18 November 2013

‘সুলভ’

সুস্নাত চৌধুরী


ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ফ্রি কিংবা একটাকা
নিশিডাকেরও বাড়া হিসিডাক। ডাক এলে, জিপার-সর্বস্ব পুং, আপনি যেকোনও ওয়ালেই পোস্ট করতে পারেন। তবে, দেওয়ালে মা দুগ্গা আর বাবা লোকনাথের টাইল দেখলে ব্যক্তিগত পোস্টাপিস খুলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে ডাকঘরে। তোমার ডাকে সাড়া দিতেই, বহে গেছে...! আপনি কেগেল এক্সারসাইজের বিস্ময় বালক, উসেইনতর গতিতে পৌঁছে যাবেন ওই দূরে --- কংক্রিটের আধখাওয়া অকর্পোরেট কিউবিকলে। বলে লাভ নেই, ইটের ধাপে আপনি পা রাখতে পারবেন না; কেননা আপনার আগের জন রাখেননি। কারণ, তার আগের জনও রাখেননি। তার আগের জনও...। বিনে পয়সার পৌনপুনিকতা কাটাতে চাইলে আপনি খুঁজবেন এ এলাকায় দুর্লভ একটি সুলভ। কমপ্লেক্স তো বটেই ব্যাপারটা। তার ওপর গ্যাঁটগচ্চা আছে। খুচরোর আকালে পার্সে কয়েন না থাকলে রবিঠাকুর কয়েনই শেষ পারানির কড়ি। ‘দ্বারী মোদের চেনে না যে, বাধা দেয় পথের মাঝে, বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি, লও ভিতরে ডেকে ডেকে’। মুক্ত। ধারা।
আপনিও চেনেন না বিন্দেশ্বর পাঠককে। পদ্মভূষণ, ১৯৯১। একটাকায় মুক্তির কারিগর। আপনার ওয়াটার-লু যুদ্ধের বিরুদ্ধেই তাঁর ‘সুলভ আন্দোলন’। সেই ১৯৭০-এ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন সুলভ ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস অর্গানাইজেশন। আপনি জানেন না তিনি ডবল এমএ। পিএইচডি, ১৯৮৫, পটনা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বেচারার বিদ্যালয় হয়তো ছিল আপনারই মতো। ফার্স্ট আর ফিফ্‌থ পিরিয়ডে মিস বললে তবেই, গুটিগুটি বাথরুম যাওয়া। নইলে চেপে বসে থাকো। সেই আপনার পাবলিক টয়লেটে হাতেমাটির হাতেখড়ি। আপনার মতো এহেন চাপের ব্যাকগ্রাউন্ডই হয়তো বিন্দেশ্বরকে আন্দোলনের পথে ঠেলেছিল। কিন্তু, আপনি? বান্ধবীদের ড্রেস না তলপেটের যাতনা, কী থেকে জন্ম নিল আপনারও বিপ্লবী চেতনা? জন হেনরির হাতুড়ির মতো প্রতিবাদের ভাষায় হিজিবিজি আঁকলেন আর লিখলেন। গ্রাফিতি। ১৯৬৬-তে বার্কলের অ্যালান দুন্দে ‌যাকে ডাকলেন ‘ল্যাট্রিনালিয়া’ বলে। রেস্টরুমের আঁকিবুকি। দিন যত গড়াল, মাইনাস করার দেওয়ালে এঁকে চললেন একের পর এক ‘প্লাস’। নিজের নামের সঙ্গে জুড়তে থাকলেন সেই সব ডাকসাইটে সুন্দরীর নাম, যাঁদের বাসস্টপে তিনমিনিট, কিন্তু স্বপ্নে সারারাত দেখেছেন। আপনার যৌন একাকিত্ব ‘অমুক + তমুক’-এর নিরামিশ গ্রাফিতিতে মেশাল আমিশ মশলা। কথায়-ছবিতে সেই দেওয়াল পত্রিকায় উঠে এল স্মার্ট যৌনতার কথা। সুনির্বাচিত স্ল্যাং। কাঁচা হুমকি। আপনার চোখে তখন অবদমিত কামনার চশমা। ভেবে দেখার প্রশ্নই ওঠে না, কোন পাঠিকা বা পাঠকের জন্য এই অমর সৃষ্টি। শুধু নিজেকে একটু আড়ালে রেখে, আর-পাঁচজনের সামনে স্বরচিত রূপকথার মোরাল শোনাতে চাইছিলেন। মাঝখান থেকে সারা পৃথিবীর তাবৎ ইন্টেলেকচুয়াল সমাজবিজ্ঞানীরা হেদিয়ে পড়লেন দেওয়ালের কানে-কানে বলা সেইসব কথা আর ছবি নিয়ে। ব্যাপারটা এতদূরই এগোল আবিশ্ব, গাল পেড়ে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২০০৫-এ নাকি তাদের একটি ওপিনিয়ন কলামের নামই দিয়ে দিল How to Earn Your Pee h.D!
এত ফুটেজ খাওয়া সেই আপনিও মোক্ষম আনইজি ফিল করলেন যখন চরকসুশ্রুতধন্বন্তরীবিধানরায়তর প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হলেন স্বয়ং ডঃ ডি কে লোধ‍। টাইফয়েড-ভাইরাল-ম্যালেরিয়া-জন্ডিসে অভ্যস্ত, বড়জোর ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়ার নাম শুনেছেন। এডস-ও সই। তাবলে, বিচিত্র সব উপসর্গে অতিবিচিত্র আধা-তত্সম আধা-বিদেশি রোগের বিজ্ঞাপন! স্যরি, রোগ-উপশমেরই বিজ্ঞাপন। এসব আপনাকে তো লাজুক করে তুলবেই। তাই ইস্কুলের মতো কাটাকুটি কিংবা মেনপয়েন্ট-মেনপয়েন্ট খেলার প্রশ্নই ওঠে না। বরং আপনাকে না ‘প্যারুরেসিস’ রোগ খেয়ে ফেলে, সেদিকে লক্ষ রাখলেন আপনি। এ এক বিশেষ কিসিমের স্ফিংটেরিক ফোবিয়া। আর কেউ থাকলেই আটকে যাওয়া। হেব্বি পাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই বেরোচ্ছে না। ভাগ্যিস, এহেন প্রকাশ্য গোপনরোগের টোটকা আপনি জেনে গিয়েছিলেন! ওইখানে দাঁড়িয়ে কোনও কথা বা চোখাচোখি নয়; পারলে দু-পাশে ফাঁকা খোপ রেখে জায়গা নির্বাচন; অহেতুক দেরি নয়; কোনও ইমোশন-টিমোশন তো একেবারেই নয়। আর যদি স্মুথলি সব কিছু চলে, সেই ঝরনাতলার নির্জনে, সার্কাসের বেঁটে জোকারের মতো পিছু ফিরে নীচু হয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতেই পারেন --- একটি বুটের টোয়ের আগায় একটি শিশিরবিন্দু।


একটাকা + একটাকা = দু’টাকা
এখানে আর বসা-দাঁড়ানো লিঙ্গ বৈষম্য নেই। নারী-পুরুষ সমান-সমান। বিল গেটসও বসেই ডাউনলোড করেন। তবে, সারকথা বুঝিয়েছিলেন গোপাল ভাঁড়। ছোট কাজ না হলে বড় কাজ হয় না। তাই পার কাজ একটাকা করে মোট দু’টাকা, চলতি রেট। অবশ্য ‘ছোট বাইরে’-র নামে ঢুকে, আপনি চলে যেতেই পারেন ‘বড়’ ভেতরে! কেউ টের না পেলেই হল। খুচরো বাঁচানোর আরও পদ্ধতি আছে। ধরুন, আপনি ধর্মতলায়। ডাক এসেছে। সুলভের দিকে হাঁটবেন, নাকি স্মার্টলি সাহেব-সুবোর মতো গটগট বেগে এন্ট্রি নেবেন ওবেরয়দের গ্র্যান্ডাকঘরে? আকাচা শার্টেও আপনি এদিক-সেদিক তাকান, ঢুকে যান ওয়াশরুমে। দারোয়ান সেলাম ঠুকবে। কিংবা, বাংলায় ফিরে এসো, বাবা। আপনি নন্দন চত্বরে, খুচরো অটুট রেখে ঢুকে পড়ুন বাংলা আকাদেমির একতলায়। ঢুকে, এখনও, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও, একটু বামপন্থী হয়ে দু-পা এগোলেই, মুক্তির সন্ধান। আপনি পাঠক না-হন, ও-চত্বরে ঘোরাঘুরি যখন, লেখক-কবি-সম্পাদক কিছু তো একটা হবেনই। অতএব, বাংলা ভাষায় করা আপনার অধিকার।
যদি ভাবেন নগদে পে করে ঢুকলেও অধিকার জন্মায়, ভুল ভাবছেন। ছুটন্ত আপনি অগ্রিম দু’টাকা দিয়ে পড়িমড়ি ঢুকেছেন। গুডলাক, কোথাও কিছু ভাসছে না। নড়বড়ে ছিটকিনিটা যদিও টালিগঞ্জের সেটের মতো, ধাক্কা দিলেই যাতে খুলে যায়, সেভাবেই বানানো। তবু তাকে ম্যানেজ করে, ইজ্জত বাঁচিয়ে আপনি জাস্ট বসেছেন, একটা শান্তি আপনাকে ঘিরে ধরবে-ধরবে করছে... আআআ! সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া। ‘দাদা, আর কতক্ষণ?’ বাইরে গোটা কলকাতার একসঙ্গে পেয়েছে। দ্বার খোল, দ্বার খোল। অথবা, শৌচাগারের পাংচুয়াল কেয়ারটেকার আপনাকে জানান দিচ্ছেন, দু’টাকায় কেনা টাইম খতম। আপনি ইসবগুল নাকি সিঙ্গাপুরি, এই কোষ্ঠকঠিন পৃথিবীর তাতে থোড়াই কেয়ার। সে বিশ্বাসই করবে না, পাবলিক টয়লেট আসলে বিয়ের মতো। যারা এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে আছে, তারা চায় যেন-তেন ভেতরে ঢুকতে। সে বুঝবেই না, যারা ভেতরে আছে, তারাও মরিয়া বাইরে বেরোতে। যেন আপনি জয়রাম রমেশের দলে, শৌচাগারকেই মন্দির ভেবেছেন। উল্টে সে সতর্কীকরণ লিখে রাখবে দেওয়ালে --- নো লাউড ফিলোজফিকাল থিঙ্কিং।

তিনটাকা
চানঘর। বারাণসী-গঙ্গাসাগরের মতো স্নানের স্থানমাহাত্ম ও স্থানের স্নানমাহাত্ম এখানে নেই। এই বাথপার্টি প্রলেতারিয়েতদের। তুরস্কের কেতাদুরস্ত ‘হামাম’ বা রাশিয়ার গণস্নানঘর ‘বান্যা’-র মতো কিছু এক্সপেক্ট করা একেবারেই ভুল হবে। আপনার সুড়সুড়ি থাকলে, তা-ও এখানে মিটবে না। দিওনসুসের মন্দিরে নারী-পুরুষের নগ্নস্নান কিংবা ক্যালিগুলা-বাত্স্যায়নের দৃশ্যকল্পে গা-ভাসালেও, গা ভিজবে না। আপনার পিপিং টম দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ‘পানি মে খুদকো সমেটে হু’ গাইতে থাকা স্যাঁতস্যাতে মন্দাকিনিকে খুঁজে পাবে না। সত্যম শিবম সুন্দরম-এর ভেজা জিনাত আমান গ্রিলের ওপাশ থেকে হাস্কি গলায় বলবে না ‘মোরি চুনারিয়া লিপটি যায়ে’। কোনও হেমেন মজুমদারও তাঁর জল-রঙা ক্যানভাস এগিয়ে দেবেন না। তবু, শহরের ধুলো-ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত আপনি, শরীর আনচান করলে এখানে চান করতেই পারেন।

অনুভব করিনি, তবু বলছি
হি, শি --- ঈশ্বরের বানানো দুই রকমের জন্য দুই রকমেরই ব্যবস্থা। তবু প্রকৃতির ডাকঘরের ‘স্যানিটেশন’ পুরুষদের নয়, ছুটি না-পাওয়া মহিলাদের জন্য। একটাকা দু’টাকা তিনটাকায় সেই ডাকমাশুলের হিসেব হয় না। অনুভব করিনি, অনুমান করেছি, তাই বলছি। অনুরোধও করছি, আপনাকে কিন্তু কেউ বলেনি, ‘রক্ত দাও, স্বাধীনতা দেব’ --- তাই আপনি ফ্রি থাকতে চান থাকুন, ফ্রিডম উপভোগ করুন; কিন্তু যেখানে-সেখানে ফেলে-ছড়িয়ে আসবেন না, প্লিজ।

বেগতিক = বেগ + গতি
গতি যখন আছেই, তখন আর ‘বেগ’ মানে স্পিড নয়, ট্রাবল। হ্যাঁ, সেইসব পাবলিক টয়লেটের কথা বলছি, যখন আপনি গতিশীল, আর অনেকক্ষণ ধরে বেগ পেয়ে, এবার বেগতিক বুঝছেন। তারপর যেতে যেতে যেতে... এবং এতক্ষণ দূরপাল্লার বাসে খেতে খেতে খেতে... না, এমতাবস্থায় নদীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আপনার নেই, নদীর পাড়ে কাজ সারার প্রশ্নও নেই। বরং আপনার গন্তব্য বহরমপুর হলে কৃষ্ণনগর, দিঘা হলে মেচেদা --- এতটা পথ পেরোলে তবে হল্ট বলা যাবে। বাস থামলেই গুঁতিয়ে নামুন, পড়িমড়ি ছুটুন। কৃষ্ণনগরে সরপুরিয়া কিংবা মেচেদায় সিঙাড়ার অর্ডার দিন, সঙ্গে বিনি পয়সায় হালকা হয়ে আসুন। ব্যবস্থা এমনই, আপলোড করলে, ডাউনলোড ফ্রি।
ব্যাপারটা ট্রেনে হলে অবশ্য অন্যরকম। লোকাল ট্রেনে জার্নি যদি লম্বাতর হয়, আপনার হাতে জাস্ট কোনও অপশন নেই। সরপুরিয়াও নেই, সিঙাড়াও নেই। প্যাকেটে বাদাম বা খোসাছাড়ানো ডিমসেদ্ধর দিকেও আপনি আর লোলুপ নজরটি ফেলতে পারবেন না। কাপড়ে-চোপড়ে হওয়া থেকে বাঁচতে কোনও মতে চুপচাপ বসে, ঠায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাবতে-ভাবতে স্টেশন গুনতে লাগবেন ডিসেন্ডিং অর্ডারে। অডারে আপনার রুমাল-সর্বস্ব গোটা কম্পার্টমেন্টের কী হাল, সেদিকে না হয় ভুলেও তাকাবেন না। এ যেন জীবনের দীর্ঘতম ‌যাত্রা। গন্তব্য এলে, তারপর, সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি (কার্টসি : গোপাল ভাঁড়)! অবশ্য দূরপাল্লার ট্রেনে আপনার জন্য টোটাল অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে। ঝক্কাস! দরজায় ঘটাং-ঘট লক, চিকনাই স্টিলের কমোড (নীচে ফুটো), ঝরঝরে ফ্ল্যাশ, গুটখা-ওলা বেসিন। এখন প্রশ্ন হল একটাই, দুললে কি আপনার হয়?
কিংবা, মোশন বাড়লে কি আপনার মোশন লুজ হয়ে আসে? তাহলেও চিত্তির। বিমানে উঠলে করবেন কী! ঘনঘন যাওয়া তো বিসদৃশ ঠেকবে। আরে বাবা, মার্কিন মুলুকেই মাঝারি দরের বিমানে পঞ্চাশ জন প্রতি একটি করে ল্যাভাট্রি থাকে। লম্বা পথে অত ইয়ে ওরা ফেলবেই বা কোন চুলোয়? ট্রেনের মতো সে তো আর বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া চলে না! অবশ্য চলত এক কালে। তিরিশের দশকে বিলিতি সুপারমেরিন স্ট্র্যানরের বায়ুযানটিতে ছিল এমনই এক মুক্ত শৌচাগার। উড়তে-উড়তে তার ঢাকনাটি যখন খুলে দেওয়া হত, জন্মদিনের বেলুন ফেটে চকচকে কাগজের মতো নীচে সব ছড়িয়ে পড়ত, বাতাসের ধাক্কায় শোনা যেত একরকম শিসের আওয়াজ। সেই থেকে যানটির বদনামই হয়ে যায় --- ‘হুইসলিং শিটহাউস’। কিংবা জলপথও আপনার কিসমতে শুধু যাওয়া-আসা শুধু স্রোতে ভাসা হবে না। বাইচান্স আপনি যদি সাবমেরিনে সওয়ার হন, সে শৌচাগারটি ব্যবহার করতেই রীতিমতো একজন ইঞ্জিনায়ারকে ডাক পাঠাতে হবে! এতই নাকি জটিল তার অপারেশন। একটু ভুলচুক হলেই আপনার বাহ্যটি আর বাহ্য থাকবে না, সটান এসে মাখামাখি হবে সাবমেরিনের গায়েই। অতএব, আপনি হরাইজেন্টাল গতিতে থাকলে ভার্টিকাল বেগের কথাটা বিলক্ষণ মাথায় রাখুন।

আসুন, অন্যরকম করে করি
আসলে বলতে চাইছি, প্রকৃতির ডাক যখন, ব্যাপারটা কি মানুষের অধিকারের মধ্যেই পড়ে না? হালকা হওয়ার অধিকার। রাইট টু ফ্রি। ফ্রি-তেই তো হওয়া উচিত তবে। নিদেনপক্ষে রেটটা একটু কমুক। অন্যভাবে করুন না, মদনদা যেরকম করতে চেয়েছিলেন আরকি, বাসভাড়া না বাড়িয়ে বাসের গায়ে বিজ্ঞাপন সেঁটে দাও। অবশ্য বইমেলার মতো নয়। ‘বানান যখন ভাবায়’ শীর্ষক প্রদর্শনী। কোনওটার গায়ে লেখা --- GENTS TO LET! কোনওটার আবার --- LADIES TOY LET! এই না হলে মিলন মেলা! আমি বলছি, এসব নয়, এক্কেবারে অন্যরকম করে করুন। ধরুন, আসছে ১৯ নভেম্বর বিশ্ব শৌচাগার দিবসে টয়লেটে-টয়লেটে যদি উত্তর-আধুনিকদের ‘শক আর্ট’-এর প্রদর্শনী করা যায়। অনেকটা ২০০৮-এ নিউইয়র্কে যেমন করেছিলেন শিল্পী আন্দ্রে সেরানো। ‘শিট’ ফটোগ্রাফ এক্সিবিশন। কিংবা ১৯৬১-তে মিলানের পিয়েরো মানজোনি-র কৌটোভরা ‘আর্টিস্ট’স শিট’। ‘থার্টিগ্রাম নেট, ফ্রেশলি প্রিজার্ভড’। দেদার বিকিয়েছিল শিল্পীর সত্যি-সত্যি ক্রিয়েশন! আবার নিউজিল্যান্ডের জন কাজিনস। ১৯৮৪-তে সুরে মাতালেন এডিনবরা ফেস্টিভ্যাল। টানা সাত ঘণ্টা ধরে জল খেলেন আর লাইভ মূত্রত্যাগ করলেন সাতটি ড্রামের উপর। সা নি ধা পা মা গা রে। ভরা সন্ধ্যায় এই মূত্রশিল্পীর আশ্চর্য জলতরঙ্গ সেদিন প্রমাণ করেছিল, মানুষের ভেতরেই রয়েছে প্রকৃত হারমনি। যে শহরে জলই শোভন, জলসা এমন হতে পারে সেখানেও। এসব বাণিজ্য আরও স্ট্রেটকাট করা যায়। ১৮৭০ পর্যন্ত বিলেতে যা চলেছে। লন্ডনের স্ট্রিটকর্নার থেকে পিপে-পিপে মূত্র তোলা হত জাহাজে। তারপর জাহাজ যেত হুইটবি। ভেতরে টলটল করছে ফটকিরি তৈরির অপরিহার্য কাঁচামাল। এসব করে টু-পাইস এলে, পাবলিকের ব্লাডারে পাস্কালের সূত্রও একটু কম চাপ দিত।
আর শুধু অর্থকরী নয়, অর্থবোধকও। ১৯১৭-এ ফরাসি দাদাইস্ট মার্সেল দিউশাঁ-র আর্ট ওয়ার্ক ছিল ‘ফাউন্টেন’। স্রেফ একটা পোর্সেলেন ইউরিনালকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন স্টুডিওতে। এখন দেখার, কতটা উচ্চতায় রেখেছিলেন সেই মূত্রাধার। জলের সমোচ্চশীলতা মেনে, ঢ্যাঙা আর গেঁড়ের তো এক জায়গায় দেননি ঠাকুর! তাহলে কোন অ্যাপ্রক্সিমেশন তুলে ধরেছিল শিল্পীর চোখ? গার্নার আর গাওস্কর পাশাপাশি দাঁড়ালে কোথায় হবে গুড লেংথ? কোথাকার জল তখন কোথায় গড়াবে? এসব বিতর্কিত সময়ে, আপনি, এতক্ষণ চেপে রাখার পর, বড়জোর পুরন্দর ভাটের কবিতার ডাকে সাড়া দেবেন...

চারদিকে ছনছন
সারা গায়ে ঘিনঘিন
থই থই ছপছপ
ইউরিন! ইউরিন!

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ নভেম্বর ২০১৩

19 August 2013

কে সি পাল

সুস্নাত চৌধুরী


সূর্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে, পৃথিবী মোটেই তার চার দিকে ঘুরছে নাওয়ান ফাইন মর্নিং এই সহজ কথাটা সত্যি হয়ে দেখা দিলে আমার-আপনার কৌন সা মহাভারত অশুদ্ধ হবে? দিনের বেলা ট্রেনে সেই একই রকম ভিড় থাকবে... রাতের বেলা মিনিমাম তিন পেগ না হলে ঘুম আসবে না... মাস ফুরোলে মাইনে চার আনা বাড়বে না... বছর ঘুরলে অন্যের ইনক্রিমেন্ট দেখে আগের মতোই জ্বলুনি ধরবে...যেমন খাচ্ছেন, বাথরুম যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে শুচ্ছেন, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছেন কিংবা পিরিয়ড এলে কষ্ট পাচ্ছেন, শীতকালে পিকনিক করছেন, গ্রীষ্মকালে ঘামছেন অবিকল তেমনটাই চলতে থাকবে। আপনি ইশকুলের ভূগোল টিচার না হলে, জাস্ট কিচ্ছু যাবে-আসবে না। অথচ সেই মানুষটাকে আমি দেখেছি, আপনারাও অনেকে দেখেছেন, স্রেফ এই একটা কারণে নিজের জীবনটা যিনি খরচ করে দিয়েছেন। আপাতত ঘর-বাড়ি-পেনশন হারিয়ে গত দু’বছর ধরে কলকাতার ফুটপাতে দিন কাটাচ্ছেন। রাত কাটাচ্ছেন।
‘পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে, কিন্তু বার্ষিক গতি নেই। আহ্নিক গতি আছে বলেই দিন-রাত্রি হয়। আর ঋতু পরিবর্তন হয় সূর্যের বার্ষিক গতির জন্য।’ রাসবিহারী মোড়ে ফুটপাতের ওপর বসে বলছিলেন কার্তিকবাবু। কার্তিকচন্দ্র পাল। কে সি পাল। হাওড়া স্টেশন চত্বর কিংবা কলকাতার বহু দেওয়ালে, ব্রিজে, ল্যাম্পপোস্টে, দেওয়ালে যাঁর গ্রাফিত্তি আপনারা দেখেছেন। নিজের হাতের লেখায় তাঁর তত্ত্বের ওয়ান-লাইনার, বা ছবি-টবি দিয়ে ভাল করে এঁকে তত্ত্বটার বিশদ ব্যাখ্যা। কৌতূহলবশে বইমেলা থেকে নগদ দশ টাকা বা খুচরো এক টাকায় হয়তো বা তাঁর থিসিসও সংগ্রহ করেছেন। ই-নাগরিকরা হয়তো গুগ্‌ল-বুকস-এ তাঁর বইটির নাম দেখে থাকবেন। এর পর বাকিটা আপনার মনে হতেই পারে...
‘বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।
...ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট
সংক্ষেপে বলিতে গেলে, হিং টিং ছট্।’
কথা হচ্ছিল সেই কে সি পাল-এর সঙ্গে। পাশেই তাঁর থাকার জায়গা। থাকার জায়গা মানে, নিদেন পক্ষে নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির যে দশ ফুট বাই দশ ফুট জোটে, তা-ও নয়। ফুটপাতের রেলিঙের সঙ্গে বাঁধা, মাথা আর কুঁকড়েমুকড়ে দেহ গোঁজার একটা ঠাঁই। চওড়া বড়জোর দু-আড়াই ফুট, লম্বাতেও ছ-সাত ফুটের বেশি হবে না। শুয়ে পড়লে, পাশ ফেরার জায়গাটুকুও মেলা দায়। এর ভেতরেই সব কিছু। রান্নাবান্না, পড়াশোনা। এখানেই কে সি পালের রোজকার দিনরাত্রি, সারা বছরের ঋতু পরিবর্তন।


ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ফুটপাতের একটি ছাউনি মাত্র, কিন্তু নিজের আইডিয়ায় তাকে গড়ে তুলেছেন কার্তিকবাবু। চার দিকে কোনও প্লাস্টিক শিট কিংবা তেরপল দিয়ে বানানো দেওয়ালের আপাত সুরক্ষা নেই। বরং ছোট ছোট পিচবোর্ড বা প্লাস্টিকের টুকরো জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে পরদা। কোনওটায় লেখা তাঁর থিয়োরি, কোনওটায় তাঁর সৌরমণ্ডলের মডেল, কোনওটায় আমজনতার উদ্দেশে বক্তব্য, আবার কোনওটায় বিজ্ঞানীদের প্রতি তির্যক মন্তব্য। নিজের তত্ত্ব দিয়েই নিজের ঘর গড়েছেন তিনি। আক্ষরিক ভাবেই নিজের আইডিয়ার ভেতর বেঁচে রয়েছেন। যেন সেই বিদেশি ছবিতে দেখা পাদরির ঘর, যে ঘরের দেওয়াল জুড়ে সাঁটা বাইবেলের পাতা। যেন এক বর্ম, এক রক্ষাকবচ যেন এ ঘরে কোনও ক্রমেই না ঢুকে পড়তে পারে শয়তান! এ পৃথিবীতে অন্তত একটি ঘর আছে, যে ঘরে পৃথিবী স্থির, তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে সূর্য!
সাংবাদিকতার সূত্রেই বছর পাঁচেক আগেও এক বার গিয়েছিলাম ওঁর বাড়ি। হাওড়া শহরে। মনে আছে, পাকা বাড়ি। সামনে কিছুটা জমি। সে সব ছেড়ে এই ফুটপাত কেন? উত্তরে বুঝলাম, নেপথ্যে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক সমস্যা। হয়তো রয়েছে তাঁর এই একান্ত ব্যক্তিগত ‘সত্য’-র পিছনে সব কিছু ভুলে ছুটে চলাও। এই ‘পাগলামি’ আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! প্রতি মাসে পেনশনের কয়েক হাজার টাকাও নাকি তিনি আর হাতে পান না। জোটে মোটে পাঁচশো টাকা। ‘ইচ্ছে করলে কোর্টে যেতে পারতাম, কিন্তু সে আমি পছন্দ করি না।’ তা হলে চলে কী করে? হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দিলেন কার্তিকবাবু ‘মাসে পাঁচশো মানে, দিনে সতেরো টাকার মতো করে দাঁড়াচ্ছে। মোটামুটি খরচ ওতেই চলে যায়। দু’টাকা লাগে সকালে চা খেতে, দু’টাকা লাগে পায়খানা করতে। নস্যির জন্য সামান্য খরচ। বাকি টাকায় রান্নাবান্না। এ ছাড়াও তো বই বিক্রির টাকা থেকে লাভ থাকে।’ আমার বেসিক-পিএফ-ইএমআই-মুদিখানার জটিল সুদকষায় অভ্যস্ত মস্তিষ্কে এত সরল পাটিগণিত ঢুকছিল না। তিনি বলতে থাকেন ‘মা মারা যাওয়ার পরে গ্রামের বাড়িটাও বিক্রি করে দিই এক আত্মীয়কে। সেখানেও আশি হাজার পাঁচশো টাকা পাওনা। আড়াই বছর হয়ে গেল, কিন্তু আমি চুপ করে আছি, দেখি কবে দেয়। এখন যদি আমি ঝগড়ার মধ্যে যাই, আমার প্রচারের কাজটায় ভাটা পড়ে যাবে।’
আমি একটু কেয়ারিং হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু ফুটপাতে এ ভাবে থাকাটা কতটা সেফ?’ কার্তিকবাবু বলেন, ‘আমি তো এ সব খুলে রেখেই চলে যাই। তবে হ্যাঁ, আমার মোবাইলটা এখান থেকেই চুরি হয়ে গিয়েছে। তার পর দুজন আমাকে ফ্রি-তে ফোন দিতে চেয়েছে, বইমেলায়। আমি নিইনি। কেননা, যার ইন্টারেস্ট থাকবে, সে আমার কাছে আসবে। আমি যদি এত পরিশ্রম করে থাকি, এত পয়সা খরচ করে থাকি, সে দুটো মিনিট আর দশ-বিশ টাকা খরচ করে আসতে পারবে না? আমি রাস্তায় থাকি, এখানে অনেক পাতাখোর গাঁজাখোর ঘুরে বেড়ায়। তাদের এক দিন কম পড়লে, হয়তো আমাকে মেরে দিয়ে ফোনটা নিয়ে চলে যাবে। তখন, আমার এই আবিষ্কারের কী হবে? ফোন-টোন আমার চাই না। তবু, রাতে শোওয়ার সময় আমি মাথার কাছে একটা ছুরি নিয়ে শুই...’
‘আমার জীবনের কথা লিখে কী হবে, আমার তত্ত্বটা নিয়ে লিখুন।’ জানতে চেয়েছিলাম ওঁর পড়াশোনা কাজকর্ম সম্পর্কে। দ্বিতীয় বার অনুরোধে বলতে শুরু করলেন। জন্ম হাওড়ার আমতার আনুলিয়া গ্রামে। ১৯৪২ সালে। পড়াশোনা গ্রামেই। একটু বেশি বয়সেই ভরতি হন এআরবি হাইস্কুলে। ক্লাস থ্রি-তে। পয়সার দরকার, অতএব ক্লাস এইট-এই প্রথাগত শিক্ষায় ইতি। এলেন কলকাতা। কখনও মোটর-মেকানিকের কাজ, কখনও গড়িয়াহাটে আলু-পেঁয়াজ বিক্রি। এ সময়ই ডাক এল মিলিটারি থেকে। সেটা ১৯৬২। ভারত-চিন যুদ্ধ। প্রথমে উত্তরপ্রদেশের ফতেহ্‌গড়। রাজপুত রেজিমেন্টে কাটল দু’বছর। তার পর প্যারাশুট রেজিমেন্টের হাবিলদার। টানা পনেরো বছর। এই ’৬২ সালেই সন্ধে বা রাতে ডিউটির সময় সন্ধ্যাতারার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হঠাত্‌ই মনে প্রশ্ন দানা বাঁধে। চার মাস পর্যবেক্ষণের পর জোরদার হয় সন্দেহ। স্রেফ এক হাত লম্বা একটি পাইপ জানালার সঙ্গে বেঁধে চলে নজরদারি। কখনও তা ধ্রুবতারার দিকে তাক করা, কখনও সপ্তর্ষিমণ্ডলের কোনও তারার দিকে, কখনও আবার দিনের বেলায় পাইপের ফুটোয় সূর্য! প্রাপ্ত ফলের ওপর নির্ভর করে চলতে থাকে বিশ্লেষণ। দেখতে দেখতে কেটে যায় বারো বছর। ১৯৭৪ সালে তিনি নিশ্চিত হন পৃথিবী স্থির, সূর্যই ঘুরছে তাকে কেন্দ্র করে।
হাত-টাত নেড়ে, প্রায় ডেমনস্ট্রেট করার ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন কার্তিকবাবু। দেখছিলাম, এক জন সত্তরোর্ধ্ব মানুষেরও কী ভয়ংকর প্রাণশক্তি থাকতে পারে। সব সময় যেন ফুটছেন। ‘এই ছবিটায় আসতে আমার বারো বছর লেগে গেল। তার পর এই তত্ত্বকে যখন ভূগোল বইয়ের যে-কোনও প্রশ্ন করেছি, সব উত্তর পেয়ে গিয়েছি। এ বার আমি দেখলাম, আমার থিয়োরিটাকে দাঁড় করাতে গেলে আমাকে তো ইতিহাস জানতে হবে। আপনি যদি আমাকে টলেমির থিয়োরি জিজ্ঞেস করেন, আর আমি বলতে না পারি, তা হলে তো আমি বেওকুফ বনে যাব! সে সময় আগ্রা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি আমাকে ফ্রি-তে নানা বইপত্র পড়ার সুযোগ দিল।’ চলল ক্লাস এইট ড্রপ-আউট ছাত্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ। গ্যালিলিয়ো, অ্যারিস্টট্ল, কোপার্নিকাস, টলেমি, আর্যভট্ট...। একই সঙ্গে তিনি শুরু করে দিলেন প্রচার।
দু’মাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন। হাজার কপি করে ছাপিয়ে নিতেন তাঁর তত্ত্ব। বিলোতেন স্কুলে স্কুলে। এ সময়ই উত্তরপ্রদেশের ‘অমর উজালা’ সংবাদপত্রে সবিস্তার ছাপা হল তাঁর গবেষণার কথা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে তা আসতেই শুরু হল সমস্যা। বিনা অনুমতিতে সাক্ষাত্‌কার দেওয়ায় সার্ভিস রেকর্ডে পড়ল লাল কালির দাগ। আরও দু’বার রেড এন্ট্রির পর শো-কজ করা হল কার্তিকবাবুকে। ‘আমি বলে দিলাম, চাকরি করব না, আমি কোনও জবাব দিতে চাই না। আমার প্রচারেরও অসুবিধে হচ্ছিল। নিয়ম আছে, শো-কজের এক মাসের মধ্যে জবাব না দিলে অটোমেটিক আউট করে দেওয়ার। আমাকেও আউট করে দিল। আমি খুশিই হলাম। সেটা ১৯৭৯। ফিরে এলাম। এসে, এক বছর আমি আমার বই বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি... চার ছেলেমেয়ে... সকাল সাতটায় বেরোতাম, বারোটায় বাড়ি ফিরতাম... খেয়েদেয়ে আবার বেরোতাম, রাত দশটায় ফিরতাম! তার পর, ১৯৮০ সালে আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি পাই। রিটায়ার করি ২০০৫-এ। তখন পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম। আমার বউ...’ সেই সম্বলটুকুও হারানোর কথা বলতে থাকেন আবার। কিন্তু সেখানে কোনও আক্ষেপ বাসা বাঁধার সময় পায় না। কেন না, তত ক্ষণে আবার তিনি ঘুরে গিয়েছেন তাঁর তত্ত্বের দিকে। সেই তত্ত্ব প্রচারের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন।
‘এখন তো শুধু দু’ঘণ্টা লেকচার করি। বাসে বাসে। সকাল ন’টা থেকে এগারোটা। দু’ঘণ্টায় আমি পঞ্চাশ টাকার বিক্রি করে দেব। তাও তো এখন দাম কমিয়ে দিয়েছি। এক টাকা আর পাঁচ টাকা। আগে দশ টাকা ছিল, এখন পাতা কমিয়েছি। পুরো ইতিহাস দিলে আমার খরচ বেড়ে যাচ্ছিল। মানুষ তো মোদ্দা জিনিসটা জানতে চায়। ইতিহাস তারা জানতে চায়, যারা আমার সঙ্গে তর্ক করবে। তারা তো ইতিহাস পড়লেই জানতে পারবে, আমার বই পড়ার দরকার নেই। তা ছাড়া কিছু কিছু বিশেষ জায়গায় আমি এমনিতেই বিলি করি, পয়সা নিই না। ইংলিশ বইটা ফরেনারদের জন্য ফ্রি। তবে ফরেনাররা সবাই তো আর পণ্ডিত নয়, তাদের মধ্যেও আমাদের মতো গাধা আছে! কেউ হয়তো পড়তে চাইল না। নিল না-নিল, বয়ে গেল! যে নিল নিউ থিয়োরি: দ্য সান গোজ অ্যারাউন্ড দি আর্থ ওয়ান্স ইন আ ইয়ার, চ্যালেঞ্জ ফর অল সায়েন্টিস্ট অল ওভার দি ওয়ার্ল্ড ইংলিশে বলে দিলাম।’ এক লাখ টাকার চ্যালেঞ্জ। এক জন ফুটপাতবাসীর। তাঁর ফুটপাতের বাসার গায়েই একটা বোর্ডে বড় বড় করে লেখা!
পালটা বিরোধিতার মুখেও অনেক বার পড়তে হয়েছে। কখনও ফোনে হুমকি এসেছে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব! কখনও চিঠি। সে সব চিঠি নিজের বইতেও ছেপেছেন কার্তিকবাবু। তাঁর পাওয়া প্রথম চিঠিটি ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ লেখা। শুরুর দু’কথার পর প্রেরক লিখছেন ‘...আমার মনে হচ্ছে আপনি একটি দু’পেয়ে গরু। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আপনার গাঁজা খাওয়া কি অভ্যাস আছে? আপনার যদি নেশায় গাঁজা কম পড়ে, তা হলে দয়া করে জানাবেন। আমরা আপনার মাথার ছিট ছাড়াবার জন্য সযত্নে গাঁজা পাঠিয়ে দেব।’ আবার, ৩/৪/৮১ তারিখে আর এক জন তাঁকে লিখছেন ‘...একটি কথা বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয় যে আপনি কি রাঁচীর পাগলখানার একজন প্রাচীন সভ্য ছিলেন? তাহা না হইলে এই ধরণের মস্তিষ্কের উর্ব্বরতা কোথা হইতে আসিল? অতএব আমরা ইহাই সাব্যস্ত করিলাম যে, আপনি গাঁজা খাইয়া থিয়োরীটি উদ্ভাবন করিয়াছেন, অতএব আপনার প্রাপ্য পুরস্কার হলো একটি সুদীর্ঘ ঘুঁটের মালা।’ আবার প্রচারের সময় সরাসরি প্রতিবাদের সামনেও পড়তে হয়েছে। কেউ সরব হয়েছে বইমেলায় তাঁর ক্যানভাসিং-এর সময়, কেউ চলতি বাস থেকে তাঁকে নামিয়ে দিতে চেয়েছে। কখনও আবার প্রতিবাদ আরও দু-এক ডিগ্রি কড়া। ‘এক বার দু’জন আমাকে বলল, প্রোফেসরের কাছে নিয়ে যাব। বলে, লালবাজারে ধরে নিয়ে গেল। লালবাজার বলল এটা আমাদের আন্ডারে নয়। তার পর নিয়ে গেল হেয়ার স্ট্রিট থানায়। সেখানে ডায়েরি লিখল। অফিসার বলল ‘আরে, এনার একটা বক্তব্য আছে, বলছেন। আপনাদের ভাল লাগে শুনুন, না হলে শুনবেন না। আপনাদের তো জোর করে কেউ দিচ্ছে না বইটা।’ আমায় ছেড়ে দিল। আর এক বার হয়েছিল শিয়ালদার কাছে। এক জন প্রোফেসর জনা দশেক ছাত্র এনেছে। আমি তখন আমেরিকা থেকে আসা চিঠিগুলো ঝুলিয়ে রাখতাম। ওরা চেষ্টা করছিল কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলার। আমি ছিঁড়তে দিইনি, আমাকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে গেল শিয়ালদার কাছে একটা পুলিশ ফাঁড়িতে। অফিসারকে বললাম আমি একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছি, সেটাই প্রচার করছি, এরা আমায় ফালতু ধাক্কা মেরে এখানে নিয়ে এল। অফিসার বললেন দেখুন, আপনি একা, এরা দশ জন। আপনি আর আসবেন না এখানে। আমি বললাম ঠিক আছে। বলে, কেটে পড়লাম। আর যেতাম না ওখানে। এক বছর অন্তর এক দিন করে যেতাম, পর দিন দল বেঁধে এলেও আমাকে আর দেখতে পেত না!’
কে সি পাল-কে আমার তখন ফ্যাতাড়ু মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে একটা চোরা থ্রেট। পাগল-ছাগল ইমেজের একটা মানুষ রাসবিহারীর ফুটপাত থেকে গোটা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তাবত্‌ বিজ্ঞান যখন ‘ঘোরো ঘোরো ঘোরো’ বলে পৃথিবীর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, তিনি উলটো দিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক কথায় ‘স্টপ’ বলে সব থামিয়ে দিচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে আঙুল তুলে বলছেন, ‘একটা ছবি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি আমার থিয়োরির ভুল ধরার, পারিনি। কারও ক্ষমতা নেই এর ভুল ধরার।’ তাঁর কথায় কথায় রাম-শ্যাম-যদুর মতো উঠে আসছেন টলেমি, কোপার্নিকাস, পিথাগোরাস, অ্যারিস্টট্ল, কেপ্‌লার। অনায়াসে কাউকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউ কিঞ্চিত্‌ নম্বরও পাচ্ছেন। ‘কোপার্নিকাস, গ্যালিলিয়ো ভুল করেছিলেন, সেই ভুলটাই এখন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ পড়ছে। আমার থিয়োরিটা যে দিন স্বীকৃতি পাবে, সে দিন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ আমার কথাটাই মানবে।’
ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, একটা প্রশ্ন ওঁকে করা হল না দেওয়ালে, পোস্টারে উনি শুধু সাদা আর কালো রং-ই কেন ব্যবহার করেন? খরচের কারণে? না কি সাদা-কালোর বৈপরীত্যটা আসলে সত্য আর মিথ্যার মতোই বলে। একটা লড়াই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের। হ্যাঁ বনাম না। চল্লিশ বছর হতে চলল, যে লড়াইয়ে তিনি একাই একটা পক্ষ। উলটো দিকে আমি, আপনি, মনমোহন সিংহ, বারাক ওবামা, বিড়লা তারামণ্ডল, কেনেডি স্পেস সেন্টার... সব্বাই। গোটা দুনিয়া। তবু এক দিন এক মুহূর্তের জন্যও এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েননি ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই প্রাক্তন সদস্যটি। তিনি জানেন, তাঁকে নিয়ে সর্বত্র ব্যঙ্গ করা হয়। আড়ালে নয়, সামনেই লোকে হাসে, বইমেলায় ঘিরে ধরে হ্যারাস করে, কখনও তাঁর প্রচার শুনে খিস্তি মেরে চলে যায়, তবু সমান তেজ নিয়ে লড়ে গিয়েছেন তিনি। সামান্য ট্যারা কথা, তা সে শাশুড়ির মুখ থেকেই হোক বা বসের মুখ থেকে বঙ্গললনা আর বাঙালি বীরপুঙ্গবদের আধরাতের ঘুম কেড়ে নেয়। সেই জাতে এমন এক মানুষ সত্যিই বিরলতম, যিনি হাজারও অপমান, যাবতীয় বাধা সত্ত্বেও নিজের প্রতিপাদ্যে অবিচল থাকতে পারেন বছরের পর বছর।
তত্ত্বটা ঠিক না ভুল, সত্যিই ‘নাসা’ এক দিন তাঁর কথা মেনে নেবে কি না, ছেড়ে দিন। সেই লোকটার কথা ভাবুন, যাঁর ছেলেমেয়েরা অবধি স্কুলে গিয়ে যা পড়ে আসছে, তা তাদের বাবার কথাকে সরাসরি প্রলাপ বলে প্রমাণ করে। তবু সেই লোকটা তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়ছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, সেই বিশ্বাসটা শুধু তক্তপোশে শুয়ে শুয়ে লালন করলে চলে না। সেটা প্রচারের জন্য গোটা শহর জুড়ে নিজের হাতে লেখাগুলো লিখতে হয়, পাতাগুলো নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়ে ছাপতে হয়, বাস্তব পৃথিবীতে সরাসরি গলার শির ফাটিয়ে তা জোরে জোরে বলতে হয়। জীবনের প্রতিটি দিন মাস বছর মুহূর্ত, শরীর মন শক্তি আশা, সব এই একটা প্রোজেক্টে নিংড়ে নিংড়ে খরচা করে ফেলতে হয়। এবং এই সমস্তটাই করতে হয় পুরোপুরি জেনে, যে, পৃথিবীতে এক জনও তাঁর পক্ষে নেই, এক জনও না, এবং গলা দিয়ে রক্ত উঠে এলেও এক জনও তাঁর পক্ষে চলে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এই রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে একটা লোক একাত্তর বছর বয়সে এতটুকু অপ্রসন্ন নন। একটা কথাতেও কোনও হতাশা ধরা পড়ে না। ক্রোধ, ক্ষোভ, বিলাপ, আর্তনাদ যা প্রায় সব বাঙালি নিত্য ভাতে মেখে খায়, তা তাঁর মধ্যে প্রবেশাধিকারই পায়নি। তিনি জান লড়িয়ে দিচ্ছেন শুধু তাঁর তত্ত্বটা আঁকড়ে। অন্তত এই জায়গায়, ডেডিকেশন আর টেনাসিটির প্রশ্নে, তিনি আমাদের ইতিহাসের অতিমানবিক চরিত্রগুলির সঙ্গে তুলনীয় নন কি? তিনি লড়াইটা কি গ্যালিলিয়োর চেয়ে কম লড়ছেন? তিনি আরও অপেক্ষা করতে রাজি। তাঁর স্থির বিশ্বাস, এক দিন না এক দিন তিনি জিতবেনই। না, কথাটা ঠিক হল না তিনি জানেন, এই লড়াইয়ে সৃষ্টির আদি থেকেই তিনি জিতে রয়েছেন। তাঁর তত্ত্বই ষোলো আনা অভ্রান্ত, নির্ভুল। এই বিশ্বাসই তাঁর পুঁজি। এই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁর এই বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু নেই। আসলে কে কার চার দিকে ঘুরল, তাতে শেষ অবধি কিস্যু যায়-আসে না।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট ২০১৩