25 September 2016

শ্রেণিসংগ্রাম

সুস্নাত চৌধুরী


অরওয়েল সাহেবের কথাটি অন্তত এই ক্ষেত্রে খাপে-খাপ বটে! হ্যাঁ, সেই ‘হিট ডায়লগ’-টিই বলছি – ‘অল এনিমেলস আর ইকুয়াল, বাট সাম এনিমেলস আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদার্স’। তিন বছরের মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে দেখলাম আজও তা কী প্রবল প্রাসঙ্গিক! পিছু ফিরে মনে হল, বিশ-পঁচিশ বছর আগেও হয়তো কতকটা এমনই ছিল। তবে নিজের ছেলেবেলায় সেসব টের পাইনি। আজ চোখের ‘পাওয়ার’ বেড়েছে বলেই এসব দেখতে পাচ্ছি হয়তো!
বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাক। মানে, ‘ইউনিফর্ম’। শব্দটির মধ্যেই সকলকে সমান করে দেখার ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। কে ডাক্তারের ছেলে আর কে রিকশাচালকের, কার মা অধ্যাপিকা আর কার মা ছাপোষা গৃহবধূ, তা যেন ছা-এর বহিরঙ্গে প্রকাশ না পায়। যে কেউকেটাই হও না কেন বাপু, পারিবারিক পরিচয় গেটের বাইরে রেখে তুমি এই প্রতিষ্ঠানে পা রাখবে – ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে এনে দাঁড় করানোর এই প্রয়াসই এ পোশাকের প্রধান উদ্দেশ্য। ইউনিফর্ম এই ইউনিফর্মিটির কথাই বলতে চায়। সাধু ভাবনা, সন্দেহ নেই। কিন্তু শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিবিভাজন কি তাতে ঘোচে আদৌ? সেই ছেলেটির কথাই ভাবুন না, যে বলছে –
‘নাম বলেছি ধাম বলেছি এবং বয়েস কতো
সেই সঙ্গে এও বলেছি মা হয়েছেন গত।
দশখানা আঁক কষতে দিলে একটা হবে ভুল
আমাকে তাও নিতে নারাজ – এই তোমাদের স্কুল!’


কেন তাকে অ্যাডমিশন দিচ্ছে না স্কুল? ‘লিখছি আমি’ ছড়াটিতে তার কথাই লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত –
‘কারণ আমার প্যান্টে ফুটো, জামার কলার ফাঁসা
উড়াল সেতুর নিচে আমার পাখপাখালির বাসা।’

স্কুলের পোশাক পরার অধিকার লাভের আগেই যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পোশাকই, সেই ইউনিফর্মের ইউনিফর্মিটি নিয়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। যে আপাত সমতা আসলে এক বৈষম্যকেই চিহ্নিত করে। স্কুল পড়ুয়া ও স্কুলে ঢুকতে না-পারা দুটি বালক বা বালিকার মধ্যেও প্রকাশ্যেই সেই ফারাককে জিইয়ে রাখে এই ইউনিফর্ম। জিজ্ঞেস করতে হয় না, পোশাকই বলে দেয় কে স্কুলে যাচ্ছে আর কে চা দোকানে কাজ করতে। আবার যারা সুযোগ পেলও ইউনিফর্মটি গায়ে গলানোর, তারাও কি শেষমেশ একই ছাদের তলায় এসে দাঁড়াতে পারল? একসময় যদি দেখা যায় – কার তিন বছরের পুরোনো জামাটা বগল-ফাটা, আর কারটা উজালা-সফেদ, বদলে যাচ্ছে বছরে বেশ কয়েকবার – কার কোঁচকানো প্যান্টের ঝুল ক্রমেই খাটো হচ্ছে, কারটা নিপাট নিখুঁত নিভাঁজ – কার মোজার ইলাস্টিক শেষ পিরিয়েডেও টানটান, কার ফ্যাকাসে মোজা ম্যানেজ করতে হচ্ছে কালো গার্টারে – একই ইউনিফর্মের মধ্যেও এইসব বিভাজন কি থাকে না! বরং তথাকথিত ইউনিফর্মিটির সামতলিক একটা প্রেক্ষিত থাকে বলেই এই বিভাজনগুলি আরও বেশি চোখে পড়ার মতো হয়ে ওঠে। তখন ওই ‘অ্যানিমাল ফার্ম’-এর ‘সাম এনিমেলস আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদার্স’ হয়ে যায়। ক্লাসের গণ্ডি দিয়ে ক্লাস ডিফারেন্সকে আর চেপে রাখা যায় না। ‘সন্ধি’ আর ‘বিচ্ছেদ’ পাশাপাশি অবস্থান করে।
স্কুলজীবনে অবশ্য ‘পোশাকি’ থিয়োরির এইসব সন্ধিবিচ্ছেদ কি দ্বন্দ্বসমাস বড়-একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। সে ছিল সদলবলে পোশাক-জনিত প্র্যাকটিকাল সমস্যায় জর্জরিত হওয়ার দিন। স্কুলের শেষ ক’বছরের বেশিটাই কেটেছিল গৌরী, জয়ন্তী, নারায়ণী, অনন্যা আর সোনালী-র আশ্রয়ে। না, বান্ধবী নয়, সিনেমা হল। ম্যাটিনিতে যদি বা সেঁধিয়ে যাওয়া যেত স্কুল-ড্রেসেই, ছাল-ছাড়ানো নুন-মাখানো দুপুরের শো-এ ঢুকতে পারা ছিল ঘোর মুশকিলের। দু-চার বার সিভিল ড্রেসে গিয়ে টিকিট-কাকুর সঙ্গে বাড়তি খাতির জমাতে না পারলে, সাদা জামা আর নীল প্যান্টে গেট টপকানোর উপায় ছিল না। আর বুকের ব্যাজটা তখনও লাগানো থাকলে তো বিপত্তির একশেষ! কী ভাগ্যি, আমাদের বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলে গলায় গিট্টি-মারা টাইয়ের ঝকমারি ছিল না! নইলে তা আনটাই করতে ভুলে গেলে জানটাই বুঝি কোন দিন বেরিয়ে যেত!
ব্যক্তিগত ভাবে আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল। একটু-আধটু খেলাধুলো করতাম বলে ব্যাগে পাঠ্যপুস্তক থাকুক না-থাকুক, এক সেট খেলার পোশাক আর একটা গামছা বেশিরভাগ দিনই থাকত। বাড়িতেও এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। ভাবত, ছেলে শচীন হবে। কিন্তু সে যে স্পোর্টসম্যানের সমার্থক ঠাওরে প্লেবয়-এর সমর্থক হয়ে গিয়েছে, সে খবর আর পৌঁছোয়নি। কেবল তড়িঘড়িতে পোশাক বদলাতে গিয়ে দু-এক বার স্কুলের শার্টটি ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গিয়েছি, আর তার জন্য যেটুকু বকুনি দু-কান খোলা রেখে শুনে যেতে হয়েছে। কিন্তু স্কুল ছাত্র হিসেবে শণাক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো গিয়েছিল বিলকুল। ইউনিফর্মের এটা আরেক সমস্যা। স্কুলের ভেতর সে যতই চেষ্টা করুক না একটা হোমোজিনিয়াস পরিবেশ বজায় রাখার, বাইরে বেরোলে সেই পোশাকটাই গায়ে সেঁটে যাওয়া লেবেলের কাজ করবে। বাকি সমাজের থেকে আলাদা করে তোমাকে চিনিয়ে দিতে চাইবে। যেন তুমি হংস মধ্যে বকযথা। তুমি দুধভাত! আর সেই বেড়া ভাঙতে গেলেই দাবি করবে কৈফিয়ত। কিংবা তোমায় দেখেই বুঝে যাবে তুমি এলিট স্কুলের পড়ুয়া নাকি পাতি স্কুলের। দশ-বারো ক্লাসে পড়া প্রাপ্তমনস্ক একটি ছেলে বা মেয়ের কাছে এসব অস্বস্তিকর নয় কি!
কাজেই, সুবোধ বালক না হলেও বিদ্যাসাগরের ‘ব্যাড বয়’ যাদবকে দেখে ঈর্ষান্বিত হতেই হয়। মোটে আট বছর বয়সেই স্কুল কেটে সে খেলে বেড়ায়! বাপ-মা কি পাড়ার লোক টেরটিও পায় না। ‘যাদবের পিতা, প্রতিদিন, তাহাকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিতেন। লেখা পড়ায় যাদবের যত্ন ছিল না। সে, এক দিনও, বিদ্যালয়ে যাইত না; পথে পথে খেলা করিয়া বেড়াইত।
বিদ্যালয়ের ছুটী হইলে, সকল বালক যখন বাড়ী যায়, যাদবও সেই সময়ে বাড়ী যাইত। তাহার পিতা মাতা মনে করিতেন, যাদব বিদ্যালয়ে লেখা পড়া শিখিয়া আসিল।’ সহজেই অনুমেয়, ইউনিফর্মের ব্যাপার-স্যাপার যাদবের বিদ্যালয়ে ছিল না। থাকলে, স্কুলের পোশাক পরে প্রত্যহ পথে পথে খেলে বেড়ানো সেকালেও অত সহজ হত না। উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালাতেও যেমন – সুগত, ভানু, আলম, সৌদাস... একেক জনের পোশাক একেক রকম। সে পোশাকে বৈচিত্র আছে, বৈষম্য নেই। শুধু তাই নয়, নামের মধ্য দিয়ে তাদের ধর্মের বৈচিত্র দেখানোর ফলেও সামগ্রিক ভাবে এক সাম্যের ছবি ফুটে উঠেছে। পাঠশালা খোলা থাকলেও, রাজার মূর্তি তাক করে ঢিল মারার মতো দুঃসাহসিক কাজের জন্য তাদের পোশাক বদলে নেওয়ার সতর্কতা অবলম্বন করতে হত না।
বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন নিয়ে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষাবিধায়ক প্রস্তাব’ কিংবা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষাপ্রণালী’ গ্রন্থের ঐতিহ্য মাথায় রেখেই ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হচ্ছে অঘোরনাথ অধিকারীর ‘বিদ্যালয়-বিধায়ক বিবিধ বিধান’। তা থেকে উদ্ধার করা যেতে পারে – ‘কারসিয়ং ভিক্‌টোরিয়া স্কুলে সাহেবের ছেলেরা পড়ে। স্কুলের সঙ্গে ছাত্রনিবাস আছে, বালকেরা সেইখানে থাকে। তাহাদের মাথার চুল খুব ছোট করিয়া কাটা; পোষাক পরিচ্ছদ এক রকমের সামান্য খাকী কাপড়ের; ইহাই ব্রহ্মচর্য্য, আমাদিগেরও সেকালে ইহাই ছিল। আর এখন আমাদিগের কি হইয়াছে? আমাদের স্কুলের ছাত্রগণ সিঁথির উপর এলবার্ট কাটিয়া, ডবল প্লেট সার্টের উপর হাই কলার আটিয়া, চাদরখানি নানা রকমের চুনট করিয়া, বাঁশবেড়ের কার্ত্তিক সাজিয়া বিদ্যালয়ে উপস্থিত। আবার কেহ হয়ত দুই পায়ে দুই রকমের জুতা পরিয়া, লজ্জা নিবারণ হওয়া সুকঠিন – এরূপ ছিন্ন বস্ত্র পরিধান করিয়া, ধোয়া জামার উপর ময়লা চাদর গায় দিয়া, বড় বড় চুল গুলি পাগলের মতো এলো মেলো করিয়া বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। দুইই দোষের, কিন্তু বিলাসিতায় বালকগণ যত অধঃপাতে যায়, নোংরামীতে তত নয়। বিলাসিতার অন্তরালে কত যে কুৎসিত ভাব লুক্কায়িত থাকে, তাহা বলা বাহুল্য। অতএব সর্ব্বপ্রযত্নে এই বিলাসিতার ভাব বিনাশ করিতে চেষ্টা করিতে চেষ্টা করিবে। ছাত্রগণের জন্য একটা বিশেষ পোষাকের ব্যবস্থা করিলে কেমন হয়?’

 

অঘোরনাথ অধিকারীর ‘বিদ্যালয়-বিধায়ক বিবিধ বিধান’ (১৯০৯) গ্রন্থে ইউনিফর্ম-পরা ছাত্রদের ছবি

একশো বছরেরও বেশি আগে লেখা সে বই-এ তিনি শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের দু’টি ছবি ছাপছেন। সে ছবিতেও ছাত্রদের দেখাচ্ছেন স্কুল ইউনিফর্মে। মজার কথা, এই বছর কুড়ি আগে অঘোরনাথ অধিকারীর মতো প্রায় একই স্বর শোনা গেল বিল ক্লিন্টনের মুখে – ‘If it means that teenagers will stop killing each other over designer jackets, then our public schools should be able to require their students to wear uniforms’। ভারতের ঢের পরেই তবে বিদ্যালয়ে ইউনিফর্ম চালু করার ঝড়টা উঠল মার্কিন মুলুকে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, বাঁশবেড়ের কার্তিকই হোক বা আমেরিকার ডিজাইনার জ্যাকেট, তার প্রতি আদিখ্যেতা রুখতে গিয়ে কি একটি শিশুর কল্পনাশক্তিকেও রুখে দেওয়া হল না? মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার একটি চিরন্তন মাধ্যমই হল রং। কিশোর মনের আকর্ষণ সেই রঙের প্রতি আরও বেশি। কিন্তু তাকে প্রতিনিয়ত একই রঙের পোশাকে অভ্যস্ত করে দেওয়া মানে তো তার মানসিক বিকাশেও বাধা দান করা। এক অর্থে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপও বটে। ঘন বর্ষায় যে রঙের পোশাক পরে সে স্কুল যায়, কনকনে শীতে সেই একই রঙের পোশাক তার পরতে ইচ্ছে না-ও করতে পারে। দিনের পর দিন একঘেঁয়ে এই ঘেরাটোপে বাঁধা থাকার পর একদিন নিজেকে সে স্রেফ একটা রোবট বলে ধরে নিতেই পারে। ইউনিফর্মের জন্য তার ধারণাটা হয়ে উঠতেই পারে – ‘অল ইন অল ইট’স জাস্ট অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল’! নিছক সম্ভাবনা নয়, এমনটা যে হয়ও, তা কি আমরা নিজেদের স্কুলজীবনে দেখিনি? নইলে কেন বারবার মনে হবে, কবে যে দাদা বা দিদির মতো কলেজে উঠব! কারণ, বড় হওয়ার সমার্থক তখন কলেজে পড়া। আর কলেজে পড়লে স্কুল-ড্রেস পরতে হয় না!
এতই যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আমাদের শিক্ষায় স্কুল-ইউনিফর্মের ভূমিকাটা কী? কেনই বা ‘কচি ছেলেদের চোখ হল ট্যারা, বান্ধবীদের ড্রেস দেখে’? ব্রহ্মচর্যের ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষা না কি ঔপোনিবেশিক খোঁয়াড়ি! ছোট্ট একটা ঘটনাতেই বোধহয় বুঝিয়ে দিয়েছিল আমাদের সেরা বাঙালি ছাত্রটি – ‘একবার সে হঠাৎ পেন্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢল্‌ঢলে পায়জামার মতো পেন্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং সেটা তাহার কাছে ভারি একটা আমোদের ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘‘পেন্টেলুন পরেছিস্ কেন?’’ দাশু এক গাল হাসিয়া বলিল, ‘‘ভালো করে ইংরিজি শিখব ব’লে।’’’

রোববার, সংবাদ প্রতিদিন, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

04 September 2016

সব ন্যাটে আছে

সুস্নাত চৌধুরী




রাশিচক্রের হিসেবে তাঁর নাম ছিল ‘সর্বজ্ঞ’। সর্বজ্ঞ গঙ্গোপাধ্যায়। জন্ম ১৩৪৩ সনের ২৯ শ্রাবণ। সিংহ রাশি। এহেন ‘সর্বজ্ঞ’ পুরুষসিংহের নামকরণ অবশ্য করা হয় লালমোহন গাঙ্গুলি। পরে ছদ্মনাম নেন ‘জটায়ু’। জটায়ুর লেখক জীবনে প্রকৃত প্রস্তাবেই সর্বজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন প্রদোষচন্দ্র মিত্র। যাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের খানিকক্ষণের মধ্যেই জটায়ুকে বলতে হচ্ছে – ‘ভাগ্যিস বললেন। নেক্সট এডিশনে ওটা কারেক্ট করে দেব।’ আবার এই ফেলু মিত্তিরের মাইক্রফ্‌ট হোমস ছিলেন সিধুজ্যাঠা। সিদ্ধেশ্বর বোস। সর্বজ্ঞেরও যে তর-তম হয়, তা এই পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেই স্পষ্ট। সত্যজিতের লেখায় নয়, তবে সন্দীপের ছবিতে (গোরস্থানে সাবধান!) সিধুজ্যাঠা ফেলুদাকে বলছেন – ‘আর, এখন ওই ইন্টারনেট নামক বস্তুটি তো আছেই!’ তারপর, সিধুজ্যাঠাও যখন ব্যর্থ হচ্ছেন, জটায়ুর ভাষায় ‘পেরিপিটার’, মানে, পেরিগ্যাল রিপিটারের খোঁজে ফেলুদাকে ঢুকতে হচ্ছে সাইবার ক্যাফেতে। খুলতে হচ্ছে গুগল। কারণ, সে ততদিনে আমাদের প্রায় সবার কাছে সর্বজ্ঞ। আলটিমেট সবজান্তা।
আজ সেই গুগলই পূর্ণ করল আঠেরো বছর বয়স। এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়। সেই সংশয়হীনতার আশ্রয় এমনই ছায়াঘেরা, সেই নিশ্চয়তার বন্ধুহাত এত দূর সমর্থ যে বিশেষ্য থেকে ক্রমে ক্রিয়াপদ হয়ে উঠেছে গুগল। ‘ঘর পে যাকে তুম গুগল করলো’। যখন-তখন যে কোনও প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমরা আজ খাওয়া-বসা-শোওয়ার মতোই নির্দ্বিধায় গুগল ‘করছি’। পরিসংখ্যান বলছে, ওয়েব-দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ গুগলের মাধ্যমেই সার্চ করে থাকেন। দিনে নিদেনপক্ষে কুড়ি কোটি মানুষ গুগলের দরজায় এসে কড়া নেড়ে যান। এ পোড়া বাংলাতেও ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে গুগল। পারলে সাইবার ক্যাফেতে ফেলে-আসা পেন-ড্রাইভ কি খাইবার ক্যাফেতে ফেলে-আসা ভিজে বাঙালির ছাতাটিও যেন খুঁজে দেবে সে! বউ গেলে বউ, মায়, মা গেলে মা-ও!
ঈশ্বরই বটে! আগে লোকে বলত, ‘সব ব্যাদে আছে’। গুগলের কৃপায় আজ বলছে ‘সব ন্যাটে আছে’। কেষ্ট, খ্রিস্ট, আল্লাহ – সকলেই মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ। আজ গুগলের অবস্থানও কি সেরকমই হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? তা নইলে ফেসবুকে বা ব্লগে ‘জ্ঞানতীর্থ জ্ঞানরত্ন জ্ঞানাম্ভুধি জ্ঞানচূড়ামণি’ জাঁদরেল কুইজ মাস্টারটিকেও ডিসক্লেমার দিতে হয়, ‘গুগল না করিলে বাধিত হইব’! তা নইলে কি প্রতিষ্ঠা পায় ‘সিওজি’, মানে, ‘চার্চ অব গুগল’! যেখানে লোকে ঈশ্বর ঠাওরে উপাসনা করে গুগলের। কানাডার ম্যাট ম্যাকফারসনের এই বিচিত্র কীর্তির পর পেরিয়ে গিয়েছে দশ বছর। সেই চার্চে গুগল-উপাসকদের জন্য রয়েছে টেন কম্যান্ডমেন্টস, রয়েছে প্রার্থনা সংগীত! জিংগল বেল-এর সুরে তা শেষ হচ্ছে এই ভাবে – ‘Oh, Google's god, Google's god, I'm praying to her now. This prayer is just about over, so it's time to take my bow!’ কেবল সুরের সুতোয় শব্দ জুড়ে বানানো অ্যানালগ বাক্যবন্ধ নয়, চালু রয়েছে এই প্রার্থনা সংগীতের শূন্য-এক দিয়ে গাঁথা মালার বাইনারি গাথাও!
এখন কথা হল, আদৌ কি কারো পক্ষে ‘সবজান্তা’ বলে কিছু হওয়া সম্ভব? পরিভাষায় যাকে বলে ‘অমনিসিয়েন্ট’ কিংবা ‘প্যান্টোম্যাথ’। মাইক্রোসফ্‌ট নয়, মাইক্রফ্‌ট-এর প্রসঙ্গে কোনান ডয়েল লিখছেন, ‘অল আদার মেন আর স্পেশালিস্টস, বাট হিজ স্পেশালিজম ইজ অমনিসিয়েন্স’। কিন্তু এই ‘চূড়ান্ত’ হয়ে ওঠা তো একটা ধারণা মাত্র। আপেক্ষিকতার জালে-জড়ানো এক বিষম ধাঁধা। জটায়ু > ফেলুদা > সিধুজ্যাঠা – এই সম্পর্ক যে আপেক্ষিকতার নিদর্শন। পণ্ডিত হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গার্গীর র‍্যাপিড ফায়ারের শেষ দিকে যাজ্ঞবল্ক্যকেও প্রায় হুমকির সুরে কথা বলতে হচ্ছে। কতকটা ধম্‌কেই তিনি থামিয়ে দিচ্ছেন গার্গীকে। তা কি শেষ সত্য জানা নেই বলে, না কি সেই চূড়ান্ত সত্যটি প্রকাশিত হয়ে পড়লে ইহ জগতেরই আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না, সেই ভয়ে। ঠিক যেমন সর্বজ্ঞ ‘কম্পু’ প্রোফেসর শঙ্কুকে বলেছিল – ‘...আর সাড়ে তিন মিনিটে ভূমিকম্প হবে। মৃদু কম্পন। টের পাবে, তাতে কারুর ক্ষতি হবে না। আর তখনই আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর আমি পাব। সে উত্তর কোনও মানুষে পাবে না কোনওদিন।’ তারপর, শঙ্কু তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন – ‘ঠিক ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় পায়ের তলার মেঝেটা কেঁপে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে এক অপার্থিব বর্ণচ্ছটা বিকীর্ণ করে কম্পুর দেহ সশব্দে খণ্ড খণ্ড হয়ে স্ফটিকস্তম্ভের উপর থেকে শ্বেতপাথরের মেঝেতে পড়ল, তার ভিতরের কলকবজা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ধুলোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই ভগ্নস্তূপ থেকে একটা রক্ত হিম করা অশরীরী কণ্ঠস্বর বলে উঠল – ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি!’’ সবজান্তার এই ধাঁধাটি আরেক ভাবে খুব সহজ কথায় তুলে এনেছেন দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী। লন্ডনের গ্রেশ্যাম কলেজে এক বক্তৃতায় তিনি বলছেন – বুদ্ধ যদি সর্বজ্ঞ হন, আবার মহাবীরও যদি সর্বজ্ঞ হন; মানে, দু’জনেই যদি সবই জানেন, তাহলে তাঁদের মধ্যে মতানৈক্য হল কেন!
তবু যখন আশৈশব বলি, ‘আমার মা সব জানে’ – তখন সেই সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না। জীবনের সব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে আজও যখন নির্দ্বিধায় বনস্পতির ছায়ায় এসে দাঁড়াই, তখন আমার বাবা আমার ঈশ্বর। আমার শেষ সর্বজ্ঞ। কিংবা যখন ভাবি, ‘এই বেলা প্রশ্নটা লিখে রাখি গুছিয়ে / জবাবটা জেনে নেব মেজদাকে খুঁচিয়ে’ – তখন সবজান্তা মেজদা আমার একান্ত গুগল। আমার ভরসা। ভরসা যেন পড়ায় এবং ভরসা যেন পড়তে আসে। কিন্তু, এই ভরসারই দেখনদারিত্ব, এই প্রবল সবজান্তাপনাই আমাদের বেপথু করে যখন অপরের প্রতি এক সহজাত হ্যাটা-প্রবণতা দুন্দুভি-নিনাদে উচ্চারিত হয় – ‘বল্‌বে কি, তোমরাও নোট্‌বই পড়নি!’ তবু সংসারের গোলকধাঁধায় বারে বারে সবজান্তার ভূমিকায় অভিনয় করতে নেমেই পড়ি আমরা। সহকর্মীটির বস হতে হলে কি সহধর্মিনীটিকে বশ করতে হলে, জীবনের গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ সবজান্তা ছাড়া যে আমার-আপনার সাজার আর কিচ্ছুটি নেই। জিডিপি থেকে জিলিপি, রেশন থেকে রিসেশন – জগৎ-সংসারের সমস্ত কিছুর গুঢ় রহস্যই আপনার নখের ডগায় থাকুক না-থাকুক, জিভের ডগায় বিলক্ষণ থাকবে! পেটে না আসুক, মুখে আসা চাই। তখন সক্রেটিসের নাম আপনার ঘুণাক্ষরেও মনে আসবে না। আপনি জানেন না যে আপনি জানেন না।
আসলে দুলিরাম আর শ্যামচাঁদই আমাদের আর্কেটাইপ। দুলিরাম প্রসঙ্গে সুকুমার লিখছেন – ‘দু-চারিটি বড় বড় শোনা কথা আর খবরের কাগজ পড়িয়া দু-দশটা খবর এইমাত্র তাহার পুঁজি, তারই উপর রঙচঙ দিয়া নানারকম বাজে গল্প জুড়িয়া সে তাহার বিদ্যা জাহির করিত।’ আর দ্বিতীয়জনকে নিয়ে বলছেন – ‘বয়সের হিসাবে শ্যামচাঁদ একটু বেঁটে ছিল। পাছে কেহ তাকে ছেলেমানুষ ভাবে, এবং যথোপযুক্ত খাতির না করে, এই জন্য সর্বদাই সে অত্যন্ত বেশি রকম গম্ভীর হইয়া থাকিত এবং কথাবার্তায় নানা রকম বোলচাল দিয়া এমন বিজ্ঞের মতো ভাব প্রকাশ করিত যে স্কুলের দারোয়ান হইতে নিচের ক্লাশের ছাত্র পর্যন্ত সকলেই ভাবিত, ‘নাঃ, লোকটা কিছু জানে!’’ বলা বাহুল্য, পাঠকও জানেন, প্রথম গল্পটির নাম ‘সবজান্তা’, আর দ্বিতীয়টির ‘চালিয়াৎ’! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইশকুল-জীবনে শেখা অসংখ্য আমিষ ভোকাবুলারির মধ্যে এই নিরামিষটিও ছিল – ‘সবজান্তা গেঞ্জিওয়ালা’! সবজান্তা হওয়ার সঙ্গে হোসিয়ারি শিল্পের কী সম্পর্ক বলা মুশকিল। তবে মনে আছে, বছর বিশেক আগে সেই সব চলতা-ফিরতা সাইক্লোপিডিক দেখনদারি মানুষজনের উদ্দেশে এই বাক্যবাণ ছুড়ে দেওয়াই ছিল রেওয়াজ। আজ কাচের ঘরে বসে থাকি, তাই ঢিল ছুড়তে ভয় লাগে। বরং দরকার হলেই টুক করে গুগল করে নিই। আর গুগলেও সুবিধে না করতে পারলে, তারিণী কবিরাজের মতো বলে উঠি – ‘হয়, Zানতি পার না’।


ছুটি, সংবাদ প্রতিদিন, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

09 August 2016

ফেসবুকভরা ভালবাসা

সুস্নাত চৌধুরী


আরেকটা পৃথিবী, এবং যে পৃথিবীতে আপনিও আছেন। ‘লেট দেয়ার বি কানেক্টিভিটি’ উচ্চারণে সেই অপর দুনিয়ার জন্ম কোনো ঈশ্বর দেননি; দিয়েছিলেন হার্ভার্ড-এর ছোকরা মার্ক জুকেরবার্গ। সেই ‘সৃষ্টির আদি’ মোটে দশ-বারো বছর আগের কথা। অথচ এটুকু সময়েই যেন আবিশ্ব বদলে গেল বিশ্ব। আকাশ ছেয়ে যাওয়া বিপুল তরঙ্গ হয়ে উঠল সম্পর্কের সুতো। ভার্চুয়াল ঈশ্বরের বানানো বস্তুময় পৃথিবীর জায়গা নিতে থাকল রক্ত-মাংসের মানুষের বানানো ভার্চুয়াল পৃথিবী। যত গড়াচ্ছে দিন সেই দুনিয়ায় বেঁচে থাকছে আরও বেশি মানুষ। বাড়ছে সেখানে মরা মানুষের সংখ্যাও।
ইয়াহু মেসেঞ্জার কিংবা অরকুট-এর মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম তখনও ছিল, কিন্তু ‘ফেসবুক’ নামক বদনবইটি যে এভাবে একদিন রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে সর্বব্যাপী হয়ে উঠবে, দেখা দেবে রূপ থেকে রূপান্তরে, শুরুতে তা সম্ভবত জুকেরবার্গ সাহেবও আন্দাজ করতে পারেননি। ক্রমে যত লম্বা হয়েছে টাইমলাইন, ততই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ফেসবুক। কখনও মনের আয়না, কখনও বন্ধুত্বের ব্যালকনি, কখনও আবার রাজনীতির রণাঙ্গন। ভিতর ও বাহির – দু’দিকের জানলা খুলেই সে ইউজারকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছে। ব্যক্তিক অনুভূতিকে যেমন স্পেস দিয়েছে, তেমনই অস্বীকার করেনি নেহাত কেজো প্রয়োজনগুলিকে। আবার শুধু ইউটিলিটির ক্লান্তিকর ফর্দও বানিয়ে তোলেনি, ইউটোপিয়ার হাতছানিও রেখেছে। চেপে-রাখা কথা, আটকে-থাকা কান্না, মনে-পড়া হাসি... অক্ষর হয়ে ছবি হয়ে তার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে। প্রযুক্তিগত জায়গা থেকে তো সামগ্রিক ভাবেই কৃতিত্বের বটে, কিন্তু কনসেপ্টের ক্ষেত্রে মনে হয় ফেসবুকের সাফল্য আরও বেশি, সম্ভবত যা লুকিয়ে আছে তার এই দ্বৈত অবস্থানের মধ্যেই। এমন বন্ধু আর কে আছে!‍
প্রাথমিক ভাবে তথ্য দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যম হলেও, মানুষ ফে বু-কে নিজের মতো করে কাস্টমাইজ করে নিয়েছে। হারিয়ে-যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া কিংবা দূর-দেশি সমমনস্কের সঙ্গে যোগাযোগ – এটুকুতেই সে থেমে থাকেনি। আসলে তার কাছে ফেসবুক হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সমার্থক। ফেসবুক নিজে একটি এস্টাব্লিশমেন্ট হয়েও মানুষের হাতে ধরা দিয়েছে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্টের হাতিয়ার হিসেবে। মানুষ এখানে নিজেই নিজের কথা বলতে পেরেছে। এলাকার খবরটা সক্কলকে জানাতে টিভি ক্যামেরার জন্য বসে থাকতে হয়নি। ব্যান্ডের শো-এর জন্য বিজ্ঞাপনে মোটা টাকা খসাতে হয়নি, কেবল একটা ইভেন্ট টাঙিয়ে দিয়েই বেমালুম হাউসফুল করা গিয়েছে। সেলেব না হয়েও নিজের পাতাটি পেজ ফোরের মতো সাজিয়ে নেওয়া গিয়েছে। অ্যালবাম বানিয়েছে সে দিনের পোশাকের, রাতের মেনুর। হোক না কাঁচা, অপাঠ্য, তবু অন্তর থেকে লেখা কবিতাটা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে কোনো পত্রিকার দফতরে হত্যে দিতে হয়নি, কোনো সম্পাদককে তেল দেওয়ারও দরকার পড়েনি। বরং পাঠকের মতামতও সহজেই জানতে পেরেছে। এই যে ‘সাধারণ’ থেকে ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠা, ‘জনৈক’ থেকে হয়ে ওঠা ‘স্বয়ং’ – এই পরিবর্তন প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষেরই শক্তি বাড়িয়েছে। সেই শক্তি কতটা, তার নিদর্শন দেখিয়েছে আরব স্প্রিং। রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানকেও সে ছেড়ে কথা বলেনি। বহুলাংশে ফেসবুক হাতিয়ার করেই মিশরে হোসনি মুবারককে গদিচ্যুত করেছে জনতা। ব্যাপারটা অনেকদিনই এই জায়গায় পৌঁছেছে যে প্রতিষ্ঠানকেও গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াতে হয়েছে ফেসবুকের মঞ্চে। দেশের সরকারও তাকে বাদ দিয়ে আর ভাবতে পারছে না। বলা যায়, এস্টাব্লিশমেন্টও আজ এক প্রকার বাধ্যই হয়েছে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্টের অংশ হয়ে উঠতে।
ফেসবুকের এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ইমেজ কাজ করেছে তাদের ‘ফ্রি বেসিক’ চালু করার উদ্যোগেও। কিন্তু বিনামূল্যে কিছু সাইট ব্যবহার করতে পারার প্রস্তাব নাকি নেট নিরপেক্ষতা বিরোধী, ভারতে তাদের প্রয়াসের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য ছিল বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশেরই। সে আশঙ্কা অমূলক নয় বটে। আর ফেসবুক যে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান, আমি-আপনি পোস্ট শেয়ার করলে ফেসবুকেরও শেয়ার মহার্ঘ হয়, তা তো জানা কথাই। আবার এ-ও ঠিক, ‘ফ্রি বেসিক’ নিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্তই ভবিষ্যত অনুমান করে এক সম্ভাব্যতার খাতিরে গ্রহণ করা। নেট নিউট্রালিটি আদৌ কতটা সফল হবে, তা যে একটি ডবকা অশ্বডিম্ব প্রসব করবে না, হলফ করে তা-ই বা কে বলতে পারে! কাজেই, ফেসবুক ‘ধান্দা’ করছে বলেই হুট করে কি তাকে ‘ধান্দাবাজ’ বলে দেগে দেওয়া যায়? যে অবদান সে মানব সমাজে রেখেছে, তাকে অস্বীকার করা তো সম্ভব নয়। এমনকী তার প্রভাব সর্বদা কল্যাণকর না হওয়া সত্ত্বেও। কখনও সে ত্বরাণ্বিত করেছে সম্পর্কের ভাঙন, কখনও জন্ম দিয়েছে মানসিক অতৃপ্তির – এমন উদাহরণ সারা পৃথিবীতেই আজ ঢের। এই ফেসবুকে তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা; একটি পাখির গান কী রকম ভালো।


পঁচিশ পুরাণ, সংবাদ প্রতিদিন, ৯ আগস্ট ২০১৬

20 June 2016

আ মরি বাংলা ছবি

সুস্নাত চৌধুরী



আমাদের প্রিয় টেলিফিল্ম নির্মাতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতাও, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় লিখিত ও আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাঁচি, বাঁচাই’ উত্তর-সম্পাদকীয়ের (১২ জুন, ২০১৬) প্রেক্ষিতে এই লেখা (কৌশিকবাবুর সে লেখার লিংক রইল - http://www.anandabazar.com/editorial/the-tail-of-cinemawala-1.408838) কোনো চলচ্চিত্র-কুশলী, তাত্ত্বিক বা সমালোচক হিসেবে নয়, এ নেহাতই এক ‘দর্শক’-এর প্রতিক্রিয়া। কৌশিকবাবু তাঁর লেখায় যে গোষ্ঠীটির উদ্দেশেও বাঁচা বা বাঁচানোর ডাক তুলেছেন, এই কলমচি তাঁদেরই জনৈক প্রতিনিধি মাত্র। লেখার উদ্দেশ্যটি মহৎ, পড়লেই বোঝা যায়। যা চাইছেন, সেটি মহত্তর। কিন্তু যেভাবে চাইছেন, বা তাঁর লেখাটি যেভাবে এগিয়েছে, বহুলাংশেই তা যুক্তিহীনতায় ভরা ও অপযুক্তিতে ঠাসা বলেই বোধ হচ্ছে। সে কারণে ছবির বিষয় নিয়ে তাঁর মতোই অক্ষরের দারস্থ হয়েছি।
শুরুতেই শেষের কথায় আসি। শেষ অনুচ্ছেদে কৌশিকবাবু সাম্প্রতিক ‘শহুরে’ বাংলা ছবির দৃষ্টান্তমূলক সাফল্যের নমুনা হিসেবে কয়েকটি নাম করেছেন – ‘চাঁদের পাহাড়, বেলাশেষে, প্রাক্তন, মিশর রহস্য বা শব্দ’। যদিও, সেগুলি শুধুই ‘সফল’ ছবি, না ‘ভালো’ ছবিও বটে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। এই বিতর্কে যাব না। যা মনে হচ্ছে, তিনি বলতে চেয়েছেন, ছবিগুলি যুগপৎ সফল ও ভালো। তাহলে প্রশ্ন জাগে, কোন হিসেবে এই নির্ধারণ? মার্কেটিং-প্রোপাগান্ডা-পোষিত এই সুসময়ে মিডিয়া রিভিউ-এ বাজার খানিক গরম হয় বটে, কিন্তু তাকে কষ্টিপাথর হিসেবে খুব বোকা দর্শকও ধরেন বলে মনে হয় না। ‘কালোত্তীর্ণ’ বিশেষণটিও এত তাড়াতাড়ি প্রয়োগ করা যাবে না নিশ্চয়ই। সেক্ষেত্রে দু’টি অপশন থেকে যায় – এক, বেশি টাকার বাণিজ্য করা। দুই, ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানানো। যদি প্রথমটি ধরি, তাহলে এই তালিকায় অন্তত ‘শব্দ’ ছবিটির উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন জাগেই। ছবি হিসেবে ‘শব্দ’ ব্যতিক্রমী প্রয়াস, সন্দেহ নেই। কিন্তু সিনেমা হল থেকে এটি কত আয় দিয়েছিল কিংবা টেলিভিশন রাইটস বাবদই বা কত টিআরপি টেনেছিল! কাজেই, ধরে নিতে হচ্ছে, (জাতীয় পুরস্কারের কথা মাথায় রেখে) ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের কথাই জানিয়েছেন মাত্র। এগুলিকে অহেতুক যুগপৎ ‘ভালো’ ও ‘সফল’ হিসেবে ধরে নেওয়ার আর কোনো কারণ থাকতে পারে কি? তিনি যেমন তাঁর তালিকা পেশ করেছেন, একই ভাবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এই বাংলার প্রতিটি চলচ্চিত্র-দর্শক তাঁদের বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী প্রিয় ছবির তালিকা দিতে পারেন। সেখানে ‘বস’ বা ‘পাগলু’ ঠাঁই পেলে হয়তো কৌশিকবাবু খুশি হবেন না। সম্ভবত এগুলোকেই তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গভূমির ধানখেতে ভুট্টা’। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতা-লালিত এই সময়ে ব্যক্তি মানুষের ‘চয়েস’-কে বাদ দিই বা কী করে! তাছাড়া সাফল্য যদি আয়ের নিরিখেও ধরি, তাহলেও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় নির্মিত কিংবা এ লেখায় নির্ণীত ছবিগুলির তুলনায় তাদের আয় ঢের ঢের বেশি। সে হিসেবের কচকচিতে ঢুকছি না। বরং লক্ষ করতে বলছি, যে তালিকা কৌশিকবাবু দিচ্ছেন, তাতে পাঁচটি ছবির মধ্যে দুটির প্রোটাগনিস্ট প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, একটির দেব। বঙ্গভূমির ধানক্ষেতে সবচেয়ে বেশি ভুট্টা ফলানোর মাটি যাঁদের হাতে লেগে রয়েছে। সাম্প্রতিক যে ‘প্রাক্তন’ ছবিটি নিয়ে এত কথা, সেখানেও প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির সেই ইকুয়েশনও কিন্তু ধানখেতের ভুট্টা থেকেই উঠে আসা। সেই ইতিহাসকে এত সহজে নাকচ করে দেওয়া যায় কি?
ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এই তালে জানিয়ে রাখছি দর্শক হিসেবে এই কলমচির পছন্দের তালিকাটি। গত দশ-পনেরো বছরে যে ক’টি মাত্র হাতে-গোনা ‘শহুরে’ বাংলা ছবি উল্লেখের দাবি রাখে বলে মনে করি, তা হল – ‘পাতালঘর’, ‘হারবার্ট’, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ও ‘জাতিস্মর’। না, পরিচালক একটির ক্ষেত্রে বাই-চান্স মিলে গেলেও, ছবিগুলির একটিও কৌশিকবাবুর লিস্টির সঙ্গে মিলছে না। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছাড়া বাকিগুলি হল ভরাতে তেমন সফলও নয় বটে। তবু, ‘ভালো’ বাংলা ছবি বাছার ক্ষেত্রে আমার এই নির্বাচনের কারণ খুব সিম্পল। এক, ছবিগুলি শেষ হয়েছে। অর্থাৎ, অধিকাংশ বাংলা ছবিই দেখি আজকাল শুরু হয় পর্দা কাঁপিয়ে, তারপর রাশ ধরে থাকতে পরিচালক ডাহা ফেল করেন। কিন্তু, এ ছবিগুলির একটি করে যথাযথ ‘দি এন্ড’ আছে। দুই, ছবিগুলির রিপিট ভিউইং-এর মজা পেয়েছি! এই সময়কালে খুব কম বাংলা ছবিই হয়েছে, যা দু-বার দেখা যায়। এগুলি একাধিক বার দেখেও পুরোনো হয়নি। এই সরলীকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের তালিকাটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি হয়তো, কিন্তু কৌশিকবাবুর তালিকার কোনো ব্যাখ্যাই, মানে, কেন ‘মিশর রহস্য’ বা ‘শব্দ’-র মতো ছবি একদিন শহরের হল ভরিয়ে দেবে, তার হদিশ পাচ্ছি না। লাভ হলেও ‘প্রাক্তন’ বা ‘চাঁদের পাহাড়’ কীভাবে উল্লেখযোগ্য ছবি হল, সেটাও বুঝতে পারছি না।
কৌশিকবাবু শুরুতেই মেগা সিরিয়ালকে একহাত নিয়েছেন। ‘বুদ্ধিমান’ বাঙালি মাত্রেই ইদানিং নিয়ে থাকেন দেখি। উচিত কাজ। কৌশিকবাবু বলেছেন, ‘দেবী-দেবতা, সাপ-ব্যাঙের মধ্যযুগের গল্প’। বলেছেন, ‘শিব-দুর্গার প্রেমালাপ, জোড়া সাধকের লড়াই বা সুন্দরী মেয়ের সাপ-সাপ ভাব’। ফর্ম বা গুণগত মান নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেননি, তুলেছেন কনটেন্ট নিয়ে। তার মানে, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল কিংবা অন্নদামঙ্গলের মতো মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য নিয়েও তিনি সম্ভবত একই কথা বলবেন। বলবেন হয়তো শাক্ত পদাবলী, বৈষ্ণব পদাবলী কিংবা লক্ষ্মীর পাঁচালীর কাহিনি-কাঠামোর ক্ষেত্রেও। কারণ, তিনি তো সাফ লিখেইছেন – ‘লাভজনক বলে দেদার নির্মাণও হচ্ছে অলৌকিক বা পুরাণের গল্পবলা ধারাবাহিক’। ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ কিংবা ‘কালিয়া মর্দন’ নিয়েও কি তাঁর একই মত? পিটার ব্রুকের মহাভারত? এই মহাভারতের চিত্রনাট্য তো আবার লিখছেন জাঁ ক্লদ কারিয়ার, যিনি কাজ করেছেন লুই বুনুয়েলের সঙ্গে! মাইকেলের যে রচনাটি থেকে কৌশিকবাবু ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে’ কথাটি কোট করছেন, সেই ‘শর্মিষ্ঠা’? সেটি কি পৌরাণিক নাটক নয়? কী আশ্চর্য, তবু তাঁর মতো ‘শহুরে’ পরিচালককে আজ সেখান থেকেই শব্দ ধার করতে হচ্ছে! আরও গোদা উদাহরণ দিই। ঠিক যে অবস্থানে তিনি বাংলা সিরিয়ালকে রেখেছেন, সেই নিচুতলাতেই থাকা একটি বাংলা ছবি – ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। কৌশিকবাবুর ভাষায় সম্ভবত ‘গ্যাদগ্যাদে ও চড়া দাগের’। কিন্তু তার সাফল্যকে আয়ের নিরিখে যেমন ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনই সমাজ জীবনে প্রভাবের দিক থেকেও দেখা যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে একদা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত মন্তব্যটি পাঠকের মনে থাকবে হয়তো। একটি ছবির পলিটিকাল মেটাফর হয়ে ওঠা খুব চাট্টিখানি কথা কী! শুধু তাই নয়, চলচ্চিত্র হিসেবে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’-র গুরুত্বের কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন ফাদার গাঁস্ত রোবেজের মতো সমালোচকও। কিন্তু কৌশিকবাবু তো মনে করছেন, পপুলার মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে পিছন দিকে হাঁটা!
সম্পূর্ণ ব্যবহারিক প্রেক্ষিত থেকেও বিষয়টা দেখা যেতে পারে। তাঁর মতে যে সিরিয়ালগুলি ‘পরমার্থে... দিন-দিন রিক্ত’ করে দিচ্ছে আমাদের, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে কিন্তু দিনের শেষে জয়ী হচ্ছে নারী। কেউ আইপিএস হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, কেউ রাজনীতির ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। উইমেন এম্পাওয়ারমেন্ট নিয়ে এত এত সেমিনার-লেকচার যেখানে পৌঁছোতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে অনায়াসে এই কাহিনিগুলি স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ঠিকে ঝি, বিধবা শাশুড়ি কিংবা চারবেলার হেঁসেল-ঠেলা বউটির কাছে এটাই কি দক্ষিণ-খোলা জানলা নয়? কৌশিকবাবু ঠাকুরের ‘লোকশিক্ষে’-র প্রসঙ্গ এনেছেন। গিরিশ ঘোষের কথাও বলেছেন। কৌশিকবাবুর প্রস্তাব-মতো ‘এই দেখুন লোকশিক্ষে দিলুম’ বলে কি লোকশিক্ষা দেওয়া সম্ভব আদৌ! এখানে ‘প্রথম আলো’-র সামান্য অংশবিশেষ অর্থবহ হতে পারে। মহাভারতের জনার কাহিনি প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন – ‘দর্শক-মনোরঞ্জনের সব রকম উপাদান থাকলেও গিরিশচন্দ্র এর মধ্যে নিজস্ব জীবন-দর্শনের কথাও ঢুকিয়ে দিলেন কিছু কিছু। বিদূষক চরিত্র গিরিশের খুব প্রিয়, তাঁর হাতে খেলেও ভাল। ‘জনা’ নাটকেও বিদূষকই যেন প্রধান, তার মুখে শ্লেষ-বিদ্রূপের আড়ালে জীবনের সব সার কথা উচ্চরিত।’ বাংলা সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও এই অ্যাপ্রোচ আংশিক সত্য তো বটেই। যদিও কৌশিকবাবুর মতে এসব ভয়াবহ ‘মৃত্যুর পাঁচন’। তাহলে করণীয়? হয় এদের বন্ধ করে দাও, নয়তো ভোল বদলাও। বন্ধ করার কথা নিশ্চয়ই কৌশিকবাবু বলবেন না। কারণ, সামান্য তথ্য ঘাঁটলেই তিনি জানতে পারবেন যে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি আজ যতটা না দাঁড়িয়ে রয়েছে সিনেমায় ভর করে, তার চেয়ে ঢের বেশি মেগা সিরিয়ালে। অনেক বেশি লোকের কাজ, অনেক বেশি দিনের কাজ, অনেক বেশি আয়। শহরের স্টুডিওগুলো যে গমগম করছে, তা সিনেমার জন্য নয়, সিরিয়ালের জন্যই। তাহলে হয়তো পথ হতে পারে দ্বিতীয়টি – খোলনলচে বদলাও। এক্ষেত্রে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই বহুশ্রুত বাক্যটি – আপনি আচরি ধর্ম...। না, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগে কৌশিকবাবু কি তাঁর দলের লোকেদের এ কথা বলে দেখেছেন? তাঁর সাম্প্রতিক ছবিগুলির যাঁরা প্রযোজক, তাঁরাই তো বাংলা সিরিয়ালে অন্যতম বড় চাঁই। তাঁদের অনুরোধ করেও তো দেখতে পারেন এই সিনেমাওয়ালা। কিংবা তাঁর সাম্প্রতিক ছবির যিনি প্রোটাগনিস্ট, সেই পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো মেগা সিরিয়ালে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন, এখনও তিনি একটি নন-ফিকশন শো-এর বিচারক। অনুরোধটা আগে তাঁদের কাছে করা উচিত ছিল না কি?
আসল সমস্যাটা একেবারেই অন্য জায়গায়। কৌশিকবাবুরা (হ্যাঁ, এখানে বহুবচন ব্যবহার করলাম) সম্ভবত এক স্নবারিতে ভোগেন। এটা কোনো হতাশাজনিত কারণে ঘটে কি না জানি না। নইলে ‘ছোট ছোট শহরতলি, গ্রামে কী প্রচণ্ড অহংকার ও আবেগ নিয়ে শিল্পচর্চা হচ্ছে আজও!’ বিলম্বিত বোধোদয়ের এই প্রামাণ্য বাক্যটি তিনি লিখতেন না। যদি-বা লিখতেন, তার শেষে বিস্ময়বোধক চিহ্ন জুড়তেন না। ‘আজও’ শব্দবন্ধের ব্যবহারও আপত্তিকর। এই একই স্নবারি তাঁদের কাজ করে মূলধারার সিনেমা ও সিরিয়ালের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও। তাঁর বক্তব্য, দুধ-ভাত না খেয়ে জাঙ্কফুড খাচ্ছে আশি শতাংশ বাঙালি। অর্থাৎ, এ রাজ্যের আশি শতাংশ মানুষের নির্বাচন ও সিদ্ধান্তকে তিনি নম্বর দিচ্ছেন না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে তিনি সহ বাকি কুড়ি শতাংশ বাদে গোটা বঙ্গবাসী আবোদা, নির্বোধ? বেশ, তা-ও ধরে নিতে রাজি আছি। সেক্ষেত্রে তাঁরা এর প্যারালাল কিছু একটা নির্মাণ করে দেখান অন্তত। সেই হেলদি ‘দুধ-ভাত’-এ গাঁ-শহর নির্বিশেষে না-হয় এর অর্ধেক মানুষের ঢল নামান। একেবারে পরিসংখ্যান দিয়ে কিন্তু দেখিয়ে দেওয়া যায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এখনও কীভাবে রেটিং এনে দেয় টেলিভিশনের পর্দায়।
এই স্নবারিই বাংলা ছবির প্রকৃত ক্ষতিটা করে দিয়েছে গত বিশ-পঁচিশ বছরে। ফেস্টিভ্যাল মুখরিত আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি সমাজের ধূসর কোষে কেবল জমা হয়েছে ঋত্বিক, সত্যজিৎ, আর কিছুটা মৃণাল। তপন সিংহ, তরুণ মজুমদারও সেভাবে নন। অজয় কর কি পীযুষ বসুর মতো পরিচালকদের তো জায়গাই নেই। আর স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরী চাকর-বাকর ক্লাস! এই প্রি-অকুপেশনই মনে হয় বাংলা ছবির অধঃপতনের মূল কারণ। সে জন্যই মূলধারার বাংলা ছবি নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা নেই, তথ্যের ভাঁড়ার নেই। কারণ, বাজারকে ঘৃণা করে সে ‘ভালো’ হতে চেয়েছে। ভালো যে হতে পারেনি, তা কৌশিকবাবুর কথা থেকেই স্পষ্ট। বাজারকে প্রভাবিত করার ইচ্ছেটা যে সে ফিরে পেতে চাইছে, এটুকুই বোধহয় আশার কথা। কিন্তু তার জন্য দরকার সিনেমাটা ‘সিনেমা’ হয়ে ওঠা। কৌশিকবাবু বলেছেন, ‘দর্শক দু’হাতে আলিঙ্গন করুন মাতৃভাষার চলচ্চিত্রকে’। মাতৃভাষা থাকুক বটেই, কিন্তু বাংলা সিনেমায় সিনেমার ভাষাটাও যে থাকতে হবে। তা বড়পর্দার জন্য বানানো টেলিফিল্ম হয়ে গেলে আর লাভ নেই। জাঙ্কফুড ক্ষতিকারক ঠিকই, কিন্তু দুধের নাম করে পিটুলি-গোলা জল খাওয়ানোটা আরও ক্ষতিকারক নয় কি?

22 May 2016

বাংলা ছবির ভ্যাম্প

সুস্নাত চৌধুরী


ছবি : সুমন চৌধুরী


স্মা গলিং চাই— সোনা হিরে গাঁজা চরস, যা হোক; পাঁচটি গানের সিচুয়েশন চাই, তার মধ্যে একটি ভক্তিমূলক হলে ভাল; দুটি নাচ চাই; খান দু-তিন পশ্চাদ্ধাবন দৃশ্য বা চেজ-সিকুয়েন্স চাই— তাতে অন্তত একটি দামি মোটরগাড়ি পাহাড়ের গা গড়িয়ে ফেলতে পারলে ভাল হয়; অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য চাই...’, এর পরই লালমোহনবাবুকে হিট সিনেমার ফর্মুলা ডিক্টেশন দিতে দিতে ফেলুদা বলছেন— ‘নায়কের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে নায়িকা এবং ভিলেনের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে ভ্যাম্প বা খলনায়িকা চাই।’
সত্যজিৎ রায় ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ লেখা শেষ করছেন ১৯৭৬ সালে। হিন্দি ছবি ততদিনে ভ্যাঙ্কুবারে ভ্যাম্পায়ার! নাদিরা, কাক্কু থেকে হেলেন, বিন্দু। মায়া-ভরা চোখ আর মিনিমাম পোশাকটুকু উথলে কায়া-ভরা মাংস-চামড়া... সঙ্গে এসব তুচ্ছ করে দেওয়ার মতো দেহের মোচড়, অনবদ্য নাচের দক্ষতা। ‘ইয়ে মেরা দিল’-এর নীলচোখো লাস্য তখনও বাজার দেখেনি বটে, কিন্তু ‘পিয়া তু আব তো আজা’-র উথালপাতাল শ্বাস বছর চারেক হল ঝড় হয়ে বইছে, আর ‘মেহেবুবা ও মেহেবুবা’ তো সদ্য রিলিজ্‌ড। এহেন হেলেন-বিভঙ্গে উত্তাল সত্তর দশকে গড়পাড়ের ভেতো বাঙালি জটায়ুর কাছে হিন্দি মার্কেটে কামেয়াবির সামান্য রহস্যটুকু প্রদোষ মিত্তির ফাঁস করবেন না, তা হতে পারে না। সত্যজিৎ রায় অবশ্য এর পরই ফাঁস করছেন হিন্দি ছবির সেই টেমপ্লেটের বঙ্গীকরণের ইঙ্গিত। কলকাতার এক আজগুবি ফিল্‌ম প্রোডিউসার বারেন্দ্র সান্যালের ভেক ধরে এসে আসল কালপ্রিট মিস্টার গোরে জটায়ুকে গল্পের অফার দিয়ে বলছেন – ‘বাংলায় হিন্দি টাইপের ছবি না করলে আর চলছে না’। তার মানে, টালিগঞ্জেও ‘ভিলেনের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে ভ্যাম্প বা খলনায়িকা চাই’।
ভ্যাম্প কে? শুধু খলনায়িকা বা ভিলেনের বান্ধবী হলেই তাকে ভ্যাম্প বলা যায় না। চরিত্রটিতে হয়তো লাস্য আছে, ছল আছে, ঢলঢল যৌনতা আছে, চরিত্রটি কিছুটা নেগেটিভও বটে, কিন্তু তা হলেও সে ভ্যাম্প না-ই হতে পারে। অভিধান বলছে, ভ্যাম্প সেই রমণী, যে যৌনতা দিয়ে পুরুষকে বশ করে কার্যোদ্ধার করে। বাংলা সিনেমায় ভ্যাম্প বলতেই ‘নষ্ট মেয়ে’। হয় হাতে গেলাস, নয় ঠোঁটে সিগারেট। হয় শরীর বেচে খায়, নয় নাচ-গান। সতী-লক্ষ্মী নায়িকার প্রোটোটাইপের উলটো দিকে, হয় এরা অলক্ষ্মী, নয়তো মোহিনী।
সত্তর দশকের শুরুতে এক চিলতে খোলা শরীরের জন্য সত্যজিৎ রায় নিজেও দ্বারস্থ হচ্ছেন প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালির। প্রথমে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০)। এক নার্সের শাড়ি-ব্লাউজ খুলে ব্রা পরে সিগারেট ধরানোর সেই বিতর্কিত দৃশ্য! ‘আ ভেরি প্রাইভেট টিউটর’ যেখানে শুরুতেই সিদ্ধার্থকে (ধৃতিমান) ছুঁড়ে দিচ্ছেন ইঙ্গিতবহ প্রশ্ন – ‘তুমিও খাবে নাকি?’ তারপর, ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১)। ছবির শেষ দিকে ফুলের ছোট্ট পোশাকে হাওয়াইয়ান নাচ। ‘আমার নাচটা ছবিতে রাখতে চান বলেই কি আসল লিডো রুমে শুট করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়?’ – মিস শেফালি বলছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘সন্ধ্যারাতের শেফালি’-তে। পরে ‘রোদনভরা বসন্ত’, ‘বহ্নিশিখা’-র মতো ছবিতে শেফালির উপস্থিতি মূলত খোলামেলা নাচের জন্যই। ভরসন্ধের নয়, সে সব নাচ গভীর রাতের। ‘বহ্নিশিখা’-র পানশালায় পারফরমেন্স শুরুর আগে সেই ডান্সার বলছেন, ‘আমাদের ঘড়িতে এখন রাত্রি একটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।’ গোপন বৈঠক শুরুর সময় হয়ে গিয়েছে, ইঙ্গিতে দুষ্টচক্রের লোকজনদের উদ্দেশে অ্যালার্মের কাজ করছেন তিনি। তার পর মিউজিকের বিটে-বিটে দেহ বিভঙ্গে শুরু হচ্ছে গান— ‘লাইফ ইজ জাস্ট আ গ্যাম্বল...’।
এখনও অবধি শেফালির শেষ ছবি ‘পেন্নাম কলকাতা’। সেখানেও তিনি ‘মডার্ন ডান্সার’। শেলি সেন। হদ্দ গাঁ থেকে আসা গোবরা, মানে, গোবর্ধন দলুই (চিরঞ্জিত) যাঁর পোস্টারে পেন্নাম ঠুকে বলছেন ‘সগ্গের দেবী’, যাঁর ‘রূপ দেখলে বুকের ভেতরটা একেবারে হু হু করে’! এই গোবর্ধন আর তার স্ত্রী পদ্মকে (শতাব্দী রায়) কাজের লোক করে বাড়ি নিয়ে আসেন শেলি। গোবরকে তাঁর পিএ-র তকমা দেন। তার পর এক সন্ধ্যায়, পদ্ম যখন বাড়ির বাইরে, তাকে ঘরে ডেকে ড্রিংকস আনতে বলেন শেলি। তার পর বলেন, পা টিপতে। স্কার্টের নীচের অংশ কিছুটা তুলে দেন, গোবর যত সেটি নামিয়ে পা ঢেকে দিতে চায়, ততই তিনি টেনে তুলে নেন। মেমসাবের অনুরোধে গোবরকে গানও গাইতে হয়, ‘ওরে ও শয়তান, হ তুই সাবধান, আছে রে আছে রে আছে ভগবান।’ গাঁয়ের যাত্রার বিবেকের গানের সঙ্গে বিচিত্র কনট্রাস্টে সুরাপাত্র হাতে দুলে ওঠে মডার্ন ডান্সারের শরীর। ক্রমে ঘনিষ্ঠ হয়ে গোবরকে জাপটে ধরেন। তাকে নিয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাওয়ার বাসনাও জানান। গোবর স্ত্রী পদ্মর কথা বললে, শেলি হেসে বলেন, ‘ধুর বোকা, তুই বলবি কেন রে’!
ক্যাবারে ডান্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, অনেক পরে পাকেচক্রে থিয়েটারে এসেছিলেন শেফালি। সেখান থেকে রুপোলি পর্দা। মিস ববি-র কথা শেফালি উল্লেখ করেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। ববিও তৎকালীন বাংলা থিয়েটারের খোলামেলা নাচের সংস্কৃতি থেকেই সিনেমায় আসেন। ১৯৭৬-এর ‘বহ্নিশিখা’ সিনেমায়, ইস্তানবুলের কুখ্যাত এক নাইট ক্লাবে রাত দেড়টায় ‘মিস ববি’কে নৃত্যরত অবস্থায় দেখতে পায় বাংলা সিনেমার দর্শক। ধাতব ঝালরে ভরা উজ্জ্বল খাটো পোশাকে, স্তনবিভাজিকার মাঝ বরাবর দুই হাত ঘষটে তুলে এনে তালে তালে শুরু হয় তাঁর নাচ। ওই বছরেরই ‘হোটেল স্নো ফক্স’ ছবিতে অবশ্য আরও মাত করে দেন মিস ববি। উত্তমকুমার সেখানে বার-সিংগার। কিন্তু বিপ্লব ঘটাচ্ছেন মিস ববি! স্ট্রিপটিজ! হ্যাঁ, বাংলা ছবিতে। নাচ তেমন খাস কিছু নয়, কিন্তু ‘ক্যারাভ্যান’-এর হেলেনের চেয়েও সম্ভবত বিপজ্জনক সেই ভঙ্গি। শুরু করছেন সান্ধ্য-দস্তানা বা ইভনিং গ্লাভস দিয়ে। একে একে পোশাকের পরতগুলি খুলে ফেলছেন। শেষে, হাঁটু গেড়ে বসে ঠিক লেন্সের দিকে তাক করে ছুড়ে মারছেন বক্ষবন্ধনীটি!



ভুবন সোম

হোটেল-রেস্তরাঁ-পানশালার প্রেক্ষিতে কাহিনি ঘুরপাক খেলে এমন সিন তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। যেমন, ‘চৌরঙ্গী’ (১৯৬৮)।
‘সীমাবদ্ধ’-র মতো টুকরো ইনসার্ট নয়, সেখানে পুরোদস্তুর একটি পারফরমেন্স জায়গা পাচ্ছে। কনির ভূমিকায় সেই নাচে দেহ উন্মুক্ত করছেন ‘বোম্বে’ থেকে আসা জেনি। তার পর শাহজাহান হোটেলের হাতবদল হলে, নতুন ডিরেক্টর ফোকলা চ্যাটার্জি (তরুণকুমার) বলছেন, ‘বেশ ভাল ভাল অ্যাট্রাকটিভ গার্লস নিয়ে এসে নাচে-গানে-আনন্দে ইন্দ্রপুরী করে তোলো এই শাহজাহান হোটেলকে।’
বাংলা ছবিতে বারে বারে দেখানো হয়েছে বাইজি নাচ। সাহেব বিবি গোলাম, জলসাঘর, সন্ন্যাসী রাজা, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী... আরও কত ছবি! ছোট্ট একটা-দুটো সিনেও আঁটোসাঁটো পোশাকের নর্তকী দাগ কেটে যায়, এমন ঢলঢল খল চরিত্রেরও দেখা মেলে। তাদের ভ্যাম্প বলাই যেতে পারে। যেমন, ‘সখী কালো আমার ভাল লাগে না...’ গানটি। ‘স্ত্রী’। বছর বিশেকের অনাথা বিধবা সাদা থান ছেড়ে কৃষ্ণবর্ণ পোশাকে ঝলমল। মদে ভেজা ঠোঁট, কাজল টানা চোখ। সাপের ছোবলের মতো মিষ্টি হাসি। এ গানের লিরিকে আবার ভ্যাম্প চরিত্রগুলির সম্পর্কে সার কথা উঠে আসে। সৌমিত্রর লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন— ‘ওর ভেতর কালো, বাইরে কালো, ও যে কলঙ্কেতে কালো...’ জবাবে মান্না দে-র গলায় উত্তমকুমার ওভারট্রাম্প করছেন, ‘ও সে যতই কালো হোক, আমার ভাল লেগেছে। তার পটলচেরা চক্ষু দিয়ে চাক্কু মেরেছে, ভাল লেগেছে!’
নির্বাক যুগ কিংবা সবাক যুগের শুরুর দিকে নিউ থিয়েটার্সের আমলেও বাংলা ছবিতে ভ্যাম্প চরিত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দজ্জাল ভিলেন মহিলা হয়তো রয়েছে, কিন্তু তারা ভ্যাম্প নয়। ঝড়ের রাতে ছুটে গেলেও এদের আঁচল এতটুকু খসে না। কাহিনির খেই ধরে কখনও পতিতা, নর্তকী, দেবদাসী এসেছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই।
কস্টিউমে বা বডি-ল্যাঙ্গুয়েজের নিরিখে ‘আবর্তন’ (১৯৩৬) ছবিতে শীলা হালদার, ‘দেবদাস’-এ (১৯৩৫) চন্দ্রাবতী দেবী, ‘মহুয়া’-এ (১৯৩৪) মলিনা দেবী কিংবা ‘দেবদাসী’ (১৯৩৫) বা ‘কলঙ্কিনী’-তে (১৯৪৫) রেনুকা রায় কিছুটা ব্যতিক্রমী হয়েছেন বড়োজোর, কিন্তু উদাহরণ এমন হাতে-গোনাই। ছবিটা কিছুটা বদলাল পঞ্চাশের দশকে এসে। মঞ্জু দে (‘রত্নদীপ’, ‘কার পাপে’) বা রঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’) মতো অভিনেত্রীরা আগের ট্র্যাডিশনের মধ্যেই কিছুটা অন্য রকম হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ঠিক এই সময়েই হিন্দি ছবি থেকে বাংলায় অভিনয় করতে এলেন বেগম পারা।
১৯৫২। বিকাশ রায় অভিনীত শ্যাম চক্রবর্তীর ‘বাগদাদ’। ভ্যাম্প নন মোটেই, কিন্তু যৌন আবেদন আর এক্সপোজারে, ক্লিভেজে, স্তনবৃন্তের আভাসে বেগম পারা তাক লাগিয়ে দিলেন। সে ছবিতে গানের কথা ছিল এই রকম: ‘শরমেরে দূরে ফেলি /আঁখি মোর চুমে নে / সুধা পিয়ে নে’।
চলচ্চিত্র-সাংবাদিক রবি বসু তাঁর ‘সাতরঙ’ বইতে বলছেন ‘বাগদাদ’-এর বিহাইন্ড দ্য সিন কাহিনি। শুরু করছেন অন্য এক জনের কথা দিয়ে— সে কালের দাপুটে অভিনেত্রী-পরিচালক-প্রযোজক প্রতিমা দাশগুপ্ত। সেই সময় যে সামান্য ক’জন অভিনেত্রী নিজের নামের পাশে ‘বি-এ’ লিখতেন, প্রতিমা দেবী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সদর্পে বাইক হাঁকিয়ে তিনি সেটে আসতেন। চল্লিশের দশকে উনি বম্বে চলে যান। ফ্লাইট মেজর মনসুর-উল-হকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই মেজরের বোন ছিলেন বেগম পারা।
ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় ‘বাগদাদ’ ছবির সেটে সে দিন বেগম পারার স্নানদৃশ্যের শুটিং চলছে। বেগম পারা বাথটবে। তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত। সেই উন্মুক্ত অংশ ঢেকে রেখেছে সাবানের ঘন ফেনা। পরিচালক শ্যাম চক্রবর্তী চাইছেন, আঢাকা শরীর আরও খানিক দেখা যাক, কিন্তু কুণ্ঠাবশত কিছুতেই বেগমকে বলে উঠতে পারছেন না।
ঠিক তখনই বাইরে শোনা গেল বাইকের ভটভট শব্দ। সেটে হাজির হলেন বেগমের বউদি প্রতিমা দাশগুপ্ত। প্রতিমা ছিলেন শ্যাম চক্রবর্তীর পূর্ব-পরিচিত। শ্যামবাবু আশার আলো দেখলেন। প্রতিমাকে কানে-কানে ব্যাপারটা বলামাত্রই প্রতিমা চিৎকার করে হিন্দিতে তাঁর ননদকে বললেন, শরীরটা বাথটব থেকে একটু উপরে তুলে ধরতে!
এর পর রবি বসু লিখছেন—
‘শোনামাত্র বেগম পারা তাঁর সম্পূর্ণ অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ সহ বাথটবের ওপর উঠে বসলেন।
তাই দেখে শ্যামবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন : আরে না না, অতটা নয়, অতটা নয়। সেন্সরে আটকে দেবে যে!’
কিন্তু এ ভাবে বম্বের অভিনেত্রী নিয়ে এসে বাংলা ছবিতে ‘সাহস’ সাপ্লাই করার প্রভাব কেমন ছিল? এই ‘বাগদাদ’ তৈরি হওয়ার সময়েই ‘শারদীয়া চিত্রবাণী’-র এক সংখ্যায় ‘আমার স্বর্গারোহণ’ নামে এক কল্পকাহিনি লিখছেন ফণীন্দ্র পাল। সেখানে স্বয়ং দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তাঁর মোলাকাত হচ্ছে।
তিনি দেবীকে নালিশ জানাচ্ছেন, ‘দেখেছেন আমাদের বাঙলা ছবির প্রযোজকদের কাণ্ডকারখানা। বোম্বাই থেকে বেগমপারা, কুলদীপ, সিতারা, কাক্কুকে এনে ছবির হিরোইন করা হচ্ছে। আমাদের দেশের নিতান্ত সাধারণ শিল্পীর চেয়ে অভিনেত্রী হিসাবে এরা অনেক অযোগ্য হলেও দেহসৌষ্ঠবের ভঙ্গীমায় এরা অনেক স্মার্ট। যে sex-appeal-এর stunt দেখিয়ে হিন্দীওয়ালারা নিজেদের ব্যবসায়কে বেসামাল অবস্থায় টেনে এনেছেন বাঙলার কয়েকটি প্রযোজক সেই stunt দেখিয়ে বাজীমাৎ করবার কথা ভাবছেন।’
নালিশে কাজ হয়নি। দেহসৌষ্ঠবের স্মার্টনেস বা সেক্স অ্যাপিলের স্টান্ট কেবল হিন্দি ছবির অভিনেত্রীদের বাংলায় নায়িকাই করল না, সময় গড়াতে বাংলা ছবিতে টিপিক্যাল ভ্যাম্পের চরিত্রেও অবতীর্ণ হতে থাকলেন হেলেন, বিন্দুরা। সত্তরের সাদা-কালো ‘রাজকুমারী’ই হোক বা আশির রঙিন ‘ত্রয়ী’— হেলেন একই রকম বর্ণময় ও লাস্যময়ী। কেবল ‘ছেড়ে দাও, ওগো পথ ছাড়ো’ এক দশকে বদলে হয়ে যাচ্ছে ‘একটু বোসো, চলে যেও না’। ‘বন্দী’ ছবিতে আবার ভিড় জমছে বলিউডি ভ্যাম্পদের— হেলেন, বিন্দু, পদ্মা খন্না, প্রেমা নারায়ণ! তার আগেই ‘কলঙ্কিত নায়ক’-এ স্বনামে হাজির হয়ে আইটেম নাম্বারে মাত করে দিচ্ছেন মধুমতী। ‘দোলনচাঁপা’-তে অরুণা ইরানি, ‘শত্রু’-তে জয়শ্রী টি, কিংবা ‘অমানুষ’-এ প্রেমা নারায়ণ। নির্লোম বাহুমূল, উন্নত স্তন, ব্লাউজ-বিহীন শরীরে মাতন-ঢেউ তুলছেন— ‘...আমায় নিয়ে খেলা করো, তুমি ওগো নিঠুর বড়।’ চরিত্রটি ঠিক নেগেটিভ নয়, ক্রমে পুরোদস্তুরই পজিটিভ হয়ে উঠছে— ‘দোহাই তোমার আমায় তুমি বিষচোখে চেয়ে দেখো না।’ ‘এক যে ছিল দেশ’-এর মতো কমিক সায়েন্স ফিকশনেও তপন সিংহ প্রেমাকে কাস্টিং করছেন। একেবারেই ভ্যাম্পের খল চরিত্র। স্লিভলেসে, ঘনিষ্ঠতায়, নাচে-গানে উত্তেজক। আবার গীতা সিদ্ধার্থ ‘বারবধূ’-তে সেই পথে গরম হাওয়া আনছেন না, তাঁর আদর্শ ‘ছেনালিপনা’ চরিত্রটিকে ঝকমকে করে তুলছে।
বোম্বাইয়ের বোম্বেটেরাই শুধু নন, বাংলার মলয়জ শীতলাং অভিনেত্রীরাও গুটিগুটি পায়ে ভ্যাম্পের র‌্যাম্পে হাঁটা শুরু করছেন মুখ্যত ষাটের দশকের শেষ দিক বা সত্তরের দশকের শুরু থেকে। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম অবশ্যই উত্তমকুমার-কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ‘সোনার হরিণ’-এর বার-গাইয়ে ‘মিস রুবি মৈত্র’— নমিতা সিংহ। পরিস্থিতি তাঁকে ঠেলে দিয়েছে ‘খারাপ কাজ’-এর দিকে। ১৯৫৯ সালের এ ছবিতে স্লিভলেস কালো পোশাকে চূড়ান্ত তাঁর আকর্ষণ। দুলকি চালে গাইছেন, ‘তোমার দুটি চোখে ওই যে মিষ্টি হাসি।’ তার পর ‘এই মায়াবী তিথি, এই মধুর গীতি’-তে যেন সেক্স অ্যাপিল আরও ফুটে বেরোতে থাকে। প্রথম শটেই পা থেকে টিল্ট-আপে গোটা শরীরটি ধরা পড়ে ক্যামেরায়।
তবে সত্তরের দশকে টিপিক্যাল ভ্যাম্প চরিত্রে সব থেকে বেশি অভিনয় করেছেন বোধহয় সুলতা চৌধুরী। ‘স্ত্রী’-র সরলা লারেলাপ্পা নাচে না বটে, ঘোমটাও তার সরে না, কিন্তু চোখে থেকে যায় গোপন ঢলানি। কখনও সে অকিঞ্চিৎকর পরপুরুষের উদ্দেশে বলে, ‘কী গো, গিলে খাবে নাকি, পথ ছাড়ো’, কখনও পাঁচ টাকা অধিক বেতনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নির্দ্বিধায় শক্ত করে হাত ধরে গোপনে পথ দেখায় বউরানির পেয়ারের ক্যামেরাবাবুটিকে।
‘বাঘবন্দী খেলা’-তে সে হয়ে উঠছে ভবেশ বাঁড়ুজ্জের (উত্তমকুমার) আশমানি কবুতর! রাতের সঙ্গী। হাতে গেলাস, মুখে ধোঁয়া। খাটো পোশাকে, গভীর নাভির ঝলকে ‘বাজারের মেয়েমানুষ’। ‘সন্ন্যাসী রাজা’-র বিলাসী দাসী কিংবা ‘মৌচাক’-এর আলট্রা-মডার্ন রিনা সুলতার ভ্যাম্প-অভিনয়কে বৈচিত্রময় করে তোলে।
‘সন্ন্যাসী রাজা’-র শুরুর দিকেই খলনায়ক ডাক্তার আর বিলাসী দাসীর আলাপ বুঝিয়ে দেয় তাদের নিয়তি কোথাও সম্পর্কিত। ডাক্তারবাবুর লোলুপ দৃষ্টিতে বিলাসী মুখ টিপে হাসি চাপে, ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে মাপে। ডাক্তারবাবুকে তাঁর ঘর দেখিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে সেই ঘরকে পাকাপাকি করে তুলতেও ডাক্তারের সঙ্গে হাত মেলায় সে। এক দিন সোহাগ করে ডাক্তারের গলা জড়িয়ে ধরে জানায়, তারও চাই রানিমার মতো সোনার হার। কিন্তু সোহাগে কাজ না দিলে, এই ভিলেনটিকে ব্ল্যাকমেল করতেও সে ছাড়ে না। বলে, হার না পেলে সে ডাক্তারের সব কুকীর্তি রাজাবাবুকে ফাঁস করে দেবে। পরক্ষণেই ডাক্তার যখন তার হাতে হাত রাখে, গালে আদরের টোকা মারে, বিলাসী বলে ওঠে— ‘এ জীবন থাকতে আপনার ক্ষতি আমি কক্ষনও করব না।’ যদিও শেষমেশ তাতে কাজ হয় না, ডাক্তারের হাতেই মরতে হয় বিলাসীকে।
এখন দজ্জাল শাশুড়ির রোলে অভিনয় করেন বলে পরিচিত হলেও, অনামিকা সাহার শুরুর দিনগুলো অনেকটাই কেটেছিল ভ্যাম্পের আবছায়ায়। ‘প্রতিশোধ’-এ নাচে অপটু সৌমিত্রর সঙ্গে যেমন তিনি তাল মেলাচ্ছেন— ‘কী বিষের ছোবল দিবি কালনাগিনী তুই’! একই ভাবে ‘প্রার্থনা’-তে তাঁর লালপেড়ে শাড়ি আর পিঠখোলা ব্লাউজে নাচের রসাস্বাদন করছেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবার নায়িকা হিসেবেই যাঁরা পরিচিত, কোনও কোনও ছবিতে তাঁদের অভিনীত চরিত্রেও স্পষ্ট হয়েছে ভ্যাম্পের লক্ষণগুলি। ‘জীবন জিজ্ঞাসা’-র শেফালি (সুপ্রিয়া দেবী) যেমন খসে পড়া আঁচলে, নেশাতুর আচরণে ভ্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তেমনই ‘কলঙ্কিত নায়ক’-এ ‘ডাকসাইটে বেশ্যা’ হয়ে ওঠে রোজি (অপর্ণা সেন)।
তবে ‘মোহনার দিকে’ ছবিতে অপর্ণা সেন অভিনীত সুচেতা চরিত্রটি সে দিক থেকে অনবদ্য। তাকে প্রথম দেখা যাচ্ছে সুইমিং পুলের ধারে শুয়ে থাকতে, প্রকৃত প্রস্তাবেই ‘আপাদমস্তক’ একটি প্যানে। খোলা উরু, উন্মুক্ত বক্ষবিভাজিকা। এক দিন কলেজ ফ্রেশার্সে যে ছাত্রীটি ‘আছে গৌর-নিতাই নদিয়াতে...’ গাইতে উঠে দর্শকের তুমুল হাততালির চোটে অস্বস্তি বোধ করে তড়িঘড়ি শাড়ির আঁচল টেনে নেয়, পরবর্তী জীবনে সে-ই পানশালায় ‘এই রাতে একটুখানি কাছে, আরও কিছু কাছে আসতে পারো’-র উষ্ণতায় স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে! স্কচ-সিগারেট ছাড়া তার চলে না। যথেচ্ছ মিথ্যাচারে সে ক্রমে ডুবে যেতে থাকে সমাজের পাঁকে। ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়েও, তার মধ্যে দিয়ে যেন উঠে আসতে থাকে এক আদর্শ ভ্যাম্পের আইডিয়া।
‘এক আধুনিক বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙাতে’ মেনকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সুচেতা। সৎ আয়কর অফিসার সুশোভন (দীপঙ্কর দে) তার টার্গেট। তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে কাজ হাসিল করতে হবে। সস্ত্রীক সুশোভনকে ধাওয়া করে ম্যাকল্যাসকিগঞ্জে পৌঁছে সে বুঝতে পারে, এই সুশোভনের সঙ্গেই কলেজে তার প্রেম ছিল। সেই স্মৃতি ফিরে আসে, কাজ বুঝি আরও কঠিন হয়ে যায় সুচেতার কাছে। এক রাতে মদ্যপ টালমাটাল অবস্থায় একটা সিগারেটের জন্য সুশোভনের ঘরে পৌঁছে যায় সে। বলে, ‘এসো না, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি। ভয় নেই, তোমার বউ জেগে যাবে না।’ তার আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে সুশোভন কলকাতা ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে, এই সুচেতাই তাকে বলে, ‘কথা দিয়েছ কিন্তু, কলকাতা গিয়ে সময় দেবে। কী, আবার বউ-এর পারমিশন-টারমিশন লাগবে না তো!’
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা বদলাতে থাকল। হিন্দি ছবিতে যেমন, বাংলাতেও তেমনি ভ্যাম্পের আনাগোনা কমে এল। হবে না-ই বা কেন? ১৯৭৮-এর ‘ডন’-এ হেলেন যা করেছিলেন, ২০০৬-এ করিনা কপূরকে দিয়েই সেই কাজ করালেন ফারহান আখতার। ’৭৫-এর ‘শোলে’-তে হেলেনের যা ভূমিকা ছিল, ২০০৭-এর ‘রামগোপাল বর্মা কি আগ’-এ ‘মেহবুবা মেহবুবা’-য় সেই ভূমিকা পালন করলেন উর্মিলা মাতন্ডকর। পাবলিকও দেখল, এক জন নায়িকাকেই যদি স্বল্পবাসে পাওয়া যায়, তা হলে আর ভ্যাম্প কেন! কাজেই প্রযোজক যখন বলল, ‘একটা দুষ্টু গান ঢোকান না দাদা, দুষ্টু গান ঢোকান’, তখন আইটেম নাম্বার রইল, কিন্তু মার্কামারা ভ্যাম্প অভিনেত্রীদের আর দরকার পড়ল না। সুন্দরী নায়িকারাই সেই সব ‘ম্যাজিক মামনি’দের ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠলেন।
হালফিলের অঞ্জন দত্তের ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ (আদিম রিপু) ছবিতেও তো শিউলি দেবীর ভ্যাম্প চরিত্রে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে দেখি। এই স্বস্তিকাই অঙ্গুরী দেবী হয়ে ওঠেন দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’-তে।
‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ ফিল্‌ম হলে ডায়লগে আর ‘ভ্যাম্প’ শব্দটি রাখেন না সন্দীপ রায়। তাই কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ‘ভ্যাম্প-রা সব গেল কোথায়?’ উত্তর হবে, ‘রাতের সব ভ্যাম্পই অাছে দিনের নায়িকার গভীরে।’ আলাদা করে কাউকে ভ্যাম্প সাজানোর দরকার নেই।
আগে, নারীদের যেমনটি হওয়া উচিত, তার চৌকাঠ ধরে তৈরি হত নায়িকার ব্যবহার, আর যেমনটি হওয়া উচিত নয় (কিন্তু যেমনটি হলে পুরুষদৃষ্টির ভারী আরাম ঘটে), তেমনটি ধরে তৈরি হত ভ্যাম্পের চরিত্র। এখন নারীস্বাধীনতা কিছুটা এসে যাওয়ার ফলে, আর বাজারস্বাধীনতাও বেড়ে যাওয়ার ফলে, এ সবের ঠোক্কর ও টক্করে একই নারী কখনও শাড়ি কখনও হটপ্যান্টসে দিব্যি বিরাজ করছেন। চোখ ও মন তা মেনে নিচ্ছে।
আসলে, খাটো পোশাক, মদ, সিগারেট, পুরুষের সঙ্গে অনাড়ষ্ট, ‘কাছে এসো’ ব্যবহার— যে সব উপকরণ দিয়ে আগে ভ্যাম্প চরিত্রগুলিকে গড়া হত, আজ আর তা দিয়ে কাউকে ‘খারাপ মেয়ে’ বোঝানো সম্ভব নয়। অলক্ষ্মীর সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে লক্ষ্মীর সংজ্ঞাও। আবার এমনও হতে পারে, সংজ্ঞা মোটামুটি একই আছে, কিন্তু সবাই বুঝে গেছে, সিনেমা দেখতে বসে একই নায়িকাকে একটা দৃশ্যে ভ্যাম্প ভেবে মজা নিতে হবে, আর অন্য দৃশ্যে সতী বলে কেঁদে ভাসাতে হবে! দর্শকদের এই টু-ইন-ওয়ান পেয়ে যাওয়ার তাগিদেই কি নির্বাসনে চলে গেল ভ্যাম্পেরা?

কৃতজ্ঞতা: চন্দন গোস্বামী, বরুণ চট্টোপাধ্যায়


রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ মে ২০১৬

17 April 2016

বর্ষ, হর্ষ, ফর শো

সুস্নাত চৌধুরী


আবার বগল বাজাতে বাজাতে একটা নববর্ষে পা রাখলাম। হ্যাপি নববর্ষ! হ্যাপি... ইয়ে, মানে, এটা ফর্টিন হান্ড্রেড অ্যান্ড কত যেন? এই ভোটের বাজারে সারদা-বিবেকানন্দের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার টাঙানো খুব রিস্‌কি, আর পাঁজি নামক গ্রন্থটি খরিদ করার বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত বটতলা-স্কলার ছাড়া ইদানীং কে-ই বা নেয়! কাজেই, হয় গুগল করো, নয় খবরের কাগজ খুলে মাস্ট-হেডের তলায় চোখ রাখো। এত পরিশ্রম সয় না বাপু! সন জেনে কাজ নেই, সন্‌সনি সন্দর্ভ তো আর রচনা করছি না! বচ্ছরকার দিনে নতুন আন্ডারওয়্যার পরে একটু ফুর্তি করছি মাত্র। মোটে হাঁটু পর্যন্ত আমোদে সাঁতরাচ্ছি আমরা বাঙালি।
ঘামে-ডিওতে, বিয়ারে-ঘোলেতে লেবড়ে আমাদের ভাবখানা যেন গত বছরটা বিদেয় হয়ে বাঁচিয়েছে – আর নতুন বছরটা জাস্ট আসছিল না বলে! নববর্ষ এসে গিয়েছে, ব্যস, নো টেনশন। সংক্রান্তি কাটিয়ে রাইমা টু মাইমা এবার সকলে দুধে-ঘিয়ে ভাসব – পরীক্ষায় সাপ্লি থাকবে না, অফিসে লেটমার্ক থাকবে না, ফুটপাতে বিপিএল থাকবে না, কেবল ইডেনে আইপিএল থাকবে। ট্রেন চললে ভিড় হবে না, গরমকালে ঘাম হবে না, বৃষ্টি হলে জল হবে না, শুধু চ্যানেল চ্যানেলে সপ্তদিবানিশি মেগা সিরিয়াল আর মেগা সিরিয়াল হবে। তাহলে কথা হচ্ছে গিয়ে, নতুন বছরে কি আর হালকার ওপর লাইট করে এক-আধটা সুচারু ম্যাসাকারও হবে না? সে হবে তো হবে। বড়জোর উগ্রপন্থীরা ক্যাসুয়ালি বিস্ফোরণ ঘটাবে; দেশপ্রেমীরা বিন্দাস দেশদ্রোহীদের কোতল করবে; প্রতিদিন একটা করে ধর্ষণ মাখন হেড লাইন হবে; কিছু নৃসংশ হত্যা সংবাদমাধ্যম বাই-ডিফল্ট চেপে যেতে বাধ্য হবে; এবং লঙ্কা যে অ্যাকুয়ার করবে, মেক-আপ ছাড়া তাকে ডিট্টো রাবণের মতোই দেখতে লাগবে। আর, কেউ হয়তো কমোডে বসে হালকা সুরে গুনগুনাবে... ‘পালটায় সাল, বলো, দিনগুলো পালটাবে কবে?’
তাবলে কি প্রেম দেব না! একশোবার দেব। ইট’স আ হান্ড্রড পারসেন্ট ল্যভ। রাত পোহাতেই ঝিংকুনাকুড় নেচেছি। চ্যানেলে-চ্যানেলে বর্ষবরণের কনফেটি ফাটিয়েছি। গয়নার দোকানে গিয়ে আদেখলের মতো কোল্ড ড্রিংক, মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার বাগিয়েছি। ভুল ছন্দে ন্যাকা-ন্যাকা অকবিতায় উইশ এসএমএস করেছি। ফেবু ভরিয়ে দিয়েছি সেলফিপানা চাঁদবদন আর নোলা সক্‌সকে রোমান হরফে – হ্যাপিনেস ইজ সেলেব্রেটিং একলা বৈশাখ উইথ মাই ফেভারিট লুচি, বেগুনভাজা অ্যান্ড মাটনকষা। এইসা মেমফুর্তি না হলে কি আর এই বছরটা তত নতুন-নতুন দেখতে লাগবে! তারপর নয় বছর শুরুর খোঁয়ারি কাটলে আগের মতোই কেউ ঘুষ খাবে, কেউ জুস খাবে, কারো ভাগ্য হোঁচট খাবে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন।
অভিধানে তো নতুন মানে, নব। নব মানে, ৯। আর, নয় মানে, না। কাজেই এখন যদি বলি, নতুন বছর বলে আসলে কিছুই হয় না। দিন-ক্ষণের হিসেব রাখতে হয়, তাই এই এককের গণনা পদ্ধতি মেনে চলা। সেই ধান্দাতেই আদ্যোপান্ত নিজেদের বানানো কৃত্রিম এক সূচক হিসেবে সে-এককের শুরুটাকে হালকা হাইলাইট করে নেওয়া। কিন্তু কোনটা সেই প্রকৃত শুরু? কোন সূচনাবিন্দু থেকে সূর্যকে চক্কর কাটতে থাকল পৃথিবী? কেন এইটেই হবে বছরের পয়লা, এখান থেকেই শুরু হবে গোনা, উবু দশ কুড়ি...? আসলে দুনিয়া জুড়ে বিবিধ গোষ্ঠী যে যার ব্যাখ্যা ও সুবিধে মতো ধরে নিয়েছে নববর্ষের দিন, ছেপে গিয়েছে ক্যালেন্ডার। লগ্ন তো সম্রাটের হাতে, পঞ্জিকা কী বলে, কী এসে-যায় তাতে! আর সব অব্দ মুছে-টুছে দিয়ে পয়লা আশ্বিন থেকে যেমন শুরু হয়েছিল হিরকাব্দ, কতকটা সেইরকমই নয় কি? অথচ সেসব ম্যানুফ্যাকচার্ড পয়লা তারিখগুলি এক পাক করে ঘুরে এলে আমরা আবিশ্ব মেতে উঠেছি গভীর আদিখ্যেতায়।
তার মানে এই নয় যে জীবন থেকে হাসি, ফুর্তি, আমোদ-আহ্লাদ মুছে দিতে হবে। সেসব বিলক্ষণ থাকবে। ছিলও তো। ছিল বলেই, ‘আর ঠিক একদিন পর আচ্ছে দিন আনেওয়ালা হ্যায়’ – এই কাউন্টডাউনের মতো খিল্লিকর আর কিছু হতে পারে না। এবং তারই জন্য পেরিয়ে-আসা অতীতকে ‘পুরাতন’ বলে দেগে দেওয়া, তাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে ‘ব্র্যান্ড নিউ’-এর ক্লিশে আমোদগেঁড়েমি চালিয়ে যাওয়া অহেতুক ঠেকে। প্রকৃত প্রস্তাবে নতুন-পুরোনো কনসেপ্টটাই যখন এখানে অর্থহীন, তখন কেন এই ফর শো বর্ষবরণ? ফেলে আসা বছরটায় কি মনে রাখার মতো কিছুই ঘটেনি, কোনো স্বপ্নই কি ছিল না সেই বেঁচে থাকায়, তাহলে এই ক’দিনেই কীভাবে তাতে এত জং পড়ে গেল যে বাতিলের দলে না ফেলে দিলেই নয়! উদ্ভট শোনাতে পারে, কিংবা হেঁয়ালির মতো। কিন্তু কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত যদি আজ আরেকটা নববর্ষে এসে না পৌঁছোতাম! কোন ক্ষতিটা হত যদি এই নতুন বছরটা আদপেই নতুন বছর না হত! তার চেয়ে বরং গেল-বছর যেখানে থেমেছিলাম, এ বছর সেখান থেকেই শুরু করব। মেতে থাকব জীবনের অনন্ত যাত্রায়। যেখানে নতুন বলে কিছু নেই, কারণ পুরোনো বলে কিছু হয় না। বড়জোর মাঝে আসে এক-আধটা ক্ষণিকের বিরতি। তখন এটুকুই আওড়ে নেওয়া যায় –
‘তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না – নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে-কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।’

ছুটি, সংবাদ প্রতিদিন, ১৭ এপ্রিল ২০১৬