্রশান্তকে (অনিল চট্টোপাধ্যায়) বাঁচাতে পুলিশের হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন নির্দোষ সুধীর (উত্তমকুমার)। সাত বছর সশ্রম কারদণ্ডের আদেশ হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন। এর মূলে কি সুধীরের বড় হয়ে ওঠায় প্রশান্তর পরিবারের যে ভূমিকা, সেই ঋণশোধ; না কি প্রকৃত বন্ধুত্বের চিরন্তন কোনও সংজ্ঞা! কোন পরিতৃপ্তির বশে পারে এক জন মানুষ, অন্যের কালির দাগ নিজের শার্টে লাগাতে? এ ছবিই যখন হিন্দিতে বানান হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, সেই ‘বেমিসাল’-এও এ সব প্রশ্নই জেগে ওঠে। অমিতাভ বচ্চনের লিপে যেখানে কিশোরকুমার গেয়ে ওঠেন— ‘মুঝে দোস্তোঁ সে শিকায়ত হ্যায় শায়দ, মুঝে দুশমনো সে মহব্বত হ্যায় শায়দ’। এমনকী খলনায়কের মতো কাজকর্মে, চোখমুখের তেমনই রিঅ্যাকশনে দর্শককে বোকা বানাতে চান, আর বন্ধুকে বাঁচাতে মিথ্যে কাগজপত্র বানিয়ে নিয়ে থানায় এসে সব দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নেন অমিতাভ। পুলিশ তাঁকে ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’ বললে, জবাব দেন ‘থ্যাংক ইউ’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সোনাই আর পরি-র ট্র্যাজিক প্রেমের ছবি ‘মনপুরা’-র কাহিনিও শুরু হয় এমনই এক অপরাধ ও তার দায়ভার গ্রহণে নিরপরাধ কাউকে রাজি করানোর মধ্যে দিয়ে। গাজি সাহেবের মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে গভীর রাতে একটি খুন করে বসে। ছেলেকে বাঁচাতে অপরাধী সাজিয়ে বাড়ির কাজের লোক সোনাই-কে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সুদূর দ্বীপেও তার সন্ধান পেয়ে যায় পুলিশ। সোনাইয়ের জেল হয়। মনিবের পরিবারকে রক্ষা করতে কয়েক মাসের এই অভিনয় সে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বদলে তার গোটা জীবনটাই ক্রমশ ছারখার হয়ে যায়। ‘অল্প বয়সে পিরিতি করিয়া, হয়ে গেল জীবনেরও শেষ।’ তার মনের মানুষ পরি-র সঙ্গেও ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন গাজি সাহেব। জামিনে ছাড়া পেয়ে সোনাই যে দিন ফেরে একটি বার পরিকে দেখার জন্য, জানতে পারে সে আত্মহত্যা করেছে। একই বিয়োগান্ত কাহিনি নিয়ে এই বাংলাতেও ছবি বানিয়েছেন অঞ্জন দাস। ‘অচিন পাখি’।
শুধুই জল-মাটি-বাতাসের নরম আবহে নয়, বিরল হলেও এমন সহজ মানবিক অবস্থানের দেখা মেলে অর্থ, ক্ষমতা আর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এ প্যাঁচানো ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট ড্রয়িংরুমেও। মধুর
ভান্ডারকর-এর ‘কর্পোরেট’-এ নিশিগন্ধা দাশগুপ্ত (বিপাশা বসু) বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেহগল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-কে। কোম্পানিকে ধসের হাত থেকে রক্ষা করতে গেলে সেহগল পরিবারের বাইরের কাউকে বিরাট কেলেঙ্কারির দায় নিতে হত। রাজি হয়ে যান সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিশি। টাকার লোভ নয়, সংস্থার স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর। এর পর এনকোয়ারি কমিশন তাঁকে হেফাজতে নেয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও, অন্য রকম বোঝাপড়া হয়ে যায় উপরমহলে। বলির পাঁঠা হন নিশি।
তবে, সবচেয়ে বিস্ময় জাগে যখন ব্যক্তিগত স্বাের্থর কথা না ভেবে দাগি ক্রিমিনালরাই এই মানবিকতার শরিক হন। জরাসন্ধর ‘লৌহকপাট’-এ এমনই এক চরিত্র বদরউদ্দীন মুন্সী। সে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত। সে দিন ছিল এক বিত্তশালী সীতানাথ দত্তের মেয়ের বিয়ে। রাতে আক্রমণ করল তার ডাকাত দল। টাকাপয়সা সোনাদানা নিয়ে ফেরার পথে বদরউদ্দীনের চোখে পড়ে গেল তেতলার বন্ধ ঘরে লুকিয়ে রাখা ফুটফুটে কনেটি। গায়ে অন্তত হাজার দশেক টাকার জড়োয়ার গয়না। বদরউদ্দীনের শরীর থেকে তখন লোভ নামক বস্তুটি ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। বদলে ভেসে উঠছে তার আদরের নূরজাহানের মুখ— আট বছর আগে যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল সে, তার পর আর যে-মেয়ে ফিরে আসেনি। সেই কনের দামি গয়নায় হাত ছোঁয়াতে না পেরে ছুটে বেরিয়ে আসে বদরউদ্দীন। খানিক পরে আবার ফিরে গিয়ে দেখে তারই দলের এক জন মেয়েটিকে ধর্যণ করেছে। তার সদ্যবিবাহিত স্বামীকে খুন করেছে। বদরউদ্দীনের সব কিছু গুলিয়ে যায়। সে দিনই দুর্বল কিছু বরযাত্রী তাকে ধরে ফেলে। তার পর অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতাল। সেখানেই হাকিম ডেকে স্ব-ইচ্ছায় সে জবানবন্দি দেয়। জানায়, সে-ই এই খুন ও ধর্ষণ করেছে। এর পর জরাসন্ধ বলছেন, ‘একটা কথা শুধু বুঝতে পারছিনে। অপরাধী তার কৃত-অপরাধ স্বীকার করেছে, এটা নতুন নয়, অদ্ভুত কিছুও নয়। কিন্তু যে-অপরাধ সে করেনি, তারই বোঝা স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে হাকিম ডেকে হলপ করে বলেছে, এটা আমি করেছি— এরকম তো কখনো শুনিনি। এর মধ্যে বাহাদুরি থাকতে পারে, কিন্তু একে সৎসাহস বলে না।’
আজকের দুনিয়াতেও এমন প্রক্সি হরবখত ঘটে চলেছে। তা সে কলেজের গার্জেন কলে ভাড়াটে বাপ-মা নিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালের ভর্ৎসনা খাওয়ানোই হোক, বা কলকাতার পাতাখোরদের ভাষায় ‘পাঁচাইন’ কেসে অন্যের হয়ে দু-তিন দিনের জন্য জেল খাটাই হোক। ডেলি তিন-চারশো টাকায় রোজগার তাতে মন্দ না! বিহারেও নাকি কেউকেটাদের হয়ে জেলে ‘দাখিল’ হতে নির্দিষ্ট লোক পাওয়া যায়। জেল খাটাই নাকি তাদের পেশা। শোনা যায়, বাংলাদেশেও নাকি চার-পাঁচ বছর, এমনকী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কেসেও নকল আসামির সন্ধান মিলেছে। এককালীন দু’লক্ষ ও মাসিক পাঁচ হাজার টাকা চুক্তিতে বছর কয়েক আগেই একটি ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবনের প্রক্সি দেওয়া শুরু করেন ঢাকার এক রিকশাওয়ালা। পরে ধরাও পড়ে যান। আবার দিনাজপুরের যে সব এলাকায় বেআইনি মাদকচক্রের রমরমা, সেখানেও নাকি এমন লোক আছে, কেউ মাদক সংক্রান্ত মামলায় ফাঁসলে, তাঁর হয়ে ‘প্রফেশনালি’ জেল খেটে দেন। বাস্তবের এই দুনিয়াকে বিলক্ষণ চিনত, কাজেই ‘হযবরল’-র ন্যাড়া কোনও দিনই বোকা ছিল না। আসামি নেই দেখে তাকে যখন ভুলিয়ে-ভালিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল, সে যথার্থই ভেবেছিল, ‘আসামীরাও বুঝি পয়সা পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না’!


আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ এপ্রিল ২০১৫

26 January 2015

হাজারটা শার্লি এবদো

সুস্নাত চৌধুরী



কার্টুন ১


কোনো কিছুর প্রতিবাদ করতে হলে তাকে হাস্যাস্পদ করে তোলার চেয়ে মাখন রাস্তা আর হয় না। গালাগালি বা গোলাগুলির চেয়ে ঢের বেশি কাজ হয় কাউকে লজিকালি খোরাক করে তুলতে পারলে। ক্ষমতার দম্ভ বা শক্তির ন্যায়হীনতা তখন বাধ্যত ধুলোতে হামাগুড়ি দেয় কলমের খোঁচায়, তুলির আঁচড়ে। পাল্টা ঘুরে দাঁড়ানো অন্তত তখনকার মতো তার পক্ষে আর সম্ভবই হয় না --- কারণ চোখা বুদ্ধির সূক্ষ্মরস তার ধূসর কোষে তো নেই-ই, সোনালি কোষাগারেও নেই। অগত্যা, ক্ষমতার চিরাচরিত প্র্যাকটিসে সেই গালাগালি বা গোলাগুলিকেই আঁকড়ে ধরে সে। বোকার মতো, বুদ্ধিকে কাউন্টার করতে যায় শক্তি দিয়ে। রাজা ও রানি তাই বরাবর হেরে এসেছে জোকারের কাছে। ভয় বা ভীতি আর যাকেই বাগে আনুক না কেন, হাস্যরসকে কখনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সেই হাস্যরস, যা শুধু হাসায় না, ভাবায়ও। কারণ তার উৎসবিন্দুতেই রয়েছে গভীর কোনও ভাবনা। সেই ভারী ভাবনাই যখন হালকা ঢঙে ভেসে ওঠে মজা-পুকুরে; বেশিটা ছবিতে, বাকিটা কথায় --- কার্টুনের জন্ম হয়। নিছক ঠেস দেওয়া বা হ্যাটা করা নয়, সার্থক কার্টুনের উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক। আলোর আড়ালে থাকা অন্ধকারকে সে আন্ডারলাইন করতে চায়। সোজা কথায়, কিন্তু বাঁকা ভঙ্গিতে। এই প্রতিবাদধর্মিতাই কার্টুনের মেরুদণ্ড। দণ্ডপ্রাপ্তির তোয়াক্কা সে করে না।

কার্টুন ২
চণ্ডীবাবু যেমন বলেছিলেন তাঁর 'কার্টুনের ইতিবৃত্ত' বইয়ের ভূমিকায় --- 'যুগোত্তীর্ণ সব কার্টুনেই আছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ভোরের পূরবী নয়, মেঘ গর্জনের সমতালে দীপক রাগিণী।' এ প্রতিবাদ নানা কিসিমের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় ক্ষমতার আস্ফালনকে পাবলিকলি নগ্ন করে দেওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা রাষ্ট্র বা শাসক বিরোধী। প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ওয়ালপোলের দানছত্রের প্রবণতাকে বিদ্ধ করে ছাপা হয়েছিল শিল্পীর নামহীন একটি কার্টুন। অষ্টাদশ শতকের সেই ছবিটি উল্লেখ্য এ কারণেই যে, সেখানে ওয়ালপোলের মুখ দেখানো হয়নি, আক্ষরিকভাবেই নগ্ন করে দেখানো হয়েছিল উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ! (কার্টুন ১) তবে, এ বিষয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন কার্টুনিস্ট ডেভিড লো। ইংল্যান্ডের কাগজে কাজ করেও, নাইটহুড পেয়েও, তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও বর্ণবিদ্বেষের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে কার্টুন এঁকেছেন। কখনওই চার্চিলের চামচাগিরি করেননি। উল্টে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল, রুজভেল্ট, এমনকী স্তালিনও নাকি প্রমাদ গুনতেন ওয়ান ফাইন মর্নিং তাঁদের নিয়ে ফের কী নতুন খোরাকই না রচনা করবেন লো! (কার্টুন ২)

কার্টুন ৩
সমালোচনা সইতে না-পারা রাষ্ট্রশক্তির খাঁড়াও বহুবার নেমে এসেছে, কিন্তু কার্টুনিস্টের হাতে শেকল পরানো যায়নি। ফরাসি বিপ্লবের পর নাগাড়ে রাজা লুই ফিলিপের প্রতিবাদ করছিল প্যারিসের 'লা কারিকাতুর' পত্রিকা। রাজাকে অবমাননার অভিযোগে সম্পাদক শার্লে ফিলিপঁ-র বিচার চলল। আত্মপক্ষ সমর্থনে ফিলিপঁ বললেন, যেকোনও কিছুর সঙ্গেই যেকোনও কিছুর মিল দেখানো সম্ভব! উদাহরণস্বরূপ কার্টুনের ঢঙে এঁকে দেখালেন একটি নাশপাতির সঙ্গে রাজার মুখের সাদৃশ্য। (কার্টুন ৩) ব্যাপার হল, ফরাসি স্ল্যাং-এ নাশপাতি বা 'la poire' বলতে বোঝানো হয় : মাথামোটা। কাজেই, ফিলিপঁ-র কারাবাস সেদিন আর ঠেকায় কে! একই সঙ্গে, এরপর তামাম ফ্রান্সে মহামান্য লুই ফিলিপের কথা এলেই 'মাথামোটা' নাশপাতির অনুষঙ্গ উঠে আসাকেও আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না রাজশক্তি। এদেশেও যেমন জরুরি অবস্থার সময়ে কার্টুনে শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর মুখাবয়ব হয়ে উঠেছিল রাক্ষুসির মতো। (কার্টুন ৪) তখনই শুরু হয় রাষ্ট্রের খবরদারি। সেন্সরের ছাড়পত্র পায় না আর কে লক্ষ্মণ কিংবা আবু আব্রাহামের তুখোড় সব কার্টুন। (কার্টুন ৫) কার্টুনে কার্টুনে রাজীব গাঁধীকেও তাড়া করে ফিরেছিল বোফর্স কামানের ছায়া। (কার্টুন ৬)

কার্টুন ৪

কার্টুন ৫

কার্টুন ৬

আজও অসীম ত্রিবেদীর মতো কার্টুনিস্টের লাগাতার ব্যঙ্গ বেশিক্ষণ নিতে পারে না রাষ্ট্র। কিন্তু কোণঠাসা করে তাঁদের প্রতিবাদী স্বরও চাপা দেওয়া যায় না। চারু রায় থেকে কুট্টি, পিসিয়েল থেকে সুফি --- পেটে খিল ধরিয়েছেন, মগজের খিল খুলে দিয়েছেন। আজও রসবোধের অভাব আর বোকামির হাতে হেনস্থা হতে হয় অম্বিকেশদের। কিন্তু তারপর আর কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় না মুকুলেই ঝরে না-পড়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়া তুমুল খিল্লিসমূহের। কেননা, রেলমন্ত্রক থেকে সারদা --- টাইমলাইন রিপিট্‌স ইটসেল্ফ। (কার্টুন ৭) 

কার্টুন ৭

শুধু ক্ষমতার আধিপত্যই নয়, সমাজকাঠামো ও সমাজের ভেতরে ঘটে চলা নানা কিছুও ধিকৃত হয়েছে কার্টুনে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিঁধেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আঁকলেন 'বিদ্যার কারখানা'। দেখালেন ভারী বইয়ের চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গ্র্যাজুয়েটদের। (কার্টুন ৮) বছর ষাটেক পরও সমান প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া এ ছবিই যেন অবিকল দৃশ্যায়িত হল পিংক ফ্লয়েড-এর গানে --- All in all it's just another brick in the wall! শিক্ষাযন্ত্র যেখানে খুদে পড়ুয়াদের পিষে তৈরি করল সুস্বাদু সসেজ। অসহযোগ আন্দোলনের সময় চিত্তরঞ্জন দাশের বিদেশি শিক্ষা বর্জনের ডাকে স্কুল-কলেজ খাঁ খাঁ করতে লাগল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিরোধিতা করলেন। এবার আশুতোষকে ব্যঙ্গ করে জোড়া-কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ। 'বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিযোগ --- Man proposes fire' ও 'বিশ্ববিদ্যালয়ে জলযোগ, God Disposes --- Sweets'। (কার্টুন ৯, কার্টুন ১০) এ ধরনের সামাজিক প্রেক্ষিত নিয়ে সব শিল্পীই কম-বেশি কাজ করলেও, বিশেষভাবে উল্লেখ্য গোয়ার কার্টুনিস্ট মারিও মিরান্ডা-র নাম। তাঁর কার্টুন প্রতিবাদী, কিন্তু মোলায়েম। গরম, কিন্তু নরম।

কার্টুন ৮
কার্টুন ৯
কার্টুন ১০













ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতাও উঠে এসেছে কার্টুনে। ষোড়শো শতকের প্রথমার্ধে পোপের বিলাসবহুল জীবনযাপনকে বিদ্ধ করেন শিল্পী লুকাস ক্রানাক। বন্ধু মার্টিন লুথারও রুখে দাঁড়ান ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। প্রচারপত্রে ছাপেন পোপ-বিরোধী দু'টি কার্টুন --- The Pope-Donkey of Rome (কার্টুন ১১) ও The Monk-Calf of Freiberg। অষ্টাদশ-উনিশ শতকে ধর্মান্ধতার প্রতিবাদ করেন স্পেনীয় শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়া। কাজেই, 'শার্লি এবদো' আজ নয়, আগেও ছিল। গুলি চালালে তাদেরও ঠান্ডা করা যেত না।

কার্টুন ১১

এমন উদাহরণ খুব বিরল নয়, যেখানে এক কার্টুনিস্ট তাঁর প্রিয়জনকেও রেয়াত করছেন না। সৎ কার্টুনিস্টের প্রতিবাদী সত্ত্বা এতটাই প্রবল। বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও স্যারেন্ডার নট ব্যানার্জি-কে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। বিলেতেও দেখি, কার্টুনিস্ট ভিকি লেবার পার্টির সমর্থক ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর্নেস্ট বেভান যখন লেবার পার্টির সরকারেরই প্রধানমন্ত্রী হলেন, ভিকি তাঁকে ছেড়ে কথা বলেননি। চণ্ডী লাহিড়ীর এক আবাল্য বন্ধু মন্ত্রী হওয়ার পর, তাঁকে নিয়ে কার্টুন আঁকেন চণ্ডী। তাতে সেই বন্ধু বিস্তর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব খোয়া গেলে রাতারাতি সেই তিনিই চণ্ডীর গুণগ্রাহী হয়ে পড়েন। সব দেশে, সব কালেই রাজনীতিকের অবস্থান বদলায়। প্রকৃত কার্টুনিস্টের বদলায় না। তুলি-কলম হাতে সে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে সম্ভাবনাময় সাদা পাতার সামনে। আইডিয়া ছাড়া তার কোনও বন্ধু নেই।


সহায়ক
কার্টুনের ইতিবৃত্ত, চণ্ডী লাহিড়ী
কার্টুন সংখ্যা, কিঞ্জল পত্রিকা, ১৯৮৫
দি গেমস অব এমারজেন্সি, আবু আব্রাহাম
কার্টুন পত্তর, www.cartoonpattor.in

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫