04 September 2016

সব ন্যাটে আছে

সুস্নাত চৌধুরী




রাশিচক্রের হিসেবে তাঁর নাম ছিল ‘সর্বজ্ঞ’। সর্বজ্ঞ গঙ্গোপাধ্যায়। জন্ম ১৩৪৩ সনের ২৯ শ্রাবণ। সিংহ রাশি। এহেন ‘সর্বজ্ঞ’ পুরুষসিংহের নামকরণ অবশ্য করা হয় লালমোহন গাঙ্গুলি। পরে ছদ্মনাম নেন ‘জটায়ু’। জটায়ুর লেখক জীবনে প্রকৃত প্রস্তাবেই সর্বজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন প্রদোষচন্দ্র মিত্র। যাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের খানিকক্ষণের মধ্যেই জটায়ুকে বলতে হচ্ছে – ‘ভাগ্যিস বললেন। নেক্সট এডিশনে ওটা কারেক্ট করে দেব।’ আবার এই ফেলু মিত্তিরের মাইক্রফ্‌ট হোমস ছিলেন সিধুজ্যাঠা। সিদ্ধেশ্বর বোস। সর্বজ্ঞেরও যে তর-তম হয়, তা এই পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেই স্পষ্ট। সত্যজিতের লেখায় নয়, তবে সন্দীপের ছবিতে (গোরস্থানে সাবধান!) সিধুজ্যাঠা ফেলুদাকে বলছেন – ‘আর, এখন ওই ইন্টারনেট নামক বস্তুটি তো আছেই!’ তারপর, সিধুজ্যাঠাও যখন ব্যর্থ হচ্ছেন, জটায়ুর ভাষায় ‘পেরিপিটার’, মানে, পেরিগ্যাল রিপিটারের খোঁজে ফেলুদাকে ঢুকতে হচ্ছে সাইবার ক্যাফেতে। খুলতে হচ্ছে গুগল। কারণ, সে ততদিনে আমাদের প্রায় সবার কাছে সর্বজ্ঞ। আলটিমেট সবজান্তা।
আজ সেই গুগলই পূর্ণ করল আঠেরো বছর বয়স। এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়। সেই সংশয়হীনতার আশ্রয় এমনই ছায়াঘেরা, সেই নিশ্চয়তার বন্ধুহাত এত দূর সমর্থ যে বিশেষ্য থেকে ক্রমে ক্রিয়াপদ হয়ে উঠেছে গুগল। ‘ঘর পে যাকে তুম গুগল করলো’। যখন-তখন যে কোনও প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমরা আজ খাওয়া-বসা-শোওয়ার মতোই নির্দ্বিধায় গুগল ‘করছি’। পরিসংখ্যান বলছে, ওয়েব-দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ গুগলের মাধ্যমেই সার্চ করে থাকেন। দিনে নিদেনপক্ষে কুড়ি কোটি মানুষ গুগলের দরজায় এসে কড়া নেড়ে যান। এ পোড়া বাংলাতেও ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে গুগল। পারলে সাইবার ক্যাফেতে ফেলে-আসা পেন-ড্রাইভ কি খাইবার ক্যাফেতে ফেলে-আসা ভিজে বাঙালির ছাতাটিও যেন খুঁজে দেবে সে! বউ গেলে বউ, মায়, মা গেলে মা-ও!
ঈশ্বরই বটে! আগে লোকে বলত, ‘সব ব্যাদে আছে’। গুগলের কৃপায় আজ বলছে ‘সব ন্যাটে আছে’। কেষ্ট, খ্রিস্ট, আল্লাহ – সকলেই মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ। আজ গুগলের অবস্থানও কি সেরকমই হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? তা নইলে ফেসবুকে বা ব্লগে ‘জ্ঞানতীর্থ জ্ঞানরত্ন জ্ঞানাম্ভুধি জ্ঞানচূড়ামণি’ জাঁদরেল কুইজ মাস্টারটিকেও ডিসক্লেমার দিতে হয়, ‘গুগল না করিলে বাধিত হইব’! তা নইলে কি প্রতিষ্ঠা পায় ‘সিওজি’, মানে, ‘চার্চ অব গুগল’! যেখানে লোকে ঈশ্বর ঠাওরে উপাসনা করে গুগলের। কানাডার ম্যাট ম্যাকফারসনের এই বিচিত্র কীর্তির পর পেরিয়ে গিয়েছে দশ বছর। সেই চার্চে গুগল-উপাসকদের জন্য রয়েছে টেন কম্যান্ডমেন্টস, রয়েছে প্রার্থনা সংগীত! জিংগল বেল-এর সুরে তা শেষ হচ্ছে এই ভাবে – ‘Oh, Google's god, Google's god, I'm praying to her now. This prayer is just about over, so it's time to take my bow!’ কেবল সুরের সুতোয় শব্দ জুড়ে বানানো অ্যানালগ বাক্যবন্ধ নয়, চালু রয়েছে এই প্রার্থনা সংগীতের শূন্য-এক দিয়ে গাঁথা মালার বাইনারি গাথাও!
এখন কথা হল, আদৌ কি কারো পক্ষে ‘সবজান্তা’ বলে কিছু হওয়া সম্ভব? পরিভাষায় যাকে বলে ‘অমনিসিয়েন্ট’ কিংবা ‘প্যান্টোম্যাথ’। মাইক্রোসফ্‌ট নয়, মাইক্রফ্‌ট-এর প্রসঙ্গে কোনান ডয়েল লিখছেন, ‘অল আদার মেন আর স্পেশালিস্টস, বাট হিজ স্পেশালিজম ইজ অমনিসিয়েন্স’। কিন্তু এই ‘চূড়ান্ত’ হয়ে ওঠা তো একটা ধারণা মাত্র। আপেক্ষিকতার জালে-জড়ানো এক বিষম ধাঁধা। জটায়ু > ফেলুদা > সিধুজ্যাঠা – এই সম্পর্ক যে আপেক্ষিকতার নিদর্শন। পণ্ডিত হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গার্গীর র‍্যাপিড ফায়ারের শেষ দিকে যাজ্ঞবল্ক্যকেও প্রায় হুমকির সুরে কথা বলতে হচ্ছে। কতকটা ধম্‌কেই তিনি থামিয়ে দিচ্ছেন গার্গীকে। তা কি শেষ সত্য জানা নেই বলে, না কি সেই চূড়ান্ত সত্যটি প্রকাশিত হয়ে পড়লে ইহ জগতেরই আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না, সেই ভয়ে। ঠিক যেমন সর্বজ্ঞ ‘কম্পু’ প্রোফেসর শঙ্কুকে বলেছিল – ‘...আর সাড়ে তিন মিনিটে ভূমিকম্প হবে। মৃদু কম্পন। টের পাবে, তাতে কারুর ক্ষতি হবে না। আর তখনই আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর আমি পাব। সে উত্তর কোনও মানুষে পাবে না কোনওদিন।’ তারপর, শঙ্কু তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন – ‘ঠিক ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় পায়ের তলার মেঝেটা কেঁপে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে এক অপার্থিব বর্ণচ্ছটা বিকীর্ণ করে কম্পুর দেহ সশব্দে খণ্ড খণ্ড হয়ে স্ফটিকস্তম্ভের উপর থেকে শ্বেতপাথরের মেঝেতে পড়ল, তার ভিতরের কলকবজা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ধুলোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই ভগ্নস্তূপ থেকে একটা রক্ত হিম করা অশরীরী কণ্ঠস্বর বলে উঠল – ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি!’’ সবজান্তার এই ধাঁধাটি আরেক ভাবে খুব সহজ কথায় তুলে এনেছেন দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী। লন্ডনের গ্রেশ্যাম কলেজে এক বক্তৃতায় তিনি বলছেন – বুদ্ধ যদি সর্বজ্ঞ হন, আবার মহাবীরও যদি সর্বজ্ঞ হন; মানে, দু’জনেই যদি সবই জানেন, তাহলে তাঁদের মধ্যে মতানৈক্য হল কেন!
তবু যখন আশৈশব বলি, ‘আমার মা সব জানে’ – তখন সেই সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না। জীবনের সব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে আজও যখন নির্দ্বিধায় বনস্পতির ছায়ায় এসে দাঁড়াই, তখন আমার বাবা আমার ঈশ্বর। আমার শেষ সর্বজ্ঞ। কিংবা যখন ভাবি, ‘এই বেলা প্রশ্নটা লিখে রাখি গুছিয়ে / জবাবটা জেনে নেব মেজদাকে খুঁচিয়ে’ – তখন সবজান্তা মেজদা আমার একান্ত গুগল। আমার ভরসা। ভরসা যেন পড়ায় এবং ভরসা যেন পড়তে আসে। কিন্তু, এই ভরসারই দেখনদারিত্ব, এই প্রবল সবজান্তাপনাই আমাদের বেপথু করে যখন অপরের প্রতি এক সহজাত হ্যাটা-প্রবণতা দুন্দুভি-নিনাদে উচ্চারিত হয় – ‘বল্‌বে কি, তোমরাও নোট্‌বই পড়নি!’ তবু সংসারের গোলকধাঁধায় বারে বারে সবজান্তার ভূমিকায় অভিনয় করতে নেমেই পড়ি আমরা। সহকর্মীটির বস হতে হলে কি সহধর্মিনীটিকে বশ করতে হলে, জীবনের গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ সবজান্তা ছাড়া যে আমার-আপনার সাজার আর কিচ্ছুটি নেই। জিডিপি থেকে জিলিপি, রেশন থেকে রিসেশন – জগৎ-সংসারের সমস্ত কিছুর গুঢ় রহস্যই আপনার নখের ডগায় থাকুক না-থাকুক, জিভের ডগায় বিলক্ষণ থাকবে! পেটে না আসুক, মুখে আসা চাই। তখন সক্রেটিসের নাম আপনার ঘুণাক্ষরেও মনে আসবে না। আপনি জানেন না যে আপনি জানেন না।
আসলে দুলিরাম আর শ্যামচাঁদই আমাদের আর্কেটাইপ। দুলিরাম প্রসঙ্গে সুকুমার লিখছেন – ‘দু-চারিটি বড় বড় শোনা কথা আর খবরের কাগজ পড়িয়া দু-দশটা খবর এইমাত্র তাহার পুঁজি, তারই উপর রঙচঙ দিয়া নানারকম বাজে গল্প জুড়িয়া সে তাহার বিদ্যা জাহির করিত।’ আর দ্বিতীয়জনকে নিয়ে বলছেন – ‘বয়সের হিসাবে শ্যামচাঁদ একটু বেঁটে ছিল। পাছে কেহ তাকে ছেলেমানুষ ভাবে, এবং যথোপযুক্ত খাতির না করে, এই জন্য সর্বদাই সে অত্যন্ত বেশি রকম গম্ভীর হইয়া থাকিত এবং কথাবার্তায় নানা রকম বোলচাল দিয়া এমন বিজ্ঞের মতো ভাব প্রকাশ করিত যে স্কুলের দারোয়ান হইতে নিচের ক্লাশের ছাত্র পর্যন্ত সকলেই ভাবিত, ‘নাঃ, লোকটা কিছু জানে!’’ বলা বাহুল্য, পাঠকও জানেন, প্রথম গল্পটির নাম ‘সবজান্তা’, আর দ্বিতীয়টির ‘চালিয়াৎ’! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইশকুল-জীবনে শেখা অসংখ্য আমিষ ভোকাবুলারির মধ্যে এই নিরামিষটিও ছিল – ‘সবজান্তা গেঞ্জিওয়ালা’! সবজান্তা হওয়ার সঙ্গে হোসিয়ারি শিল্পের কী সম্পর্ক বলা মুশকিল। তবে মনে আছে, বছর বিশেক আগে সেই সব চলতা-ফিরতা সাইক্লোপিডিক দেখনদারি মানুষজনের উদ্দেশে এই বাক্যবাণ ছুড়ে দেওয়াই ছিল রেওয়াজ। আজ কাচের ঘরে বসে থাকি, তাই ঢিল ছুড়তে ভয় লাগে। বরং দরকার হলেই টুক করে গুগল করে নিই। আর গুগলেও সুবিধে না করতে পারলে, তারিণী কবিরাজের মতো বলে উঠি – ‘হয়, Zানতি পার না’।


ছুটি, সংবাদ প্রতিদিন, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

09 August 2016

ফেসবুকভরা ভালবাসা

সুস্নাত চৌধুরী


আরেকটা পৃথিবী, এবং যে পৃথিবীতে আপনিও আছেন। ‘লেট দেয়ার বি কানেক্টিভিটি’ উচ্চারণে সেই অপর দুনিয়ার জন্ম কোনো ঈশ্বর দেননি; দিয়েছিলেন হার্ভার্ড-এর ছোকরা মার্ক জুকেরবার্গ। সেই ‘সৃষ্টির আদি’ মোটে দশ-বারো বছর আগের কথা। অথচ এটুকু সময়েই যেন আবিশ্ব বদলে গেল বিশ্ব। আকাশ ছেয়ে যাওয়া বিপুল তরঙ্গ হয়ে উঠল সম্পর্কের সুতো। ভার্চুয়াল ঈশ্বরের বানানো বস্তুময় পৃথিবীর জায়গা নিতে থাকল রক্ত-মাংসের মানুষের বানানো ভার্চুয়াল পৃথিবী। যত গড়াচ্ছে দিন সেই দুনিয়ায় বেঁচে থাকছে আরও বেশি মানুষ। বাড়ছে সেখানে মরা মানুষের সংখ্যাও।
ইয়াহু মেসেঞ্জার কিংবা অরকুট-এর মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম তখনও ছিল, কিন্তু ‘ফেসবুক’ নামক বদনবইটি যে এভাবে একদিন রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে সর্বব্যাপী হয়ে উঠবে, দেখা দেবে রূপ থেকে রূপান্তরে, শুরুতে তা সম্ভবত জুকেরবার্গ সাহেবও আন্দাজ করতে পারেননি। ক্রমে যত লম্বা হয়েছে টাইমলাইন, ততই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ফেসবুক। কখনও মনের আয়না, কখনও বন্ধুত্বের ব্যালকনি, কখনও আবার রাজনীতির রণাঙ্গন। ভিতর ও বাহির – দু’দিকের জানলা খুলেই সে ইউজারকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছে। ব্যক্তিক অনুভূতিকে যেমন স্পেস দিয়েছে, তেমনই অস্বীকার করেনি নেহাত কেজো প্রয়োজনগুলিকে। আবার শুধু ইউটিলিটির ক্লান্তিকর ফর্দও বানিয়ে তোলেনি, ইউটোপিয়ার হাতছানিও রেখেছে। চেপে-রাখা কথা, আটকে-থাকা কান্না, মনে-পড়া হাসি... অক্ষর হয়ে ছবি হয়ে তার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে। প্রযুক্তিগত জায়গা থেকে তো সামগ্রিক ভাবেই কৃতিত্বের বটে, কিন্তু কনসেপ্টের ক্ষেত্রে মনে হয় ফেসবুকের সাফল্য আরও বেশি, সম্ভবত যা লুকিয়ে আছে তার এই দ্বৈত অবস্থানের মধ্যেই। এমন বন্ধু আর কে আছে!‍
প্রাথমিক ভাবে তথ্য দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যম হলেও, মানুষ ফে বু-কে নিজের মতো করে কাস্টমাইজ করে নিয়েছে। হারিয়ে-যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া কিংবা দূর-দেশি সমমনস্কের সঙ্গে যোগাযোগ – এটুকুতেই সে থেমে থাকেনি। আসলে তার কাছে ফেসবুক হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সমার্থক। ফেসবুক নিজে একটি এস্টাব্লিশমেন্ট হয়েও মানুষের হাতে ধরা দিয়েছে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্টের হাতিয়ার হিসেবে। মানুষ এখানে নিজেই নিজের কথা বলতে পেরেছে। এলাকার খবরটা সক্কলকে জানাতে টিভি ক্যামেরার জন্য বসে থাকতে হয়নি। ব্যান্ডের শো-এর জন্য বিজ্ঞাপনে মোটা টাকা খসাতে হয়নি, কেবল একটা ইভেন্ট টাঙিয়ে দিয়েই বেমালুম হাউসফুল করা গিয়েছে। সেলেব না হয়েও নিজের পাতাটি পেজ ফোরের মতো সাজিয়ে নেওয়া গিয়েছে। অ্যালবাম বানিয়েছে সে দিনের পোশাকের, রাতের মেনুর। হোক না কাঁচা, অপাঠ্য, তবু অন্তর থেকে লেখা কবিতাটা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে কোনো পত্রিকার দফতরে হত্যে দিতে হয়নি, কোনো সম্পাদককে তেল দেওয়ারও দরকার পড়েনি। বরং পাঠকের মতামতও সহজেই জানতে পেরেছে। এই যে ‘সাধারণ’ থেকে ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠা, ‘জনৈক’ থেকে হয়ে ওঠা ‘স্বয়ং’ – এই পরিবর্তন প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষেরই শক্তি বাড়িয়েছে। সেই শক্তি কতটা, তার নিদর্শন দেখিয়েছে আরব স্প্রিং। রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানকেও সে ছেড়ে কথা বলেনি। বহুলাংশে ফেসবুক হাতিয়ার করেই মিশরে হোসনি মুবারককে গদিচ্যুত করেছে জনতা। ব্যাপারটা অনেকদিনই এই জায়গায় পৌঁছেছে যে প্রতিষ্ঠানকেও গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াতে হয়েছে ফেসবুকের মঞ্চে। দেশের সরকারও তাকে বাদ দিয়ে আর ভাবতে পারছে না। বলা যায়, এস্টাব্লিশমেন্টও আজ এক প্রকার বাধ্যই হয়েছে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্টের অংশ হয়ে উঠতে।
ফেসবুকের এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ইমেজ কাজ করেছে তাদের ‘ফ্রি বেসিক’ চালু করার উদ্যোগেও। কিন্তু বিনামূল্যে কিছু সাইট ব্যবহার করতে পারার প্রস্তাব নাকি নেট নিরপেক্ষতা বিরোধী, ভারতে তাদের প্রয়াসের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য ছিল বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশেরই। সে আশঙ্কা অমূলক নয় বটে। আর ফেসবুক যে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান, আমি-আপনি পোস্ট শেয়ার করলে ফেসবুকেরও শেয়ার মহার্ঘ হয়, তা তো জানা কথাই। আবার এ-ও ঠিক, ‘ফ্রি বেসিক’ নিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্তই ভবিষ্যত অনুমান করে এক সম্ভাব্যতার খাতিরে গ্রহণ করা। নেট নিউট্রালিটি আদৌ কতটা সফল হবে, তা যে একটি ডবকা অশ্বডিম্ব প্রসব করবে না, হলফ করে তা-ই বা কে বলতে পারে! কাজেই, ফেসবুক ‘ধান্দা’ করছে বলেই হুট করে কি তাকে ‘ধান্দাবাজ’ বলে দেগে দেওয়া যায়? যে অবদান সে মানব সমাজে রেখেছে, তাকে অস্বীকার করা তো সম্ভব নয়। এমনকী তার প্রভাব সর্বদা কল্যাণকর না হওয়া সত্ত্বেও। কখনও সে ত্বরাণ্বিত করেছে সম্পর্কের ভাঙন, কখনও জন্ম দিয়েছে মানসিক অতৃপ্তির – এমন উদাহরণ সারা পৃথিবীতেই আজ ঢের। এই ফেসবুকে তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা; একটি পাখির গান কী রকম ভালো।


পঁচিশ পুরাণ, সংবাদ প্রতিদিন, ৯ আগস্ট ২০১৬